মারিয়া সালামের গল্প ‘প্রেমিকরা প্রাক্তন হয়ে যায়’
প্রকাশিত : মে ৩১, ২০২২
আমাদের পুঠিয়ার রাজবাড়ি দেখতে যাবার প্ল্যান। আমাদের বলতে আমার আর বন্ধু সুমন্তের। মাঝে অবশ্য আমি আগবেড়ে একজনকে বলে বসেছি, তুমিও চলো। আমরা ঠিক সকাল ৭টার পরপরই রওনা দেব, তুমি কিন্তু চলে এসো।
আমার কথা শুনেই সেই একজন বেশ একটা ভাব নিয়ে বলল, আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠি না। তোমরা চলে যেও। আমি বেলা হলে বাইক নিয়ে আসতে পারি।
আসতে পারি মানে নাও আসতে পারি, তাই না? আমি উত্তর শুনে একটু ধাক্কা খেলাম। মানে, আমাকে সরাসরি এভাবে রিফিউজ করার ঘটনা খুব কম ঘটেছে। অথচ একটু আগেই সে নিজেই আমাকে বলেছে বাইকে করে নিউমার্কেট নামিয়ে দেবে। আমি অবশ্য না করে দিয়েছিলাম।
আমি আর সুমন্ত একসাথেই বলে উঠেছিলাম, বাইকে উঠতে সমস্যা আছে, উই মিন একটা বাজে অভিজ্ঞতা আছে, ওঠা যাবে না।
প্রতিশোধ নিচ্ছে, এটা ভাবতে ভাবতেই আমি আর সুমন্ত রিকশায় উঠে নিউমার্কেটের দিকে রওনা দিলাম। পথে আমরা এই প্রসঙ্গ প্রায় ভুলেই গেলাম।
এটা সেটা নিয়ে গল্প করতে করতে হঠাৎ সুমন্তকে বললাম, বাইকে উঠিনি বলে কি রাগ করতে পারে? এজন্যই কি কাল আসবে না?
বন্ধু ঘাড় ঝাকিয়ে বলল, সেরকম মনে হলো না। তবে, তাকে আসতেই হবে। তুমি ডেকেছ বলে কথা, তোমার কথার একটা ভার আছে না? মানে, তাকে আনতেই হবে।
সকালের আলো ফোটার আগথেকেই শুরু হলো ভয়ানক বৃষ্টি। আমরা ঠিক করলাম, এরমধ্যে শহরের বাইরে গিয়ে কাজ নেই। একটু বেলা বাড়ুক, আমরা পদ্মার বুকে নৌকায় করে আজ বৃষ্টি বিলাস করব।
তাকেও ফোন দাও, বলে দাও পুঠিয়া যাচ্ছি না। সে যেন সোজা কোর্ট বাজারে চলে আসে ঠিক বেলা ১১টায়, ফোন রাখতে রাখতে সুমন্ত বলল।
আমি নিজেও একবার সেটা যে ভাবিনি তা না, কিন্তু কণ্ঠে কীরকম একটা অনাগ্রহ নিয়ে বললাম, ধুর বাদ দাও। তার এত শখ থাকলে নিজেই কল দেবে।
এই সে বা সে একজন, যার কথা বলছি, তারসাথে গতকাল দেখা হয়েছে বহুবছর পর। দেখা হয়েছে বললে ভুল হবে, রীতিমতো দিন ও সময় ঠিক করে আমি দেখা করতে এসেছি। কেন দেখা করতে চেয়েছি, সেটা নিজেও বুঝছি না। এমন না যে, সে আমাকে ডেকেছে, আমিই বরং বলে ফেলেছি, কাল দেখা করা যেতে পারে। তাকে খুব পছন্দ করি সেরকমও না, বরং একটু এড়িয়ে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করতাম।
অথচ, তাকেই আমি ডেকে ফেলেছি। নিজের ওপর খুব বিরক্তি নিয়ে প্যারিস রোডে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। মোবাইলে দেখলাম, দেখা করার সময় পার হয়ে আরো পনের মিনিট। আস্তে ধীরে উঠে একটা রিকশা নিলাম। মাথা খাটিয়ে সুমন্তকে ফোন দিলাম।
তুমি কই? ফ্রি আছ? জিজ্ঞাস করতেই ওপার থেকে একগাদা প্রশ্ন, তুমি কই? রাজশাহী এসেছ? কখন দেখা হবে...
তুমি নদীর পাড়ে চলে আসো। এসে কল দিও, তখন বিস্তারিত আলাপ হবে। ফোন রেখে ভাবলাম, যাক সুমন্ত থাকলে আমার অস্বস্তিভাবটা কাটবে।
নদীর পাড়ে যখন নামলাম, তখন বিকালের আলো নিভে গেছে। অথচ, আমাদের কথা ছিল বিকালে দেখা করব। উনি আমার দেরি দেখে খুব অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন। আমাকে দেখেই উনি চমকে উঠে বললেন, আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। ফোনে বলে দেবে, সরি, আসতে পারলাম না।
আমি উত্তর না দিয়ে মুখ টিপে একটু হাসলাম। এরপর, এই টুকটাক গল্প করতে করতে কখন যে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, আমাদের খেয়াল নাই। ঘড়িতে দেখি রাত ৮টা, এদিকে সুমন্তের কোনো খবর নাই। ফোন দেব ভাবতেই বেচারা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির। আমরা তৃতীয় কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আবার আড্ডায় বসলাম। আড্ডা হয়ত চলত আরো কয়েক ঘণ্টা যদি না বাড়ি থেকে ফোন দিয়ে বারবার ডাকা হতো। খুব অনিচ্ছায় যখন আমরা কফিশপ থেকে বের হলাম, তখন ঘড়ির কাটা রাত ১০টা ছুঁই ছুঁই।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোন রেখে গোসলে গেলাম। এসে দেখি ৯টা বেজে পার। ম্যাসেঞ্জারে কোনো নোটিফিকেশন না পেয়ে রীতিমতো বিগড়ে গেলাম। তুই না গেলে না যাবি, অন্তত ভদ্রতা করে হলেও তো সেটাই না হয় জানিয়ে দিবি যে, যাবি না। মনে মনে তাকে বকাবকি করতে করতে আমি নিজেই টেক্সট করলাম, শোনো, আজ এই বৃষ্টিতে শহরের বাইরে যাচ্ছি না। আমরা আজ নৌকায় ভাসার প্ল্যান করেছি, তুমিও আসো, এই এগারোটার দিকে।
সুমন্ত আর আমি যখন এদিক সেদিক ঘুরে পদ্মার পাড়ে পোঁছালাম, তখন বাজে এগারোটা। ভদ্রলোক উত্তর দিল? সুমন্তের প্রশ্ন শুনে ফোনের স্ক্রিনে একবার তাকালাম। ঘাড় নেড়ে বললাম, না। উত্তর না দিলে না দিক, এত ঠেকা কি? আমরা নিজেরা ঘুরব।
মাথা ঝাঁকিয়ে সে বলল, তা হবে না। তুমি একবার ডেকে ফেলেছ যখন, তখন তাকে আসতেই হবে। এতবার বলার পরে না আসা মানে কঠিন অপমান।
আমিও মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক, কথায় পয়েন্ট আছে। বলেই তড়িঘড়ি করে তাকে আবার টেক্সট দিলাম, বাইরে খুব বৃষ্টি, তোমার ঠাণ্ডার সমস্যা থাকলে রেইনকোট নিয়ে এসো, আর হ্যাঁ, আমার নিজেরও খুব শীত শীত লাগছে, তোমার বাসায় চাদর থাকলে একটা নিয়ে এসো। নৌকায় উঠলে আরো শীত লাগবে ☺️।
ফোন রেখে আমরা ক্যামেরায় মন দিলাম। আমার বন্ধু নদীর ছবি তোলে, আমার ছবি তোলে, আমরা মানুষজন দেখি, কফি খাই। ভদ্রলোকের ফোন আসল বেলা ঠিক ১২টায়।
তোমরা কই?
আমরা কোর্টবাজার, তুমি কই? আসছ তো?
হ্যা, আসছি। এখন বাসায়।
বাসায় মানে? দ্রুত আসো, নইলে আজ আর দেখা হবে না, আমার ঠিক দুটার সময় বাসায় থাকতেই হবে।
এই আমার দশ মিনিট লাগবে, আসছি, সে ফোন রাখতেই আমরা আরেক কাপ কফির কথা বলে আবার ক্যামেরায় মন দিলাম।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় পথের শেষ মাথায় কালো বাইকটা এসে থামল। সুমন্ত ওর ক্যামেরার ডিসপ্লে আমার মুখের সামনে ধরল। সেখানে একজন ভয়াবহ আনন্দিত মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোক হাসি থামাতে গিয়ে রীতিমতো হয়রান!
আমি ঠোঁট উল্টে সুমন্তকে বললাম, মালটা এত খুশি কেন?
সে বলল, তুমি খুশি বলে।
ধুর বলে মাথা ঘুরিয়ে নৌকা দেখতে থাকলাম, এর মধ্যেই উনি এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন। আমি জানতামই না যে উনি এসে গেছেন, এরকম একটা ভাব নিয়ে সবাইকে তাড়া দিয়ে নৌকায় উঠালাম।
ভয়ানক বৃষ্টি, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তিনজন কাকভেজা হয়ে তিনমাথায় বসে আছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। মাঝে মাঝে কথা বলার কিছু থাকে না। সেরকম একটা সময়ে আমরা ভেসে চলেছি পদ্মার ওপরে। তিনজন কেবল তিনজনের দিকে তাকিয়ে একটু করে হাসছি, কিছু ছবি তুলছি আবার দূরে গিয়ে বসে বৃষ্টিতে ভিজছি।
সময় গড়িয়ে চলছে, আমার বাড়ি ফেরার তাড়া। অথচ, আমি এভাবেই বসে থাকতে চাইছি আরও অনেক কাল। আমার ধ্যান ভাঙল আবার সেই বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে। ওদের সাথে ঠিকমতো কথা শেষ না করেই রিকশায় উঠলাম। হঠাৎ দেখি, উনি বাইক নিয়ে পাগলের মতো আমার পিছে পিছে আসছেন।
আমি গলা চড়িয়ে বললাম, এই তোমার বাসার রাস্তা তো ওদিকে।
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষটির মতো হাসতে হাসতে উনি আমার পিছে আসতে থাকলেন।
আমি পলিথিনের আড়ালে মুখ ঢাকলাম, আমার চোখে পানি এসে গেল। হঠাৎ মনে হলো, ভাইকিংসদের প্রাচীন গ্রাম হোক, বসফরাসের পাড় হোক বা রাইন নদীর মাঝখানে হোক, যেখানেই আমি একা হেঁটেছি, সেখানে সেখানেই কাউকে না কাউকে তো পাশে চেয়েছি।
রাতে যখন ডায়েরি নিয়ে বসলাম, তখন তার কথা এক’দুই লাইন লিখি আর অসংখ্যবার কেটে দি। কাটাকাটি করতে করতে শেষতক লিখলাম: প্রেমিকরা প্রাক্তন হয়ে যায়।