মারিয়া সালামের গল্প ‘এ পাড়ায় রাতে আর পুলিশ আসবে না’

প্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০২০

দোকানের এখানে সেখানে লেগে থাকা তেলের চিটা ঘষে ঘষে তুলে মজিদ একবার চারপাশে চোখ বুলালো। নাহ, এখন বেশ নতুন নতুন লাগছে দোকানটা। বেশ কয়েকমাস মুদির দোকানটা পরিষ্কার করা হচ্ছিল না। নোংরা দোকানে আজকাল কাস্টমার জিনিস কিনতে চায় না, নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে মজিদ একটা ডার্বি ধরিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।

কয়েক ঘণ্টার লাগাতার পরিশ্রমে এই শীতেও মজিদের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। মাথার উপরে ঘটাং ঘটাং ফ্যানের আওয়াজের মধ্যেই ওর একটু ঝিমুনি এসে গেল।

ভাই, আপনার কাছে বেনসন লাইট হবে? ভারি আর খ্যাসখেসে গলার স্বরে মজিদের ঘুমঘুম ভাবটা কেটে গেল। সামনে রাগিরাগি চেহারার এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে।

আগন্তুকের চোখদুটো লাল হয়ে আছে, অনেক্ষণ না ঘুমালে বা খুব রেগে গেলে মানুষের চোখ এমন লাল হতে পারে। ছোট করে ছাঁটা চুল, মস্ত মোছ আর বিশাল বাইক দেখে মজিদ ধরেই নিল, আগন্তুক পুলিশের লোক।

মজিদ আড়চোখে ঘড়ি দেখল একবার, রাত একটা চল্লিশ। এই শীতের রাতে বাইক নিয়ে এপাড়ায় নিশ্চয়ই কেউ বেড়াতে আসেনি আর আসলেও তার দোকানে বেনসন চাইবে না। তার দোকানে যে বেনসন পাওয়া যায় না, এটা এপাড়ায় সবাই জানে। লোকটা ডিবি থেকে এসেছে, মজিদ একশোভাগ নিশ্চিত।

না স্যার বেনসন হবে না, দিশেহারা মজিদ মিনমিন করে বলল।

আগন্তুক উত্তরের তোয়াক্কা না করেই একটা সিগারেট ধরাল। ফোন বের করে বলল, নীরা বারান্দায় আসো। আবার কড়া গলায় বলল, আমি বলেছি তাই আসবা।

মজিদ দেখল নীরার রুমের বারান্দার দিকের দরজা খুলে গেল। এই পরিবারের বিশাল ঝামেলা আছে, মজিদ নিজের মনেই বলল।

এই মেয়ে আর এর ভাই নাস্তিক রাজনীতি করে, কি জানি বলে? হ্যাঁ কম্যুনিস্ট। সারাদিন মিটিং মিছিল করে আর পুলিশের মার খায়। সপ্তাখানেক আগেও রাতে ডিবির লোকজন বাড়িতে এসে শাসিয়ে গেছে।

আবার কী ঝামেলা বাঁধিয়েছে, কে জানে! এই ঝামেলায় জড়ানো যাবে না, মজিদ দ্রুত দোকানের পাল্লা নামিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

নীরা থিসিসের একগাদা কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার মাঝখানে বসে আছে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে নীরা, কাগজপত্রে মন নেই ওর। এমাসে নীরার উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পার্থে চলে যাবার কথা। কিন্তু নীরা যেতে চায় না, দেশের জন্য কিছু করতে চায় দেশে থেকেই।

আরেকটা সমস্যা রুদ্র। রুদ্র নীরার প্রেমিক। শুধু প্রেমিক না, রগচটা প্রেমিক। যার প্রধান কাজ যখন তখন রেগে গিয়ে নীরাকে বকাবকি করা। বেশিরভাগ সময়ই নীরা বোঝে না, এত রাগের কারণ কি!

আজ বিকেলেও রুদ্রর সাথে ঝগড়া হয়ে গেল নীরার। রুদ্রর শেষ কথা, একটু অপেক্ষা করো, পার্থে না বিয়ে করে আমরা একসাথে জার্মানিতে পড়তে যাব।

জার্মানিতে যেতে বা অপেক্ষা করতে নীরার সমস্যা নাই। সমস্যা হলো, মাকে এখন বিয়ের কথা বলা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু রুদ্র মানতে নারাজ। ফলাফল ব্রেকআপ, তাতেও রুদ্রর সমস্যা মনে হচ্ছে। এই রাতদুপুরে আবার বাসার সামনে এসে ডাকাডাকি।

রুদ্র, তোমাকে বলেছি মা রাতে জেগে থাকে। আমি বারান্দায় গেলেই সমস্যা, নীরা ফোন কেটে দেয়। আবার ফোন বেজে ওঠে, বাধ্য হয়ে নীরা বারান্দার দিকের দরজা খোলে। রুদ্র দাঁত বের করে হাসছে, বিকেলের রাগ একদম পড়ে গেছে ওর।

তোমার চোখ লাল কেন? আবার কি ডরমিকাম খেয়েছ?
নীরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রুদ্র হাসিমুখে বলে, নীরা, আমাদের ব্রেকআপ হচ্ছে না।
মানে আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করতে রাজি? নীরার মনের কালো মেঘ কেটে যায়।
না, অপেক্ষা করতে রাজি না। তোমাকে এখনই যেতে দেয়া হচ্ছে না, আমরা বিয়ে করে একসাথে যাব।

নীরা বুঝে ওঠার আগেই রুদ্র ওর বন্ধুদের ভিডিও কল দিয়ে ফোন লাউড স্পিকারে দেয়। একসাথে আট-দশজন সমানে চেঁচাতে থাকে, নীরা তুমি যেও না, যেও না প্লিজ।

আহ, রুদ্র এতরাতে কেন এসেছ? মা জেগে আছে।
নীরার কথায় কান না দিয়ে রুদ্র বলে, তুমি তোমার সিদ্ধান্ত না বদলালে আমি এখন থেকে প্রতিরাতে এসে তোমার বাসার সামনে ঘুরে যাব।

নীরা কোনো উত্তর দেয়ার আগেই মায়ের ঘরের রাস্তার দিকের জানালা খুলে যায়। ও পড়িমড়ি করে ঘরের দিকে দৌড় দেয়। রুদ্রর বাইকের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাবার আগেই মায়ের ঘরের জানালা বন্ধ হবার শব্দ পায় নীরা।

নীরা শক্ত বকা খাবার প্রস্তুতি নেয়। মা এখনি ওর দরজা ধাক্কা দেবে আর কঠিন বকাবকি করবে। নীরা বকা খাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, দশ মিনিট পেরিয়ে যায়, মা আসে না।

নীরার মা খুব কঠিন টাইপ মানুষ। ওদের মা-ই আসলে ওদের বাবা। মানে মানুষের বাবাদের যেমন রাগ, নীরার মায়ের তেমন রাগ। মা কঠোরভাবে নিয়মমানা মানুষ। সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে আবার ঠিক রাত এগারোটাই বিছানায় যাবেই যাবে। এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় না কোনোদিন।

তবে, ইদানীং মা রাতে ঘুমাতে পারে না ঠিকমতো। মায়ের ধারণা, যেকোনো সময় রাতে ওদের দু`ভাইবোনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রশফায়ারে দেবে। সেই চিন্তায় রাতে মায়ের ঘুম হয় না। ফলাফল সারাদিন ওদের বকাবকি করতে থাকেন।

মায়ের মনে এই ভয় ঢুকেছে গতসপ্তাহ থেকে। গতসপ্তাহে ওরা দু`ভাইবোন পার্টির মিছিলে গিয়ে পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়েছিল। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ওদের থানায় নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল।

তাতে তেমন সমস্যা ছিল না। সমস্যা হলো, রাতে পুলিশ বাড়িতে এসে ওদের বুঝিয়ে বলে গেছে, এই বয়সে এসব মিটিং মিছিল না করে পড়ালেখায় মন দিতে। এটা পুলিশের রুটিন কাজ। কিন্তু মায়ের ধারণা এটার মানে, আমরা তোমাদের বাড়ি চিনে গেলাম, যেকোনো রাতে এসে তোমাদের নিয়ে ক্রশফায়ারে দেয়া হবে।

মাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নীরা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

সকালে নিরার ঘুম ভাঙল মায়ের চেঁচামেচিতে। রাতের ঘটনার কথা মনে করে নীরা ভয়ে ভয়ে খাবার ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। নির্বাণ টেবিলে মাথা নিচু করে বসে চা খাচ্ছে আর পা দুলাচ্ছে। নীরার চোখের ইশারায় একটু মুখ বাঁকা করে হাসি দিল নির্বাণ, মা, নীরা এসে গেছে। এবার আমি উঠি। ওর শেয়ারের বকা ওকে দাও।

খবরদার, বাইরে যাবি না। একদম না, তোদের লজ্জা করে না? এই বয়সে তোদের জন্য আমি আমি ঘুমাতে পারি না। মা চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল।

তোরা তো নিশ্চিন্তে ঘুমাস। কালরাতেও যে এপাড়ায় পুলিশের লোক এসে ওয়্যারলেসে নীরা নীরা করে চিৎকার করে গেছে সে খবর রাখিস তোরা? কালরাতেই সব ইনফরমেশন পাস হয়ে গেছে, মায়ের গলা ধরে আসে।

নীরা কি বলবে বুঝতে পারে না, অসহায়ের মতো নির্বাণের দিকে তাকায়। শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা চিন্তা করো না প্লিজ। ব্যবস্থা নিয়ে ফেলব, কাল থেকে এপাড়ায় রাতে আর পুলিশ আসবে না।