মারুফ ইসলামের গল্প ‘জন্ম’
প্রকাশিত : মে ১২, ২০২০
ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, চাঁদের আলোয় চারদিক রোশনাই হয়ে আছে। এমন একটা রাত মৃত্যুর জন্য বেছে নিতে পেরেছি দেখে নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে।
আমার আব্বার ধারণা, ছোটবেলা থেকেই আমি অনেক বুদ্ধিমান। কেবল কপাল দোষে মৈত্রী বাসের হেলপার হয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছিল। অবশ্য আজ সেই জীবনেরও অবসান হতে যাচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকালাম। শায়লার জন্য আমার মন খারাপ লাগছে। বেচারা ঘরের মধ্যে একলা ঘুমোচ্ছে এখন। তার পাশ থেকে আমি উঠে এসেছি, সে টেরই পায়নি।
সে যখন ঘুম থেকে উঠে দেখবে আমি নেই, যখন জানবে কখনোই ফিরে আসবো না আর, তখন সে কি কাঁদবে খুব? পাড়ভাঙা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে পড়ে? না, না, এখন আছাড়ি পিছাড়ি করা ঠিক হবে না শায়লার। তার পেট হাওয়া দেয়া বেলুনের মতো ফুলে আছে। ফুলে থাকা পেটের মধ্যে জিয়ল মাছের মতো খলবল করছে আমাদের সন্তান। আমরা ধরেই নিয়েছি, আমাদের সন্তান হবে ছেলে, আর আমরা তার নাম রাখব সালমান শাহ।
আমাদের দুজনেরই প্রিয় নায়ক। কিশোরবেলায় আমরা কত যে সিনেমা দেখেছি সালমান শাহর! আচ্ছা, আমি তো থাকব না। শায়লা কি সত্যি সত্যি আমাদের ছেলের নাম রাখবে সালমান শাহ? নাকি অন্য কিছু রাখবে? আমার স্মৃতি কি মনে রাখবে শায়লা?
ধুর! আমি কুদ্দুস। আমি মৈত্রী বাসের হেলপার। আমার কথা মনে রাখার কী হেতু আছে শায়লার? গত তিন মাস ধরে সমস্ত কামাই-কাজ্যি বন্ধ আমার। গাড়ি ঘোড়া কিচ্ছু চলে না। কি এক রোগ এলো শহরে। সব বন্ধ হয়ে গেল। তিনবেলা তিনমুঠো ভাতই দিতে পারিনি শায়লাকে। আহারে! পোয়াতি বউ আমার! ক্ষমা কর শায়লা।
আমি চোখ মুছে সামনে পা বাড়াই। চারদিক শুনসান। বেড়িবাঁধ বস্তি তলিয়ে আছে গভীর ঘুমে। দূরে কোথাও রাত প্রহরীর বাঁশি বেজে উঠল একবার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরও দূরে কোথাও ডেকে উঠল কয়েকটা কুকুর। মাথার উপর মস্ত একটা চাঁদ ছাড়া আমাকে দেখার কেউ নেই।
আমি বেড়িবাঁধ থেকে বসিলা রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এলাম বসিলা ব্রিজের উপর। ব্রিজের নিচে শায়লার চোখের মতো টলটলে স্বচ্ছ নদী। নদীর বুকে হামলে পড়েছে জোছনা। ওই জোছনার মতো আমাকেও এখন হামলে পড়তে হবে। হঠাৎ ব্রিজের গোড়া থেকে বিকট একটা আওয়াজ ভেসে এলো।
মানুষের চিৎকারের মতো। কিন্তু এমন ভয়ংকর চিৎকার ইহজনমে শুনিনি আমি। কেবল জন্তু-জানোয়ারের পক্ষেই এমন জান্তব চিৎকার করা সম্ভব। আমি ব্রিজের গোড়ার দিকে এগিয়ে গেলাম।
গোড়ার নিচে ঢালুমতো একটা জায়গা। সেখানে পলিথিনের ছাউনি দেয়া কুঁড়েঘরের মতো একটা ঘর। ঘরের সামনে এক মেয়েমানুষ বসে আছে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তার মুখে রক্তের লেশমাত্র নেই। পুরো মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কেবল বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেসে যাচ্ছে নাক, থুতনি, চিবুক, কপাল। মহিলা তার গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছে। হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুকের ছাতি।
আমাকে দেখে এমন জোরে পুনর্বার চিৎকার করে উঠল সে, আমি ভয় পেয়ে দু পা পেছনে সরে গেলাম। দেখলাম তার কপালের দু পাশের নীল রগ দপদপ করছে। যেকোনো মুহূর্তে ফেটে যেতে পারে। চিৎকারের পর তার গলা থেকে গোঙানির মতো আওয়াজ আসছে। সে আরেকবার তীব্র চিৎকার দিয়ে তার শাড়ি ছিঁড়ে ফেলল। আমি দেখলাম, এক বালতি তাজা থকথকে রক্তের মধ্যে নিতম্ব ডুবিয়ে বসে আছে সে। তার পায়ের কাছে রক্তের জোলার ভেতর হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করছে এক নবজাতক!
মহিলা পাতি হাঁসের মতো গলা টানতে টানতে ফ্যাশফেসে কণ্ঠে বলে উঠল—‘পানি...। একটু পানি খাব’।
আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। কেমন যেন বিপন্ন বোধ করলাম। চারদিক ভীষণ রকম শান্ত—কোথাও কোনো জনমনিষ্যি নেই। কেবল মাথার উপর একটা আজদাহা চাঁদ। মেয়েলোকটি দূরাগত কোনো জাহাজের ধ্বনির মতো ভেসে যাওয়া কণ্ঠে আবার বলে উঠল—‘বাবা, আমাকে একটু বাঁচান। আমার স্বামী আমাকে ফেলে চলে গেছে’। তারপরই সে কাটা বৃক্ষের মতো ধপ করে ডানপাশে এলিয়ে পড়ল। আমি দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখি তার কোনো সাড়াশব্দ নেই।
একটু আগে হাপরের মতো দুলছিল যে বুক, তা থেমে গেছে। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে মাছের মতো। শুধু তার পায়ের কাছে হাত পা ছুঁড়ে তখনও কেঁদে যাচ্ছে নবজাতকটি।
আমার সামনে হঠাৎ শায়লার মুখ ভেসে উঠল।