মারুফ ইসলামের গল্প ‘সাধিত রাধিকা’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২০, ২০২০
সবকিছু আগের মতোই আছে। ঠিকঠাক, কোথাও কোনো গুরুচণ্ডালি দোষ নেই। ওই তো আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেএফসি, তার বগলঘেঁষে উল্টো দিকের ফুটপাতে অনুরূপ অনাভিজাত্য নিয়ে কোনোমতে বসে আছে আখতার ভাইয়ের চায়ের দোকান। দোকান ঘিরে একঝাঁক মুখস্ত মানুষ— অন্তু, অর্ণব, বর্ণ, রুদ্র, কমল, পলাশ। মানুষগুলোর দু’হাত থেকেই উঠছে ধোঁয়ার রেখা। এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে সিগারেট। ওদের চোখ কেফসির দুয়ারে, একটা দুটো বিনোদনবর্ষণকারিনী ঢুকে যায় দুয়ার দিয়ে। বেরিয়ে আসে একটা দুটো। তা দেখে ঠোঁটে চার্লি চ্যাপলিন হাসি ফোটে এদের। মুখে জাগে ফিসফিসানি— পুরাই বিনোদন! অস্থির মাল মামা!
জায়গাটা ধানমন্ডি সাতের এ, সন্ধ্যাটা গুমোট, বাতাসবিহীন আর আমাদের হৃদয়ভর্তি ভালোবাসা, পকেটভর্তি শূন্যতা। আমরা হাজির প্রতিদিনের মতো। কোথাও কোনো গুরুচণ্ডালি দোষ নেই। সবকিছুই ঠিকঠাক আগের মতো। তবু আড্ডাটা ঠিক আগের সুরে বাজে না। বীণার তার ছিঁড়ে গেছে কোথাও একটা। আমরা টের পাই এবং সহসা উপলব্ধি করি, আরে! সঞ্জু আসেনি তো এখনো। তাই তো বলি, আজকের আড্ডা এতো পানসে ক্যান!
ফোন দে তো, ফোন দে তো। হালার মায়েরে বাপ, প্রত্যেক দিন লেট করব... ধমক লাগায় অর্ণব। অর্ণবের ধমক খেয়ে ডায়াল করি সঞ্জুর নম্বরে, ওই নবাবের বচ্চা নবাব...
মনডা ভালো নাই মামা। বিরস কণ্ঠে জবাব দেয় সঞ্জু। যেন একটু আগেই দুই ঢোক চিরতার রস খেয়েছে।
আমি ধমক লাগাই, মন ভালো নাই মানে? নয়া নকশা আরম্ভ করছ! আজ তোমার মন খারাপ, কাল তোমার পেট খারাপ... তুমি পাইছডা কী! ক্লাস মিস করবা, পরীক্ষা মিস করবা হেইডা না হয় মানন যায়, তাই বইলা আড্ডাতেও আসবা না!
কইলাম তো মামা, মনডা ভালো নাই। আড্ডা দিতে মন চাইতেছে না।সঞ্জুর কণ্ঠ আরো বিরস শোনায়। যেন এইমাত্র চিরতার গ্লাসে আবার চুমুক দিয়েছে।
হালায় কয় কী! আখতারের চা প্যাডে না পড়লে তোর ঘুম আইব? জলদি আয় কইতাছি। আমরা ব্যাবাকতে রইছি... আমি আবারো পূর্ববৎ ধমকের সুরে বলি।
মনডা বহুতই খারাপ মামা। হুদাই জেদ করিস না। আজ আমি আইতে মারুম না।
তা হইছেডা কী, কইবি তো?
মৌলিক শব্দ আর সাধিত শব্দ নিয়া বহুত প্যারায় আছি।
আবার নকশা আরম্ভ করলি!
না, মানে, যে শব্দকে আর ভাইঙ্গা আলাদা করন যায় না হেইডাই তো মৌলিক শব্দ নাকি?
হ।
আর যে শব্দকে ভাঙলে আলাদা অর্থ পাওন যায় হেইডাই তো শাধিত শব্দ?
হ।
তুই ফোন রাখ। এইবার পাইছি!
কী পাইছস?
কবিতা।
কী?
...???
ওই ব্যাডা, সঞ্জু? কী পাইছস, কইলি?
সঞ্জু ফোন রেখে দিয়েছে। ইডিয়েটটার চরিত্রের কোনো বদল হলো না। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। যেমন খুশি তেমন সাজো টাইপের চরিত্র। মন চাইলো একটা বিষয় নিয়ে বেশ কিছু দিন মেতে থাকলো, তারপর ‘দূর ছাই’ বলে হঠাৎ একদিন ছেড়ে দিলো। কোনো ব্যাপারেই কোনো সিরিয়াসনেস নেই। এই তো কদিন ধরে দেখছি সাহিত্য নিয়ে বেশ মেতে আছে। ব্যাকরণ মেনে কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। জানি, কদিন বাদে সে এই কাব্যদেবীকেও দূর ছাই বলে খেদিয়ে দেবে। তবে ওর মধ্যে অদ্ভূত এক ক্ষমতা আছে। ও কীভাবে জানি আমার মনের খবরটা আগেই টের পেয়ে যায়। আমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা আগে থেকেই জেনে ফেলে। অদ্ভূত! পুরাই ইডিয়েট একটা! এসব কারণেই ইডিয়েটটার সঙ্গ ছাড়তে পারি না!
কিন্তু একটু আগে সঞ্জুর বলা মৌলিক শব্দ আর সাধিত শব্দ আমার মাথাকে অবশ করে রাখলো অনেকক্ষণ। এবং এতটাই অবশ করে রাখলো যে ‘আরেশ্শালা! পুরাই হট পেটিস!’ অন্তুর এমন চাপা স্বর কানে এলেও কেএফসির দুয়ারে কোনো বিনোদনবর্ষিণীকে খুঁজতে সাধ জাগল না আমার। আমি ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে ফিরে যাই দুই বছর আগের একদিনে। তখন শ্রাবণীর সঙ্গে তুমুল প্রেম আমার। আমরা রোজ টিএসসির ডাসে বসে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখি। একদিন শ্রাবণী আইসক্রিমে কামড় দিতে দিতে বলল, আমাদের এই প্রেমের নাম কী গো? রোমিও-জুলিয়েট? আমি বললাম, না।
তাহলে ইসল্ট-ত্রিস্তান?
আমি বললাম, না।
লাইলি-মজনু?
না।
অ্যন্থনি-ক্লিওপেট্রা?
উমহু।
বুঝেছি। তুমি এই উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে আমাদের প্রেমের নাম দিতে চাও। তাহলে আমাদের প্রেমের নাম রাধা-কৃষ্ণ। ঠিক?
না, ঠিক নয়।
বেহুলা-লখিন্দর?
তাও না।
দূর ছাই! এতগুলো নাম বললাম, একটাও তোমার পছন্দ হলো না! আমাদের প্রেম কী ওদের মতো নয়?
শ্রাবণী গাল ফুলায়। হাতের আধখাওয়া আইসক্রিমটা ছুঁড়ে মারে সামনে। একটা ছালওঠা কুকুর ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে পায়ের কাছে পড়ে থাকা আইসক্রিমটা শুকে দেখে। শ্রাবণী অভিমানী চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি রাজু ভাস্কর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলি, না, আমাদের প্রেম ওদের মতো নয়।
শ্রাবণী এবার তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায়। কোমরে দুহাত রেখে ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ পাকিয়ে আগুন-গলায় বলে, তুমি কী ওদের মতো প্রেম করতে চাও না?
না।
লুচ্চা। বদমাস। আমার সাথে রঙ্গ করতে আসছ, না!
শ্রাবণী হনহন করে হাঁটা দেয়। আমি পিছু পিছু দৌড়ে গিয়ে পথ আটকায়, কথা শোনো...আমার কথা শোনো, লক্ষ্মীটি।
হাত ধরে ফের বসাই তাকে। চোখের ওপর নেমে আসা চুল আলতো করে সরাতেই দেখি টলমল করছে একজোড়া নীলপদ্ম। আমি নরম গলায় বলি, আমাদের প্রেম আর কারো প্রেমের মতো নয় শ্রাবণী। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট, চণ্ডিদাস-রজোকিনী কারো মতোই নয়। আমাদের প্রেম আমাদের মতো। এ প্রেমকে ভাঙলে শুধু প্রেমই পাওয়া যাবে, আর কিছু নয়। তাই আমাদের প্রেমের নাম মৌলিক প্রেম।
টলমলে নীলপদ্ম থেকে এবার অশ্রু গড়াতে শুরু করে। ভেজা গলায় শ্রাবণী বলে, মনে রেখো, এই মৌলিক প্রেম যেন কোনোদিন সাধিত প্রেম না হয়।
আমি আঙুলের ছোঁয়ায় অশ্রু মুছে দিতে দিতে বলি, যথাজ্ঞা, মহামান্য রাণী।
হাসি ফোঁটে শ্রাবণীর ঠোটে। আমি পিছন ফিরে চিৎকার করে বলি, রাসু, আরেকটা আইসক্রিম।
সেই দিন একেবারেই গেছে। কিছুই বাকি নেই আর। যদিও টিএসসির ডাস আগের মতোই আছে। ছালওঠা কুকুরটাও আগের মতো মুখগুজে শুয়ে থাকে। আমিও আগের মতোই ডাসের ভেতর গাছের গোড়ায় বসে থাকি। চেয়ে চেয়ে কুকুরটার শুয়ে থাকা দেখি। শুধু রাসুকে আর পিছন ফিরে চিৎকার করে বলা হয় না, আরেকটা আইসক্রিম...
রাসুটা বদলে গেছে। আর বদলে গেছে শ্রাবণী। রাসু আগের চেয়ে একটু লম্বা হয়েছে, আর একটু হ্যাংলা হয়েছে। আর শ্রাবণী এখন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে আইসক্রিম খায়। গাল ফোলায়। কোমরে হাত রেখে ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ পাকিয়ে সেই আরেকজনের দিকে তাকায়। আর সেই আরেকজন তখন ‘রাসু আরেকটা আইসক্রিম’ বলে হাঁক ছাড়ে।
শ্রাবণী আর নেই সেই শ্রাবণী। শ্রাবণী এখন সাধিত রাধিকা।
হঠাৎ প্যান্টের পকেটে মোবাইলটা কেঁপে উঠলে সম্বিৎ ফিরে পাই। অন্তু, অর্ণব, বর্ণ, রুদ্র, কমল, পলাশ— সবার চোখ এখনও ঝুলে আছে কেএফসির দুয়ারে। আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখি সঞ্জু ফোন করেছে। রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে ভেসে এলো সঞ্জুর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ, একটা কবিতা লিখেছি, শুনবি?
হুম, শুনব। বল।
বেশি বড় না। মুক্তগদ্যেই লিখলাম। কবিতার নাম সাধিত রাধিকা। হ্যালো, শুনছিস? হ্যালো...