সুধীর চক্রবর্তী

সুধীর চক্রবর্তী

মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৩৯

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৬, ২০২০

এই বাংলা জনপদকে বুঝে উঠতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল। আমি তল পাচ্ছিলাম না। খুঁজছিলাম। কেবলই খুঁজছিলাম। কিন্তু কী খুঁজছিলাম, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একদিন সুধীর চক্রবর্তীর ‘গভীর নির্জন পথে’ বইটি পড়তে বললেন শ্রদ্ধেয় যতীন সরকার। বললেন, ‘দেখবে, এক গুপ্ত ভাণ্ডার তুমি আবিষ্কার করতে পারবে।’ ছয় বছর ধরে বইটি কতবার চোখে পড়েছে আজিজ মার্কেটের দোকানগুলোতে। অথচ সংগ্রহ করিনি। কে জানে, কেন করিনি!

ছয় বছর পর একদিন বইটি কিনলাম। পড়তে শুরু করলাম। প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার বইটির একটি শব্দও বাদ না দিয়ে পড়া শেষ করি। শব্দের সঙ্গে শব্দ এমনভাবে সংশ্লিষ্ট, বাদ দিলে মনে হচ্ছিল, গভীর নির্জন যে গুপ্ত জগৎ পরিভ্রমণ করছি, ভ্রমণ করতে করতে যে অমূল্য মণি-মুক্তো কুড়াচ্ছি, তার একটি যেন পায়ে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছি। বইটি পড়ার পর আমার সামনে একটি দুয়ার খুলে গেল। সেই দুয়ারপথে দেখতে পাই এক বিশাল বাংলা। কে যেন কানে কানে বলল, ‘তুমি যা খুঁজছিলে সম্ভবত তার একটি সূত্র পেয়ে গেছ।’

হ্যাঁ, আমি সূত্র পেয়ে গেলাম। সুধীর চক্রবর্তী আমাকে বাংলার আউল-বাউল-বৈরাগী-দরবেশ-সাঁই কিংবা সহজিয়া উপাসক সম্প্রদায়ের একেবারে গভীরে ঢুকিয়ে দিলেন। গভীর নির্জন পথে একাকী পায়ে হেঁটে, দুই দশক ধরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান-কুষ্টিয়া-মেহেরপুরের গ্রামীণ পরিমণ্ডল ঢুঁড়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন এমন এক বিশাল গুপ্ত জগৎ, যে জগৎ আমাদের একেবারেই অচেনা। আর তা ব্যক্ত করেছেন এমন এক আঙ্গিকে, যা গল্প নয়, অথচ গল্প; উপন্যাস নয়, অথচ উপন্যাস; প্রবন্ধ নয়, অথচ প্রবন্ধ। গবেষণাধর্মী রচনার আঙ্গিক এমন হতে পারে, ধারণাই ছিল না। আর সে কি শক্তি তার গদ্যের! কোথা থেকে রপ্ত করলেন এই গদ্যভাষা!

বইটি পড়ে মনে হয়েছিল, আমরা কত কি জানি। কথায় কথায় রুশো, কান্ট, হেগেল, ফয়েরবাখ, ফ্রয়েড আওড়াই। অথচ বাড়ির কাছের পড়শি লালন সাঁই, পাঞ্জু শা, দুদ্দু শাহ, হাউড়ে গোঁসাই, লালশশী, কুবির গোঁসাইকে চিনি না। কী তাদের চিন্তা, একটু খুঁজে দেখি না। কী বিপুল ঐশ্বর্যে ভরপুর তাদের চিন্তার জগৎ! প্রচলতি রক্ষণশীল ধর্মমতকে কি দুঃসাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। কী আশ্চর্য তাঁদের সাধন-ভজন! আকাশের ঈশ্বরকে তারা টেনে মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। বললেন, এখানে, এই ‘লা মাকানে’ ঈশ্বরের অধিবাস। আকাশে নয়, এই মানবপিঞ্জরেই তাকে খোঁজো। আমরা পশ্চিম থেকে ধার করা হিউম্যানিজমের কথা বলি, অথচ আমাদের এই পড়শিরা গত পাঁচশো বছর ধরে যে মানবতাবাদের চর্চা করে আসছেন, তা আমরা দেখি না। কী অপূর্ব তাদের সমন্বয়বাদ! সকল জাতপাতকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে মানবতার যে কেতন তারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, তা বিশ্ববিরল।

যখন ‘গভীর নির্জন পথে’ পড়ছিলাম এবং পড়া শেষ করার পর কয়েক মাস ধরে বুকের মধ্যে বাজছিল, ‘মানুষ ভজ মানুষ ধরো শোন বলিরে পাগল মন।’ কার গান? গুগল সার্চ করে দেখি গীতিকার রশিদ উদ্দিনের। এমন হাজারো রশিদ উদ্দিনদের নিয়ে ছিল সুধীর চক্রবর্তীর সাধনা। মরমিবাদের চারণভূমি এই বাংলায় ঈশ্বরের চেয়ে মানুষকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গোঁড়া হিন্দু ও গোঁড়া মুসলিমদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাংলায় যেসব লোকধর্মের সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলোর মূলমন্ত্রও ছিল মানুষ। সেসব ধর্মের অনুসারীরা অলৌকিক ঈশ্বরের চেয়ে লৌকিক মানুষকেই গুরুত্ব দিতেন বেশি। সেই ধর্মগুলো ছিল সমন্বয়বাদী, উদার। হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষরাই ঠাঁই নিয়েছিল সেসব ধর্মমতে।

‘গভীর নির্জন পথে’ পড়ে এমন এক সম্প্রদায় সম্পর্কে জানতে পারি, যারা মানুষকে ভজনা করার কথা বলে, মানুষই যাদের ঈশ্বর। সেই সম্প্রদায়টির নাম ‘বলরামী’ বা ‘বলা হাড়ির মত।’ এক হাড়িপুত্র এই মতের প্রবক্তা। ১৮২৫ সালে বাংলাদেশের মেহেরপুরের এক মালোপাড়ায় জন্ম তাঁর। নাম বলরাম। সেকালে হাড়িদের জীবিকা ছিল শুয়োর চরানো, গাছগাছড়ার ওষুধ বিক্রি, লাঠিয়ালগিরি বা বড়লোকের দারোয়ানি। বলরাম ছিলেন মেহেরপুরর বিখ্যাত ধনী পদ্মলোচন মল্লিকের দারোয়ান। একরাতে মল্লিকদের গৃহদেবতার সমস্ত অলংকার চুরি হয়ে গেল। মল্লিক সন্দেহ করল বলরামকে। নিশ্চয়ই সে চুরি করেছে। তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে খুব মার দিলো। মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়েও দিল।

বেশ কয় বছর পর আবার যখন গ্রামে ফিরে এলেন বলরাম, তখন তাকে আর চেনা যায় না। একেবারেই অন্য মানুষ। ধ্যানী সাধক। ভৈরব নদীর ধারে আসন তৈরি করলেন। এরই মধ্যে অলংকার চোর ধরা পড়েছিল। তাই অনুতপ্ত পদ্মলোচন মল্লিক জমি আর অর্থ দিলেন বলরামকে। গড়ে উঠল বলরামের আসন। দীর্ঘদিনের ব্রাহ্মণশোষিত অনন্তজ কৈবর্ত, বেদে, বাগদি, নমঃশূদ্ররা এসে বলরামের শিষ্য হতে লাগল দলে দলে। দেখতে দেখতে বিশ হাজার ভক্ত হয়ে গেল।

প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন বটে বলরাম। একটা ঘটনার কথা বলি। আশ্বিন মাস ছিল তখন। একদিন ভৈরব নদীতে পিতৃপুরুষের নামে তর্পণ করছেন ব্রাহ্মণরা। অঞ্জলি ভরে নদীর জল নিয়ে পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে পিতৃপুরুষের ধ্যান করতে করতে হঠাৎ দেখলেন অনতিদূরে বুকজলে দাঁড়িয়ে একজন অন্তজ মানুষ তর্পণ করছে। ভালো করে দেখে তারা চিনতে পারলেন মালোপাড়ার বলরাম হাড়িকে। কী স্পর্ধা তার! ব্রাহ্মণের পুকুরে ব্রাহ্মণদের মতো তর্পণ করছে! পরিহাসের সুরে এক ব্রাহ্মণ বলে উঠলেন, ‘কী রে বলা, তোরাও কি আজকাল আমাদের মতো পিতৃতর্পণ করছিস নাকি?’ জবাবে বলরাম বললেন, ‘আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই, আমি আমার শাকের ক্ষেতে জলসেচ করছি।’ ব্রাহ্মণদের তো বিশ্বাসই হলো না যে পুকুরে তারা তর্পণ করছেন সেই পুকুরের জল শাকক্ষেতে যেতে পারে! এক ব্রাহ্মণ বললেন, ‘বলিস কী? এখানকার জল তোর জমিতে যাচ্ছে কী করে? আকাশ দিয়ে নাকি?’ বলরামের সকৌতুক উত্তর, ‘আপনাদের তর্পণের জল কী করে পিতৃপুরুষের কাছে যাচ্ছে? আকাশ দিয়ে? বুঝলেন ঠাকুরমশায়, আপনাদের জল যেমন করে পিতৃপুরুষরা পাচ্ছেন আমার জলও তেমনি করে জমিনে যাচ্ছে।’ অকাট্য যুক্তি বটে।

সংকীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে বাঁচা নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা ছিল বলরামের মূলমন্ত্র। তাই মূর্তিপূজা, অপদেবতা পূজা, অকারণ তীর্থভ্রমণ, দেবদ্বিজে বিশ্বাস, শাস্ত্র নির্ভরতা ও আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে তার অস্ত্র ছিল জাতভেদহীন সমন্বয় এবং নতুন মানবতাবাদী সহজ ধর্মাচরণ। কর্তাভাজা সম্প্রদায় তো অবতারতত্ত্ব মানত, বলরাম তাও মানেননি। যুগলভনজও না। বৈষ্ণবতারও বিরোধী ছিলেন। গুরুবাদেও তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তাঁর সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের কেউ নেই। একেবারে নিম্নবর্ণের হিন্দু, অন্ত্যজ ব্রাত্য সব মানুষ আর কিছু দলছুট মুসলমান তাঁর শরণ নিয়েছিল। তাঁর সম্প্রদায়ে মুরুব্বিদের অত্যাচার নেই। উচ্চবর্ণ নেই। গুরু নেই। তাই গদি নেই, খাজনা নেই, মন্ততন্ত্রের অভিচার নেই, আখড়া নেই, আসন নেই। আসন মোট দুই জায়গায়: বাংলাদেশের মেহেরপুর, পশ্চিমবঙ্গের নিশ্চিন্তপুর। আলখাল্লা, জপমালা, তসবি বা খেলকা এদের নেই।

তার মানে বলরাম ও তাঁর অনুসারীরা প্রচলিত সব ধর্মমতের বিরোধী। প্রচলিত ঈশ্বরেও তারা অবিশ্বাসী। তারা মনে করে, ‘যাহা দেখিনি নয়নে তাহা ভজিব কেমনে?’ তাই তারা অদেখা কোনো ঈশ্বরের ভজনা করে না, করে হাড়িরামের ভজনা। হাড়িরাম মানে বলরাম। হাড়িরাম রক্তমাংসের মানুষ। তারা এই রক্তমাংসের মানুষেরই ভজনা করে। মানুষই তাদের ঈশ্বর। এই বলরামীদের মতো অসংখ্য মরমি সম্প্রদায় রয়েছে বাংলায়। সবার একটাই কথা,মানুষ ভজ মানুষ ধরো শোন বলিরে পাগল মন।

‘গভীর নির্জন পথে’ পড়ে জেনেছি, বাস্তব জগৎ ও জীবনকে, দেহ এবং দেহাশ্রিত গভীর অনুভবগুলোকে বাউল-ফকিররা কোনো আনুমানিক যুক্তি বা কাল্পনিক ঈশ্বর দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। পরলোকের স্বর্গ বা নরকে নেই তাদের আস্থা। জৈব রাসায়নিক ব্যাখ্যায় সাধকেরা রজঃবীজে জীবন ও জগতের উদ্ভব নির্ণয় করে, মান্য করে চার ভূতকে। মানুষে, আদিশক্তি প্রকৃতিতে নির্মাণ করে প্রাণ, প্রাণী। কল্পিত পরলোক, স্বর্গ, পুনর্জম্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে বাউল-ফকিররা অগ্রাহ্য করে। মানুষ ছাড়া স্রষ্টাতেও তাদের অমনোযোগ।

যা ভারতীয় তাই পশ্চাদপদ এবং ইউরোপীয় মূল্যবোধ মানেই সভ্যতা, প্রগতিশীলতা―এই মতবাদ উপনিবেশ বা নয়া উপনিবেশ ভারতবর্ষে এখনও প্রবল। যারা বলেন বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, বস্তুবাদ, মানবতাবাদ আমরা ইউরোপের বর্জুয়া সভ্যতা থেকে গ্রহণ করেছি, এগুলো আমাদের ছিল না, তাদের যুক্তি খণ্ডন করে সুধীর চক্রবর্তী আমাদের জানিয়েছেন, ভারত আধ্যাত্মিকতার দেশ। অথচ পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, বাস্তুবিদ্যা, চিকিৎসা-বিজ্ঞান প্রভৃতি এখানে ঐতিহাসিক নিয়মে বিকশিত হয়েছিল। প্রাক-পলাশী বাংলার কৃষি ও শিল্প প্রযুক্তি সেকালের ইংল্যান্ডের চেয়ে অনগ্রসর ছিল না। ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান সমাজে কেবল আধ্যাত্মিকতা, অনড় অচলায়তন এবং কুসংস্কার ছিল না। এখানে বহু মতবাদের সংঘাত ছিল। ছিল ধর্মীয় ভাববাদ, ধর্মাচারের, পারলৌকিক কল্পনাদির তীব্র প্রতিবাদ।

জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার সমান্তরালে এই বাংলায় বিকশিত হয়েছিল এক অমল মানবতা। শাস্ত্র এবং পুরোহিত-তন্ত্র মানুষকে খণ্ডখণ্ড করে ধর্ম, ঈশ্বর ও আচারের নামে যে সম্প্রদায় রচনা করেছিল; চর্যাপদ, ভক্তি আন্দোলন, বাউল-ফকির মতবাদ সেগুলোকে ধিক্কার দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা প্রত্যাখ্যান করেছে শাস্ত্রীয় ধর্ম। মানুষকে কেন্দ্রে বা সবার উপরে রেখে তারা পরলোক পাপপুণ্য ও ঈশ্বরকে পুনর্মুল্যায়ন করেছে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনের কর্তৃত্ব বিরোধী এক প্রতিবাদী আন্দোলন। ধর্মাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদ, প্রতিবাদকে রক্ষা ও বহন করে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রাচীন বস্তুবাদী চিন্তার ঐতিহ্য এবং প্রগতিশীলতার ইতিহাস।

কালের উদরে আজ লুপ্ত হলেন সুধীর চক্রবর্তী। একজন সাধক চলে গেলেন, যিনি বাংলাকে বুঝেছিলেন, খুব গভীরভাবে বুঝেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। চলবে