মারিয়া সালামের গল্প ‘বর্ষামঙ্গল’
প্রকাশিত : অক্টোবর ০৫, ২০১৯
চোখ মেলতেই লাবণ্য দেখলো, ঝুম বৃষ্টি এই ছোট্ট শহরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ ভ্রমণের পথে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, নিজেই বোঝেনি।
ওর গাড়ি একমো কিলোমিটার স্পিডে দুই টিলার মাঝখানের আধা ক্ষয়ে যাওয়া এবড়োখেবড়ো রাস্তার বুক চিড়ে ঢাকার দিকে ছুটছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগাতেই ঘুমটা ভেঙে গেছে ওর। চোখ মেলেই অবাক হয়ে গেছে। শরতের এই সময়ে সামান্য বৃষ্টি অস্বাভাবিক তেমন কিছু না। কিন্তু সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া এই বৃষ্টি!
লাবণ্য জানালার গ্লাস নামিয়ে হালকা করে মুখটা বাড়িয়ে দিল সামনে। বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর মুখ, চুল। পানিতে সিঁদুরের রঙ গলে কপাল চুইয়ে নাক অবধি এসে একবিন্দু জল হয়ে আটকে গেছে। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ড্রাইভারের দিকে লাজুক মুখে তাকিয়ে বলল, ওহ ভেতরের সব ভিজে যাচ্ছে না? ড্রাইভার ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিল, শেষে পানি পড়ে জানালার গ্লাস জ্যাম হয়ে গেলে আরেক বিপদ। লাবণ্য দ্রুত গ্লাস উঠিয়ে আবার সিটের উপরে নিজেকে ছেড়ে দিল।
কী অদ্ভুত সুন্দর বৃষ্টি! হ্যাঁ, এরকম বৃষ্টিই তো সে ভালবাসতো। পৃথিবীর সব পাগলামি এরকম দিনেই তাকে পেয়ে বসতো। সবচেয়ে বড় পাগলামিটা ছিল, এরকম একটা দিনেই হুটহাট বিয়ে করে ফেলা। লাবণ্য যেদিন বিয়ে করে ওর পরনে ছিল হালকা পিচ রঙের একটা সালোয়ার কামিজ। কামিজের নিচের দিকের সেলাই কিছুটা খুলে গেছে। ওড়নাটাও একঘেয়ে জলপাই রঙের। সে একমনে ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে কবিতা আউড়ে চলছিল। প্লাবন এসে কথাবার্তা নাই, ওকে টেনে বের করে বলেছিল, তোর না শখ ঝুম বৃষ্টির দিনে বিয়ে করা, চল আজকেই বিয়ে করে ফেলি।
কিন্তু আমার হাতে একদম কোনো টাকা-পয়সা নাই। ব্যাগে মাত্র পাঁচ টাকার একটা কয়েন, আর কাপড়ের হাল দেখেছিস? লাবণ্যের কথার জবাবে প্লাবন পাল্টা কিছুই বলেনি। কেবল ওকে টেনে একটা রিকশায় তুলেছে। লাবণ্য মনে মনে হাসে, প্রথম প্রথম এইসব দিনে সে দুজনের জন্য কত আয়োজন করে কতসব প্ল্যান করতো। সেইসব এখন ঝাপসা স্মৃতি।
যার জন্য এত আয়োজন হতো সে এসব দিনে কী ভাবে, লাবণ্য সেসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না একদম। এরকম কত বর্ষার দিনগুলো সে নিজেই কাটিয়ে দেয় ঘুমিয়ে অথবা ঘরে ফিরে দীর্ঘসব ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে।
ফেসবুকের টুংটাং নোটিফিকেশনের শব্দে ওর চিন্তায় ছেদ পড়ে। ফেসবুক ওপেন করতেই খবরটা চোখে পড়ে: পূজার মণ্ডপে ঢোকারমুখে কোনো এক তরুণ তার প্রেমিকাকে চুমু দিচ্ছে। মণ্ডপের বাইরে বৃষ্টির তোড়ে তাদের চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পেছনে কেবল দেবি প্রতিমার ঝাপসা অবয়ব বলে দিচ্ছে, এটা একটা পূজা মণ্ডপের সামনেই।
এই নিয়ে ফেসবুকের দেয়াল ভেসে যাচ্ছে নানা মতামতে। কারো ভালো লেগেছে, কারো মোটেই না। কেউ বলছে, কলিকালে এমন অনেক কিছুই দেখতে হবে। সবচেয়ে লেগেছে যারা নিজেদের ভগবানের লাঠিয়াল হিসেবে ভেবে নিয়েছে, তাদের। তারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই হন্যে হয়ে ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে উচিত শিক্ষা দেবে বলে। নিজের মনেই হেসে ফেলল লাবণ্য।
ক্লান্ত হাতে মোবাইল ফোনটা সিটের উপরে ছুঁড়ে দিতে দিতে নিজেই মনে মনে বলল, প্রেমহীন এই নাগরিক জীবনে একটা চুম্বনের ছবি কত সহজেই ভাইরাল হয়ে যায়!