মারিয়া সালাম
মারিয়া সালামের ভৌতিক গল্প ‘লম্বা আলখাল্লা’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৬, ২০২২
আমার নিজেরই চোখের ভুল, এই ভাবতে ভাবতে আমি মোবাইলে সময় দেখলাম। রাত আড়াইটা পার হয়েছে। বিড়বিড় করে বললাম, আর মাত্র পঁচিশ মিনিট, তারপর সেটানিক আওয়ার। এটুকু বলতেই উত্তেজনায় আমার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেল। আমি আবার আড়চোখে একবার তাকালাম ড্রয়িংরুমের দিকে। হ্যাঁ, উনি বসে আছেন। বিশাল চুলদাড়ি বিস্তার করে বসে আছেন।
বেডরুমের যেদিকটায় খাট ফেলেছি, সেখান থেকে সরাসরি ড্রয়িংরুমের দিকে তাকালেই উনাকে দেখা যাচ্ছে। উনি সিঙ্গেল সোফাতে আয়েশ করে বসে আছেন।
আমি তখন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলাম। হঠাৎ অস্বস্তি লাগা শুরু হলো রাত একটার পর থেকে। আমার মনে হতে লাগল, বাসায় আমি একা নই।
এর কয়েকদিন আগে থেকেই আমার এরকম মনে হচ্ছিল। প্রথম প্রথম ভাবছিলাম, এতবড় বাড়িতে দিনের পর দিন একা থাকছি দেখেই এরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। আমার অবচেতন মন একটা সঙ্গী জুটিয়ে ফেলেছে।
ব্যাপারটাতো নতুন না। ছেলেবেলায় যখন মনের মতো কোনো বন্ধু পেতাম না, তখনও আমার একজন কাল্পনিক বন্ধু ছিল, তামসি। তার নাম তামসি কেন রেখেছিলাম, সেটা আমার মনে নেই। অনেক আগের কথা তো!
ভেবেছিলাম, এবারো সেরকম কিছু একটা আমার মন বানিয়ে নিচ্ছে। যে পরিবেশে আছি, যে অবস্থায় আছি, তাতে একজন এরকম সঙ্গী যদি মন বানিয়ে নিয়ে আসে, খুব অস্বাভাবিক কিছুতো না।
দুই হাজার স্বয়ারফিটের এই তিনবেডের বাসায় উঠেছি তখন চারমাস হচ্ছে। আমি একাই উঠেছি। কেন উঠেছি, সে পুরানো গল্পে আর যাচ্ছি না।
বাসায় উঠে প্রথম দেড়মাস দারুণ কাটল। সকালে উঠে কফি হাতে বসে বসে গান শুনি, ধীরেসুস্থে নাস্তা করে, সময় নিয়ে গোসল করে, দুপুরের পরে অফিসে ঢুকি। রাত ন`টা অবধি অফিস করেই আবার বাড়িতে ঢুকে পড়ি।
আসলে এই যে তখন একা একা এতবড় বাড়িতে থাকি, সে বিষয়টা খুব উপভোগ করছি সেটাও না আবার একদম খারাপ লাগছে তাও না। নিজের মতো বই পড়ছি, সিনেমা দেখছি, আঁকছি, নাচছি। বেশতো!
তবে, মাঝেমাঝে এ বাসার বাতাস খুব ভারি হয়ে ওঠে। মনে হয় কে যেন লম্বা আলখাল্লা ছেঁচড়ে বাসাময় হেঁটে বেড়ায়। আমি নিশ্বাসের শব্দ পাই মাঝেমাঝে। ভয় ঠিক পাই না, তবে গা ছমছমে একটা ভাব হয়। কিন্তু আমি কাউকে দেখি না।
লকডাউনের আগে আগে, যখন বাড়িতে আমার সাহায্যকারী থাকত, সে তখন দু`একবার বলেছে, আপু, কে য্যান বাসার মদ্যে হাডে। বড়বড় চুল নিয়া দেয়ালডার উপ্রে হামা দিয়া ঘুরে।
কে ঘুরে? দেখতে ক্যামন?
এরে তো আমি দেখি ন্যাক্যা!
দেখ না তো বুঝ ক্যামনে?
বুঝন যায়, আমার শইলডার ভিত্রে কাডা দিয়া উঠে আপু।
তুমি আস দুপুরে, যাও সন্ধ্যায়। এই টাইমে কি ভূত থাকে বলো? ভূত আসে মধ্যরাতের পরে। তখন আমি একা থাকি। কই কাউকে তো দেখি না।
আপনে দেখেন না বইলা কি হ্যাই নাই? আল্লারে দেখেন না বইলা কি আল্লা নাই?
কিসের মধ্যে কি? তাহলে কি এখন এর নামে নামাজে বসবা?
নামাজ পড়তাম না, তই এরে সাব বইলা দিসি, দ্যাক আমি তোর কিছু করিনাই, তুই আমার কিছু করিসনা বেডি।
বেশ, তাইলে তো হলোই, আর চিন্তা কি, নির্ভয়ে কাজ করো।
লকডাউনের পর থেকে সে আসা বন্ধ করল, আমি একাই থাকি বাসায়। কখনো কিছু দেখি না। সমস্যা বাঁধল ওইদিন, যেদিনের কথা বলছি।
অফিসে যাবার আগে জানালার গ্লাস লাগিয়ে গিয়েছিলাম, আমার বেশ মনে আছে। রাতে বাসায় ফিরে দেখি ড্রয়িংরুমে টাঙ্গিয়ে রাখা দুটা পাখা মাটিতে আর দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা আমার বড় ছবিটা মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ফ্রেমের কাঁচ ভেঙে পুরা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আমি খুব উত্তেজনা বোধ করলাম এসব দেখে। প্রথমেই ভাবলাম, কে আমার এই গল্প শুনে আমার মতোই সমানভাবে উত্তেজনা বোধ করবে। আমি বাপিকে ফোন দিয়ে আরেকটু বাড়িয়ে বললাম।
হ্যা বাপি, জানালা সব বন্ধ ছিল, মেঝেভর্তি দেখি ধুলা। ঠিক ধুলা না, ওই যে কবরের উপরে যে ঝুরি মাটি থাকে সেরকম।
কী সাংঘাতিক! আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। তুমি একদম ঘাবড়ে যাবা না। তোমার এখন দুইটা কাজ। প্রথমেই খোঁজ নাও আশেপাশে কোথাও কোন মহিলা মারা গেছে কিনা, তারপর দ্রুত বাড়ি খুঁজে সিফট করে ফেল।
আগে যে আন্টি ছিল এ বাসায়, সে তিনমাস হয় মারা গেছে।
রাইট, একদম ঠিক ধরেছি। কোনো চিন্তা নাই, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো, আমি কাল সকালেই ইমাম সাহেবকে বলব দোয়া করতে।
হ্যা, সেটাই ভালো বাপি। এখন রাখি, যাই নামাজে বসে পড়ি।
ওকে।
বাই বাপি।
নামাজ পড়ার কথা বললেও, আমি সিনেমা দেখতে বসে গেলাম।
এইতো এরপর বিছানায় গেলাম রাত একটায়, আর তখন থেকেই এই অস্বস্তি।
রাত তিনটা বাজল। আমি আবার তাকালাম দরজা বরাবর। উনি সেভাবেই বসে আছেন। বয়সটা অনেক বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। সে হবেই, অনেকবছর হলো তো!
আমি বই বন্ধ করে ড্রয়িংরুমে তার সামনের সোফায় বসলাম। বললাম, চুলদাড়ি কাটেন না কেন?
কোনো উত্তর পেলাম না, পাব না সেটা জেনেই প্রশ্ন করেছিলাম। আমি আবার বেডরুমে ঢুকে বই পড়াতে মন দিলাম।
এরপর থেকেই উনি নিয়মিতভাবে ড্রয়িংরুমে বসা শুরু করলেন। তবে আমি আর এখন আগবেড়ে গল্প করতে যাই না।
যেদিন সন্ধ্যায় বাসায় আগে আগে চলে আসি, সেদিন সম্পূর্ণকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি। সম্পূর্ণ উনার দিকে তাকিয়ে হাসে, আ উ করে, তার কোনো উত্তর আসে না। আমার খুব বিরক্ত লাগে।
বাচ্চাকে ইগনোর করা আমার পছন্দ হয় না। আমি বিরক্ত হয়ে উনার মুখের উপরে দরজা লাগিয়ে চলে আসি।