মানিক বাঁড়ুজ্জের সাথে যাবার সময়

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ০৫, ২০১৯

উৎসর্গ: দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যার ঝোলাতে সকলের জন্য ভালোবাসার পর্যাপ্ত মজুত থাকত

 

১৯৫২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত খুব খেটে-খুটে মানিক বাঁড়ুজ্জে নিজের জীবন এবং সংসারে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছলতা আনার জন্য একটি ত্রৈমাসিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। তখন সীমান্তের ওপারে বাঙ্গালরা ঢাকাতে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে গেলেও সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু নিয়ে এমনকি লেখকরা পর্যন্ত তেমন ভাবিত নন। তাই তারা অক্লেশে দিনপঞ্জি এবং চিঠিপত্রে বাংলার পাশাপাশি যুতমতো ইংরেজি-হিন্দি বসিয়ে দেন। কেননা তারা খেয়াল করেছেন যে অনেক সময় সঠিক ভাবটি প্রকাশের জন্য লেখাপড়াজানা মধ্যবিত্ত বাঙালির হিন্দি-ইংরেজি শব্দের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই। তাই মানিক বাঁড়ুজ্জেও তার এই পরিকল্পনার শিরোনাম দিলেন ‘ত্রৈমাসিক প্ল্যান’। এবং লিখলেন, ‘কঠোর চেষ্টার দ্বারা এই তিনমাসে বর্তমান অবস্থা অনেকটা বদলাইয়া না দিলে সর্ব্বনাশ ঠেকানো যাইবে না’। তিনমাসের প্ল্যানে আবার প্রধান কাজ তিনটি। ১. সমস্ত খরচ ও ঋণ মিটিয়ে ব্যাংকে অন্তত পাঁচশত টাকা সঞ্চয় করা। ২. নিজের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং লেখা ছাড়া অন্য উপায়েও রোজগারের চেষ্টা করার সময় ও সুযোগ পাওয়া। ৩. ডি অর্থাৎ দিশি মদ দিনে চার বোতল থেকে এক বোতলে নামিয়ে আনা এবং কাঁচিমার্কা সিগারেট প্রতিদিন পাঁচ প্যাকেটের জায়গায় যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।

বছর দুয়েক আগে মানিক বাঁডুজ্জের স্ত্রী ডলি বৌদির হঠাৎ রক্তস্রাব শুরু হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। বৌদিকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে রেখে মানিক বাঁড়ুজ্জে বেরুলেন টাকার সন্ধানে। গেলেন বেঙ্গল পাবলিশার্সে। সেখানে মনোজ বসু নেই। চেক সই করা যাবে না। শচীন বুদ্ধিমান। মানিক বাঁড়ুজ্জে চটে উঠছেন বুঝতে পেরে চট করে বলল, একটু বসুন, দেখি কী করতে পারি। তাকে সামনে বসিয়ে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের গল্প। দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকতে থাকতে যখন ধৈর্য প্রায় শেষ পর্যায়ে, সেই সময় শচীন বেরিয়ে গিয়ে ফিরে এসে হাতে তুলে দিল একশো টাকা।

টাকা নিয়ে হাসপাতালে ফিরে মানিক বাঁড়ুজ্জে শুনলেন যে ডলি মরা বাচ্চা বিইয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। পরদিন সকালে বেডের পাশে গিয়ে মানিক বাঁড়ুজ্জে দেখলেন, স্ত্রী দিব্যি পাশের বেডের রোগিণীর সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। পেটের বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি মোটেই অখুশি নয়। বরং তার কথা, বাঁচা গেছে বাবা। আমি হিসেব করছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম নিয়ে রান্নার মেয়েটিকে বিদায় করে দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।

ডলির কথা শুনে কোনো কথাই বলতে পারেননি মানিক বাঁড়ুজ্জে। কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছিলেন, মানুষ সন্তানকে ভয় করছে! দশমাস গর্ভে ধারণ করে মৃতসন্তান প্রসব করে মা ভাবছে, বাঁচা গেল! অভিশপ্ত সমাজ এতখানি অস্বাভাবিক করে তুলেছে জীবনকে! তারপর থেকে মানিক বাঁড়ুজ্জের ফিট বাড়তে লাগল। ফিট থেকে সংজ্ঞা ফিরে আসে প্রতিবারই। আর প্রতিবারই নিজেকে মনে হয় প্রাণশক্তি নিংড়ে নেওয়া ব্লটিং কাগজ। কিন্তু না লিখে তো উপায় নেই। না লিখলে উনুনে হাঁড়ি চড়বে না। লিখতে বসার শক্তিটুকুর জন্য তখন আবার বেশি বেশি ডি।

‘রস’ গল্প লিখে হইচই ফেলে দেওয়া লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র এলেন একদিন। ঘরে ঢুকেই মানুষটা থ! বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীর এই অবস্থা! এ কী ঘরদোর! আসবাবপত্রের এ কী ছন্নছাড়া চেহারা! সস্তা একজোড়া চেয়ার-টেবিল। একপাশে আচ্ছাদনহীন একখানা তক্তপোষ। দেয়ালে ঠেস-দেওয়া কাচভাঙা আলমারি ছেঁড়াখোঁড়া বইপত্রে ঠাসা। কিছু চিঠি আর ছেঁড়া পাতায় লেখা খসড়া রচনা এখানে-ওখানে গোঁজা। যেন কিছু সৃষ্টির বীজ হেলাফেলা করে ছড়ানো। টেবিলের ওপর কয়েকটা ওষুধের শিশি আর চিনেমাটির ওয়াটার বটল। জয়ন্তী সংকলন ‘পরিচয়’ আর মলাট ছেঁড়া ‘মৌচাক’-এর বার্ষিক সংখ্যা বুক সেলফের ওপর এমনভাবে রাখা যে চোখে পড়বেই।

ছোট্ট ঘর। চটের পর্দা দিয়ে কোনো রকমে পার্টিসান করা। পর্দার ওপাশে বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় নীরব রোগশয্যায় শুয়ে আছেন। রোগশয্যায় নিজের যৌবনের কথা কি তার মনে পড়ছে? সেই যে তিনি, যখন মাসিক পঁচিশ টাকা বেতনে পি.ডব্লিউ.ডি-র অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লার্ক, জেল সুপারের বাগানে এক আধা-পাগল কয়েদি তার হাত দেখেছিল। ‘পাগলা খানিকক্ষণ হাত দেখিয়া বলিল, “তুমি একজন হাকিম হইবে।” আমি ও জেইলারবাবু হাসিয়া উঠিলাম। আমি মাটিকাটা অফিসে ২৫্ বেতনের কেরানী, আমি যেদিন হাকিম হইব সেদিন সূর্য্যদেব পশ্চিমে উদয় হইবেন।’ কুড়ি বছর পরে কিন্তু সূর্য্যদেব পশ্চিমে উদয় হইলেন না। ‘এতকালের পর কত আশা ও নিরাশার মধ্য দিয়া ভগবান আমার বহুকালের সঞ্চিত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলেন। আর এতদিন পরে সেই বালেশ্বর জেলখানার পাগলা-কয়েদীর ভবিষ্যৎ বাণী সফল হইল।’ সেই হাকিমও এখন চটের পর্দার আরেকপাশে জীর্ণ তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে নিজের মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে পুত্রকেও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখছেন। তিনি কি ছেলেকে হঠাৎ হঠাৎ অন্য প্রতিবেশীদের মতো ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘তোর ভায়েরা কেউ ডাক্তার কেউ হাকিম, তারা আলিশান বাড়ি বানিয়েছে, কলকাতা শহরে গাড়ি হাঁকাচ্ছে, তুই কী করলি রে মানিক!’ না, বলেন না। বললে যদি পাল্টা শুনতে হয়, ‘তোমার সেই কৃতি পুত্রদের আলিশান বাড়িতে না থেকে এখানে এই ফাটাচালের ঘরে পড়ে আছো কেন?’

আমরা যখন এসে পৌঁছুলাম, তখনো তার চোখ দুটি খোলা, কপালের ওপর আর কানের পাশে কয়েকটি শিরা জোঁকের মতো ফুলে উঠেছে, ডান হাতটা তিনি একবার জোরে নাড়লেন তীব্র প্রতিবাদের ভঙ্গিতে, চাউনি বরাবরের মতোই তীব্র আর প্রতিবাদী, গলা থেকে অস্ফুট শব্দ বেরুচ্ছে থেকে থেকে, যার কোনো ভাষা নেই, কিন্তু যন্ত্রণা আছে। নেয়ারের খাটে শোয়ানো লম্বা দেহটা লেপ দিয়ে ঢাকা, শুধু ডান হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। চওড়া হাড়ের ওপর মাংস নেই, মেদ নেই। শিথিল চামড়া। কপালে অজস্র রেখার জটিল আঁকিবুকি। মুখের এখানে-ওখানে আর গালে কয়েকটি পুরনো কাটার ক্ষতরেখা। মাথার চুল যে কতদিন তেলের ছোঁয়া পায়নি! ঝুরঝুরে ভঙ্গুর চুল।

এবার তিনি তার আশ্চর্য চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললেন। আর বোধহয় খুলে রাখতে পারছিলেন না। সমস্ত বাংলা যে চোখদুটিকে শ্রদ্ধা করে, গদিনশিনরা যে চোখদুটিকে প্রচণ্ড ভয় পায়, সেই আশ্চর্য তীক্ষ্ন চোখজোড়া এখন বন্ধ! অক্সিজেনের সিলিন্ডারটা খাটের তলায় শুইয়ে রাখা। সরু একটা রবারের নল বাঁ নাকের ফুটোয় ঢোকানো। মাঝেমাঝেই আক্ষেপে শরীর মোচড়াচ্ছেন। শরীরের নড়াচড়ায় যাতে পড়ে না যায়, নেই জন্য এক টুকরো লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে নলটাকে গালের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুযোগের সুরে ডলি বৌদিকে বললেন, এত খারাপ অবস্থা! আমাদের আরো আগে টেলিফোন করেননি কেন? বৌদি হাসলেন। সেই হাসিতে এত কান্না এত অসহায়তা! তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই!

বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লেখকের অসুখের খবর জানতে সাথীদের এতটা সময় লাগে, কারণ টেলিফোন করার জন্য পাবলিক বুথে পাঁচ আনা পয়সার দরকার হয়। পাঁচ আনা পয়সা! আর কাউকে জানানো হয়নি? আপনি জানাননি? মানিক বাড়ুজ্জে জানাননি কাউকে?

ধনাঢ্য বড় দাদার কাছে লেখা চিঠিটা যে এখন কোথায় আছে!

‘শ্রীচরণকমলেষু
আপনি বোধহয় জানেন আমি প্রায় দুই বৎসর হইল মাথার অসুখে ভুগিতেছি, মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া যাই। এ পর্য্যন্ত নানাভাবে চিকিৎসা হইয়াছে, কিন্তু সাময়িকভাবে একটু উপশম হইলেও আসল অসুখ সারে নাই। কয়েকজন বড় বড় ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আমি বুঝিতে পারিয়াছি কেবল ডাক্তারি চিকিৎসার উপর নির্ভর করিয়া থাকিলে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হইবে কি না সন্দেহ। অথচ প্রথম অবস্থায় আরোগ্যলাভের ব্যবস্থা না করিলে অসুখ যত পুরাতন হইবে, ততই আরোগ্যের সম্ভাবনা কমিয়া যাইবে। সুতরাং অন্য চিন্তা স্থগিত রাখিয়া সর্ব্বাগ্রে আমাকে সুস্থ হইবার জন্য সর্ব্বপ্রকার চেষ্টা করিতে হইবে। আমার যতদূর বিশ্বাস, সাহিত্যক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি নাম করিবার জন্য স্বাস্থ্যকে সম্পূর্ণ অবহেলা করাই আমার এই অসুখের কারণ। আমার প্রথম পুস্তক ১৩৪০ সালে প্রকাশিত হয়। তিন চার বৎসরের মধ্যে বাঙ্গালা সাহিত্যের অধিকাংশ সমালোচক স্বীকার করিয়াছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরবর্ত্তী যুগে আমি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ লেখক। অবশ্য mass-এর নিকট popular হইতে আমার কিছুদিন সময় লাগিবে, কারণ mass নূতন চিন্তাধারাকে অত্যন্ত ধীরে ধীরে গ্রহণ করে। এই নিয়মে শিক্ষিত শ্রেণী ছাড়াও mass-এর মধ্যেও আমার popularity যে ক্রমে ক্রমে বাড়িতেছে তাহার পরিচয়ও আমি পাইতেছি। বাঙ্গালা দেশে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য আমাকে আর কিছু করিতে হইবে না।

কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি যখন International fame এর জন্য নিজেকে প্রন্তুত করিতেছিলাম, সেই সময় এই অসুখ হইয়া সব গোলমাল করিয়া দিয়াছে। যে সময়ের মধ্যে এবং যে বয়সে আমি বাঙ্গালা সাহিত্যে যতখানি প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছি, বাঙ্গালা দেশে আর কেহই তাহা পারে নাই। অন্য দেশের সাহিত্যের ইতিহাসেও এরূপ দৃষ্টান্ত নাই। এজন্য আমার স্বাস্থ্যহানি ঘটিবে তাহা আমি জানিতাম, কিন্তু এরূপ একটা অসুখ যে হইবে তাহা আমি কল্পনাও করিতে পারি নাই। সাধারণভাবে স্বাস্থ্য খারাপ হইলে বৎসরখানেক লেখা ও পড়া কমাইয়া দিয়া নিয়মমত থাকিলে স্বাস্থ্য ভাল করা যাইবে আমার এইরূপই ধারণা ছিল। আমি এক বৎসরকাল আমার এই অসুখ সারাইবার জন্য ব্যয় করিব স্থির করিয়াছি। জোড়াতালি দেওয়া চিকিৎসার পরিবর্ত্তে আরোগ্য লাভের জন্য যাহা কিছু প্রয়োজন সমস্ত ব্যবস্থা করিব, কারণ তাহা না করিলে এই অসুখ সারিবে কি না বলা কঠিন। এক বৎসর চেষ্টা করিয়া যদি আরোগ্য লাভ না করিতে পারি, তাহা হইলে বুঝিতে পারিব আমার যে অত্যন্ত উচ্চ ambition ছিল তাহা সম্পূর্ণরূপে সফল করিতে পারিব না। আংশিক সাফল্য লইয়াই সাধারণভাবে আমাকে জীবন কাটাইতে হইবে। এভাবে বাঁচিয়া থাকিবার ইচ্ছা আমার নাই।

আমি আপনাকে সমস্ত কথা পরিষ্কার করিয়া খুলিয়া লিখিলাম। চিকিৎসার জন্য আমার অর্থের প্রয়োজন আছে, এখন চাকুরীতে আমি যাহা মাহিনা পাই তাহাতে চিকিৎসা চলিবে না। এ পর্য্যন্ত যেরূপ চলিয়াছে সেইরূপ জোড়াতালি দেওয়া চিকিৎসা চলিতে পারে মাত্র। এই জন্য আমি আপনার নিকট এক বৎসা কালের জন্য মাসিক একশত টাকা করিয়া সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি। চিকিৎসার ক্ষতি না করিয়া আমি যাহা উপার্জ্জন করিব এবং এই একশত টাকা করিয়া পাইলে আমি ঠিক ভাবে চালাইতে পারিব। আশা করি আপনি ভাবিয়া দেখিবেন যে, আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ এই অসুখ হইতে আরোগ্য লাভের উপর নির্ভর করিতেছে। আমার ইহা সাধারণ অসুখ নহে, ইহার প্রকৃত চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ওষুধ প্রভৃতির খরচ ছাড়াও আরও বহুবিধ খরচ দরকার। আপনার পক্ষে মাসিক একশত টাকা দেওয়া কিছুই নহে, কিন্তু ইহা আমার জীবন মরণ সমস্যা।’

দাদার উত্তর কী ছিল তা জানা নেই। তবে দিদির কাছে লেখা চিঠি বলে দেয়, দাদার আচরণ কেমন ছিল—

‘দিদি,
তুমি কি জানো যে বাবাকে টালিগঞ্জের বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, বাবা হঠাৎ এসে আমার এখানে উঠেছেন? আগের মত আমায় ভাড়াটে ঘরে চটের পার্টিসান করে বাবাকে থাকতে দিতে হয়েছে? বাবার শরীর খারাপ, মন খারাপ। মনটাই বেশী খারাপ। হাজার হাজার টাকা রোজগার করা ছেলে আছে, তবু কি দুর্দ্দশা। তুমি আর অন্নদাবাবু দুজনেই বাবাকে স্নেহ ভালবাসা জানিয়ে চিঠি লিখো। ভয় নেই। বাবা তোমাদের ঘাড়ে চাপবেন না। চিঠি পড়ে মনটা একটু খুসী হবে।’

লোকটা আকণ্ঠ মদ টেনে টেনেই নিজেকে অকালে মেরে ফেলবে। নরেন মিত্তিরের আক্ষেপ। তারাশঙ্করের আক্ষেপ। ‘পরিচয়’ অফিসে আক্ষেপ। ‘স্বাধীনতা’ অফিসে আক্ষেপ। পার্টির অফিসেও আক্ষেপ। তাদের সবার উত্তর দেবার জন্যে অতুলচন্দ্র গুপ্ত যদি তার কাছে লেখা চিঠিটা সাইক্লোস্টাইল করে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিতেন! ‘আমার কোন রোগ নেই, আমি সুস্থ সবল সক্রিয় মানুষ— এ বিশ্বাস আঁকড়ে থাকা ছাড়া আমার কোন গতি নেই। কারণগুলি এই—

(১) প্রথমদিকে পুতুলনাচের ইতিকথা প্রভৃতি কয়েকখানা বই লিখতে মেতে গিয়ে যখন আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা শরীর আছে এবং পরিবারের মানুষরাও নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন হয়ে গিয়েছিল তখন একদিন হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। একমাস থেকে দু’তিনমাস অন্তর এটা ঘটতে থাকে।
(২) কয়েক বছর ধরে বহুভাবে আমার চিকিৎসা হয়েছে। ডাক্তাররা শুধু ব্রোমাইড ইত্যাদি ওষুধের ব্যবস্থা করতেন।
অ্যালকোহলের সঙ্গে তখন আমার সম্পর্ক ছিল না।
(৩) ঝিমিয়ে দেওয়া ওষুধ খেয়ে খেয়ে ক্রমে ক্রমে অকর্মণ্য হয়ে পড়লাম এবং মৃত্যুর প্রায় মুখোমুখি দাঁড়ালাম।
(৪) দীর্ঘকাল চিকিৎসা চালিয়ে অকর্মণ্য মরণাপন্ন হয়ে আমি তখন সিদ্ধান্ত নিই যে নিজেকে আর রোগী ভাবব না।
কোনো ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়েই আমি একটা পেটেন্ট ওষুধ এবং সেই সঙ্গে এত বছর ঝিমিয়ে দেওয়া ওষুধ খাওয়ার প্রতিষেধক হিসাবে বিপরীত জিনিষ অ্যালকোহল শুরু করি।
(৫) একটা কথা ভুল বুঝবেন না-- আমি কোনদিন চিকিৎসাবিজ্ঞান বা ডাক্তারকে উড়িয়ে দেবার কথা কল্পনাতেও আনি নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমি বিশ্বাসী। আমি বরাবর ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছি, দরকার মত ওষুধপত্র খেয়েছি।
(৬) তবে কথা হল এই, ডাক্তারের সব উপদেশ মেনে চলা বা নব ওষুধ নিয়মমত খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।
কারণ অর্থাভাব এবং অতিরিক্ত খাটুনি। আজ এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমোলে কাল হাঁড়ি চড়বে না-- খানিকটা অ্যালকোহল গিললে কিছুক্ষণের জন্য তাজা হয়ে হাতের কাজটা শেষ করতে পারব।
(৭) (৮) (৯) এবং (১০) আমি মাতাল নই-- সাহিত্যিক।’

তার প্রিয় বাংলাদেশ কী করছে এখন? যে বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এখন চোখ বুঁজে পড়ে আছেন? দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রায়ের শিষ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিংবদন্তি ডাক্তার বিধান রায় নাকি খুবই সাহিত্যপ্রেমী! তিনি কি জানেন তার রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ এখন অগস্ত্যযাত্রার জন্য তৈরি? এই সময় কী কী দেখা যাচ্ছে কোলকাতায়? রাস্তায় হাঁটলে কী দেখা যায়? বিধান রায়ের আলোকোজ্জ্বল প্রাসাদ। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বামপন্থিদের বিশাল নির্বাচনী সভা। দেয়ালে দেয়ালে হাঙ্গেরির গোলযোগের ওপর লেখা বড় বড় পোস্টার। কলেজ স্ট্রিটে সারবাঁধা বইয়ের দোকান।
সব দোকানেই মানিক বাঁড়ুজ্জের বই পাওয়া যায়। সিনেমা হলের সামনে লম্বা লাইন।

বাড়ির বাইরে ঘ্যাঁসঘ্যাঁস আওয়াজ তুলে অসুস্থ একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। মিউনিসিপ্যালটির ভাঙা অ্যাম্বুলেন্সটা। পাগলের মতো কোলকাতা শহরের এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এটাকেই শুধু জোগাড় করতে পেরেছেন। এই গাড়ি তাকে হাসপাতাল অব্দি নিয়ে যেত পারবে! ঘরে ঢোকার পর থেকে নেয়ারের খাটের একপ্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই দীপেন্দ্রনাথ, যিনি মানিক বাঁড়ুজ্জের মাঝে সবসময় কেবলমাত্র জীবন দেখতে পেয়েছেন। আজ যেন এই জীবনহীনতার দিকে যাত্রা তার সহ্য হচ্ছে না, বিশ্বাস হচ্ছে না। এই ছোট্ট ঘরটার মধ্যে যেন গমগম করে উঠছে দীপেন্দ্রনাথের চিৎকার— মানিকবাবুর গল্প-উপন্যাসের একমাত্র বিষয় হচ্ছে বাঁচা, মানুষের বাঁচা, বেঁচে থাকার অর্থ খোঁজা, ঠিকমতো বাঁচবার প্রক্রিয়া আয়ত্ত করা।

পাড়ার তরুণ ডাক্তারবাবু একটা ইনজেকশন দিলেন। স্পিরিটমাখা তুলোটা বাহুতে ঘষতেই মানিকবাবু চোখ মেলে তাকালেন, অস্ফুটে কী যেন বললেন। ইনজেকশনের সুঁচটা বাহুতে বেঁধামাত্র মুচড়ে উঠল সমস্ত শরীর। তাকে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তোলার সময় পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকালেন। তবে নেই চোখে কোনো অর্থদৃষ্টি নেই। সবসময় অব্যবস্থা দেখে যিনি অভ্যস্ত হওয়ার বদলে আরো বিরক্ত হয়ে উঠতেন। সেই বিখ্যাত বিরক্তি আরেকবার তার গলা চিরে বেরুল— নাঃ! নাঃ!

রোগজর্জর অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে রওনা দিল। বরানগর থেকে মৌলালি। কী দীর্ঘ আর কী ভয়ংকর সেই যাত্রা! বিটি রোডে পৌঁছে অ্যাম্বুলেন্স একবার ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ অ্যাম্বুলেন্স থামায় রাস্তার এক লোক কৌতূহলী চোখে উঁকি দিল ভেতরের দিকে। শুধু এক পলক উঁকি। তারপরই তার কৌতূহল শেষ। লোকটা যেন বাঙালি জাতির প্রতিনিধি। যদি জানত কে যাচ্ছে এই অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে! গাড়ি এবার শ্যামবাজারের পাঁচ রাস্তার মোড়ে। ডলি বউদি হাতে জলের বোতলটি নিয়ে সেই একইভাবে বসে আছেন। চোখে বেদনা নেই, কান্না নেই, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনাও নেই। কেন যে তিনি ঈশ্বরকে ডাকছেন না? তিনিও কি তাহলে জেনে গেছেন— ‘ঈশ্বর থাকেন না এখানে। তিনি থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে’। একেবারে হাসপাতালে পৌঁছে কথা বললেন বৌদি। উডবার্নের বারান্দায় একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে স্বগতোক্তির মতো বললেন, দুদিন আগে যদি আনা যেত, তাহলে হয়তো মানুষটা বেঁচেও যেতে পারতেন।

পরদিন পালঙ্কসুদ্ধ খুব যত্নে যখন তাকে সুপরিসর নতুন ট্রাকে তোলা হলো, তখন তার একটা চোখ খোলা আর একটা চোখ বন্ধ। চারপাশ লোকে লোকারণ্য। ভিড় আর ভিড়। আর ফুল। আর মালা। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। সঙ্গে ফুল। বিরোধী দলের প্রধান। সঙ্গে ফুল। সাহিত্যের মানুষ। সঙ্গে ফুল। নাটকের মানুষ। সঙ্গে ফুল। খেলার মানুষ। সঙ্গে ফুল। ব্যবসার মানুষ। সঙ্গে ফুল। সিনেমার মানুষ। সঙ্গে ফুল।

হঠাৎ গোপাল হালদার নিচ থেকে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সন্ত্রস্ত ইশারা করে দেখালেন— ফুলের ভাড়ে সুদৃশ্য দামি পালঙ্কটির এটা পায়াতে ফাটল ধরে গেছে। একচোখ খোলা একচোখ বন্ধ মানিক বাঁড়ুজ্জে তখন বোধহয় তীব্র বিদ্রূপে হাসছিলেন। হয়তো নিঃশব্দে কিছু বলছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবি মানুষ। মৃতদের ঠোঁট না নড়িয়ে বলা কথাও বুঝে নিতে পারেন। তিনি পরে মানিক বাঁড়ুজ্জের সেই বিদ্রূপকে ভাষাতে রূপ দিয়েছিলেন—

‘ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশী মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনদিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি—
যা দিয়ে কোনদিন কারো মুখোশ হয় না।’

শোকের মুখোশ পরা আমাদের মুখগুলো তখনো এই জনসমক্ষে মানিক বাঁড়ুজ্জের মতো বিদ্রূপের হাসি হেসে ওঠার সাহসটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি।