ছবি-রিফাত বিন সালাম

ছবি-রিফাত বিন সালাম

মারিয়া সালামের গল্প ‘ক্ষত’

প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২০

আশিক কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ রেখে আবার খোলার চেষ্টা করল। তেমন লাভ হলো না, কপাল বেয়ে ঘাম অনবরত গড়িয়ে গড়িয়ে ওর চোখে যাচ্ছে আর চোখ জ্বালা করছে। কোনরকমে একচোখ অল্প একটু খুলে ভিড় ঠেলে সামনের বাসে উঠে গেল ও।

সকাল আটটা পনের বাজে, এসময় বাসে পা ফেলার জায়গা থাকে না। সবার অফিসে যাবার তাড়া থাকে আর বাসে ভিড় থাকলেই আশিকের বরং বেশ লাভ হয়, পেপারের কাটতি ভালো হয়। রাস্তায় জ্যাম থাকলে আরো ভালো।

একবার আড়চোখে সামনের আপুকে দেখল আশিক। তারপরেই নিজের পায়ের দিকে তাকাল, মার্চের এইসময় স্যান্ডেল ছাড়া রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে পেপার বিক্রি করা বেশ কষ্টকর। স্যান্ডেলের ফিতা ছিড়েছে গতপরশু কিন্তু আশিকের হাতে নতুন স্যান্ডেল কেনার বা পুরাতনটাই মেরামত করার মতো টাকা নাই। পেপার বিক্রির সব টাকাই ইদানীং মায়ের চিকিৎসার পিছে চলে যাচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে তিন বেলা তিনজন মানুষের ভাত জোগাড় করাই ওদের জন্য মুসকিল।

আপু, পেপার নিবেন?
সামনের মেয়েটার হাসি হাসি মুখ দেখে আশিক একটু ভরসা পেল। হাতে পেপার ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, আপু একশটা টাকা আমাকে খুশি হয়ে দিবেন? একটা স্যান্ডেল কিনতাম।

মেয়েটার হাসি হাসি ভাবটা উধাও হয়ে গেলেও সে আশিকের হাতে পেপারের দামসহ পুরা একশদশ টাকা ধরিয়ে দিল। আশিক বেশ কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল মেয়েটার দিকে, ও ভাবে নি এক বলাতেই কেউ একশ টাকা দিবে। ও ভেবেছিল কম হলেও দুইদিন লাগবে স্যান্ডেলের টাকা জোগাড় করতে। কি বলে ধন্যবাদ দিবে বুঝে না পেয়ে মেয়েটার হাতে আরেকটা পেপার ধরিয়ে দিয়েই হুড়মুড় করে ভিড় ঠেলে বাস থেকে নামল ও।

আজই স্যান্ডেল কিনে ফেলতে হবে। কাল থেকে লকডাউন। দেশে করোনার প্রকোপ রোধ করতে সরকার আগামীকাল থেকে অফিস আর মার্কেট বন্ধ রাখার ঘোষনা দিয়েছে। আশিক এমনিই চিন্তায় ছিল। অফিস বন্ধ হলে ও আর পেপার ফেরি করতে পারবে কিনা বুঝছে না এখনও। পেপার বিক্রি বন্ধ হলে আরেক বিপদ। না পারবে তিন বেলা খেতে না পারবে মায়ের প্রতিদিনের ওষুধ কিনতে।

কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ফুটপাথের স্যান্ডেলের দোকানের সামনে বেশ কয়েকবার ঢুঁ দিল আশিক। পকেটে হাত দিয়ে টাকাটার অস্তিত্ব অনুভব করল কয়েকবার। যতবার টাকাটা ছুয়ে দেখছে ততবার ওর শান্তি লাগছে।

এই অনিশ্চিত সময়ে একশটাকা মানে অন্তত একদিন রাতে পেটপুরে খেয়ে ঘুমাতে যেতে পারবে ওরা। কিন্তু এই গরমে রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটাইতো দায়। স্যান্ডেলটা খুব দরকার আবার কাজ না থাকলে শুধু শুধু স্যান্ডেল কিনে কোন লাভও হবে না। এই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে হেঁটে চলল আশিক।

আশিক, ওর মা আর চারবছরের ছোটবোন, এই ওদের সংসার। তিনবছর আগে পদ্মায় ঐযে ঘর ভাঙল ওদের, ওরা একরাতে ঢাকায় আসল। বাবা রিক্সা চালান শুরু করেছিল আর মা মানুষের বাসায় কাজ করত। আশিক বস্তির স্কুলে যেত, বেশ ছিল দিনগুলো। এরপর একদিন বাবা চলে গেল, কোথায় গেল ও জানে না। আশিকের স্কুল বন্ধ হলো, ও পেপারের হকার হয়ে গেল।

বাবার কথা মনে পড়তেই আশিকের চোখে পানি আসল। আবার একটু পরেই খুব রাগ হলো বাবার উপরে। শক্ত মুখে আশিক ঘরে ঢুকল। মা আজ অনেকদিন বাদের নিজে রান্না করছে দেখে আশিকের রাগটা পড়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, মা, তুমার শরীর ভালো তো?

হ্যাঁ রে বাপ। গরীব ম্যানষের আবার শরীর। কাল থ্যেকি তোর পেপার বিক্রি বন্ধ হলে কি যে খাব?
আশিক চিন্তিত মুখে চালের ড্রামের ঢাকনা উঠিয়ে দেখল। যা আছে হয়ত টেনেটুনে একসপ্তাহ যাবে। এই সময় এই অনেক বেশি, এরপর একটা ব্যবস্থা হবে।

ক্লান্ত শরীর বিছানায় ছেড়ে দিতে দিতে আশিক ঠিক করল, ধারবাকির দোকান থেকে আরো এক সপ্তাহের চাল এনে রাখতে হবে। পকেটে হাত দিয়ে টাকাটা ছুয়ে দেখল। মনে মনে ভাবল, এটা খরচ করা যাবে না, স্যান্ডেল কেনা খুব দরকার।

ধার-বাকির দোকানে গিয়ে কোন লাভ হয়নি আশিকের, আসলে বস্তির কেউই কোন সুবিধা করতে পারে নি। বাকি বিক্রি বন্ধ। এই সময়ে এরকম শয়তানি মানুষ করে!

আশিকের চিন্তার বাইরের জগত নিয়ে ওর মাথাব্যথা নাই, কারোরই নাই আসলে। দোকানদার একমাস বাকিতে জিনিস দিলে, তার নিজের যে খেয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে সেটা আশিক কেন, অনেক বড় মানুষই বুঝতে পারে না।

এই সাতদিন টেনেটুনে সংসার চলেছে, এখন আর উপায় নাই। বস্তির মেয়েদের সাথে দল বেঁধে আশিকের মা আর বোন এখন প্রতিদিন ভিক্ষায় যায়। যা পায় টেনেটুনে দুইবেলা খায় ওরা।

মায়ের শরীর আরো খারাপ হয়েছে। আশিকের মায়ের দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগে। ওর কিছুই করার নাই। গ্লানি নিয়ে রাস্তার মাথার বাতিল মালের দোকানে গিয়ে ছেড়া স্যান্ডেলটা দশটাকায় বিক্রি করে আশিক।

একটা চিপসের প্যাকেট কিনে একবার মুখ খুলতে গিয়েও খোলে না। ঘরে গিয়ে বোনের জন্য রেখে দেয়, বেচারি সারাদিন ভিক্ষা করে খালি পেটে ফিরে।

সরকার নাকি অনেকটাকার জিনিস দিচ্ছে গরীব মানুষদের। সেসব অনেকেই পাচ্ছে। আশিকরা কিছুই পায় নি এখনও। সেসব কিভাবে পাবে, কার কাছে যাবে এই ভাবতে ভাবতে গলির মাথায় এসে দাঁড়ায় আশিক।

গলির মাথায় মেয়েদের বিরাট জটলা। সবাই চিৎকার করে কাকে যেন বকাবকি করছে। আশিকের কানে হালকা করে করোনা, করোনা শব্দটা ভেসে আসছে। আশেপাশে আরো যারা ছিল সবাই দৌড়ে যাচ্ছে করোনা রোগী দেখবে বলে।

ভিড়ের সাথে আশিকও দৌড়ে গিয়ে দেখে ওর মা রাস্তায় পড়ে আছে, পাশে বোন চিৎকার করে কাঁদছে। মায়ের শরীর নিস্তেজ, অসুস্থ শরীর এই গরমের মধ্যে সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির ধকল নিতে পারেনি।

আশিক চিৎকার করে বলে, মায়ের করোনা না। মাকে কেউ একটু পানি দাও, রোদের তাত লাগসে মায়ের। দুইদিন হলো আশিকের মায়ের ভিক্ষা বন্ধ, শরীরে আর কুলিয়ে উঠছে না যে এই তাপে রাস্তায় নামবে। আশিক চালের ড্রামের ঢাকনা ভয়ে ভয়ে উঠিয়ে দেখে। চাল তলানিতে। কোনরকমে দুপুরে হলেও রাতে হবে না।

ওর গলার কাছে দলা দলা কষ্ট জমে আসে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিকেটের টাকাটা শেষবারের মতো স্পর্শ করে আশিক। একবার নিজের পায়ের দিকে তাকায় তারপর শার্টের হাতায় চোখ মুছে মুদির দোকানের দিকে হাঁটা দেয়।

মুদির দোকানের সামনে গাড়িতে বসে বড়লোকের দুইছেলে আইসক্রিম খাচ্ছে। একজনের আইসক্রিমের কাঠি বেয়ে সবুজ সবুজ রস পড়ে মুখের মাস্কটা ভিজে গেছে। মা সেটা খুলে রাস্তায় ফেলে দিল।

আশিক মাস্কটা কুড়িয়ে পকেটে পুরল। লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে গাড়ির দরজায় হাত পাতল। আপা, এককেজি চাল কিনব, পঞ্চাশটা টাকা দেন।

মহিলা আশিকের হাতে দশটাকা ধরিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়া করে জানালার গ্লাস উঠিয়ে দিল। চারদিক থেকে তেড়ে আসা ভিক্ষুকগুলো গাড়ি ঘিরে ফেলার আগেই আশিক সরে আসল।

ড্রেনের দিকটায় সরে আসতেই পায়ে খচ করে ব্যথা অনুভব করল ও। মাগো বলে কঁকিয়ে উঠে দেখল, পায়ের তলায় ভাঙা বোতলের টুকরা বিঁধে গেছে। সেটা বের করে ড্রেনের মধ্যে আছড়ে ফেলল আশিক। মুখ থেকে একদলা থুথু নিয়ে ক্ষতের জায়গায় লাগিয়ে দিল। তারপর, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলল আরেকটা গাড়ির দিকে।