মানবিক কল্যাণের আলোকবর্তিকা দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
শাহ নজরুল আলমপ্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২৪
জাগতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার মধ্যদিয়ে মানুষ জীবন যাপন করে। মানুষ স্বাপ্নিক। তার অন্তর্দৃষ্টি কিছু দেখে বলেই সে দার্শনিক। জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমাদের জাতীয় জীবনে এক নক্ষত্র পুরুষ এবং উপমহাদেশের অন্যতম দার্শনিক। তিনি যে সামগ্রিক জীবন দর্শনের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা হচ্ছে ইসলামি বিশ্বজনীন জীবনদৃষ্টি। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কর্মকাণ্ডে একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করেন। সম্প্রীতি ও উদারতার মাধ্যমে তিনি সকল ধর্মাবলম্বী মানুষকে আলিঙ্গনে আনেন। ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ তাঁকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল। তাঁর জীবন দর্শন সচেতন মানুষের মানবিক কল্যাণের আলোকবর্তিকা।
এগারো ফেব্রুয়ারি দুই হাজার, রোজ শুক্রবার। সকাল ৮টা থেকে গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। কবি আবদুল কাইয়ূম ভাইয়ের অপেক্ষায়। মুসলিম সাহিত্য সংসদের শিকড়ের সন্ধ্যানে অভিযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে একসঙ্গে যাব। মিনিট ত্রিশেক পর তিনি আমাকে তার দ্রুতগামী মটরবাইকে তোলেন। আরও মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে আমরা সাহিত্য সংসদে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে দেখি, অধিকাংশ শেকড় সন্ধানি এসে গেছেন। দু’একজনের জন্য কিছুটা অপেক্ষা করা হচ্ছে। সে অভিযাত্রায় সব শ্রেণির মানুষ ছিলেন। তন্মধ্যে বেশির ভাগ সাহিত্যকর্মী। একটি বাস সংসদের সামনে ছিল। সে বাসে প্রায় অর্ধশতাধিক শেকড় সন্ধানি আরোহন করেন।
বাসের সামনে ব্যানারে লেখা ছিল, উপমহাদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের স্মৃতি বিজড়িত দোহালিয়ায় শেকড়ের সন্ধানে অভিযাত্রা। অভিযাত্রিক দলের সামনে ছিলেন সাহিত্য সংসদের সহ-সভাপতি আ.ফ.ম কামাল, নির্বাহী অফিসার ইতিহাসবেত্তা মনির উদ্দিন চৌধুরী (প্রয়াত), রাজনীতিবিদ সিরাজ উদ্দিন আহমদ (প্রয়াত) প্রমুখ। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে বাস গিয়ে ছাতক শিল্প নগরীতে পৌঁছে। প্রাইভেট কারে এসে এখানে যোগ দেন কবি রাগিব হোসেন চৌধুরী। আমরা বাস থেকে নেমে বাজার দিয়ে হেঁটে সুরমা নদীর ঘাটে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় উঠি। আমাদের এই দলবেঁধে অভিনব যাত্রা দেখে বাজার ও স্থানীয় লোকেরা উৎসুক চোখে লক্ষ্যপাত করে।
নৌকায় সবাই আরোহনের পর সাংবাদিক সেলিম আউয়াল মাউথপিস হাতে নিয়ে বলেন, সম্মানিত এলাকাবাসী, আমরা দোহালিয়া যাচ্ছি। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের স্মৃতি ধন্য দোহালিয়া যাচ্ছি। এই ঘোষণা শুনে স্থানীয় জনগণ কিছুটা স্বস্তিবোধ করেন। তবুও তাদের দৃষ্টি ছিল আমাদের অভিযাত্রিক দলের প্রতি। নৌকা ছাড়ার সময় আবার ঘোষণা হয়, দেওয়ান আজরফের মাঝার জিয়ারতে দোহালিয়া যাচ্ছি। নৌকার ভিতরে ও ছাদে অভিযাত্রীরা বসে। কবিতা গানে নৌকা যাত্রা পুরো সরগরম হয়ে ওঠে। সুরমার বুক চিরে নৌকা যাচ্ছে ! দু’তীরের বাসিন্দা, নদীঘাট, ক্ষেত খামার আমরা অবলোকন করছি। আরো ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আমরা দোহালিয়া বাজারে পৌঁছে যাই।
মাইল খানিক হেঁটে আমাদের কাংখিত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বাড়িতে পৌঁছায়। জুমু’আর নামাজ আদায় করি তাঁর বাড়ির মসজিদে। এই মসজিদ সুনামগঞ্জের প্রাচীনতম পাকা মসজিদ। কয়েক শতাব্দী পুরনো। আমরা নামাজ শেষে তাঁর কবর ও চাচাতো ভাই দেওয়ান আহবাব (তৎকালীন আসাম পার্লামেন্ট মেম্বার) এবং পারিবারিক কবরস্থান জিয়ারত করি। বাড়ির সামনে প্যান্ডেলের নিচে শুরু হয় তাঁর কর্মময় জীবন ভিত্তিক আলোচনা সভা। সভাপতিত্ব করেন তাঁর বড় ছেলে নুরুজ্জামান চৌধুরী। অনুষ্ঠান শেষে মধ্যাহ্নভোজ শুরু হয়। কয়েক রকমের মাছের তরকারি। বিশেষত মাগুর মাছ ও উরি বিচির তরকারী ছিল সুস্বাদু। এত মানুষকে মাছের তরকারী দিয়ে আপ্যায়ন, সুনামগঞ্জের হাওর-বাওরের ঐতিহ্য। নতুবা অন্য কোন এলাকায় স্থানীয় বাজারে এত মানুষের জন্য মাগুর মাছ পাওয়া যাবে না।
কবিতা পাঠের আসর বিকেলে শুরু হয়। চা-বিস্কুট ও ফাঁকে ফাঁকে চলে। সবার হাতে একটি করে গিফট প্যাকেট দেওয়া হয়। প্যাকেটের ভিতর একটি বাঁশি ছিল ! আমাদের ঘরে ফেরার পালা। বাঁশি বাজিয়ে হেঁটে আবার নৌকায় উঠি। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পথাতিক্রম করি। মুসলিম সাহিত্য সংসদের কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দেই, এরকম শেকড় সন্ধানী অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর শতাব্দীর মতো বয়সী বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের দ্বীপশিখা। এ দীর্ঘ জীবনের কাহিনী জানার জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন ‘সোনা ঝরা দিনগুলি’ আত্মকথা।
অধ্যাপক শাহেদ আলীর ভাষায় ‘তাঁর এ জীবন স্বভাবত আমাদের জন্যে একটি মহান উত্তরাধিকার।’ তিনি আরো বলেন, জমিদারি প্রথা তাঁর কাছে অপছন্দনীয় ছিল। কিন্তু জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করলে তাঁর মত অনেক জমিদারদের সম্মানের সঙ্গে জীবন ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়বে এই আশংকায় তিনি নিরবতা অবলম্বন করেছিলেন।’
আমাদের সেই মহান উত্তরাধিকার থেকে যত কিঞ্চিত চলমান প্রবন্ধে আলোকপাত করছি। এই মহান ব্যক্তি ২৫শে অক্টোবর ১৯০৬ সালে নানাবাড়ি লক্ষণশ্রী গ্রামে তেঘরিয়া জমিদার বাড়ি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন দোহালিয়ার জমিদার মোহাম্মদ আশফ। মাতা মরমী কবি হাছন রাজার বড় মেয়ে রওশন ভানু। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯১৩ সালে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তিনি ১৯২৫ সালে জুবিলী হাইস্কুল থেকে ফারসি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি উত্তীর্ণ হন। ১৯২৭ সালে সিলেট মুরারী চাঁদ (এম,সি) কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে বিএ এবং ১৯৩২ সালে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি ১৯৩৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার এমসি একাডেমিতে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করে। ১৯৪৮ সালে সুনামগঞ্জ কলেজে ইংরেজি, বাংলা ও দর্শনের শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৫৭ সালে নরসিংদী ও ১৯৬৫ সালে মতলব কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ‘আবুজর গিফারী কলেজ’র প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ১৯৭৩ সাল থেকে খণ্ডকালীন অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি শিক্ষা বিস্তারে ও জ্ঞান চর্চায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, ইসলামি সাম্য ও মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, ইসলামি চিন্তাবিদ ও সুলেখক ছিলেন। ‘শিয়াল মামা’ শীর্ষক গল্পের মাধ্যমে ১৯১৮ সালে সাহিত্যাঙ্গাণে প্রবেশ করেন। সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে পঞ্চাশাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি ছিলেন সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার বিরোধী ও মানবতাবাদী। বৃটিশ বিরোধী ও ভাষা আন্দোলনে একজন শিক্ষাবীদ ও লেখক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ভাষা, সাহিত্য ও রাজনীতির সাথে তাঁর সম্পর্কের জন্যে ১৯৪৬ সালে আসাম আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯৪৭ সালে আসাম সরকারের বাঙ্গাল খেদা অভিযানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করে শীলচরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৬ সালে সিলেটে প্রতিষ্ঠিত ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ‘সাপ্তাহিক নওবেলাল’র সম্পাদক ছিলেন ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তান দর্শন সমিতির সদস্য পদ ১৯৫৪ সালে লাভ করেন। তিনি দর্শনের তীর্থ যাত্রায় দীর্ঘকাল বিচরণ করেন। নিজের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে তিনি বলেন ‘জীবন প্রভাতেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে; আমি কোথা থেকে এলাম? কোথায় ছিল আমার পূর্বের বাসস্থান? কোথায়ই বা আমি ফিরে যাবো? আমার চারদিকে যেসব বস্তু রয়েছে ওরা আমার শত্র না মিত্র? এভাবে আত্মসচেতন মানুষের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে দর্শন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ১৯৬২ সালে ইরাক সরকারের আমন্ত্রনে ইরাক যান। সেখানে বাগদাদ নগরীর সহস্র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এবং দার্শনিক আল-জিন্দির জন্ম সহস্র বার্ষিকীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮১ সালে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ‘শান্তি নিকেতন’ এ ‘রব্বানী’ দর্শনের উপর বক্তৃতা দেন। ১৯৮৬ সালে বিপ্লব বার্ষিকীতে ইরান সরকারের আমন্ত্রণে যোগদান করেন। তিনি স্বীকৃতি স্বরুপ জাতীয় পুরুষ্কারসহ বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হন। এসবের মধ্যে ১৯৮১ স্বাধীনতা দিবস পুরুষ্কার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরুষ্কার ১৯৮৩ এবং বাংলা একাডেমি ফেলো নির্বাচিত হন ১৯৮৪ সালে। সিলেট নাট্যলোক ১৯৯০ সালে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। একুশে পদক এবং স্যার জগদিশ চন্দ্র বসু পুরুষ্কার ১৯৯২ সালে লাভ করেন।
বিশ্বনাথ ছাত্র কল্যাণ সমিতি কর্তৃক ১৯৯২ সালে ১২ এপ্রিল রোজ রবিবার রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে তাঁর সম্মানার্থে এক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মির্জা আছকির বেগ। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, বিশ্বনাথের কৃতিপুরুষ মরমী কবি হাছন রাজা আমার নানা। আমি ছোটবেলায় অনেক বার নৌকায় মায়ের সাথে রামপাশা এসেছি। বিশ্বনাথের ঐতিহ্য কে বলেছে নেই ! বিশ্বনাথ কখনও শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে ছিলনা। নব প্রজন্মের কাছে সেই ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে। যাতে তারাও শিক্ষার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। তিনি সে অনুষ্ঠানে শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেন।
সেদিন পড়ন্ত বিকেলে তাঁর দর্শন ভিত্তিক বক্তব্য ছাত্র-জনতা সবার হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে জাতীয় অধ্যাপক সম্মানে ভূষিত হন। তিনি আজ সভা-সেমিনার সিস্পোজয়ামে উপস্থিত নেই। কিন্তু আমাদের সামনে তাঁর মনুষ্যত্ব্যের দ্বীপ শিখাটি জ্বালিয়ে গেছেন। যা থেকে মানুষ যুগ যুগ উৎসাহ-উদ্দীপনা পাবে। এই মহৎ প্রাণ ব্যক্তি ধুলিমাটির সংসারের রৌদ্রুজ্জ্বল মায়া কাটিয়ে অনন্তের শাশ্বত মহা পৃথিবীতে ১লা নভেম্বর ১৯৯৯ সালে চলে গেছেন। তিনি নিভৃতে শুয়ে আছেন কোলাহল মুক্ত পানাইল গ্রামে। মসজিদের কাছে মায়ের কবরের পার্শ্বে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। আমরা তাঁর পরকালীন জীবনে মুক্তি ও সম্মানিত স্থান প্রার্থনা করছি।