মারুফ ইসলামের গল্প ‘আমাদের আঞ্জু আপা’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০২০
ভর দুপুরে বৃষ্টি নামল।
এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, ঘনঘোর লকডাউনকালে, বাসার সামনের গেইটে ‘মেহমান আসা নিষেধ, যার ফ্ল্যাটে মেহমান আসবে তাকেসহ পুলিশে দেয়া হবে’— এমন সাইনবোর্ড উপেক্ষা করে, দারোয়ানের উপর্যুপরি বাধা ও একপ্রস্থ ঝগড়া সমাপন করে আমার ফ্ল্যাটের দরজায় হাজির কেউ একজন।
ঠক ঠক।
আমি দরজা খুলে হতভম্ব!
বৃষ্টিভেজা জবজবে শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঞ্জু আপা! তার নাকের ডগায়, কানের লতিতে, থুতনিতে লেগে আছে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি!
আঞ্জু আপা হারিয়ে গিয়েছিল মাসখানের আগে। মানে প্রথম যেদিন করোনা হানা দিল বুড়িগঙ্গার তীরে, ভয়ে কম্পমান হয়ে উঠল বঙ্গসমাজ, ভয় সামাল দিতে তালগোল পাকিয়ে ‘লকডাউন’ শব্দের পরিবর্তে ‘সাধারণ ছুটি’ ব্যবহার করল সরকার মশাই, তখন হঠাৎ শুনি আঞ্জু আপা উধাও।
উধাও মানে লাপাত্তা। লাপাত্তা মানে নিখোঁজ। আমরা হেথায় সেথায় এমনকি মর্গে পর্যন্ত খুঁজলাম। পেলাম না। থানা পুলিশ করলাম। তারাও কোনো হদিস দিতে পারল না। শেষে আঞ্জু আপাকে ফিরে পাবার আশা এক প্রকার ছেড়ে দিয়ে যখন ঘরবন্দি হয়েছি, ঠিক তখনই আঞ্জু আপা নিজেই হাজির।
আঞ্জু আপাকে চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করে খুশিতে আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু উজ্জ্বল মুখটা তৎক্ষণাৎ দপ করে নিভে গেল আপার পিছনে দাঁড়ানো দারোয়ানকে দেখে।
‘কামডা মোটেও ঠিক হইল না মামা। গেটে পরিষ্কার লেইখা দিছি মেহমান আসা নিষেধ। হ্যারপরও এই বেয়াদ্দপ মেহমান ঢুইকা পড়ছে।’
দারোয়ান মাজেদ ভীষণ ঘাউরা। তাকে বসে রাখতে হয় চোখ টিপ দিয়ে। আমি তার দিকে তাকিয়ে কড়া করে একটা চোখ টিপ দিলাম। এক চোখ টিপ মানে একশো টাকা। ওমা! সে দেখি নড়ে না। আমি আরেকটা চোখ টিপ মারলাম। সে তবুও নট নড়নচড়ন। বুঝলাম এটা অন্য কেস। হাদিয়া একটু বেশি চায় মাজেদ মিয়া। লকডাউনের মধ্যে বাইরের লোক ঢুকেছে বাসায়। এত বড় অপরাধ মাত্র দুশো টাকার নোটের তলায় চাপা দেয়া সম্ভব না। আমি গুণে গুণে পাঁচটা চোখ টিপ মারার পর সে বিদায় নেয়।
‘আপা তুমি কই হারাই গেছিলা? আসো, ঘরে আসো তো আগে।’ আপাকে টেনে ঘরে ঢুকাই।
তারপর আপার কাছ থেকে যা শুনি, তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম! আপা নাকি এই শহরের সেইসব শিল্পপতিদের প্রাসাদে লুকিয়ে লুকিয়ে ঢুকেছিল, যারা পানি পর্যন্ত বিদেশ থেকে এনে খায়, তারা এখন কী খাচ্ছে— এটা দেখতে। তারা যা কিছু খায়, যা কিছু পরে সবই তো বিদেশ থেকে আনা, অসুস্থ হওয়ার আগেই নিয়মিত চেকআপ করতে যায় বিদেশে। এখন তো তারা বিদেশ টিদেশ যেতে পারছে না, বার টার বন্ধ, ক্লাব-পার্টি বন্ধ, তো এহেন পরিস্থিতিতে কীভাবে তাদের দিন কাটছে এটা দেখার নাকি খুব শখ হয়েছিল আঞ্জু আপার।
কয়েকজন পরিচিত সংবাদিককেও নাকি অনুরোধ করেছিল এই বলে— ‘আচ্ছা, আপনারা তো আগডুমবাকডুম কতকিছু নিয়ে প্রোগ্রাম করেন, লাইভ করেন, এই লকডাউনে শিল্পপতিরা কীভাবে সময় কাটাচ্ছে সেটা নিয়ে কী কোনো প্রোগ্রাম করা যায় না?’
তারপরের ঘটনা অননুমেয়। যা ভেবেছিলাম তা ঘটেনি। ভেবেছিলাম, আঞ্জু আপা হয়তো রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘরে ফিরে এসেছিল। কিন্তু না, ভদ্রমহোদয়া তারপর কী ঘটিয়েছিল তা তার মুখ থেকেই শোনা যাক:
‘গেলাম গুলশানে এক শিল্পপতির বাসায়, বুঝলি। গভীর রাত। সবকিছু শুনশান। সিকিউরিটি ঘুমে ঢুলছে। আমি পাচিল টপকাতে গেলাম। বুঝতেই পারছিস, মেয়ে মানুষের কাজ কি আর পাচিল টপকানো? ধপ করে পড়ে গিয়ে যথারীতি ধরা খেলাম।’
এরপর আঞ্জু আপার ঠিকানা হওয়ার কথা ছিল সোজাসুজি হাজতখানা। কিন্তু তা হলো না। আপার ভাষ্যমতে, শিল্পপতি ভদ্রলোক বেজায় রসিক। তিনি আঞ্জু আপার উদ্দেশ্য আদ্যপান্ত শুনে নাকি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। তার হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, ‘অ্যাই কে কোথায় আছিস! দক্ষিণের গেস্টরুমে ওনার থাকার ব্যবস্থা কর। ওনার যেহেতু শখ হয়েছে আমরা কী খাচ্ছি না খাচ্ছি দেখার, তো দেখুক। শখের কেজি লাখ টাকা। ওনার শখ পূরণ হোক।’
আলিশান ঘর, বিশাল পালঙ্ক, ফোমের গদি, মাথার উপর ঝাড়বাতি— সে এক এলাহি কাণ্ড! এমন পরিবেশে থাকতে থাকতে পাঁচ দিনের মধ্যেই নাকি হাঁপ ধরে গিয়েছিল আপার। তারপর সিকিউরিটি গার্ডের হাতেপায়ে ধরে কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে আজ।
এবং ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সোজা আমার বাসায়!