মানুষের বোঝাবুঝির কিছু জরুরি নোক্তা
তুহিন খানপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০
গাজীপুরের গার্মেন্টস ঘটনার কয়েকটা ডাইমেনশন খেয়াল করলে, ধর্ম নিয়া ফ্যাসিবাদী জামানায় মানুষের বোঝাবুঝির কিছু জরুরি নোক্তা পাইতে পারেন।
প্রথমত, গার্মেন্টসের মালিক বলতেছেন, গার্মেন্টসে যেহেতু এজ আ টিম সবার কাজ করা লাগে, তাই টিমের মধ্যে মতভেদ দূর করা জরুরি। সেজন্য সবার একসাথে বসা জরুরি। আর এই ঐক্যনির্মাণের জন্য দিনে পাঁচবার মসজিদে সবার মোলাকাত ছাড়া আর কোনও ভালো ওয়ে উনি পান নাই।
উনি এই ঘটনার ফিজিক্যাল ব্যাখ্যাও দিছেন যে, সারাদিন বইসা থাকলে স্বাস্থ্যে নানা সমস্যা হয়। ফলে নামাজের মাধ্যমে স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। বেতন কাটার ব্যাপারে উনি কোনও ব্যাখ্যা না দিয়া বলছেন, আজ পর্যন্ত কারুর বেতন কাটা হয় নাই।
এবার থিওলজির আলাপে আসেন। এই যে এবাদতের পার্থিব ফায়দা, এবাদতের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাগুলারে পোলারাইজ করা— এইটা মূলত মডার্নিস্ট বা মডারেট মুসলমানদের প্রবণতা। এই ব্যাখ্যা, খুব দৃঢ়ভাবে নাকচ করেন ট্রাডিশনাল ওলামারা। নামাজ পড়লে স্বাস্থ্য ভালো হবে, যাকাত দিলে অর্থনীতি ভালো থাকবে, হজ আসলে ঐক্যের ব্যাপার— এইগুলা উনাদের কাছে গুরুতর কিছু না। গুরুতর হইল, এগুলা `এবাদত`।
আবু তাহের মেসবাহ সাহেবের `বাইতুল্লাহর মুসাফির` অনেকেই পড়ছেন। সেখানে প্রফেসর আখতার ফারুকের সাথে একটা ঘটনার বয়ান আছে উনার। আখতার ফারুক হজের সময় কোরবানির পশুর গোশত অপচয় নিয়া আফসোস করছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আবু তাহের মেসবাহ সাহেবের বক্তব্য এমন— `বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা ও প্রবণতা আমাদের মনমানসকে এমনই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে, এমনকি ইবাদতের ক্ষেত্রেও চলে আসে জাগতিক লাভ লোকসানের মানদণ্ড। তাই নামাজের মাঝে সন্ধান করি শরীরচর্চার উপকারিতা; রোযার মাঝে তালাশ করি স্বাস্থ্যগত সুফল....এগুলো তো গৌণ, অথচ এগুলোই যেন এখন মুখ্য!... আফসোস, কিছু চালাক দুশমন ও বহু নাদান দোস্ত আজ উঠেপড়ে লেগেছে ইবাদতের রুহ ও হাকিকতকে বিকৃত করার কাজে...` (বাইতুল্লাহর মুসাফির, ২৭২)।
এবাদত ও দ্বীন নিয়া ট্রাডিশনাল বা কওমিপন্থী ওলামাদের সাথে জামাতে ইসলামির দ্বন্দ্বের একটা বড় জায়গা ছিল এবাদত ও দ্বীনের হাকিকত নিয়া গ্যাঞ্জাম। এখন দেখেন, আমাদের কওমি ওলামারাও কেউ কেউ এই ঘটনায় খুশি। উনারা বলতেছেন, কাজটা ভাল হইছে। কিন্তু শরীরচর্চা আর টিম ওয়ার্ক ঠিক রাখার জন্য নামাজের ব্যবস্থা আর সেই নামাজ মিস গেলে মাইনে কাটা— এর শরঈ ভিত্তি কি আছে? এই মাইনে কাটার অর্থ কি নামাজ পড়ে নাই তাই মাইনে কাটা, নাকি প্রতিষ্ঠানের টিম ওয়ার্কে যায় নাই তাই মাইনে কাটা? উনারা বুচ্ছেন, নামাজ বাধ্যতামূলক করছে, ভাল তো। কিন্তু কেন বা কী কারণে করা হইছে কাজটা, এর মাধ্যমে জুলুমের কোনও রাস্তা খুইলা যায় কিনা, তা নিয়া উনাদের বক্তব্য নাই।
ইন্টারেস্টিং ডিবেট আরো পাইবেন হিস্ট্রিতে। কোরানের `আকিমুস সালাত`র অর্থ নিয়াও বেশ গোলযোগ আছে ট্রাডিশনাল ও মডারেট, মোটাদাগে কওমি আর জামাতিদের মধ্যে। জামাতিরা `নামাজ কায়েম` বলতে সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে নামাজরে বাধ্যতামূলক করা বুঝতেন, এ না হইলে এই আয়াতের `ফরজ` আদেশ পুরা হবে না। বিপরীতে ট্রাডিশনাল আলেমরা নিজের নামাজ পড়া এবং অন্যরে নামাজের দাওয়াত দেওয়া— এইটারেই `নামাজ কায়েম করা` অর্থে বুঝতেন। ট্রাডিশনাল উলামাদের `রাষ্ট্রবাসনা` যেহেতু ছিল আলাদা রকমের, সেই উমাইয়া আমল থিকাই, ফলে উনারা `নামাজ কায়েম` ব্যাপারটা এইভাবেই বুঝতেন। কিন্তু এখন তাদের অনেকে এই ঘটনায় খুশি।
নামাজ আল্লাহর হক। এমনকি নামাজ হুদুদ বা কেসাসের ভিতরেও পড়ে না, ইসলামের জুডিশিয়ারি সিস্টেমের ভিতরেও নামাজ না পড়ার কোন `হদ` নাই। তাইলে নামাজ না পড়লে বেতন কাটার নিয়ম কীভাবে যৌক্তিক? আর সেই নামাজ যখন মূলত গার্মেন্টসের বসের ওয়ার্কিং সিস্টেমের একটা টুলমাত্র, তখন সেইখানে এবাদতের হাকিকত ও মোটিভ নিয়া প্রশ্ন ওঠে কিনা? ইসলামের শুরু যুগে, নামাজ না পড়ায় কোনও লিগ্যাল শাস্তির বিধান ছিল কিনা?
ধর্মের চিন্তা থিকা নজর আরো চোখা করলে দেখবেন, কে কারে নামাজ পড়াইতেছে, কে কার নামাজের দায়িত্ব লইল। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বা মজুরি নিয়া আলাপ করলে তেমন কেউ নাই। কিন্তু শ্রমিকদের জোর কইরা নামাজ পড়ানোর কাজে বহু লোক আছে। তাইলে নামাজ যখন গার্মেন্টস মালিকের শ্রমিকদেরকে বশে রাখার টুল, সেই নামাজ কেমন? যে দেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরির ঠিক নাই, শত শত গার্মেন্টস কর্মী রাস্তায়, সেইখানে যদি নামাজের নিয়ম কইরা বেতন কাটা হয়, সেই নামাজটা আদৌ নামাজ কিনা?
ধর্মের টুল নানাভাবেই ব্যবহার করা যায় তো। মসজিদে যেরারও মসজিদই ছিল। কিন্তু তার প্রাণবস্তু ঠিক ছিল না। তো প্রাণবস্তু ঠিক থাকার গ্যারান্টিও বা কে দেবে? ওই লোক সৎ, তাই নিজের মোটিভ বইলা দিছেন। অনেকে নাও বলতে পারেন। ফলে এই ধরনের উদ্যোগ, কী কী প্রভাব তৈরি করবে লং রানে, সেই চিন্তা কইরাই ফতোয়া দেয়া উচিত।