অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম
মারুফ ইসলামের গল্প ‘ধার’
প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২০
জমেলার কথা শেষ না হতেই বাইরে একটা পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যায়, ভাবি, ও ভাবি, বায়িৎ আছিন?
কণ্ঠটা চিনতে অসুবিধা হয় না জমেলার। এ তো আলতাব মুন্সীর গলা! জমেলা দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে, উঠানে দাঁড়িয়ে আছে আলতাব মুন্সী।
আসিন ভাই, ভিতরে আস্যা বসিন। আলতাবকে আহ্বান জানায় জমেলা। এর আগেও একদিন এসেছিল সে। কিছু একটা বলতে চায় জমেলাকে। কিন্তু বলে না। আজ আবার কেন এলো, কে জানে!
আলতাব মুন্সীর মতিগতির অতল স্পর্শ করতে পারে না জমেলা। সে ভাবে, মানুষের মুখ দেখেই যদি মনের ভেতরটা পড়া যেত কতই না ভালো হতো। উঠোন লাগোয়া বারান্দায় ছিল একটি বসার টুল। সেখানেই বসতে বসতে আলতাব মুন্সী বলে, না থাক ভাবি, ঘরের ভিতরে আর যামো না। ছলেরা পড়িচ্ছে মনে হয়। পড়ুক। ছোলপলোক লেকাপড়া শিখাইয়ো ভাবি। ওরাই কিন্তুক তোমার অন্ধের যষ্টি। যষ্টি মানে বুচ্ছিন তো। লাঠি, লাঠি। লাঠি হারালে সব শ্যাষ।
হয় ভাই। ঠিকই কছিন। কানার লাঠি হারালে তো আর কিছু থাকে না।
সেই জন্যই কচ্ছি, সাবধানে থাকো। আর একটা কথা কবার চাছনু ভাবি। কিন্তু ক্যাংকা কর্যা যে কমো। তোমার এত বিপদ। গরুগুলাও চুরি হয়্যা গেল। এই দিকে হামিও পড়িছি বিপদে। না কইয়া থাকপারও পারিচ্ছি না।
কন ভাই কন। মনের মদ্যে কোনো সংকোচ থুয়েন না ভাই। কন, কী কবার চাচ্ছিন। মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিতে দিতে কথাগুলো বলল জমেলা।
তার এক হাতে ছিল হারিকেন। সেটি মাটিয়ে নামিয়ে রেখে বারান্দায় বসে পড়ল সে। হাত তিনেক দূরে কাঠের টুলের উপর বসে আছে আলতাব মুন্সী। তার মাথা নিচু। হারিকেনের মৃদু আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। সন্ধ্যা উৎরে গেছে অনেক আগেই। আকাশে চাঁদ ওঠেনি এখনো। জমেলার উঠোনের এক কোনায় ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি কামরাঙা গাছ। তার তলায় একরাশ অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে।
সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাত কচলাতে শুরু করে আলতাব মুন্সী। তারপর থেমে থেমে একটু ধীর গলায় বলে, ঘটনা হছে কী ভাবি, একরাম ভাই বাঁচ্যা থাকতে হামার কাছ থাক্যা দশ হাজার ট্যাকা ধার লিছলো। কছলো, পরে আস্তে আস্তে শোধ কর্যা দিবে। কিন্তু আল্লার কি কাম দেখলিন! মানুষটা ধাম কর্যা মর্যা গেল! এখন হামিও তো গরিব মানুষ। কষ্টেবিষ্টে ট্যাকা কয়টা জড়ো করিছিনু। হামার তো আর কোনো জমানো ট্যাকা নাই ভাবি। ট্যাকাডা দিলে উপকার হলোহিনি। তোমার ভাবির কি এক ব্যরাম হছে। অ্যানা ডাক্তার দেখানুহিনি।
হঠাৎ করে যেন বাজ পড়ল জামেলার মাথার উপর। তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। এমন কথা তো সে কখনো শোনেনি! জমেলার স্বামী একরাম বেঁচে থাকতে কখনো তো টাকা ধার করার কথা বলেনি। আর এত টাকা ধার করে সে কী করেছে? কোথায় খরচ করেছে? কাকে দিয়েছে? নাকি আলতাব মুন্সী মিথ্যা কথা বলে জমেলার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে? নানা প্রশ্ন একসাথে আছড়ে মনে জমেলার মনে। কিন্তু আলতাবকে কোনো প্রশ্ন করতে পারে না সে। এতদিনের পরিচিত আলতাব মুন্সী, এত বিশ্বস্ত, সবসময় তার স্বামী একরাম আর এই আলতাব মুন্সী একসঙ্গে কুলির কাজ করেছে, সে কি মিথ্যা কথা বলতে পারে জমেলার কাছে? জমেলার বিশ্বাস হয় না। সে তাই আলতাব মুন্সীর কথাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে এবং ধরে নেয় সত্যিই একরাম তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। কিন্তু টাকা ধার নিয়ে সে কী করেছে সেই প্রশ্নের উত্তর পায় না জমেলা।
অদূরে কামরাঙা গাছের তলা থেকে জমাটবাঁধা অন্ধকারটা পায়ে পায়ে উঠে এসে জমেলার বুকের উপর যেন চেপে বসে। সে শ্বাস নিতে পারে না।
আজ তালে উঠি ভাবি। তুমি ক্যাংকা কর্যা কী করবিন, তোমার সিদ্ধান্তের কথা পরে তালে হামাক জানাইও। উঠোন পেরিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় আলতাব মুন্সী। তার চলে যাওয়া পথের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে জমেলা। তার শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে।