চিত্রকর্ম: প্রকাশ রমন
মরিস ব্লাঁশোর গল্প ‘দিনটার পাগলামি’
বাঙ্লায়ন: রথো রাফিপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২০
এটা আসলে কবিতা, গল্প, গদ্য ও প্রবন্ধের স্বাতন্ত্র্য ও ভেদ বিরোধী একটি কাজ। কবিতার মতো এর বুনন, গল্পের আঁচ আছে, কিন্তু গল্পটা ঠিকঠাক নেই। সময় ও স্থানের স্পষ্টতা যেমন নেই, তেমনি সিদ্ধান্ত, ব্যাকরণ ও যুক্তির হাতে ধরা দিতে না চাওয়া একটি কর্তৃত্ব বিরোধী, বিশৃঙ্খল সত্তার ক্ষুদে মানচিত্র। এক প্রকার আধুনিকতাবাদী বা এনলাইটেনমেন্টের চরম চাওয়া স্পষ্টতা ও সব বুঝে ফেলা বা ফেলতে চাওয়া মনোভাব বা ঝোঁকের বিরুদ্ধে সাহিত্যের একটি ক্ষুদে টুকরো। ব্লাঁশো, জর্জ বাতাই-রাই উত্তর আধুনিক দর্শন ও সাহিত্যের ঊষা-মনীষা। —রথো রাফি
শিক্ষিত নই আমি, মুর্খও নই। আনন্দকেও জেনেছি আমি। এ কথা খুব অল্পই প্রকাশ করতে পারে যে: আমি জীবন্ত, এবং এ জীবন সবচেয়ে বড় আনন্দটাই দিয়েছে আমাকে। এবং মৃত্যু সম্পর্কে কি বলা যায়? যখনই মরতে বসি (বস্তুত এখন যেকোনো মুহুর্তেই), আনন্দের সীমা থাকবে না আমার, আমি মৃত্যুর পূর্বস্বাদ নিয়ে কথা বলছি না, যা তিক্ত, ক্ষয়িত এবং প্রায়ই অগ্রহণযোগ্য। দুর্ভোগ সংবেদনকে ভোঁতা করে দেয়। কিন্তু এটা উল্লেখ করার মতোই এক সত্য, আর আমিও এ বিষয়ে নিশ্চিত: আমি অসীম আনন্দ পেয়েছি বেঁচে থাকার ভেতর, এবং আমি মরার ভেতরও অসীম আত্মতুষ্টি লুটে নেব।
আমি ঘুরে বেড়িয়েছি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। আমি একটা মাত্র জায়গাতেই থেকেছি এবং থাকতাম একটামাত্র রুমেই। ছিলাম তো অনেক গরিব, তারপর অধিক ধনী হলাম, তারপর অনেক লোকের চেয়েই অধিক গরিব হতে থাকলাম। শিশু হিসেবে আমার অনুরাগের সীমা-পরিসীমা ছিলো না। যা-ই চেয়েছি, দেয়া হয়েছে আমাকে। আমার শৈশব হারিয়ে গেছে, যৌবন পড়ে রইলো পেছনে। এ কোনো বিষয়ই না। যা ঘটছিল খুশি আমি সে-নিয়ে, যা ঘটছে তা নিয়েও খুশি, এবং যা আমার জন্য ঘটার অপেক্ষায়, আমার সাথে ঠিকই মানিয়ে যাবে, মানিয়ে যাবে বেশ ভালোভাবেই।
আমার জীবন কি অন্যলোকদের জীবনের চেয়ে বেশি ভালো? হতে পারে। আমার মাথার উপর একটা ছাদ রয়েছে, আর অনেকেরই তা নেই। আমার কোনো মৃগীরোগ নেই, আমি অন্ধ নই, আমি দেখতে পাই পৃথিবীটাকে— কী অতুলনীয় সুখ আমার! এই দিনটাকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি, এর বাইরে কিছুরই অস্তিত্ব নেই। কে একে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে? যখন দিনটা মিলিয়ে যাবে, আমিও এর সাথে বিলীন হয়ে যাব— একটা চিন্তা, একটা নিশ্চয়তা, যা আমাকে পরম আনন্দমগ্ন করে রাখে। আমি লোকজনকে ভালোবেসেছিলাম, তাদের হারিয়েও ফেলেছি আমি। আমি পাগলা হয়ে গেলাম, যখনই আমার ওপর এসে ঘুষিটা পড়লো। কারণ এ ছিল একটা নরক। আমার পাগলামোর কোনো সাক্ষি ছিল না। কারণ আমার ক্রোধ ততটা স্পষ্ট ছিল না, আমার একেবারে ভেতরকার সত্তাটিই ছিল শুধু বদ্ধ উন্মাদ।
মাঝে মাঝে আমি ভীষণ রেগে যেতাম। লোকজন হয়তো আমাকে বলতো, ‘তুমি এত শান্তশিষ্ট কেন?’ কিন্তু আমি আপাদমস্তক লিঙ্গপা একেবারেই দগ্ধ অনুভব করতাম; রাতে রাস্তা দিয়ে হয়তো ছুটতাম আর হয়তো চেঁচিয়ে বেড়াতাম; দিনের বেলা ঠিকই শান্তভাবে কাজ করতাম।
অল্প কিছুদিন পরই পৃথিবীটার পাগলামি ফেটে পড়লো। এই বাঁধার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনেকের মতো আমিও ছিলাম পাগলপারা। কেন? কোনো কারণই নেই। বন্দুকগুলো থামতো না। আমি নিজেকে বললাম, তুমি কী করছো, ঈশ্বর? সেই চিন্তাতেই আমার পাগল হওয়া থেমে গেল। পৃথিবীটা দ্বিধা করলো, তারপরেই তার ভারসাম্যটা ফিরে পেল। যেহেতু যুক্তিবোধ ফিরে এলো আমার, ফিরে এলো স্মৃতি তার সাথে, এবং আমি দেখতে পেলাম, এমনকি নিকৃষ্ট দিনেও, যখন ভাবতাম আমি ভীষণভাবে এবং পরিপূর্ণভাবেই অসুখী-দুর্ভাগা, তবু আমি, প্রায় সবসময়েই, ছিলাম সুখ-চূড়ায়। এটা আমাকে সুযোগ দিয়েছিল কিছু একটা নিয়ে ভাবার।
এই আবিষ্কার সুখকর কিছু ছিল না। মনে হলো, আমি হারাচ্ছি বহুকিছুই। নিজেকে জিগ্যেস করলাম, আমি কি দুঃখী ছিলাম না? আমার জীবন ধসে পড়ছে বলে কি অনুভব করতাম না আমি? হ্যাঁ, সত্যিই ছিল বটে সেটা। কিন্তু প্রতিটি মিনিট, যখন আমি রুমের একটা কোনায় বসে থাকতাম নড়চড়বিহীন, রাতের নীরবতা আর মেঝের সুস্থিতি আমাকে শ্বাস ফেলার সক্ষমতা ফিরিয়ে দিতো, আর প্রশান্তির মাঝে বিশ্রামে ডুবে থাকার ক্ষমতাও ফিরে পেতাম আমি।
মানুষ মৃত্যুর কাছ থেকে পালাতে চায়, কী অদ্ভুত জীব তারা! এবং এদের কেউকেউ ‘মরে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি’ বলে হাউমাউ জুড়ে দেয়। কারণ তারা জীবন থেকে পালাতে চায়, ‘এই কী জীবন, আমি আমাকে খুন করে ফেলবো। আমি হেরে গেলাম!’ এ খুবই দুঃখজনক আর অদ্ভুত, এটা তো একটা ভুলই। এর বাইরেও আমি এমনসব লোকের সংস্পর্শে এসেছি যারা জীবনকে কখনো বলেনি, ‘থামো, শান্ত হও!,’ যারা কখনো মৃত্যুকে বলেনি, ‘পালাও!’ অধিকাংশ মহিলাই সুন্দর সৃষ্টি, সবসময়েই। লোকেরা আতঙ্কে চাবকানো, রাত তাদের সবলে ভেদ করে যায়, তারা দেখতে পায় তাদের পরিকল্পনা ধসে পড়েছে, তাদের সমস্ত কর্ম ধুলো হয়ে যাচ্ছে। যারা কিনা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যারা কিনা পৃথিবীটা সৃষ্টি করে নিতে চেয়েছিল, তাদেরকে বিস্ময়ে বোবা হয়ে পড়তে দেখা যায়; দুমড়ে মোচড়ে যায় প্রত্যেকটা বিষয়।
আমি কি আমাকে বিচারের প্রক্রিয়াগুলি বর্ণনা করতে পারি? হাঁটতে পারতাম না আমি, পারতাম না শ্বাস নিতে, কিংবা খেতে। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস ছিল পাথরের তৈরি, আর শরীরটা ছিল জলের, এরপরেও আমি তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছিলাম। একদিন তারা আমাকে মাটির উপর ছুঁড়ে ফেললো; ডাক্তাররা কাদায় লেপ্টে ফেললো আমাকে। ঐ মাটির তলায় কোন কর্ম সমাধা হচ্ছিল! কে বললো এটা ঠাণ্ডা ছিল? তা ছিল আগুনের বিছানা, কাঁটার ঝোপ ছিল সেটা। যখন জাগলাম, কিছুই অনুভব করতে পারলাম না। আমার স্পর্শ করার অনুভূতি আমার থেকে ছয় ফুট দূরে ভেসে বেড়াচ্ছিল; যদি কেউ আমার রুমে ঢুকতো, চেঁচিয়ে উঠতাম আমি, কিন্তু চাকুটা নির্বিকার কেটেই যাচ্ছিল আমাকে। হ্যাঁ, আমি একটা কঙ্কালেই পরিণত হলাম। আমার এই হালকাপাতলা গড়ন রাতে জেগে উঠতো আমার সামনে, আমাকেই ভয় দেখাতে। এভাবেই এ আবির্ভূত হতো এবং মিলিয়ে যেত, আঘাত করতো আমাকে, একেবারেই ক্লান্ত ও নিঃশেষ করে ফেলতো, ওহ, নিশ্চিতভাবেই ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম আমি।
আমি কি অহংকারী? মাত্র অল্প কজনের সামনেই আমি ক্লান্ত অনুভব করি, মায়া হয় না কারো জন্যেই, খুব কমই কাউকে তুষ্ট করতে চাই, খুব কম সময়েই তুষ্ট হতে চাই, এবং আমি যে কিনা নিজে কোথায় আছি এ বিষয়ে অনভূতিশূন্য বলা যায়, তাদের মাঝে দুর্ভোগ পোহাচ্ছি, তাই তাদের মৃদুতম দুশ্চিন্তাও আমার জন্য সীমাহীন দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এবং এমনকি তাও, যদি আমাকে করতে হয় তো আমি সচেতনভাবেই তাদের উৎসর্গ করে দিই। আমি সুখের প্রতিটি অনুভূতি থেকে তাদের বঞ্চিত করি, (কখনো কখনো তাদের খুন করি)। পরিপক্কতার শক্তিতে আমি কাদাভরা ডোবা থেকে নিজেকে উঠিয়ে আনলাম। এর আগে কী ছিলাম আমি? ছিলাম একটা জলের ব্যাগ, জীবনশূন্য একটা বাহুল্য, গতিহীন খা খা একটা গর্ত। (যদিও তখনো জানতাম আমি, কে ছিলাম, বেঁচে ছিলাম আমি, কিছু-না’র মাঝে আমি তলিয়ে যাইনি।) লোকজন বহু দূরদূরান্ত থেকে আসতো আমাকে দেখতে। শিশুকিশোররা খেলতো আমার কাছাকাছি। মাটির উপর নিচু হয়ে শুয়ে পড়তো মহিলারা, আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। তখন তরুণ ছিলাম আমি। কিন্তু ফাঁপা শূন্যতা নিশ্চতভাবেই নিরাশ করলো আমাকে।
ভীতু নই আমি, আমাকে চারদিক থেকে আঘাতের পর আঘাত করা হলো। কেউ একজন (এক লোক বুদ্ধির প্যাঁচ কষে) আমার হাতটা টেনে নিলো এবং তার হাতের চাকুটা আমার মুঠোয় ঢুকিয়ে দিলো। সবজায়গা রক্তে সয়লাব। এরপরই সে কাঁপতে লাগলো। সে তার হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো, যেন আমি হাতটাকে টেবিলের সাথে গেঁথে ফেলতে পারি কিংবা দরজাতে চেপে ধরতে পারি। কারণ সে আমাকেও তেমনই আঘাত করেছে, লোকটি একটা ঘোর উন্মাদ। তার মনে হলো সে এখন আমার বন্ধু। সে তার বউটাকে আমার বাহুর মাঝে চেপে ধরলো। সে চেঁচাতে চেঁচাতে আমাকে রাস্তায় অনুসরণ করতে থাকলো, ‘আমি একাট হাবড়া, স্বীকার করছি, আমি অনৈতিক এক পাগলাঘোরের খেলমাত্র, স্বীকার করছি আমি।’ এক অদ্ভুতুড়ে পাগলামি ছাড়া এ আরকি। এরই মধ্যে রক্ত আমার একমাত্র স্যুটের উপর দিয়ে গড়াতে লাগলো।
শহরেই আমার বসবাস প্রায় সারাক্ষণের। কিছুক্ষণের জন্যই কেবল আমি সাধারণের জীবন যাপন করে থাকি। আমি আইনে আকৃষ্ট ছিলাম, ভিড় আমি পছন্দ করতাম। অন্যান্য লোকের মাঝে আমি ছিলাম অচেনা। কেউ না আমি, এ দিক থেকে ভাবলে আমি ছিলাম স্বাধীন। কিন্তু একদিন আমাকে ক্লান্ত করে ফেলে আমার এই পাথরবৎ থাকা, যা নিঃসঙ্গ মানুষকে নিয়ে মৃত্যুর সাথে জুয়া খেলে। আইনকে প্রলুব্ধ করতে আমি শে-কে নরোম স্বরে বললাম, ‘এখানে আসো, তোমার মুখোমুখি হতে দাও।’ (এক মুহূর্তের জন্য আমি শে-কে পাশে সরিয়ে নিতে চাইলাম।) এটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ আবেদন। কী করতে পারতাম আমি, যদি শে উত্তর দিতো? বলতেই হয় যে, আমি অনেক বই পড়েছি। আমি যখন হারিয়ে যাব, ঐসব গ্রন্থরাজি বেখায়েলেই পরিবর্তিত হয়ে যাবে; পাতার কানি প্রশস্থ হবে আরো, চিন্তা আরো কাপুরুষতায় পর্যবসিত হবে। হ্যাঁ, আমি অনেক মানুষের সাথেই আলাপ করেছি, আমি এখন এ দিয়েই আচ্ছন্ন আছি, প্রতিটা মানুষই আমার কাছে একেকটা পরিপূর্ণ মানুষ। ওইসব বিশাল অপর মানুষেরাই আমাকে অনেক বেশি গড়েপিটে নিয়েছে, তা যতটা-না আমি নিজেই পছন্দ করেছি। এখন আমার জীবন বিস্ময়কর রকম নিরাপদ; এমনকি মারাত্মক রোগগুলোও আমাকে আক্রমণ করা খুব কঠিন মনে করে। দুঃখিত আমি, কিন্তু নেহায়েত অল্প কজন অপরকে কবরে ঢোকাতে হবে, নিজে কবরে ঢুকবার আগে, আর তা আমি করবোই।
আমি দারিদ্রে তলাতে লাগলাম। ধীরে, এটা আমাকে ঘিরে বৃত্তগুলো আঁকছিল। প্রথমটা মনে হলো সবকিছুই ত্যাগ করেছে আমাকে। শেষটায় মনে হলো, যে আমাকে ত্যাগ করবে সে হলো আমি নিজেই। একদিন আমি শহরটিতে নিজেকে বন্দি দেখতে পেলাম। ঘুরে-বেড়ানো তখন কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি টেলিফোনের নাগালে থাকতে পারতাম না। আমার জামা কাপড় একে একে ছিঁড়ে যেতে লাগলো। ঠাণ্ডায় ভুগতে লাগলাম। বসন্ত বড়ই দ্রুত। আমি লাইব্রেরিগুলো যেতাম। এজনের বন্ধু হলাম আমি, যে কাজ করতো একটা লাইব্রেরিতে, এবং সে আমাকে খুব গরম একটি বেজমেন্টের নিচে নিয়ে গেল। তার উপকারের জন্য আমি উঠেপড়ে লাগলাম। চিপা পথে ছুটাছুটি করলাম এবং বই এনে দিলাম তাকে। যে সমস্ত বই সে তার পাঠের বিষণ্ণ ইচ্ছের দিকে ছুঁড়ে দিলো। কিন্তু সেই ইচ্ছে আমার বিরুদ্ধে সেসব শব্দকেই জড়ো করলো কেবল, যে সব শব্দ আমার প্রতি খুব একটা সদয় ছিল না; আমি এর চোখের সামনে আরো ক্ষুদ্র হয়ে গেলাম। এর চোখ যেহেতু দেখতে পাচ্ছিল, যা ছিলাম আমি, একটা পোকা, দারিদ্রের অন্ধকার থেকে উঠে আসা একটা দাঁড়াময় প্রাণী। কে ছিলাম আমি? আমার প্রশ্নের উত্তর যোগাতে এটা আমাকে আরো দ্বিধাজটিল অবস্থার মাঝে নিক্ষেপ করলো।
বাইরে আমি এক পলক দেখেছিলাম। আমার কয়েক পা দূরে রাস্তার একেবারে কোনাটায় আমি জায়গাটা থেকে চলে যাচ্ছিলাম প্রায়। বেবি-ক্যারিজ নিয়ে চলতে থাকা এক মহিলা থামলো সেখানে। তাকে স্পষ্টভাবে দেখতেও পাচ্ছিলাম না। ক্যারিজটাকে বাহির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টাটা তার দেহ ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছিলো। সেই সময় সেই দরজা দিয়ে ঢুকতে এক লোক এগিয়ে এলো, যাকে দেখতে পাইনি আমি। সে এরই মধ্যে চৌকাঠে পা ফেলেছিল। তখন পিছন ফিরলো আর বেরিয়ে এলো আবার। যখন সে দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সামনে দিয়ে বেবি ক্যারিজটা এগিয়ে যাচ্ছিল। চৌকাঠ পার করতেই ক্যারিজটাকে একটু তুলে ধরা হলো, এবং তরুণী নারীটি মাথা তুলে লোকটিকে দেখলো একবার। এরপরই ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই সংক্ষিপ্ত দৃশ্যটিই আমাকে উত্তেজিত করে একেবারে মানসিক বিকারগ্রস্ততার দিকে ঠেলে দিলো। আমি নিশ্চিতভাবেই নিজের কাছে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারি না এটা। এবং তারপরও আমি এ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম, আমি মুহূর্তটিকে নিঃশেষ করে ফেলেছি, যখন কিনা দিনটি একটা বাস্তব ঘটনার গায়ে হোঁচট খেয়ে নিজেরই সম্পাদিত কাজের দিকে যেতে তাড়াহুড়ো শুরু করেছে। তাহলে শুরু হলো, নিজেকে বললাম, সমাপ্তি তাহলে শুরু হলো; কিছু একটা ঘটছে, সমাপ্তিটাই তাহলে শুরু হচ্ছে। আমি আনন্দে ডুবে গেলাম।
আমি বাড়িটাতে গেলাম কিন্তু ভেতরে ঢুকলাম না। খোলা গেট দিয়ে আমি ভেতরবাড়ির উঠোনের ওই কালো কিনারটা দেখতে পেলাম। আমি বাইরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি খুবই শীতার্ত ছিলাম। ঠাণ্ডা আমার মাথা থেকে পা অবধি আমাকে তলিয়ে ফেললো। আমি অনুভব করলাম, ধীরে আমার সর্বোচ্চ সহনশীলতা এই সীমাহীন শীতের মাত্রায় পৌঁছে গেছে। তা বাড়তে লাগলো শান্তভাবে, নিজের সত্যকার স্বভাব অনুযাযী। আমি এই সুখের মাঝে ঝুলেই রইলাম, এবং এই নিপুণতায়। কেননা আকাশ ছোঁয়া একটা পাথরের মতো মনে হলো মাথাটা আমার, আর পা গেঁথে আছে মাটিতে। আর এসব একেবারে বাস্তব এবং সঠিক, লিখে নিন।
আমার কোনো শত্রু নেই। কেউই আমারে পুছে না। কখনো কখনো আমার মাথার ভেতর বিশাল নিঃসঙ্গতা শুরু হয় এবং সারাটা জগৎ এর ভেতর সেঁধিয়ে যায়। কিন্তু বেরিয়েও আসে অনাহতভাবেই, কোনো আঁচড় না-খেয়েই, কিছুই না-হারিয়ে। আমি আমার দৃষ্টি হারিয়ে ফেললাম প্রায়। কারণ কেউ একজন আমার চোখের মাঝে গ্লাশ ভেঙেছে। ওই আঘাতটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, আমাকে তা স্বীকার করতেই হবে। আমার মনে হচ্ছিল, আমার কিছুটা শক্তি দরকার যা আমার নেই। আমাকে বলা হলো, ‘তুমি তোমার সমস্যাগুলোকে ব্যাপক তুষ্টিসহকারেই মেনে নিয়েছো।’ এ আমাকে বিস্মিত করলো। বিশ বছর বয়েসে, এই একই পরিস্থিতিতে, আমাকে হয়তো কেউ লক্ষই করতো না। চল্লিশে, বেশ গরিব, আমি ক্রমে কপর্দকহীন হতে থাকলাম। এবং কোত্থেকে এই হতাশ চেহারাটা বেরিয়ে এসেছিল? আমার মনে হলো, এটি আমি রাস্তাতেই এটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। রাস্তাগুলো আমাকে ধনী করলো না, যেকোনো কারণেই হোক, তাদের তা করা উচিত ছিল।
অনেকটা বিপরীতভাবেই ফুটপাত ধরে যখন আমি হাঁটছিলাম। সাব-ওয়ের উজ্জ্বল আলোর ভেতরে ঢুকে পড়লাম। পরিচ্ছন্ন এভিনিউ ছেড়ে দিলাম। যেখানে শহরটি অপূর্বভাবে আলোক-বিচ্ছুরণময়। আমি হয়ে পড়লাম একেবারেই বিমর্ষ, বিনম্র আর ক্লান্ত। নামহীন ভয়ের ভীষণ আঘাত হজম করতে করতে আমি আরো বেশি মনোযোগ দিলাম। কারণ এই ধস আমার জন্য ছিল না, এবং আমারই বানানো, বানোয়াট আর আকারহীন একটা কিছু; আর এই কারণেই মনে হলো এটা ক্রিয়া করলো, এবং করলো নির্লজ্জভাবেই। দারিদ্র নিয়ে যেটা অস্বস্তির ব্যাপার, সেটা হলো এটা দেখা যায়, এবং যেই দেখে সেই ভাবে: তুমিতো দেখতেই পাচ্ছ, আমাকে শুধু দোষাই হচ্ছে; আমাকে আঘাত করছে কে? কিন্তু আমি কোনোভাবেই আমার জামাকাপড় ঘিরে কোনো ধরনের বিচার আশা করছি না। তারা আমাকে বললো, (অনেক সময় ডাক্তার লোকটি, অনেক সময় নার্সটি), ‘তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ, তোমার মেধা আছে; এর ব্যবহার না করায়, এ যদি দশজনের মাঝে বিতরণ করা হতো, যারা এর অভাবে ভুগছে, তাহলে তাদের বাঁচার সুযোগ দেয়া হতো, তুমি তাদের বঞ্চিত করছো, যা তাদের নেই তা থেকে, এবং তোমার দারিদ্র, যাকে এড়ানো সম্ভব হতো, তা তাদের প্রয়োজনকেই কটাক্ষ করছে।’ আমি জিগ্যেস করলাম, `এই বকরবকর কেন? আমি কি নিজের জায়গাটুকু চুরি করে নিচ্ছি? আমার কাছ থেকে তা ফিরিয়ে নিন।’ আমি অনুভব করলাম, অন্যায় চিন্তা আর যুক্তির ঘুরপ্যাঁচ আটকে ফেলেছে আমাকে।
আর যারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তারা কারা? এক অদৃশ্য শিক্ষা, যা কেউই প্রমাণ করতে পারবে না, এবং যেটা আমি নিজেও খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি শুধু। একজন শিক্ষিত লোক ছিলাম আমি। তা কিন্তু সবসময়েই নয়। মেধাবী? কোথায় ছিল এতসব মেধা, যা বিচারে বসা জোব্বা-ঢাকা বিচারকদের মতো কথা বলতে বাধ্য হয়েছিল, আর প্রস্তুত ছিল আমাকেই দোষারোপ করতে দিনরাত? ডাক্তারদের বেশ ভালই লেগেছিল আমার। এবং তাদের সন্দেহের মাঝেও নিজেকে অপমানিত মনে হয়নি। যেটা বিরক্তিকর তাদের কর্তৃত্ব সময়ের সাথে সাথে অধিক দৃশ্যমান হতে থাকে। কেউ এ নিয়ে সতর্ক থাকে না, কিন্তু এসব লোক হলো রাজা। আমার রুমটা খুলেই তারা হয়তো জিগ্যেস করবে, ‘এখানে যা আছে সবই আমাদের করতলে। আমার খাপছাড়া চিন্তার অতিক্ষুদ্র ফেলনা কোনো টুকরার উপরেও তারা ঝাঁপিয়ে পড়তো: ‘এসবই আমাদের।’ তারা আমার গল্পকেই চ্যালেঞ্জ করতো: ‘কথা বলো,’ এবং আমার গল্পটা নিজেই তাদের ইচ্ছের সেবায় লেগে যেতো। দ্রুতই আমি আমার-আমাকে মুক্ত করে দিতাম। আমি আমার রক্ত আমার ভেতরকার সত্তাটাকে তাদের মাঝে বিলিয়ে দিতাম। তাদেরকে ধার দিতাম আমার জগৎটাই, আমার দিনটাও দিয়ে দিতাম তাদেরকে। তাদের একবারে চোখের সামনেই, যদিও তারা বিস্মিত হতো না মোটেও, এক ফোঁটা জলে পরিণত হতাম আমি, কালির একটা চিহ্নে। আমি তাদের কাছে নিজেকে সংক্ষিপ্ত করে নিলাম। আমার পূর্ণ উপস্থিতি তাদের মাঝ দিয়ে পূর্ণ দৃশ্যমান হয়ে হয়ে উঠলো, এবং যখন শেষাবধি কিছুই আর উপস্থিত রইলো না, কেবল আমার পরিপূর্ণ শূন্যতাই দৃশ্যমান রইলো, আর দেখার মতো সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, তারা আমাকে দেখে দেখে নিঃশেষও করে ফেলেছিল। খুবই বিরক্তিকর। তারা উঠে দাঁড়ালো আর চিৎকার করে উঠলো, ‘তাহলে কোথায় তুমি? কোথায় লুকিয়ে আছো? লুকিয়ে থাকা নিষেধ, এটা একটা অপরাধ,’ ইত্যাদি।
তাদের পেছনে আইনের ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। প্রত্যেকেই যে আইন জানে তা নয়, যা সংকটময় এবং তেমন-একটা মানা সম্ভব খুব-কম সময়েই; এই আইন ভিন্ন জিনিস। শে-ও বিপদের শিকার হওয়া থেকে অনেক দূরে, মনে হচ্ছিল আমি ছিলাম তেমনই একজন যে শে-কে সন্ত্রস্ত করছিলাম। তার মতে, আমার দৃষ্টি বিজলি-আঁটা এবং আমার হাত তিক্ততার লক্ষণভরা। আর কী চাই, আইন আমার সমস্ত কর্তৃত্বে উদ্ভটভাবে আস্থা স্থাপন করলো, শে নিজের জানান দিলো, শেষাবধি আমার সামনে নতুজানু হলো। কিন্তু শে আমাকে সুযোগ দিলো না তাকে কিছু জিগ্যেস করার, যখন শে আমাকে স্বীকৃতি দিলো, যেকোনো জায়গায় থাকার অধিকারের, তার মানে হলো, তখন কোথাও আমার আর কোনো জায়গাই নেই। যখন শে আমাকে কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বে স্থাপন করলো, এর অর্থ হলো তখন আমার কিছু করারই কর্তৃত্ব নেই আর। যদিও শে নিজে নত হলো, আপনারা আমাকে আর শ্রদ্ধা করবেন না।
জানি তার একটা লক্ষ্য ছিল আমাকে বোঝানো যে, ‘দেখো, বিচার শেষ।’ শে হয়তো বলতো আমাকে, ‘এখন তুমি একটা ব্যাতিক্রম ঘটনামাত্র; কেউই তোমার কিছু করতে পারবে না। তুমি কথা বলতে পারো, কেউই তোমাকে বিশ্বাস করবে না; শপথ এখন তোমাকে আর বেঁধে রাখবে না; তেমন কাজকারবার কোনো পরিণতিই ডেকে আনবে না। আমার সবকিছুর মাঝেই কেবল তুমি ঘুরে বেড়াও, এবং এই এখানেই আমি, তোমার চিরকালের সেবাদাস।’ সেবাদাস? আমি কোনো সেবাদাস চাই না, কোনোভাবেই না। শে আমাকে বলতে চাইতো, ‘তুমি তো বিচার ভালবাসো।’
‘হ্যাঁ, আমিতো তাই ভাবি।’
‘তোমার মাঝে বিচারকে কেন তুমি আঘাত করো, যা খুব চোখে পড়ে?’
‘কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে আমার কাছে চোখে পড়ার মতো কেউ মনে হয় না।’
‘যদি বিচার তোমার মাঝে দুর্বলতায় ভোগে, শে-তো অন্যের মাঝেও দুর্বল হয়ে পড়বে, যারা এর কারণে দুর্ভোগেই পড়বে।’
‘কিন্তু এই বিষয়টা শে-কে কখনোই পরোয়া করে না।’
‘সবকিছুই শে-কে মেনে চলে।’
‘কিন্তু আপনি যে বললেন, আমি একটা ব্যাতিক্রমী ঘটনা।’
‘বিশেষ ঘটনা যখন তুমি নিজে করো— আর তা কখনোই নয় যখন তুমি অন্যকে তা করতে দাও।’
শে বাতুল কথায় মন দিলো, ‘সত্য হলো আমরা ফের বিচ্ছিন্ন হতে পারি না। সবখানেই আমি তোমার পিছু নেব। আমি তোমার ছাদের তলায় থাকবো; আমরা একই বিছানায় ঘুম ভাগ করে নেব।’
আমি নিজেকে বন্দি করে রাখলাম। সাময়িকভাবে, তারা বললো আমাকে। ঠিক, সাময়িকভাবে। বাইরে থাকার সময়ে, বাসার আরেক লোক, সাদা দাড়ির এক বুড়ো, আমার কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, এবং মাথার উপরে নানান ভঙ্গি দেখাতে লাগলো। তাকে বললাম, ‘কে তুমি, তলস্তয়?’ এর কারণ, ওই ডাক্তার ভাবলো আমি সত্যিই আবেগ তাড়িত ছিলাম। শেষে আমি আমার পিঠের প্রত্যেকটা লোককে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, শক্তবাঁধনে আঁটা লোকের একটা দল, মধ্যবয়সীদের দল একটা, আধিপত্য বিস্তারের ভুলমোহে পড়লো, এক হতভাগা ছেলেমানুষী, এবং যখন আমি আমার কমরেডদের (কারণ, আর যাইহোক আমিতো আর ঘোড়া নই) প্রায় সবাইকে ধরাশায়ী করলাম, যারা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, তারা আমাকে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করে ফেললো। সে বড়ো সুখের সময়।
আইন আমার আচরণ নিয়ে ব্যাপক, তীক্ষ্ণ-তির্যক ও সজাগ, ‘তুমি ছিলে খুবই অন্যরকম, আগের-তোমাকে যেমনটা জানতাম।
‘খুব বেশি কি বেমানান?’
‘লোকজন তোমার দারিদ্র্য নিয়ে মজা করেনি। তোমার দিকে তাকানো মানে একজনের জীবনকে দেখার মতোই মূল্যবান। আর তোমাকে ভালবাসার মানে তো মরণ। লোকজন গভীর গর্ত খুঁড়ে তোমার দৃষ্টির বাইরে নিজেদের লুকিয়ে রাখার জন্য। একে অপরকে জিগ্যেস করে, ‘লোকটা কি চলে গেছে? পৃথিবীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা-যে আমাদেরকে লুকিয়ে রেখেছে।’
‘তারা কি আমাকে এতো ভয় পায়?’
‘ভয় তোমার জন্য যথেষ্ট ছিল না, হৃদয়ের তল থেকে প্রশংসাও ছিলো না কোনো কাজের, না কোনো মাপাজোখা জীবনও নয়, না বিনয়ে ধুলোয় গড়াগড়িও না। সর্বোপরি, আমাকে নিয়ে কেউ যেন প্রশ্ন করো না। কে আমাকে নিয়ে ভাবার সাহস দেখায়?’
শে আমাকে বিস্মিত করে সফল হলো। শে আমাকে মর্যাদাবান করে তুললো, কিন্তু এর বদলে শে নিজেকেই মর্যাদামতি করতে চাইলো।
‘তুমি ছিলে ক্ষুধার্ত, বেমানান, খুনী, এবং ফুরিয়ে যাওয়া।’
‘বেশ,’ শে-কে বললাম আমি, ‘আমাদের দুজনেরই বন্দি হয়ে থাকার ক্ষেত্রে এসবইতো অনেক বড় কারণ।’
সত্য হলো আমি তাকে পছন্দ করতাম। এইসব পরিপার্শ্বিকে, লোকারণ্যে, শে-ই ছিল একমাত্র নারীস্বভাবা বস্তু। একবার শে তার হাঁটু ছুঁতে দিয়েছিল... এ এক বিস্ময়কর অনুভূতি।
আমি তাকে যতটা পারি বললাম, ‘আমি সে ধরনের লোক নই যে-কিনা হাঁটু ছুঁয়েই তুষ্ট থাকে!’ শে-ও উত্তর দিলো: ‘তা খুবই বাজে ব্যাপার!’
এ ছিল তার অনেক খেলের একটা। শে আমাকে একটুকরো জায়গাই দেখাতো, জানালার এবং ছাদের মাঝামাঝি। ‘তুমি সেখানেই,’ শে বললো। আমি ওই জায়গাটার দিকে কষ্ট করে তাকালাম।
‘তুমি কি ওখানে আছো?’ আমি আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে এর দিকে তাকালাম। ‘বেশ?’ আমার চোখদুটো উড়ে গেছে অনুভব করলাম, আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষত মাত্র এখন, আমার মাথাটা একটা গর্ত, সমস্ত শক্তি কেড়ে নেয়া হয়েছে তেমন একটা ষাঁড় আমি। আচমকা শে চিৎকার করে উঠলো, ‘ওহ, দিনটার সাক্ষি হলাম আমি, হায়রে সর্বনাশ’, ইত্যাদি। প্রতিবাদ করলাম আমি যে, এই খেলা আমাকে ভীষণভাবে ক্লান্ত করে ফেলছিল, কিন্তু শে-তো রাক্ষসের মতো আমার ঐশ্বর্যের ওপরে চেপে বসেই ছিল। তোমার মুখে কে গ্লাশটা ছুঁড়ে মেরেছিল? ওই প্রশ্নটা অন্যসব প্রশ্নকে ছাপিয়ে উঠতে পারতো পুনরায়। এ প্রশ্নটা ওটার তুলনায় বেশি সরাসরি তোলা হয়নি, কিন্তু এ ছিল সেই মোড়টা যেখানে এসে সব পথ মিশে গেছে। তারা আমাকে বুঝিয়ে দিলো যে, আমার উত্তরগুলো কোনোকিছুই উদঘাটন করবে না আর, কারণ বহু-আগেই সব গুমর ফাঁস হয়ে আছে।
‘আর সব যুক্তিই ছিল আর-কথা-না-চালানোর।’
‘দেখো, তুমি একজন শিক্ষিত লোক; তুমিতো জানো নীরবতা মনোযোগ কাড়ে। তোমার বোবামি তোমার সাথেই খুব বোকাসোকা ধরনে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।’
‘আমি উত্তর দিবোই তাদেরকে, তবে ‘আমার নীরবতাতো একবারেই নিখাদ, আমি যদি তা তোমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি, তোমরা একটু এগোলেই ঠিক তার সন্ধান পেয়ে যাবে। এ যদি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে, তাহলে তাতো তোমাদের জন্যই সবচেয়ে ভালো, তাতো সহযোগিতাই করছে তোমাদের, সবটাই বেশি ভালো আমার জন্য, যাকে সহযোগিতা করছো বলে তোমারা দাবি করছো।’ তাই তাদের আকাশপাতাল ঢ়ুঁড়ে-খুঁড়ে বেড়াতে হলো বিষয়টার তল খুঁজে পেতে।
আমি তাদের অনুসন্ধানের সাথে জড়িয়ে গেলাম। তারা সবাই ছিল মুখোশ-পরা শিকারির মতো। কাকে প্রশ্ন করা হচ্ছিল? কারাই বা উত্তর দিচ্ছিলো? একজন হয়ে পড়লো অন্যজন। যেসব কথা তাদের মাধ্যমে উচ্চারিত হলো। নীরবতা তাদের ভেতরে প্রবেশ করলো। অপূর্ব এক প্রতিরোধ, যেহেতু আমিই একমাত্র লোক যে এ বিষয়টি লক্ষ্য করেছিল।
আমাকে জিগ্যেস করা হলো, যা ঘটেছে ঠিকঠাক বলো আমাদের। গল্প? আমি শিক্ষিত নই; আমি অজ্ঞও নই। আমি আনন্দকে চিনেছি। এ আসলে এক তিলও প্রকাশ করতে পারছে না। তাদেরকে আমি পুরো গল্পটাই বললাম, এবং শুনলো তারা। আমার মনে হলো, কৌতূহল নিয়েই, শুরুর দিকে অন্তত। কিন্তু শেষটা ছিল এক বিস্ময়, আমাদের সবার কাছেই। ‘শুরু ছিল সেটাই,’ বললো তারা, ’এখন ঘটনায় আসো। কী করে ঘটলো এমন? শেষ হয়ে গিয়েছিল গল্পটা!’
আমাকে বলতেই হতো, এ সমস্ত ঘটনা থেকে গল্প গড়ে তুলতেই অপারগ আমি। আমি গল্প-বুদ্ধি হারিয়েছি এক্কেবারেই। বেশ শক্ত কিছু অসুখেরই ফল এটা। কিন্তু এই ব্যাখ্যা তাদেরকে আরো সন্দেহের আবর্তে ফেলে দিল। এরপর এই প্রথম আমি লক্ষ্য করলাম, তাদের মাঝে দুজন লোক রয়েছে। এবং প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বিচ্যুতি শুরু হলো। বস্তুত এমনকি ওদের একজন চোখের ডাক্তার হলেও, এবং অন্যজন মানসিক অসুস্থতার ডাক্তার বলে এর একটা ব্যাখ্যা দেয়া হলেও, ক্রমাগত তারা আমাদের আলাপকে একটা কর্তত্বপরায়ণ ইন্টারোগেশনের রূপ দিচ্ছিল, একগুচ্ছ কঠোর নিয়মরীতি অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ চালাচ্ছিল। অবশ্যই তারা কেউই পুলিশের প্রধান ছিল না। কিন্তু কারণ তারা ছিল দুজন, তারা ছিল তিনজন, আর এই তৃতীয়জনই ছিল একেবারে সন্তুষ্ট, নিশ্চিত আমি, যে একজন লেখক, এক লোক যে কথা বলে, যে স্বতন্ত্র যুক্তি দেয়, ঘটনাগুলো সবসময়েই পুনর্বিবেচনা করতে পারে, যেগুলো সে মনে করতে পারে।
একটা গল্প? না। কোন গল্প নয়, কখনোই নয় আর।
লেখক পরিচিতি: ফরাসি লেখক, দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক মরিস ব্লঁশোর জন্ম ১৯০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। মারা যান ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। জিল দ্যলুজ, মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা ও জঁ-ল্যুক নঁসির মতো উত্তর-গঠনবাদী দার্শনিকদের ওপর তার কাজের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।