মারুফ ইসলামের গল্প ‘শামুকজীবন’

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০১৯

আজ বিকেলে ফার্মগেটের মোড়ে তৃপ্তির সঙ্গে দেখা হওয়ারও বেশ আগে থেকে আমার জীবন গুটিয়ে গেছে শামুকের মতো। গল্প সেটা নয়, গল্প অন্যখানে। এই যে যারা শামুকের মতো জীবন যাপন করেন তারা চান না আর কেউ ‌`শামুক-জীবন` লাভ করুক। কারণ তারা জানেন, এ জীবন ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে যাওয়ার; এ জীবন লুকোচুরির।

লুকাচুরিটা সমাজ-সংসারের সঙ্গে তো বটেই, নিজের সঙ্গেও। আমি তাই কবি হেলাল হাফিজের মতো দীর্ঘদিন যাবৎ শামুকের মতো ঘরবাড়ি পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। পরিচিত চেনাজানা কাউকে দেখলেই দ্রুত খোলসের মধ্যে মাথা লুকিয়ে ফেলি, যেন চিনতে না পারে কেউ।

আজও তেমনই কিছু ঘটতে যাচ্ছিল। ফার্মগেটের অপরিসর ফুটপাতে কিলবিল করা মানুষের ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ তৃপ্তির চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায়-আরে! এই মেয়েকে তো আমি চিনি! অতএব আমাকে চিনে ফেলার আগেই লুকিয়ে ফেলতে হবে নিজেকে। এখনই। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না, গুটাতে পারলাম না নিজেকে। খোলসের মধ্যে মাথা লুকিয়ে ফেলব, ঠিক সেই মুহূর্তে চিৎকার করে ওঠে তৃপ্তি, `তুমি মারুফ না!`

`জি, মারুফ।` হেসে জবাব দিই আমি। বলি, `তুমি নিশ্চয় তৃপ্তি মণ্ডল।`

তৃপ্তি হেসে বলে, `মনে রেখেছ তাহলে আমার নাম!`

বস্তুত তৃপ্তির নাম মনে রাখার কোনো কারণ নেই। আপাত কৃষ্ণ বর্ণের এই মেয়ের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম এমন কিছু নেই যা আলাদা করে নজর কাড়ে। অতি সাধারণ দুটি চোখ, নাক, মুখ, ভ্রু, কপাল, চিবুক, চুল...। তবে হ্যাঁ, তৃপ্তি ব্যতিক্রম ছিল একটা কারণে, সেটা তার মেধা। কিন্তু মেধা দেখার মতো চোখ কী আর আমার আছে? তৃপ্তিকে তাই কোনোদিন আমার চোখে পড়েনি। তৃপ্তিকে তাই কোনোদিন আমি মনে রাখিনি।

কিন্তু আজ এই ভ্যাপসা গরমের বিকেলে প্রায় বছর তিনেক পর তৃপ্তিকে যখন সত্যি সত্যি চিনে ফেলি তখন তৃপ্তি মণ্ডল বিস্মিত না হয়ে পারে না। নিজের অজান্তেই যেনবা বলে ফেলে `মনে রেখেছ তাহলে`!

তৃপ্তির এহেন বিস্ময়বোধ আমাকে অবশ্য স্পর্শ করে না। আমি হঠাৎ উপলব্ধি করি, আমি যেন ফার্মগেটে নেই। আমার চারপাশে সবুজ সবুজ গাছপালা আর একটা হলুদ রঙের বিল্ডিং। বিল্ডিংটার তিন তলার করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর তৃপ্তি মণ্ডল। আমাদের চারপাশে আরও অনেক প্রিয় প্রিয় মুখ। আলাদা আলাদাভাবে নাম ধরে না বলে বরং বলি সমাজবিজ্ঞান থার্ড ব্যাচ। হ্যাঁ, এটাই ছিল তখন আমাদের সম্মিলিত পরিচয়।

সেই থার্ড ব্যাচের সবার খবর জানতে আবেদন জানাই তৃপ্তির কাছে। সবার খবর জানাতে না পারলেও অনেকের খবরই জানায় সে।

`মুক্তা তো ট্রাস্ট ব্যাংকে জয়েন করছে। বিয়ে শাদিও করে ফেলেছে।`
বাহ! বেশ তো। আর ফারাহর কী খবর। জিজ্ঞেস করি আমি।
‘ফারাহ ইউএনডিপির একটা প্রজেক্টে কাজ করছে। আশালতা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জয়েন করেছে।পলি বিয়ে করেছে। চাকরি করছে কি না জানি না। সানজিদাও বিয়ে করেছে। রেনুকা কী যেন একটা চাকরি করছে। ববির বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। বিয়ে করেছে শিউলি। প্রাইমারি স্কুলের টিচার হয়েছে তো অনেক আগেই। আর রাকিব বিয়ে করেছে...।’

হ্যাঁ, আমাদেরই এক সহপাঠীকে বিয়ে করেছে রাকিব। শুনে কিছুটা অবাক হই। অবাক হই, কারণ আমি হয়ত মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম ‘রহিম-রূপবান বিয়ে করেছে’ এই টাইপ খবর শোনার জন্য। তার বদলে শুনি রাকিবের বিয়ের খবর। যাইহোক, বিস্ময়ের দুলুনি সামলে তারপর তৃপ্তির কাছে জানতে চাই থার্ড ব্যাচের ছেলেদের খবর।

তৃপ্তি জানায়, অপু চুয়েটের টিচার হয়েছে। টিচার হওয়ার তালিকায় আছে সুমন আর আক্তার। সুমন গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে আর আক্তার এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। অন্য সব ছেলেরাও সবাই কিছু না কিছু করছে।

‘এবার তোমার খবর বলো।’ তৃপ্তিকে বলি আমি। ‘বিয়ে থা কিছু করেছ?’

`আরে! আমার মতো কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে।`

তৃপ্তির কণ্ঠটা হাহাকারের মতো শোনায়। ছোটবেলায় যখন ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজাতাম তখন ধুলোপড়া ক্যাসেট থেকে এরকম ঘ্যারঘ্যারে আওয়াজ বের হতো। আমি তৃপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে যেন মেঘের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে ক্রমশ বুড়ো হতে থাকা একটা চাতক পাখি বসে আছে! এমন দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। চোখ নামিয়ে বলি, ‘চাকরি বাকরি কিছু করছ?’

`মেধা নাই। চাচা মামাও নাই। চাকরি হবে কী করে! ৩৫তম বিসিএসের রিটেন দিছিলাম, টিকি নাই। সোনালী ব্যাংকের ভাইবা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করলো না, এমনকি রেজাল্ট পর্যন্ত জানতে চাইল না। এত খাইটাখুইটা যে ভার্সিটিতে রেজাল্ট ভালো করলাম, কী লাভ হলো? কেউ তো রেজাল্ট দেখতেই চায় না!`

মাথা নিচু করেই ছিলাম। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, কিছুক্ষণ আগের পরিবেশ আর নেই। আমার চারপাশের সবুজ সবুজ গাছপালাগুলো উধাও। হলুদ বিল্ডিংটাও নেই। টের পাই, আমার চারপাশে আবার বয়ে যাচ্ছে জনতার স্রোত। গাড়ির হর্ন, ট্রাফিকের বাঁশি আর মানুষের কোলাহলে কান পাতা দায়।আমি ঢের বুঝতে পারি, তৃপ্তি এখন জানতে চাইবে, `তোমার কী খবর?`

এ প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া যাবে না তৃপ্তিকে। আমাকে এখনই শামুক হয়ে যেতে হবে। গুটিয়ে ফেলতে হবে নিজেকে। অতএব, মুখে একটা তেলতেলে হাসি নিয়ে তৃপ্তিকে বলি, `আজ একটু তাড়া আছে। বাকি কথা ফেসবুকে হবে। যোগাযোগ রেখ।`

দ্রুত মিশে যাই ভিড়ের মাঝে। পিছন ফিরে আর দেখি না আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী তৃপ্তি মণ্ডলের মুখ। যদি বলে ফেলে, `তোমার লুকোচুরি ধরে ফেলেছি মারুফ! বেশ তো আছ শামুক-জীবন নিয়ে!`

তৃপ্তি শেষ পর্যন্ত বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। সে এখন পুলিশ বিভাগে চাকরি করছে।