মধ্যযুগের মুসলমান সভ্যতা সম্পর্কে জওহরলাল নেহরু
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৮, ২০২২
কারাগারে বসে জওহরলাল নেহরু ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম সভ্যতা নিয়ে তরুণী কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে বিভিন্ন চিঠিতে যা লিখেছিলেন, মনে হয় সেগুলি পাঠ করলে নতুন কিছু জানার সুযোগ হবে।
মরুভূমির দেশ আরব দেশ। মরুভূমি আর পার্বত্য দেশের অধিবাসীরা সাধারণত কঠোর প্রকৃতির লোক, স্বাধীনতা প্রিয়; সহজে বশ্যতা স্বীকার করে না। আরব সেই সময়ে কখনোই ঐশ্বর্যশালী দেশ ছিল না, কাজে কাজেই বিদেশি আক্রমণকারী কিংবা সাম্রাজ্যবাদীদের কুদৃষ্টি পড়েনি। সে দেশের থাকবার মতো ছিল ছোট দুটি শহর মক্কা আর এদ্রিব। বাদবাকি মরুভূমি এবং সেখানেই লোকে ঘববাড়ি করে বাস করতো। তাদের বলা হতো বেদুইন, অর্থাৎ মরুভূমির অধিবাসী। তাদের চিরসঙ্গী ছিল উট আর ঘোড়া। মরুভূমির এই লোকেরা ছিল স্বভাবতই গর্বিত আর ঝগড়াটে স্বভাবের। খুব অল্পতেই রেগে যেত। পরস্পরের মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। বৎসরে একবার ঝগড়া মিটমাট করে সবাই মিলে একসঙ্গে যেত তীর্থস্থানে, মক্কায়। মক্কায় তখন অনেক দেবতার মূর্তি ছিল। বিশেষ করে তারা এক বিরাট কালো প্রস্তরখণ্ডের পূজা করতো, ওটা কাবা নামে পরিচিত।
হ্যাঁ, আরবরা ছিল যাযাবর জাতি, অবশ্য বহু পরে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হয়েছে। কত সময়ে কত সাম্রাজ্য আরবদেশকে অধিকারভুক্ত করতে চেয়েছে, কিন্তু যাযাবর মরুজাতিকে অধীনস্ত করা সহজ ছিল না। বহুকাল ধরেই বেদুইনরা মরুভূমিতেই বাস করতো। তাদের কেউ কেউ জাহাজে করে দেশে-বিদেশে যেতে ব্যবসা বাণিজ্য করতে। কিন্তু দেশের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। কতক লোক খ্রিস্টান হলো আবার কতক ইহুদি। কিন্তু অধিকাংশই ছিল মক্কার সেই কাবাঘর আর অন্যান্য ৩৬০টি মূর্তির উপাসক। বহুদিন আরব জাতি ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল, বাইরের জগতে কী ঘটছে না ঘটছে তার খবরাখবর রাখতো না। কিন্তু হঠাৎ তাদের ঘুম ভেঙে গেল, আয়ত্ত করলো বিপুল ক্ষমতা। সারা পৃথিবীতে চমক লেগে গেল। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল আরবরা গড়ে তুললো উচ্চাঙ্গের সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
যা বলা হলো, আরবজাতির সেই নবচেতনা আর শক্তির মূলে ছিল ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহম্মদ (স.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ইনি শান্ত-সমাহিত জীবন যাপন করতেন, লোকে তাঁকে খুব বিশ্বাস করতো। কিন্তু যখন তিনি নতুন ধর্ম প্রচার শুরু করলেন, বিশেষ করে মক্কায় মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করলেন তখন চারদিক থেকে লোকে প্রতিবাদ আরম্ভ করলো। মহম্মদ (স.) প্রচার করলেন আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং মুহম্মদ তার প্রেরিতপুরুষ। মক্কা থেকে মুহম্মদকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। মক্কা থেকে বিতারিত হয়ে মহম্মদ তাঁর কয়েকজন শিষ্যসহ এদ্রিবে আশ্রয় নিলেন। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে মহম্মদের এই পলায়নকে ‘হিজরী’ বলা হয়। হিজরীর আরম্ভ থেকেই ইসলামধর্মের অভ্যুদয় ধরা হয়, যদিও তা আরো কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছিল। ইসলামের নবির এই আগমনকে এদ্রিব নগরী সাদরে গ্রহণ করলেন এবং তাঁর সম্মানার্থে ঐ নগরের নাম দেওয়া হলো মদিনাৎ-উন-নবী, অর্থাৎ পয়গম্বরের শহর।
ইসলাম ধর্মের বিস্তার এবং আরবজাতির ক্ষমতালাভের কথা বলার আগে একবার চারদিকের অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করা যাক। স্বল্প আগেই রোম নগরীর পতন হয়েছে। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিহ্ন মাত্র নেই। একদিকে প্রচীন সভ্যতা সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে, নতুন সভ্যতারও বিকাশ হয়নি। সুতরাং ইউরোপের তখন অন্ধকারের যুগ। ইউরোপের পূর্ব প্রান্তে অবশ্য পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তখনো টিকে ছিল। রাজধানী কন্সটানটিনোপল তখন খুব সমৃদ্ধশালী, ইউরোপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নগর। জাঁকজমকের সেখানে অন্ত ছিল না। কিন্তু ছিল না জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার। ইউরোপের যখন এইরকম অবস্থা তখন ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়। মদিনায় পালিয়ে যাবার সাত বছরের মধ্যে বিজয়ীর বেশে মক্কায় ফিলে এলেন মহম্মদ। নতুন শক্তি সঞ্চয় করলেন মরুজাতির মধ্যে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে বিভক্ত জাতিকে তিনি একটি পতাকার নিচে সমবেত করলেন। ইসলাম ধর্মের বাণী হলো, ‘ইসলামধর্মাবলম্বীরা সবাই এক ভাই-ভাই’। এতে করে লোকে গণতন্ত্রের কতকটা আঁচ পেল। খ্রিস্টধর্ম তখন যেরূপ বিকৃত হয়ে পড়েছিল তাতে ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বাণী কেবল আরবজাতিই নয়, অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের মনেও সাড়া জাগিয়েছিল। নিকটবর্তী দেশসমূহের অধিবাসীরা বহুকাল যাবৎ স্বেচ্ছাচারী শাসক আর ধর্মগুরুদের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে উঠেছিল। ইসলাম ধর্মের সহজ-সরল পন্থা, সাম্য ও গণতন্ত্রের আদর্শ তাদের মনে সাড়া জাগিয়ে তুললো। তারা একটা পরিবর্তনের জন্য একান্ত উদগ্রীব হয়ে ছিল। ইসলামের মধ্যে তারা ঐ পরিবর্তন খুঁজে পেল। ফলে তাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হলো, লোপ পেল অনাচার। দৃঢ় হলো ভ্রাতৃত্ব বোধ।
যখন মুসলমান-আরবরা দেশ জয়ে বের হলো, অনেক সময় বিনাযুদ্ধেই জয়লাভ করেছে। পয়গম্বরের মৃত্যুর পঁচিশ বৎসরের মধ্যে আরবগণ পারশ্য, সিরিয়া, মিশর, আরমেনিয়া এবং মধ্য এশিয়া আর আফ্রিকার কতকাংশ জয় করে নেয়। মিশর অতি সহজেই পরাজিত হলো। কারণ রোমান সাম্রাজ্যের শোষণ এবং বিভিন্ন খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়গুলির বিরোধের ফলে মিশর একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। ফলে জনগণ নতুন কারো শাসনের জন্য অপেক্ষা করছিল। খলিফা আবুবকর আর উমরের বারো বছরের শাসনকালের মধ্যেই পূর্ব রোমান-সাম্রাজ্য, পারশ্য, ইরাক, জেরুজালেম মুসলমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পূর্ব দিকে মুসলমানরা হিরাট, কাবুল জয় করে সিন্ধুদেশের উপকূলে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু তখন অগ্রসর হয়ে ভারতের অভ্যন্তরে আর প্রবেশ করলো না। ভারতবর্ষের কেবলমাত্র সিন্ধুপ্রদেশ মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু পাশ্চাত্যে তাদের জয়যাত্রা ক্ষান্ত হলো না। উত্তর আফ্রিকা অতিক্রম করে একেবারে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে এসে থামলো। সেই স্থানের এখন নাম হয়েছে মরক্কো। অতপর জয় করলো স্পেন আর ইউরোপ।
ইউরোপের স্পেন জয় করতে বেগ পেতে হলো না। আরবগণ ফ্রান্সের দক্ষিণ-অঞ্চলে প্রবেশ করলো। দক্ষিণ-ফ্রান্সে আরবগণ সংখ্যায় ছিল অল্প। কিন্তু তথাপি ফ্রান্সের ঐ আরবদের ভয়ে পশ্চিম ইউরোপ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। কয়েকটি দেশ সম্মিলিতভাবে আরবদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধলো। মুসলমানরা সেখানে হেরে গেল। ফ্র্যান্স আর জয় করা হলো না। কিন্তু স্পেনে তাদের আধিপত্য বজায় থাকলো কয়েকশো বছর। যাযাবর মরুজাতি কি না স্পেন থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিরাট এক সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু আশ্চর্য যে এই মরুজাতি শীঘ্রই তাদের প্রথম দিকের সরল জীবন যাপন বাদ দিয়ে বিলাসবৈভবে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। নগরে নগরে গড়ে তোলা হলো বিরাট সব অট্টালিকা। প্রথমদিকের বিজয়ী তাঁবুর জীবন ছেড়ে আরামে গা ভাসাতে থাকলো। আবুবকর আর উমর এই দুই মহান খলিফার শাসনের পরেই উপদ্রব সৃষ্টি হতে থাকে। বিভিন্নরকম হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে। শিয়া আর সুন্নী মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেল মুসলমানরা। ভিন্ন দিকে উমাইয়া আর আব্বসীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকে।
দামাস্কাস ছিল মুসলমান শাসনের রাজধানী। খুব সুন্দর শহর ছিল এই দামাস্কাস। কত গির্জা, প্রাসাদোপম অট্টালিকা আর ফোয়ারা ছিল। দামাস্কাস শহরের জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল চমৎকার। এই সময়ে আরবগণ নতুন ধরনের এক স্থাপত্যশিল্প গড়ে তুলেছিল। সাদাসিধা অথচ সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক। স্তম্ভ, তোরণ, মসজিদের চূড়া, গম্বুজ ইত্যাদিতে ঐ শিল্পের বিকাশ হয়েছিল। অদ্যাপি স্পেনে এই স্থাপত্যশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। ভারতেও এই শিল্পের আমদানী হয়েছিল। ঘোড়দৌড়, শিকার, দাবাখেলা আরবদের খুব প্রিয় ছিল। গানবাজনার প্রতি তাদের একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। সব বাদ গেল। ক্রমশ নারীসমাজেও একটা পরিবর্তন ঘটতে লাগল। আরবদেশে স্ত্রীলোকেরা পর্দানশীন ছিল না। অবরোধপ্রথা না থাকায় তারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করতো, গির্জ কিংবা সভাসমিতিতে যেত, এমনকি বক্তৃতাও দিতো। কিন্তু ক্রমে আরবরা পূর্ব-রোম আর পারশ্য এই দুটি প্রাচীন সাম্রাজ্যের কতকগুলো আচার ব্যবহার ও রীতিনীতি অনুকরণ করতে শুরু করলো। কন্সটানটিনোপল আর পারশ্যের প্রভাবেই আরবদের নারী-সমাজে অবরোধপ্রথার সৃষ্টি হয়। সেইসব স্থানের প্রভাবেই ক্রমে হারেম-ব্যবস্থা প্রচলিত হলো। সামাজিকভাবে স্ত্রী-পুরুষের দেখাসাক্ষাৎ বিরল হয়ে দাঁড়ালো।
ইসলামের শাসনে পরধর্মসহিষ্ণুতার জায়গা ছিল। জেরুজালেমে খলিফা উমর এই বিষয়ে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। মুসলমানদের শাসনে স্পেনের খ্রিস্টানদের খ্রিস্টধর্মপালনে বা ধর্মাচারণে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। মুসলমানদের শাসনে সিন্ধুদেশেও দুই ধর্মের মধ্যে মেলামেশা এবং মধুর সম্পর্ক বজায় ছিল। লক্ষ্য করবার বিষয় হলো, এই সময়ের ইতিহাসে মুসলমান আরবদের পরমতসহিষ্ণুতা আর ইউরোপের খ্রিস্টানদের অসহিষ্ণুতা দুটাই আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে নানারকম বিরোধ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। নবির বংশের উমাইয়ারা শত বছর ধরে খলিফা হতেন, কিন্তু উমাইয়াদের পরাস্ত করে মহম্মদের আর এক শাখা ক্ষমতা লাভ করে। এঁরা হলেন মহম্মদের খুড়ো আব্বাসের বংশধর, যারা আব্বাসী নামে পরিচিত ছিলেন। প্রথম দিকে ইসলামে বংশানুক্রমিক ক্ষমতা লাভের সুযোগ ছিল না, ক্ষমতা লাভ করতে হতো সবার সমর্থন বা ভোটাধিকারের মাধ্যমে।
ইসলামে ন্যূনতম হলে গণতন্ত্রের ধারণা বহাল ছিল প্রথম দিকে। কিন্তু পরে ক্ষমতা প্রদর্শন আরম্ভ হলো। যখন আব্বাসীরা খলিফার পদ অধিকার করলো, উমাইয়াদের উপর প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করে। ফলে অনেকদিন ধরে হত্যাকাণ্ড চললো। যখন যেখানে উমাইয়াদের পেল, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসী খলিফাদের শাসন আরম্ভ হয়। আরম্ভটা শুভ না হলেও, আব্বাসীদের আমলে আরবজাতি খুব উন্নতি লাভ করেছিল। নানা বিষয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। স্বদেশে আব্বাসীরা বিজয়ী হলেও, সুদূর স্পেনে ছিল উমাইয়াদের শাসন। কিন্তু উমাইয়া শাসকরা আব্বাসীদের খলিফা হিসেবে মানতে অস্বীকার করে। মিশর তো আব্বাসীদের উপেক্ষা করে নিজেরা নতুন এক খলিফা মনোনীত করলো। আফ্রিকাতেও আব্বাসীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঠিক এই আব্বাসী শাসনের শুরুতেই মুসলিম-আরবদের সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়। খলিফা আর মুসলিম জগতের একচ্ছত্র অধিপতি বা ধর্মগুরু থাকলেন না। ইসলাম ধর্মের একতা নষ্ট হলো।
ইসলামের যে ধর্মবিশ্বাস আর যে শক্তি প্রথম আরবজাতিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, তা লোপ পেল। ইসলামের প্রথম দিকের সরলতা আর গণতন্ত্রের আদর্শ হারিয়ে গেল। প্রাচীন পারশ্য কিংবা কন্সটানটিনোপলের সম্রাটের সঙ্গে ইসলামের নতুন ধর্মগুরুর আর পার্থক্য রইলো না। হযরত মহম্মদের সময়কার মুসলমান-আরবদের মধ্যে অদ্ভুত জীবনীশক্তি পাওয়া যেত, সে যুগের পৃথিবীতে মুসলমান-আরবদের সমকক্ষ কেউ ছিল না। সেই সময়ে সকল রাজ্যই তাদের কাছে মাথা নত করেছে, কেউ তাদের অগ্রগতিতে বাধা দিতে পারেনি। বিভিন্ন রাজ্যে তখন মুসলিম-আরবরা আশার বানী নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেই অবস্থাটা ততদিনে বদলে গেছে। বিভিন্ন রাজ্যগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুসলমান শাসকরা নিজেদের জাঁকজমক বাড়িয়েছে, গ্রহণ করেছে বহু খারাপ রীতিনীতি; নারীর উপরে চাপিয়ে দিয়েছে অবরোধপ্রথা।
রাজধানী দামাস্কাস থেকে স্থানান্তরিত হলো বাগদাদে। আব্বাসী শাসকরা নিজেদের সাম্রাজ্যকে সংহত করতে মন দিলেন। সহস্র-এক রজনীর গল্পের শাহজাদীর কাহিনীর সেই শহর, আরব্যোপন্যাসের সেই নগরী হয়ে উঠলো নতুন শাসক আব্বাসীদের রাজধানী। খলিফারা ছিলেন বেজায় বিলাসী। অসংখ্য দাস তাঁদের পরিচর্যার জন্য নিযুক্ত থাকতো, স্ত্রীলোকরা বাস করতেন হারেমে। ইসলামের প্রথম যুগের স্বাধীন নারীদের দেখা পাওয়া যাবে না এখানে। ইতিবাচক দিকও আছে। বাগদাদ বিরাট শহর, কতো প্রাসাদোপম অট্টালিকা, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, কার্যালয়, বিচারালয় আর দোকানপাট এবং প্রমোদোদ্যান আর খেলার মাঠ রয়েছে সেই শহরে। প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠলো এই শহরে। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো ডাকবিভাগ, শহরে হাসপাতাল ছিল অসংখ্য। দেশবিদেশ থেকে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে ছাত্র আর শিল্পীদের। কারণ খলিফারা সত্যিই বিদ্বান আর শিল্পীদের গুণের কদর করতে জানতেন।
ইসলামের ইতিহাসের সেটা ছিল ভিন্ন যুগ। বাগদাদ ছিল সবদিক দিয়ে তৎকালের শ্রেষ্ঠ শহর। শুধু মাত্র আরব শাসিত স্পেন ছাড়া তৎকালে ইউরোপের তুলনায় বাগদাদ ছিল সবদিক থেকে এগিয়ে এবং শিক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য আর শাসনপদ্ধতিতে উন্নত। এই সময়ে আরবদেশে বিজ্ঞান চর্চাও শুরু হয়। ইউরোপের সেই অন্ধকার যুগে আরবদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা দেখা গিয়েছিল, সুতরাং তাদের আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মদাতা বলা যেতে পারে। বাগদাদ ছিল এইসব বিদ্যানুশীলনের একটা বড় কেন্দ্র। ভিন্ন দিকে পাশ্চাত্যে আরব-স্পেনের রাজধানী কর্ডোভা ছিল আর একটি জ্ঞানচর্চার জায়গা। তাছাড়াও আরব সাম্রাজ্যে এই ধরনের আরো কতকগুলি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। কায়রো, বসরা, কুফা ইত্যাদি শহরে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হতো।
মুসলমান-আরবগণ ইতিহাস চর্চা করতেন। তাঁদের লেখা বইপুস্তক এবং ইতিহাস থেকে আরবজাতি সম্বন্ধে আমরা অনেক কথা জানতে পারি। আর তাঁরা অদ্ভুত অদ্ভুত কাহিনী আর উপন্যাস রচনা করতে পারতেন। সবচেয়ে আলোচিত ‘সহস্র-এক আরব রজনী’ সারা বিশ্বে পরিচিত। দূরবীন আর দিগদর্শন যন্ত্র প্রথম মুসলমানরাই আবিষ্কার করেছে। শিক্ষালাভ ছিল ইসলাম ধর্মের প্রধান একটি অনুষঙ্গ। চিকিৎসাশাস্ত্রে আরবরা বিশেষ উন্নতি করেছিল। আরব চিকিৎসকগণ ইউরোপে বিখ্যাত ছিল। বাগদাদ ছিল বিদ্যানুশীলনের একটা বড় কেন্দ্র। পাশ্চাত্যে আরবি-স্পেনের রাজধানী কর্ডোভা ছিল আরো একটি উন্নত শিক্ষার জায়গা। আরব সাম্রাজ্যে এইধরনের অনেক শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, যেমন কায়রো, বসরা, কুফা ইত্যাদি। কিন্তু সকলের ওপরে বাগদাদের স্থান, ইসলামধর্মের রাজধানী, সাম্রাজ্যের রাজধানী, শিল্প সংস্কৃতি সৌন্দর্য্যরে কেন্দ্র।
মুসলমানরাই তারপর গ্রীসের জ্ঞানবিজ্ঞানকে রক্ষা করে এবং তার চর্চা করে। প্লাটো, অ্যারিস্টোটল সহ ভারতীয় গণিত মুসলমানদের দ্বারাই বিকশিত হয়। জওহরলাল লিখেছেন, চিকিৎসা, গণিতশাস্ত্র ইত্যাদি কতকগুলি বিষয় অরবের মুসলমানরা ভারতবর্ষের কাছ থেকে শিখেছে। চীনের কাছ থেকে শিখেছে আরবরা কাগজ তৈরি করা। সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থাদি আরবরা নিজ ভাষায় অনূদিত করেছিল। কিন্তু অপরের কাছ থেকে যা শিখেছে, সেটা ভিত্তি করে অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। ভারত থেকে পাওয়া গণিতশাস্ত্রকে তাঁরা আরো বিকশিত করেন। মুসলমান সেনাপতি তারিক খ্রিস্টীয় ৭১১ সালে সমুদ্র পার হয়ে আফ্রিকা থেকে স্পেনে পদার্পন করেন, স্পেন এইভাবে বিরাট আরব-সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। স্পেনের আরবরা ছিলেন উমাইয়াদের প্রতিনিধি। একাদিক্রমে আরবরা যে স্পেন শাসন করেছিল সে-কথা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। আরো আশ্চর্য ঘটনা হলো, এই আরব মুরদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এদিক থেকে তারা যে খুবই উন্নত ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কর্ডোভা ছিল পাঁচশো বছর ধরে মুর-রাজ্যের রাজধানী। সমস্ত ইউরোপ যখন অজ্ঞান ও হিংসাবিদ্বেষের অন্ধকারে ডুবে ছিল তখন পশ্চিম-জগতের দৃষ্টির সম্মুখে কর্ডোভা জ্ঞান ও সভ্যতার আলোক তুলে ধরেছিল। শহরে অনেকগুলি গ্রন্থাগার ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল আমিরের খাস গ্রন্থাগার। এ গ্রন্থাগারের পুস্তক-সংখ্যা ছিল চার লক্ষ। কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় সারা ইউরোপে এমনকি পশ্চিম-এশিয়াতেও বিদ্যার পীঠস্থান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। দরিদ্র প্রজাদের জন্য অনেকগুলি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। বিশেষ করে একজন ঐতিহাসিক বলেন, স্পেনের অধিকাংশ লোকই লিখতে পড়তে জানতেন। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ইউরোপে কিন্তু তা ছিল না। সেখানে একমাত্র যাজক-সম্প্রদায় ছাড়া আর সকলে এমনকি উচ্চবংশীয় লোকের পর্যন্ত নিরক্ষর ছিল। কর্ডোভার সঙ্গে একটি মাত্র শহর তুলনীয় ছিল, তা হলো আব্বাসী মুসলমানদের শাসিত বাগদাদ। কর্ডোভার খ্যাতি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। দশম শতকে একজন জার্মান লেখক কর্ডোভার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘এ শহর সমস্ত বিশ্বের ভূষণস্বরূপ’। দূর দেশ থেকে ছাত্ররা আসতো কর্ডোভা-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা করতে। আরব-দর্শনের প্রভাব ইউরোপের নাম-করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে; প্যারিস, অক্সফোর্ড, উত্তর ইতালীর বিখ্যাত বিদ্যাকেন্দ্রগুলিতে এই দর্শনের যথেষ্ট সমাদর হয়।
খ্রিস্টীয় ১০০০ অব্দের কাছাকাছি আমিরের রাজত্ব প্রায় সারা স্পেন জুড়ে বিস্তৃত ছিল। শেষ পর্যন্ত ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে কাস্টিলের খ্রিস্টান রাজার হাতে কর্ডোভার পতন ঘটে। দক্ষিণ দিকে সরে যায় আরবরা। সেখানে গ্রানাডা নামক একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করে। গ্রানাডা দুশো বছর আরবদের শাসনাধীন ছিল। গ্রানাডা যে এতবছর টিকে ছিল তার কারণ, খ্রিস্টান রাজ্যগুলি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। ১৪৯২ সালে গ্রানাডায় আরব রাজত্বের অবসান ঘটে। কিছু কিছু আরব যাঁরা স্পেনে থেকে গিয়েছিলেন, নিষ্ঠুরভাবে তাদের উপর হত্যালীলা চালানো হয়। মুসলমানরা তাদের শাসনে স্পেনে যে পরধর্মসহিষ্ণুতা দেখাতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টানরা তা পারেনি। মুসলমানদের শাসনে ইহুদিদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রভুত উন্নতি লাভ করেছিল। মুসলমানরা ইহুদিদের সেই সুযোগ দিয়েছিল। খ্রিস্টানরা স্পেন দখল করার পর সেইসব ইহুদিদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। ধর্ম ত্যাগ করতে যারা চায়নি তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হলো। স্ত্রীলোক আর শিশুদের উপরেও এই অত্যাচার চলেছিল। যারা ধর্ম ত্যাগ করে থেকে গিয়েছিল, তাদের নাম এবং ভাষা পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
ভিন্ন একটি ঘটনা হলো, স্পেনদেশীয়রা স্নান করা, গা-হাত-পা ধোয়া বিশেষ পছন্দ করতো না। আরবরা স্নান, অবগাহন, আচমন ইত্যাদি ভালোবাসতো বলেই বহু স্নানাগার তৈরি করেছিল। সকলেই তা ব্যবহার করতে পারতো। স্পেনের কর্তারা হুকুম জারি করলেন যে, সাধারণের ব্যবহারের সব হামামগুলি বন্ধ করে দিতে হবে। বলা হলো, ‘বিধর্মী মোরিস্ক বা মুরদের পাপের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য এমন আইন বানাতে হবে যাতে আরবরা স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে ঘরে অথবা বাইরে, প্রকাশ্যে অথবা গোপনে স্নান-প্রক্ষালনাদি আর করতে না পারে। আরবদের তৈরি পাপের কুণ্ড হামামগুলি ভেঙেচুরে ধ্বংস করে দিতে হবে।’ স্নানরূপ অপরাধ ছাড়া আর একটি দোষের জন্য আরবরা স্পেনের কাছে অপরাধী প্রতিপন্ন হয়েছিল। সেটা হলো আরবদের পরধর্মসহিষ্ণুতা। কথাটা শুনতে খুব আশ্চর্য মনে হয়, কিন্তু ধর্মবিষয়ে আরবদের ঔদার্য অপরাধের তালিকায় খুব উঁচু স্থান পেয়েছিল। ভ্যালেন্সিয়ার ধর্মযাজক ১৬০২ সালে রচিত তাঁর একটি বইয়ে মুসলমান সারসেনাদের স্পেন থেকে বিতারণের যতোগুলি কারণ দেখিয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধান যুক্তি ছিল এই যে, আরবরা তাদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কেও যথেষ্ট গোঁড়া ছিল না। তিনি লিখেছেন, ‘এই মোরিস্ক অর্থাৎ আরবরা তুর্কি ও অন্যান্য মুসলমান জাতির মতো ধর্মবিষয়ে নিজেদের প্রজাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। প্রজারা এদের অধীনে নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী স্ব স্ব ধর্মমত অনুসরণ করে।’ সমালোচনা করতে গিয়ে এই যাজক যে বিপরীত দিকে মুসলমানদের কতোটা প্রশংসা করে গেছেন তা নিজেও জানতেন না।
মধ্যযুগের ইসলাম ধর্ম বা মুসলিম সভ্যতা সম্পর্কে জওহরলাল নিজের কন্যাকে যা লিখেছিলেন, সে-সবের সঙ্গে বর্তমান ইসলাম বা মুসলমান সভ্যতার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে? তিনি যেসব শিক্ষাকেন্দ্রের কথা বলছেন, সেগুলিই ছিল মধ্যযুগের মাদ্রাসা, বর্তমান মাদ্রাসা কী এর ধারে কাছে আছে? তখন মুসলমানদের জ্ঞানবিজ্ঞানের রাজ্যে কী ছিল আর এখন কী হয়েছে? বিরাট সংখ্যক মুসলমানরা কূপমণ্ডুক হতে হতে জ্ঞানবিজ্ঞান ছেড়ে সস্তা কথাবার্তা বলা শুরু করেছে। মধ্যযুগের মুসলমানদের নিয়ে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা অনেক চমৎকার চমৎকার প্রশংসা বাক্য লিখেছেন আর এখন, মুসলমানরা হয়ে উঠেছে সবার কাছে করুণার পাত্র। নিজেদের আত্মঅহমিকার শেষ নেই, কিন্তু কারো কাছেই জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে আগের সেই সম্মান লাভ করতে পারছে না। মুসলমানদের সভ্যতা মসজিদে পাঁচবার প্রার্থনার মধ্যে আটকে পড়েছে। পূর্বের সেই বিশাল কর্মজগত আর বিজ্ঞানের জগত কিছুই নেই। সাংস্কৃতিক মানও তলানীতে। সেই কারণে সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারছে না। মনে হয় মধ্যযুগের কাছ থেকে আবার শিখতে হবে মুসলমানদের, ঠিক যেভাবে পাশ্চাত্য নবজাগৃতির সময়ে পুনরায় আরম্ভ করেছিল প্রাচীন গ্রীস আর রোমের সভ্যতার দিকে তাকিয়ে। মুসলমানদের তখন সবচেয়ে বড় গুণটাই ছিল পরধর্মসহিষ্ণুতা। ভিন্ন দিকে প্রবলভাবে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক