অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম
মারিয়া সালামের গল্প ‘সিলিং ভূত মাদো’
প্রকাশিত : জুন ১৮, ২০২০
লম্বা কাঠির মাথায় আস্ত একটা পিঠালু গেঁথে কামড় বসাল মাদো। একটা কামড় দিয়েই মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল ওর। পিঠালু জিনিসটা মাদোর একদম পছন্দ না। ওর পছন্দ কচুরিপানার হালকা বেগুনি রংয়ের ফুল। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ থাকে আর খেতে গেলে দাঁতেও তেমন আটকে যায় না।
কিন্তু পিঠালু খেলে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, তাই মা জোর করেই রোজ এই অখাদ্য দিচ্ছে। প্রতিবাদ করে তেমন লাভ নেই, উল্টো কান মলা খেতে হয়েছে মাদোর। এই রাতে ঘুম থেকে উঠেই পিটুনি খেতে কার ভালো লাগে? সিলিং ফ্যানের উপরে পা দুলিয়ে বসে আছে মাদো। অনিচ্ছা নিয়ে পিঠালু চিবোচ্ছে আর ওর দুই গাল বেয়ে সবুজ অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে।
মাদো হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে মেঝের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল। নিরু একমনে ছবি আঁকছে ওর পড়ার টেবিলে বসে। নিরুর মা এক গ্লাস দুধ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকেই নিরুর চুলে হালকা করে হাত বুলিয়ে দিল। নিরু বিনাবাক্য ব্যয়ে গ্লাসের পুরোটা দুধ শেষ করে মায়ের হাতে গ্লাস দিয়ে আবার ছবি আঁকায় মন দিল।
মা ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল, নিরু ঘুমাতে হবে তো। রাত দুইটা বাজে, তোমার অভ্যাস তো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নিরু কথা না বাড়িয়ে ড্রয়িং বুক বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
নিরুর বয়স সাত, মাদোরও একই বয়স। কিন্তু নিরু মাদোর চেয়ে একদম আলাদা। মায়ের কথা সব মেনে চলে আর সময়মত সব কাজ করে। এত রাতে নিরুর জেগে থাকার কথাই না। ও ঘুমাতে যায় ঠিক রাত এগারোটায় আর উঠে সকাল আটটায়। মাদো আগে যখনই নিরুকে দেখেছে ঘুমাতেই দেখেছে, নিরুর মাও ঘুমাতো। মাদোর ঘুম থেকে উঠার সময় রাত বারটা, ঘুমাতে যাবার সময় সকাল ছয়টা।
ইদানিং করোনাভাইরাসের প্রকোপের জন্য নিরুর স্কুল বন্ধ, নিরুর মাও অফিস করে না। ওরা এখন ঘুমাতে যায় বেশ দেরিতে আর উঠেও দেরি করে। এজন্যই মাদো আজকাল নিরুকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়। এবং নিরুকে দেখে সে খুব বিরক্ত।
এরকম বিশ্রি ছেলে মাদো আগে দেখেনি। মানুষের বাচ্চাগুলা কি সবাই নিরুর মতো বোকা আর একঘেয়ে ধরণের? মায়ের কথা এত শোনার কি দরকার? মা দুধ দিলেই সেটা খেতে হবে?
আর মানুষের বাচ্চাগুলা দুধ খায় কেমন করে? মাদো নিজের অজান্তেই মুখ কুঁচকে ফেলল। পরক্ষণেই নিরুর মায়ের আদর করার কথা মনে হতেই মাদোর চোখে আবার অশ্রু গড়াতে লাগল।
মাদোর খুব ইচ্ছা ওর মা-ও তাকে খুব করে ভালোবাসবে। কিন্তু ও তার জন্য নিরুর মতো হতে পারবে না। ভূতদের কি ভালো হবার দরকার আছে? মাদো আধা খাওয়া পিঠালুর পুরোটা কোনরকমে গিলে এক লাফে নিরুর পড়ার টেবিলে বসল। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক দেখেই একটানে নিরুর আঁকার খাতা ছিঁড়ে পাতাগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে মনের সুখে আলমারির দরজা ধরে ঝুলতে লাগল।
নিরুর মা ঘুম ভেঙেই প্রথমে ছেলের ঘরে আসে সকালবেলা। সকাল দশটা বাজে। মাদো সেই আলো ফোটার আগেই ঘুমাতে গেছে। ও মায়ের সঙ্গে ঘুমায় নিরুর খাটের নিচে, এতেও মাদোর রাগ হয় অনেক। নিরু কি সুন্দর একা ঘুমাতে পারে। মাদোর সে স্বাধীনতা নেই।
ঘরে ঢুকেই মা চোখ কুঁচকে ঘুমন্ত নিরুকে একবার দেখে আর অবিশ্বাস নিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাগজের টুকরো আর জামা-কাপড়গুলো দেখে। নিরু একাজ করেতেই পারে না।
চিন্তিত মুখে মেঝে পরিষ্কার করে নিরুকে নাস্তার জন্য ডাকে নিরুর মা। একবার বকা দিতে গিয়েও থেমে যায়। প্রায় তিনমাস টানা বাড়িতে থেকে তারই পাগল পাগল অবস্থা, নিরুতো বেচারা ছোট বাচ্চা!
মাদোর আজও ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে। খাটের নিচ থেকে বেরিয়েই দেখে নিরু মায়ের কোলে বসে মোবাইলে কার্টুন দেখছে। এত বড় কাণ্ডের পরও যে নিরু মায়ের কাছে পিটুনি খেলো না, সেটা বুঝতে পেরেই মাদোর আবার কান্না পেল।
মন খারাপ করে আবার মেঝেতে শরীর এলিয়ে দিতেই বেশ শক্ত কানমলা খেল মাদো। মা চেঁচিয়ে বলল, ফের যদি ঘুমাতে যাবি একদম পিটিয়ে মানুষ বানিয়ে দিব। মাদো কান ডলতে ডলতে রাগে গজগজ করে বলল, সেটাই ভালো। মানুষের মাগুলো এত ভালো!
মানুষের মায়ের খোঁজ না নিয়ে তুই মানুষের বাচ্চাদের দেখে শিখ, মা রেগে গিয়ে বলল। নিরুকে দেখ কেমন মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। মাদো আর কথা বাড়াতে চায় না, আবার কানমলাও খেতে চায় না ও। মনের কষ্ট মনে রেখে আবার লাফিয়ে ফ্যানের উপরে গিয়ে বসে নিরুকে দেখা শুরু করল ও।
নিরু সোনা ঘুমাতে হবে এবার। দুধ এনে দি, খেয়েই বিছানায় যাবে কিন্তু, মা মিষ্টি করে বলল নিরুকে।
নিরুও সুবোধ বালকের মতো মৃদু ঘাড় নেড়ে ওয়াসরুমে গেল হাতমুখ পরিষ্কার করতে। মা বলেছে, এই করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই বারবার হাত ধুতে হবে।
নিরু ফিরে এসে অবাক হয়ে খেয়াল করল ওর বিছানার চাদর সিলিং এর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে ঝুলছে আর বিছানার গদির এককোণা ছিঁড়ে তুলো বের হয়ে আছে।
দুধ হাতে ফিরে নিরুর মাও হতভম্ব হয়ে মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। অবিশ্বাস নিয়ে নিরুকে জড়িয়ে ধরে বলল, নিরু তোমার কি শরীর খারাপ? বা মন কোন কারণে খারাপ?
নিরু কিছু বুঝতে না পেরেই কেঁদে ফেলল। মা নিরুকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, তোমার কি আজ একা ঘুমাতে খারাপ লাগছে? আমার সঙ্গে যাবে?
নিরু মায়ের ঘরে যেতেই নিরুর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল মাদো। একটা আরামের ঘুম দেয়া যেতে পারে। ভাবতে ভাবতেই নিরুর আর ওর মায়ের কান্নার শব্দে মাদোর ঘুমঘুম ভাবটা ছুটে গেল।
মাদো উড়ে উড়ে নিরুর মায়ের ঘরের দিকে যেতে লাগল, পিছে পিছে মাদোর মাও আসল।
নিরু মায়ের ওয়াসরুমে আরেকবার মুখ ধুতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে কপালের অনেকটাই কেটে ফেলেছে। সেখান দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। নিরুর ব্যথা পাওয়া মুখ দেখে মাদোর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে অপরাধী মনে হলো মাদোর। ওর আবার কান্না পেল, ওর জন্যই তো নিরু এই ঘরে এসেছিল।
মাদো কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর মা ওর কান টেনে নিরুর ঘরের দিকে নিয়ে গেল। বিছানার চাদর তুই ফ্যানের উপরে তুলেছিস তাই না? মা হিসহিসিয়ে বলে উঠল।
মাদোর চোখে অশ্রু দেখে চড় মারতে উঠা হাতটা নামিয়ে মা মাদোকে বিছানার এককোণে বসাল। গলা নরম করে বলল, এই কাজটা কেন করলি, ওরা আমাদের প্রতিবেশী। ওদের অমঙ্গল চাওয়াটা অন্যায় মাদো।
মাদো মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা তুমি মানুষের মায়ের মতো আমাকে আদর কর, আমি ভালো হয়ে যাব।
মা মাদোকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, মাদো তুমি অনেক ভালো ভূতশিশু। আমি চাই তুমি আরো ভালো ভূত হও। কিন্তু তার জন্য তোমাকে নিরুর মতো নিয়মে আসতে হবে। ওর ক্ষতি করে তুমি ওকে কষ্ট দিতে পারবে, কিন্তু তাতে তোমার কোন লাভ হবে না।
মা মাদোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আলতো করে। মাদোর কপালে চুমু দিয়ে বলল, কেউ ভালো কাজ করলে সেটা শিখতে হয়। তবেই তার জায়গায় তুমি যেতে পারবে। তার ক্ষতি করে তুমি বরং আরো নীচে নামবে। বুঝেছ?
মাদো মাথা নেড়ে সিলিং থেকে বিছানার চাদর নামিয়ে আবার আগের মতো সাজিয়ে দিল। মায়ের হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মা আজ কি নাস্তায় কচুরিপানার ফুল দেয়া যাবে?
লেখক পরিচিতি: ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশা সাংবাদিকতা, বর্তমানে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় কাজ করেন। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন অনলাইন সাহিত্য সাময়িকী ‘ছাড়পত্র’। প্রকাশিত ছোটগল্পের দুটি বই ‘নীলকণ্ঠী’ ও ‘সময়ের কাছে’।