মাইকেল মধুসূদন দত্তের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৫, ২০২১
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের আজ ১৯৮তম জন্মদিন। ১৮২৪ সালে ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে তার জন্ম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হরো:
কবি
কে কবি— কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
সেই কি সে যম‐দমী? তার শিরোপরি
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
যার মনঃ‐কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি‐ভানু‐প্রভা‐সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ‐কিরণ।
আনন্দ, আক্ষেপ ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা‐বলে;
নন্দন‐কানন হতে যে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে;
মরুভূমে— তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে!
কমলে কামিনী
কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে
কালিদহে। বসি বামা শতদল-দলে
(নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে
মনোহরা।) বাম করে সাপটি হেলনে
গজেশে, গ্রাসিছে তারে উগরি সঘনে
গুঞ্জরিছে অলিপুঞ্জ অন্ধ পরিমলে,
বহিছে দহের বারি মৃদু কলকলে!
কার না ভোলে রে মনঃ, এহেন ছলনে!
কবিতা-পঙ্কজ-রবি, শ্রীকবিকঙ্কণ,
ধন্য তুমি বঙ্গভূমে! যশ: সুধাদানে
অমর করিলা তোমা অমরকারিণী
বাগ্দেবী! ভোগিলা দুখ জীবনে, ব্রাহ্মণ,
এবে কে না পূজে তোমা, মজি তব গানে?
বঙ্গ-হৃদ-হ্রদে চণ্ডী কমলে কামিনী।।
ইতালি
ইতালি, বিখ্যাত দেশ, কাব্যের কানন,
বহুবিধ পিক যথা গায় মধুস্বরে,
সঙ্গীত‐সুধার রস করি বরিষণ,
বাসন্ত আমোদে আমোদ মন পূরি নিরন্তরে;—
সে দেশে জনম পূর্বে করিলা গ্রহণ
ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরাকা কবি; বাক্দেবীর বরে
বড়ই যশস্বী সাধু, কবি‐কুল‐ধন,
রসনা অমৃতে সিক্ত, স্বর্ণ বীণা করে।
কাব্যের খনিতে পেয়ে এই ক্ষুদ্র মণি,
স্বমন্দিরে প্রদানিলা বাণীর চরণে
কবীন্দ্র: প্রসন্নভাবে গ্রহিলা জননী
(মনোনীত বর দিয়া) এ উপকরণে।
ভারতে ভারতী‐পদ উপযুক্ত গণি,
উপহাররূপে আজি অরপি রতনে।।
বঙ্গভূমির প্রতি
রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ,
ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে দৈবের বশে,
জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে, খেদ নাহি তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে,
নাহি, মা, ডরি শমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো, পড়িলে অমৃত-হ্রদে!
সেই ধন্য নরকুলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন;
কিন্তু কোন্ গুণ আছে,
যাচিব যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি, কহ, গো, শ্যামা জন্ম দে!
তবে যদি দয়া কর,
ভুল দোষ, গুণ ধর,
অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে,
মানসে, মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস কি বসন্ত, কি শরদে!
আত্মবিলাপ
আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু,হায়,
তাই ভাবী মনে?
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন ,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?
জাগিবি রে কবে?
জীবন-উদ্যানে তোর যৌবন-কুসুম-ভাতি
কত দিন রবে?
নীর বিন্ধু, দূর্বাদলে,নিত্য কিরে ঝলঝলে?
কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতি?
নিশার স্বপন-সুখে সুখী যে কী সুখ তার?
জাগে সে কাঁদিতে!
ক্ষণপ্রভা প্রভা -দানে বাড়ায় মাত্ত আঁধার
পথিকে ধাঁদিতে!
মরীচিকা মরুদেশে,নাশে প্রাণ তৃষাক্লেশে—
এ তিনের ছল সম ছল রে এ কু-আশার।
প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাদে
কী ফল লভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়,ধাইলি,অবোধ,হায়
না দেখলি না শুনিলি,এবে রে পরাণ কাঁদে
বাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে,
সে সাধ সাধিতে?
ক্ষত মাত্ত হাত তোর মৃণাল-কণ্টকগণে
কমল তুলিতে
নারিলি হরিতে মণি, দঃশিল কেবল ফণী
এ বিষম বিষজ্বালা ভুলিবি, মন,কেমনে!
যশোলাভ লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়,
কব তা কাহারে?
সুগন্ধ কুসুম-গন্ধে অন্ধ কীট যথা ধায়,
কাটিতে তাহারে?
মাৎসর্য-বিষদশন, কামড়ে রে অনুক্ষণ!
এই কি লভিলি লাভ,অনাহারে,অনিদ্রায়?
মুকুতা-ফলের লোভে,ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস,পামড়!
ফিরি দিবি হারাধন,কে তোরে,অবোধ মন,
হায় রে,ভুলিবি কত আশার কুহক-ছলে!