মারুফ ইসলামের গল্প ‘বিকেলের মৃত্যু’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২২, ২০২০

নশরৎপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে বারোটা বেজে গেল।
মাথার উপর ভাদ্রের সূর্য। আকাশ থেকে যেন রাশি রাশি আগুনের ফুল ঝরে পড়ছে। এত গরম! গলা শুকিয়ে এঁটেল মাটির পথ। স্রেফ সারমেয় নই বলে জিভটা মুখ থেকে ঝুলে পড়েনি এখনো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ভাই, একটু পানি হবে?

ছোট্ট একটা টং দোকান। অল্প কয়েকটা চায়ের কাপ, একটা কেতলি, কয়েকটা অলটাইম পাউরুটি নিয়ে যিনি বসে আছেন তার কাছেই পানির আবদার করলাম। চারদিক জনমানবশূন্য। পাড়া গাঁয়ের নির্জন দুপুর। তিনি একাই বসে আছেন। ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ করি চল্লিশ হবে। নাকের তলায় মোটা গোঁফ। গোঁফের নিচে ততধিক মোটা ঠোঁট। তলোয়ারের মতো সোজা ভুরু। ডানপাশের ভুরুর উপরে কাটা দাগ। ছোটবেলায় ফুত্তিপান্টি খেলতে গিয়ে নিশ্চয়ই ভুরু কেটে ফেলেছেন। আর যারা ছোটকালে দুষ্টুর হাড্ডি থাকে, তারা বড় হলে এমন সুবোধ দোকানদার হয়।

এই ল্যান, পানি।
হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নেয়ার সময় দেখলাম, লোকটির দাঁত অতিশয় ঝকঝকে। কালো মানুষের দাঁত কাচের মতো স্বচ্ছ হয়। ইনি তার ব্যতিক্রম নন।
আপনি মনে হয় লতুন আসিছিন।
বললাম, জি, আমি এই এলাকায় নতুন। একটু আগেই নামলাম। ভাইজান, এখানে কী হোটেল মোটেল কিছু আছে?
নাই আবার? বাজারের ভিতরৎ যান। আল্লার দান।

ছোট্ট একটা বাজার। অল্প কিছু দোকানপাট। শাড়ি-লুঙির দোকান, মুদি দোকান, কসমেটিকের দোকান ইত্যাদি পেরিয়ে ‘আল্লাহর দান’ পাওয়া গেল বটে। তবে তা থাকার হোটেল নয়, ভাতের হোটেল।
আল্লাহর দানের ক্যাশে ভুড়ি এলিয়ে বসে আছেন মধ্য বয়স পেরিয়ে যাওয়া এক লোক। গায়ে সাদা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি। গেঞ্জির নিচের অংশ গুটিয়ে ভুড়ির উপর তুলে রেখেছেন। অনুমান করি, ভাদ্রের তালপাকা গরমই এর পেছনে দায়ী।
স্লামালেকুম। এখানে কী থাকার মতো কোনো হোটেল আছে?
ভদ্রলোক সম্ভবত নিরালা দুপুরে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন। চমকে উঠে চোখ মেলে তাকলেন।
ঘর ভাড়া খুঁজিচ্ছিন?
জি। জি। আমার একটা থাকার মতো ঘর দরকার।
এটি তো ঘরভাড়া পাওয়া মুশকিল রে বা। এক কাম করিন। সোজা বাজারের শ্যাষ মাথাত যাবিন। একটা চারতলা বিল্ডিং দেখা পাবিন। বশিরের বিল্ডিং। ভাড়া পালে ওটিই পাবিন। বশির মাঝেমধ্যে ঘর ভাড়া দেয়।

বাজারের শেষ মাথায় বশির ভদ্রলোককে পাওয়া গেল। এই ব্যক্তিও মধ্যবয়সী। পঞ্চাশোর্ধ। গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। পরনের লুঙিটাও পরিষ্কার। মাথায় সিঁথি কাটা চুল। তেল দিয়ে পরিপাটি করে বাঁ দিকে সিঁথি কেটেছেন। বললাম, একটা এনজিও থেকে জরিপের কাজে এসেছি। এই নশরৎপুর ইউনিয়নে যতগুলো গ্রাম আছে, সব গ্রাম ঘুরব। দিন সাতেক সময় লাগবে। এই কটা দিনের জন্য আপনি কী একটা ঘর ভাড়া দিবেন? শুনেছি আপনার এখানে অনেক ঘর আছে।

বশির সাহেব পান চিবুচ্ছিলেন। পান চিবুতে চিবুতে বিস্তারিত শুনলেন এবং ঘর ভাড়া দিতে সম্মত হলেন। বললেন, চাবিটা থোন। চার তলার দক্ষিণ দিকের ঘর। সব রেডি করাই আছে। যান। শোনেন, একটা শর্ত আছে কিন্তু। প্রত্যেক রাতে হামাক এক ঘণ্টা সময় দেওয়া লাগবে।

বিস্মিত হলাম। কিন্তু অতিরিক্ত কৌতূহল দেখালাম না। ভাবখানা এমন, এ আর এমন কী শর্ত। এ রকম শর্ত প্রত্যহ তিনবেলা করে পালন করি। এছাড়া উপায় ছিল না। শর্ত না মানলে অন্যত্র ঘর খুঁজতে হবে। সেই ঝক্কি সইবার এবং সময় ব্যয় করবার মতো অবস্থা আমার নেই। আমার হাতে অনেক কাজ। এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। তাই বশির হকের দিকে তাকিয়ে মুখ থেকে স্মিত হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চার তলায় উঠে গেলাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার স্ত্রীর ফোন এলো। রিসিভ করে বললাম, অফিসে আছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ লাঞ্চ করেছি। তুমিও খেয়ে নাও।
মিথ্যা বললাম। নিউ নরমাল লাইফে এটাই এখন স্বাভাবিক। প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলতে হয়। তাও আবার নিজের পরিবারের সঙ্গে। নিজের স্ত্রী পরিজনদের কাছে মিথ্যে বলার মতো কষ্টের আর কিছু নেই।

চারতলার দক্ষিণ দিকের ঘরে ব্যাগ রেখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সবচেয়ে কাছের গ্রাম সম্ভবত কাউয়াতলা। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। আমাকে হেড অফিস থেকে যে লিস্ট দেয়া হয়েছে সেখানেও অবশ্য প্রথমেই রয়েছে কাউয়াতলা। এই ইউনিয়নে সাতটি গ্রাম আছে। সবকটি গ্রামেই আমাকে যেতে হবে।

রোদের তাপ একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপর। রোদ আর গরমে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। অনভ্যস্ততার ফল। মাস চারেক আগেও আমি ঢাকা শহরের শীত ও গরম নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে অফিস করতাম। এইচআর অফিসার হিসেবে আমার সে কী দাপট! সেই আমাকে এখন রোদে পুড়ে ঘামে ভিজে গ্রামে গ্রামে হাঁটতে হচ্ছে।

আধা ঘণ্টা বিরামহীন হণ্টন শেষে কাউয়াতলায় পৌঁছলাম। ছায়াঘন গ্রাম। এমন শান্ত গ্রাম, এমন শ্যামল ছায়া বহুকাল দেখিনি। ঢাকা শহরে থাকতে থাকতে চোখ পচে গেছে। সেই পচা চোখে হঠাৎ ঝিরিঝিরি হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল।

গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা বিশাল জামগাছ। জাম গাছের তলায় বসে খানিক জিরিয়ে নিলাম। একটা বিষয় ভেবে ভালো লাগছে। আমার স্ত্রী-কন্যা গ্রামে আছে। তারা প্রকৃতির আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠছে। হয়ত নাগরিক সুবিধা কিছু কম পায়, কিন্তু প্রকৃতির সুবিধা তা পুষিয়ে দেয়।

হণ্টন ক্লান্তি কিছুটা কেমে এলে আমি জাম গাছতলা ত্যাগ করি। গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে যে বাড়িটি চোখে পড়ল, তার সদর দরজা খোলা। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে, মাটির চুলায় রান্না করছেন এক নারী। দুপুরের রোদ, গরম আর চুলার আঁচে রক্তাভ হয়ে উঠেছে তার মুখ। আমি পরিচিত মানুষের মতো হাঁক দিতে দিতে সোজা ঢুকে পড়লাম বাড়ির ভিতর— চাচি… ও চাচি। বাড়ি আছেন?

গ্রাম্য বধূটি এমন অচেনা আগন্তুকের অকস্মাৎ গৃহপ্রবেশে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। দ্রুত মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। আপনি কে? কুটি থ্যাকা আসিচিন? একেবারে বাড়ির মদ্যে সান্দাছিন ক্যাম্বা!
আমি একটা এনজিওতে চাকরি করি। আমার নাম মেহেদী। একটা জরিপের কাজে এসেছি।
ও…। কিস্তি স্যার আপনে। হামরা তো কিস্তি লেই না।
না, না, কিস্তি না। আমি কিছু তথ্য নিতে এসেছি। এই ধরেন…।
শোনেন, শোনেন। বাড়িত কোনো মরদ মানুষ নাই এখন। বেবাকে নামাজ পড়ব্যা গ্যাছে। আপনে পরে আসিন।

অগত্যা অন্য বাড়ির দিকে রওনা দিতে হলো। কয়েক গজ দূরেই আরেকটি বাড়ি। খরের চাল দেয়া একতলা। এখনো খরের চাল আছে দেখে অবাক হলাম। কত মানুষ কতভাবে নিজের ভাগ্য বদলাচ্ছে, আর এই লোকটা নিজের বাড়িতে একটা টিনের চাল দিতে পারল না! আমার মতো হতভাগা আর কি।

বারান্দায় বসে পাট পাকাচ্ছিলেন এক প্রৌঢ়। আমার দিকে জিজ্ঞাসার চোখ মেলে তাকিয়ে থাকলেন। কিছু বললেন না।
আমি এনজিও থেকে এসেছি। চাচাজান, ভালো আছেন?
প্রৌঢ়ের মুখে হাসি ফুটল। তুমি কিস্তি দেওয়ার জন্যি আসিচিন? লুন দিবিন?
না, না চাচা। আমি করোনা ভাইরাস নিয়ে একটা জরিপ করতে এসেছি। এই ধরেন আপনার বাড়িতে কারও করোনা হয়েছিল কিনা, করোনায় কেউ মারা গেছে কিনা এইসব।
ও...। প্রৌঢ়ের মখের হাসি নিভে গেল। বলল, করোনা ফরোনা কিছু হয়নি হামাকেরে। গরিবের করোনা হয় না কো। তিনি পাট পাকানোয় মন দিলেন। তারপর কি মনে করে করুণ গলায় বলতে শুরু করেন, এখন আর কিস্তিঅলারা আসে না লয়? অ্যানা লুন পালে উপগার হলোনি রে বা। যারা কিস্তি দেয় তারকে দেখা পালে আমাকেরে গাঁওত অ্যানা আসপার কইয়ো।

বিষণ্ণ মনে ‘আচ্ছা’ বলে পা উঠালাম। তারপর গ্রামের ভিতর প্রায় প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি ঘুরলাম। করোনায় কেউ মারা গেছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। জ্বরটর হয়ে অনেকেই মারা গেছে কিন্তু করোনায় মারা গেছে কিনা তা জানে না তারা। পরীক্ষা করায়নি কেউ।

সূর্য বিকেলের কোলে মাথা রেখেছে। আলো মরে আসছে। আমার মাথাটা আবার চক্কর দিয়ে উঠল। দুপুরে না খেয়ে কাজে বের হওয়া উচিত হয়নি। আমি নশরৎপুর বাজারে ফেরার জন্য রওনা দিলাম। ফিরতে ফিরতে বিকেলের মৃত্যু হলো। খানিক বাদেই সন্ধ্যা জেগে উঠবে। নশরৎপুর বাজারে লোক সমাগম বেড়েছে। দুপুরের মতো নির্জন নয়। আজ মনে হয় হাটবার। অনেকে তরিতরকারি নিয়ে বসেছে। এক কোনায় দেখলাম পলিথিন বিছিয়ে শাড়ি, লুঙি ও গামছা নিয়ে বসেছে একজন।

কাছে গেলাম। হঠাৎ কী মনে করে জিজ্ঞেস করলাম, শাড়ি আছে? ছোট বাচ্চাদের শাড়ি?
বয়াস কত?
এই তো আড়াই বছর, তিন বছর হবে।
শাড়ির স্তূপের মধ্যে তিনি বাচ্চাদের শাড়ি খুঁজতে লাগলেন। বিড়বিড় করে বললেন, এত ছোট শাড়ি মনে হয় নাই কো।
আমি বললাম, একটু বড় হলেও ক্ষতি নাই। প্যাচাইয়া পুচাইয়া পইরা দিমু আর কি। আমার মেয়ের জন্য।

একটা হলুদ রঙের শাড়ি বের করলেন তিনি। বললেন, এর চেয়ে ছোড আর নাই।
আমতা আমতা করে বললাম, লাল রঙের হয় না?
তিনি বললেন, এই এডা শাড়িই আছে।
আচ্ছা হোক। হলুদ রঙেরই হোক। হলুদ শাড়িতে আমার কন্যাকে হলদে পাখির ছানার মতো লাগবে। গুটি গুটি পায়ে সে হাঁটবে, খেলবে, দৌড়াবে। কল্পনায় সেই দৃশ্য দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। কবে বাড়ি যেতে পারব জানি না। পাঁচ মাস হয় বাড়ি যাই না। মাদারিপুরের কালকিনিতে আমার এক টুকরো আত্মা পড়ে আছে। আমি একটা দেহের খোলস নিয়ে এখানে পড়ে আছি। আমার বৃদ্ধ মা, আমার ভালোবাসার বউকে কতদিন দেখি না!

শাড়িটা কাগজে মুড়ে আল্লাহর দান হোটেলে গিয়ে ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলাম। সারাদিন পর ভাত খাওয়ার ফলে আমার শরীর অবশ হয়ে এলো। আমি কোনোমতে বশির বিল্ডিংয়ের চারতলায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে শোয়ামাত্র ঘুমের অতলে ডুবে গেলাম।

ঘুম ভাঙল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। কেউ একজন দরজায় ক্রমাগত আঘাত করেই যাচ্ছে। ঘুম চোখে মোবাইল জ্বালিয়ে দেখলাম, বারোটা উনিশ। এত রাতে কে? একটা ভয়মিশ্রিত অনুভূতি আমাকে গ্রাস করল। নতুন জায়গা। কিছুই চিনি না। কাউকে চিনি না। মাত্রই এসেছি আজ। লা ইলাহা ইল্লা আন্তা পড়তে পড়তে দরজা খুললাম।
এনজিও সায়েব ঘুমাচ্ছিলিন বোধয়।
চোখ কচলে দেখলাম, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বশির সাহেব। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর সোনালি পাড়ের সাদা লুঙিতে তাকে সিনেমায় দেখা জিনের বাদশার মতো লাগছে। তিনি পান চিবুচ্ছেন। যথারীতি তেল দিয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো।
শর্ত আছলো, আতের বেলা হামাক এক ঘণ্টা সময় দিবিন। ভুলা গেলিন?
না, না, মানে ইয়ে…। সারাদিন ক্লান্ত ছিলাম তো। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছি।
চলিন। ছাদত চলিন। বলে তিনি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে থাকলেন।

আসন্ন বিপদের কথা ভেবে শিউরে উঠলাম। আগামী এক ঘণ্টা কপালে কী আছে কে জানে। লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে না তো? কী ভাবছি এসব! মেরে ফেলবে কেন? আমি কি তার কোনো ক্ষতি করেছি?

ছাদে আগে থেকেই দুটো চেয়ার পাতা রয়েছে। চারদিক শুনশান। মৃদু হাওয়া বইছে। সারা দিনের ভ্যাপসা গরমটা নেই। আকাশের বুকে বিশাল একটা চাঁদ। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। এমন চাঁদভাসা রাতে মানুষের হৃদয়ের গোপন দুয়ার খুলে যায়। জেগে ওঠে গোপন দুঃখ। কেউ কেউ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। যেমন বশির সাহেব ঘর ছেড়ে ছাদে চলে এসেছেন। একটা চেয়ারে বসলেন তিনি।

এনজিও সায়েব, খাড়া হয়্যা আছিন ক্যা? বসিন বসিন। ভয় পাছিন নাকি?
না না না। ভয় পাব কেন? ভয় পাব কেন? কী যে বলেন!
অতিরিক্ত ভয়ের চোটে আমার দ্বিরুক্তি হচ্ছে। একই কথা দু’বার করে বলছি।

বশির সাহেব হঠাৎ উদাস হয়ে গেলেন। আনমনা হয়ে বলতে শুরু করলেন, একলা একলা মানুষ বাঁচপার পারে না, বুঝলিন। গপ্পো করার জন্যি হলেও একটা মানুষ লাগে। হামার কোনো মানুষ নাই।

আমি চুপ করে আছি। কী বলা উচিত বুঝতে পারছি না। বশির সাহেবের মতিগতি রহস্যজনক। স্রেফ গল্প গুজব করার জন্য এই নিশুতি রাতে একজন ঘুমন্ত মানুষকে তিনি ছাদের উপর ডেকে এনেছেন বলে মনে হয় না। গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন বশির হক। তারপর বললেন, আপনের বাড়ির লোকজন সব ভালো আছে?
শুকনো গলায় বললাম, জি, আছে।
কে কে আছে আপনের বায়িৎ?
এই তো, মা, বউ আর ছোট একটা বাচ্চা আছে।

বশির হক উৎফুল্ল গলায় বললেন, মাশাআল্লাহ। আপনের কপাল কত ভালো। খোদাপাক আপনাক সন্তান দিছে। ব্যাটা ছোল নাকি বেটি ছোল?
আমি বললাম, মেয়ে।
বশির হক আবার বললেন, মাশাআল্লাহ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো তার বুক থেকে। তিনি বললেন, হামি নিঃসন্তান, বুজলিন। খোদাপাক হামাক কোনো ছোলপল দেয়নি। সেই দুঃখেই কি না জানি না, বউ হামার আপন ছোট ভাইয়ের সাথে পল্যা গেছে। এগলা শরমের কথা মানষক কওয়া যায়? তাই এলাকাত রটনা কর‌্যা দিনু বউ করোনা হয়্যা মর‌্যা গেছে। ঢাকাত লিয়া গেছনু চিকিৎসার জন্য। ওটিই কব্বর দিছি। এছাড়া আর কী কমো কও? বউ ভেগে গ্যাছে ছোট ভাইয়ের সাথে। এর চেয়ে শরমের আর কিছু আছে? মনে হয় মাটির সাথে মিশ্যা যাই।

বশির হক পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট একটা বোতল বের করলেন। ছিপি খুলতেই একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। তিনি খুব সাবধানে, যেন কেউ দেখে না ফেলে তেমন ভঙ্গিতে সুরুৎ করে এক চুমুক খেলেন। তার চোখেমুখে তখনও লজ্জার ছাপ স্পষ্ট।

ব্যাপারটা লজ্জারই বটে। স্ত্রী যখন দেবরের সঙ্গে পালিয়ে যায় তখন স্বামীর জন্য তা বিরাট লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বশির সাহেব লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। জোছনার অম্লান জোয়ার তার লজ্জাকে ভাসিয়ে নিতে পারছে না। আমার ভয় খানিকটা দ্রবীভূত হয়েছে। আমি তার সামনের চেয়ারটায় বসলাম। মৃদু স্বরে বললাম, আপনার আর কেউ নেই?

বশির সাহেব হাসলেন। বললেন, সেগলা ম্যালা কিচ্ছা। কবার লাগলে আত পুয়্যা যাবে। হামার জ্ঞাতি গুষ্টি সব ইন্ডিয়াত থাকে। ইন্ডিয়ার কোচবিহার। অনেক ছোটবেলায় হামি আর হামার ছোটভাই ট্রেনত উঠ্যা চল্যা আসিছি এই এলাকাত। অভাবের তাড়নায়, বুঝলিন। এটি কুণ্ডু মাড়োয়ারির ধানের চাতাল আছলো। দুই ভাই চাতালত ধান শুকানের কাম লিনু। তারপর আর বায়িত যাইনি। একাত্তর সালে মাড়োয়ারিরা সব থুয়্যা ইন্ডিয়াত চল্যা গেল। যাওয়ার সময় কলো, তোরা চাতালডা দেখিস। সেই থ্যাকা চাতাল হামার হয়্যা গেল। পরে তো ম্যালা ট্যাকা করিছি। চাউলের আড়ৎ দিছি। কিন্তু কী লাভ হলো কও? এত ট্যাকা পয়সা হামার কে খাবে? সন্তানাদি হলো না। বউ চল্যা গেল। ছোট ভাইডাও গেল। কুটি যে গেল তারা, খোদাপাক জানে। এগলা দুঃখের কথা তো কাউকে কওয়া যায় না। তাই তোমার মতো অপরিচিত মানুষ যখন অল্প কয়দিনের জন্য ঘর ভাড়া লিবা আসে, তখন তার কাছেই কই। আজ যেমন তোমাক কচ্চি। তোমার কাছে কওয়াতে লজ্জা নাই। কারণ দুই দিন পর তুমি চল্যা যাবিন। তোমার সাথে হামার আর কোনোদিন দেখা হবে না। ঠিক কিনা কও?

বশির হক তুমিতে নেমে এসেছেন। গভীর নৈকট্য অনুভব না করলে কাউকে তুমি বলা যায় না। তিনি আমাকে নিকটজন ভাবছেন। আমারও তাকে আপন আপন লাগছে। তার থিউরিটা আমার মনঃপুত হয়েছে। আমার মনে হলো, আমার গল্পটাও বশির সাহেবের কাছে বলা উচিত। যে গল্পগুলো আমি কখনো কাউকে বলতে পারি না, স্ত্রীর কাছে বলতে পারি না, বন্ধুদের কাছে বলতে পারি না— সেই করোনার কারণে চাকরি হারানোর গল্প, চাকরি হারিয়ে পথে পথে ঘোরার গল্প, না খেয়ে থাকার গল্প, শেষে এই জরিপের চাকরি জুটিয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রামে আসার গল্প, স্ত্রীর কাছে প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলার গল্প, কন্যার জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা পুষে রাখার গল্প হরহর করে বলে যাই মধ্যবয়সী বশির হকের কাছে। বশির হক জোছনার প্রান্তরে মুখ তুলে টোঠ কামড়ে বসে থাকেন।