মনের যত্ন
শাহিদা আরবী ছুটিপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০১৯
কোনো মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়— কে বলেছে, কেউ দায়ী না? আমরা সবাই দায়ী, সবাই...
এক.
আমার মেয়ের বয়স ছয় বছর। তিন বছর বয়স থেকেই সে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে দিনে দুইবার দাঁত ব্রাশ করে। টুল নিয়ে বেসিনের পাশে দাঁড়িয়ে সে খুব আগ্রহ নিয়ে এই কাজটা করে। যেই বাচ্চা জুতার ফিতাটা পর্যন্ত ঠিক করে বাঁধতে পারেনা, সে এই পার্সোনাল হাইজিনটা ঠিক জানে। একইভাবে সে যখন পড়ে গিয়ে কোথাও ব্যথা পায়, সেই জায়গাটা কাটুক কিংবা না কাটুক, রক্তের কোনো চিহ্ন থাকুক কিংবা না থাকুক— সে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। তার তখন একটা ব্যাণ্ডেজ লাগবে এবং সেই সাথে লাগবে সেই ব্যথা পাওয়া জায়গায় আমার একটা চুমু।
ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ দেয়ার বিষয়টা আমরা সবাই জানি, ক্ষত ঢাকার প্রক্রিয়াটা আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়। যদিও আমাদের সময় অবশ্য এসব ব্যাণ্ডেজ ফেন্ডেজ এত পপুলার ছিল না, তখন ছিল অন্য প্রক্রিয়া। যেমন হাত পা ছিলে গেলে, ঘাস ডলে সে ক্ষতস্থানে তার রস লাগানো, ঠাণ্ডা লাগলে অল্প একটু হলুদ, গরম দুধে দিয়ে সেই দুধ পান করা, খুশ খুশ কাশিতে আদা চা খাওয়া (যদিও এটা ছোটদের জন্য সেভাবে বরাদ্দ ছিল না)। তখন এমন আরো অনেক ঘরোয়া নিরাময় পদ্ধতি ছিল, যা আমাদের তৎক্ষণাৎ ফার্স্ট এইড সার্ভিস দিতো।
আচ্ছা, সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় কি করে শরীরের যত্ন নিতে হবে, কিভাবে সাধারণ ক্ষতগুলো দ্রুত নিরাময় করা যাবে, কিন্তু মনের বিষয়ে আমাদের কিছু বলা হয় না কেন? আমাদের শরীর এক ধরনের যত্ন পায় আর আমাদের মনের স্বাস্থ্যের বিষয়টা আমরা এভাবে চেপে যাই কেন? কেন মনের ফার্স্ট এইড সার্ভিস আমাদের শেখানো হয় না?
স্কুলের প্রিয় বন্ধুর বাবার যখন অন্য জায়গায় ট্রান্সফার হয় তখন সেই প্রিয় বন্ধুকে হারাবার কষ্ট আমরা বুকে চেপে মুভ অন করি, নতুন বন্ধু বানাই, তারপর সেই কষ্ট ভুলে যাই একসময়। কেন? কেন মনের সেই শত শত ক্ষতগুলো আমরা খোলা বাতাসে এমনি এমনি শুকিয়ে নিরাময় করি? কেন আমাদের বাবা মা বলেনি, `ও দূরে চলে গেছে, এটা অবশ্যই খুব দুঃখজনক। কিন্তু ও তো ইচ্ছে করে যায়নি, ওর বাবার ট্রান্সফার হয়েছে। ও তোমার বন্ধু ছিল এবং থাকবে। তুমি ওকে চিঠি লিখতে পারো, ঈদে কার্ড পাঠাতে পারো, স্কুলের ছুটিতে ওর বাসায় ঘুরে আসতে পারো এবং আরো আনন্দের ব্যাপার হলো, তোমার এখন নতুন আরো কিছু বন্ধু হবে, যাদের গল্প ওকে চিঠি লিখে বলতে পারো।`
তাহলে আমরা খুব সহজেই সেসময় গ্রিফ (দুঃখপ্রকাশ) হ্যান্ডেল করাটা শিখে ফেলতাম। চিঠি লিখা, ঈদে কার্ড পাঠানো, নতুন বন্ধু বানানো— এসব আমরা হয়তো এমনেই করেছি, মনের অজান্তে করেছি। কিন্তু ছোটবেলার সেই গ্রিফ বা হারানোটাকে কেউ ঠিক করে আইডেন্টিফাই করেনি। কেউ ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে দেয়নি...
এভাবে অটোমেটিক উপায়ে আমরা অনেকগুলো ঘা শুকাতে শুকাতে বড় হই, তারপর? তারপর বড়বেলার বড় ঘাগুলো নিয়ে আমরা বিপাকে পড়ে যাই। আমরা খুব চাই, ছোটবেলার মতন ঘাগুলো এমনি এমনি শুকিয়ে যাক. কিন্তু বড়বেলার বড় ঘাগুলো আর বাতাসে শুকায় না— একসময় সেখান থেকে ক্যান্সার হয়, আর আমরা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই।
দুই.
ধরা যাক, একটা মেয়ে একটা ছেলের সাথে ব্রেক আপ করেছে. সেই ছেলে যখন তার কাছের কোনো বন্ধুর সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করে, তখন সেই বন্ধুটি ধুম করে বলে ফেলে, ‘আরে ওত একটা মা**, আগেই কইছিলাম দূরে থাক. যাক ব্যাপার না, ভাত থাকলে কাউয়ার অভাব হয় না। তুই এর চেয়ে অনেক ভালো মেয়ে পাবি, মুভি ওন দোস্ত।’
কী হলো এর মানে? সে আপনাকে তার মতোন সমাধান দিয়েছে, মনের খায়েশ মিটিয়ে আপনার এক্সকে গালি দিয়েছে। আপনার পুরো কষ্টের বিষয়টা সে ভাত আর কাউয়ার সাথে তুলনা করেছে। কিন্তু আপনার মনের ক্ষতটুকু সে আইডেন্টিফাই করেনি। বলেনি, ‘দোস্ত, আমি হয়তো তোর মতন করে তোর কষ্ট বুঝবো না। কিন্তু আমারও খুব খারাপ লাগছে। এমন হওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি জানি না আমি কি করতে পারবো, কিন্তু চল, আজকে সারারাত আমার বাসার ছাদে গিটার বাজাই, গান গাই।’
তারপর সেই গান গেতে গেতে বলল, ‘দোস্ত পৃথিবীতে আরো অনেক ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে আছে যে তোকে হয়তো তোর মতন করে ভালোবাসবে, this is not end of the world... আস্তে আস্তে তুইও মুভ অন কর।’
একই ভাষ্য, একই উপদেশ কত আলাদাভাবে দেয়া যায়। কিন্তু তা হয় না, সেই ছেলে আরেক মেয়ের সাথে মুভ অন করে ঠিকই কিন্তু তার মনে থাকে অবিশ্বাস, তার ভালোবাসা নির্মল হয় না, হয় খুব কন্সাস। খুব ছোট থেকে ছোট ভুলে, সেও একসময় তার দ্বিতীয় গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ করে। ব্রেক আপ তার কাছে এখন ডালভাত। কিন্তু ব্রেক আপের সময় সেই মেয়েকে সে তার বন্ধুর শেখানো সেই গালিটা দিয়ে ফেলে, যেই গালি সে আগের জনকে দিতে পারেনি।
তারপর সেই মেয়ের বান্ধবী এই কাহিনি জেনে বলে ওঠে, ‘হারামজাদা কোথাকার, দেখলেই ফালতু মনে হইতো। ওর কপাল তুই ওর সাথে প্রেম করছিস, কাউয়ার মুখে কমলা। বাদ দে, দুনিয়ার আরো কত পোলা তোর জন্য লাইন ধরে আছে। মুভ অন কর।’
মুভ অন এত সহজ? কারো এক পা ভাঙলে তাকে কি বলেন অন্যপা দিয়ে দৌড়াতে? সে পাড়বে? তাহলে কি হলো এটা? কষ্টটার আইডেন্টিফাই হয়েছে? মেয়েটার হয়তো ব্রেক আপ না কিন্তু ছেলেটার দেয়া সেই গালি কুরেকুরে খাচ্ছিল। ছেলেটার সাথে তো তার শুধু মনের সম্পর্ক ছিল না, শরীরেরও ছিল। তাহলে কি সে সত্যি সত্যিই একটা মা**?
শুরু হয় ডিপ্রেশন, আতঙ্ক... ঘৃণা হয় নিজের শরীর, মনকেও... তারপর? তারপর কোনো একদিন সে তার পেছনে ছেলেদের বিশাল লাইন উপেক্ষা করে আত্মহত্যা করে ফেলে। শুধু যদি একবার সেই বান্ধবীটা বলতো, ‘দোস্ত, একেইতো ব্রেক-আপ তার উপর এই কুৎসিত গালি। আমার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু শোন, তুই মোটেও এমন না। আমি জানি তুই কেমন মেয়ে, তোর আব্বা আম্মা জানে তুই কেমন মেয়ে, অমুক ভাই তমুক আন্টি জানে তুই কত লক্ষ্মী। একটা গালি তোকে পাল্টে দেয় নাই। গালি দেয়া না-দেয়া পারিবারিক শিক্ষা। সেই শিক্ষা ওর ছিল না কিন্তু তুইতো ভালো মেয়ে। পুরা পৃথিবীর কাছে তুই যেমন ছিলি তেমনি আছিস। চল আজকে ধানমন্ডির ক্রিমসন কাপে কফি খাই, ফারজানা শাকিলস এ আমার ভ্রু প্লাগ করতে হবে। তোর হেয়ার কালারও যা তা অবস্থা। চল হেয়ার কালারও করে আসি। আজকে আমি সারাদিন ফ্রি।’
আপনি সারাদিন ফ্রি না থাকলেও, বান্ধবীর জন্য হয়ে যান। আপনার বান্ধবীর তৎক্ষণাৎ ফার্স্ট এইড লাগবে, মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড। এই সামান্য চিকিৎসা হয়তো আপনার বান্ধবীর জীবন রক্ষা করতে পারে।
আমাদের মধ্যে কারো কারো বাবা-মাই বন্ধুবান্ধবী, কারো হয়তো দুটোই। তাই, যে যেই বয়সেই থাকুন না কেন, আসুন আমরা মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড শুরু করি...। পার্সোনাল হাইজিন এর পাশাপাশি, ইমোশনাল হাইজিন চর্চা করি. মনের ক্ষতগুলোকে কিভাবে দেখে - শুনে - বুঝে নিরাময় করা যায় সেই চর্চা করি. এই জিনিস পশ্চিমা বিশ্বে ঢুকে গেছে কিন্তু আমাদেরমাঝে ঢুকেনি। এই জিনিস মাথায় ঢুকানোর জন্য টাকা পয়সা না, প্রথমে সচেতনতা দরকার। আসুন, উপরের উদাহরণের মতন - আমরা একজনের ঘৃণা বহন করে আরেকজনের মাঝে ছড়িয়ে না দেই...
পার্সোনাল হাইজিন— যেমন দাঁত ব্রাশ করা, মাথায় শ্যাম্পু করা, নিয়মিত গোসল করা, ডিওড্র্যান্ট ব্যবহার করা— মাত্র পঞ্চাশ বছরে এই বিশ্বে অনেক পপুলার হয়ে ওঠে। তার ফলস্বরূপ বিশ বছরে মানুষের গড় আয়ু ২০-৩০ বছর বেড়ে যায়। জাস্ট একবার ভাবুন, ইমোশনাল হাইজিন মানে নিজের মনের ক্ষত সময় মতোন আইডেন্টিফাই করে নিরাময় করতে জানলে এবং নিয়মিত যত্ন নিতে পারলে কত শত মানুষ বেঁচে যাবে। আসুন শরীরের পাশাপাশি আমরা আমাদের মনের যত্নকেও বাধ্যতামূলক করে ফেলি। তাহলে হয়তো অনেকগুলো হিমু বেঁচে যাবে...