মজদুর মজবুর হ্যাঁ

কালকেতু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮

                                                              (ক)
 
 পাঁচটার শিফট শেষ হলে সবাই যে যার মতো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পরে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। শরীরে চটের রুই মেখে মেহেবুব ধীর পায়ে হেটে যায় কলোনির দিকে। কলোনির স্যাঁতস্যাঁতে গলি গুলো তার কাছে গোলকধাঁধার মতো মনে হতে থাকে। সেই কবে লখনৌতে সে দেখে ছিলো গোলকধাঁধা। গলির মোরে বাচ্চাদের যে জটলাটা এতক্ষণ ছিলো তারাও মিলিয়ে যায় বকের ঝাঁকের মতো। আরও যারা এই তল্লাটে আছে তারাও হারিয়ে যেতে থাকে। কবেকার সব ঘুপচি গুলোতে শ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস খুবই কম, তবুও এইটুকু সময় যেন সব চেয়ে প্রিয়। খানিক পা ছড়িয়ে বসে থাকা যায়, জীবনের যত সুখদুঃখের কথা বায়োস্কোপের মতো মাথার চারপাশে এই সময়টাতেই ঘুরঘুর করে। মেহেবুব জামা কাপড় খুলে বসে। তাদের সংসার এই ঘুপচি কুটীরের তুলোনায় বেশ বিস্তৃত। মেহেবুবের মত আরও যারা আছে তাদেরও তাই। সবাই যেন নিজেদের কবরের মধ্যে নিজেরাই ঢুকে বসে আছে। তবুও দিনের এই সময়টা সবার খুব প্রিয়। মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে আর অন্য দিকে নির্মান করে একটা মস্ত কিছু- একটা অতিবাস্তব কিছু অথচ বাস্তবের প্রত্যক্ষ রূপে সে বেঁচে থাকে। যা তার থেকে অনেক দূরে অথচ খুব কাছে, সে নিজেই নিজের শত্রুকে নির্মাণ করে। সময়ের মূল্যে দুঃসময়কে নির্মাণ করে। আর এই দুঃসময় শেষ হয় তখনই যখন বাস্তবতা উল্টে যায়।
 
 
                                                                (খ)
 
সাইরেনের বাঁশি ভয়ংকর অথচ মিষ্টি কিশোরীর মতো। সে একঘেয়ে কিন্তু চঞ্চল। ঘেন্নার গুহাতে এইবার নিজেকে ধ্বংস করার সময়। অথচ নিজেকে ধ্বংস না করলে নিজেকে সৃষ্টির পথে রাখা মুস্কিল, বাঁচিয়ে রাখা মুস্কিল। গেটের বাইরে জমতে থাকা মানুষ গুলো জট বেধে আসে। বিরক্তির ভাব নিয়ে যে বৃদ্ধ সবার আগে দাঁড়িয়ে তার নাম গফফর। গত বছর বর্ষাতে অবসর নেওয়ার কথাছিলো। ‘অবসর তবু নেই’। তার আপন দেহের খন্ড গুলো এখনও সেই সুবিশাল ‘নির্মাণের’ কাছে জমা হয়ে আছে। ওগুলো পাছে চুরি হয়ে যায় সেই ভয়ে সে সাইরেন শুনে গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায়। যে কাজকে সে সব চেয়ে বেশী ঘেন্না করে তার কাছেই গফফর আসে। গফফর এই ভাবে তাঁতের যন্ত্রে এক নাগাড়ে তিরিশটা বছর কাটিয়ে দেয়, একটা সময় আসে যখন সে আর বুঝতেই পারে না সে কী করছে। তার সজীব দেহের অনিচ্ছা সে অনুভব করতে থাকে। ঘুলঘুলির সব গুল ফটক বন্ধ। এই দমবন্ধ অবস্থাতে ববিন পাক খেতে থাকে। মেশিনের চিৎকারে বেড়ে চলে শত্রুর দেহ। আশি গজের বদলে এখন একশ ষাট গজের চট বুনিয়ে তবেই ছুটি। গফফর বিয়োগ করে দেখে দ্বিগুণ শত্রু সে নির্মাণ করছে তার সামনে। সময়ের সাথে সাথে হাত গুলো আপনা আপনি চলতে থাকে। প্রতিবর্তক্রিয়া কি খুব স্বাভাবিক! নিজের কাজ থেকে গফফররা নিজেদের আলাদা করে দেখে। দেখতে বাধ্য হয়। এই ভাবে কত মানুষ আসে, আবার চলে যায়। যে গ্রাম ছেড়ে তারা এসেছিলো মুক্তির জন্য, সেই মুক্তি তাদের কাছে একটা শিকলের চেয়ে বেশী কিছু না; এই কথা গফফর প্রায় ভাবে। তার সামনে চলে আসে কুশি নদীর সেই পড়ন্ত বিকেল গুলো, সারসের ঝাঁক আর প্রাচীন চিলের ডেকে যাওয়া। কি নিদারুণ সেই খচ্চর মহাজন- এখনও গফফর তার কথা ভেবে চোখ লাল করে ফেলে। নিজের চোখের সামনে বাপকে মরতে দেখেছিলো এক ফালি জমির জন্য। গফফরের মেরুদন্ডে আগ্নেয় জ্বালা প্রবাহিত হয়। সেই বন্ধন ছেড়ে এসেছিলো সে ‘মুক্তির’ খোঁজে!
 
 
                                                                (গ)
 
 কি বিরাট দুনিয়া- এই দুনিয়ার একটা অংশ মানুষ, তার দেহ। দেহ বাদে সে যেটা অনুভব করে সেটা হলো বাকী দুনিয়াটাকে। যে দুনিয়ার জন্য মানুষ শ্বাস নিতে পারে সেই দুনিয়ার শ্বাস তাকে প্রতিদিন রোধ করতে হয়। একটা নিতান্ত মাকড়সা অতিনিখুঁত জাল বুনে যতই বাহাদুরি আদায় করার চেষ্টা করুক না কেন সেই জাল শুধুই তার নিজের আর তার হাজার হাজার হিংস্র শিশুর জন্য। একটা বাদর যখন বাগান থেকে কলা চুরি করে আনে সেটা তার আর তার শিশুর জন্য। তারাও নির্মান করে কিন্তু নিতান্ত তুচ্ছ ভাবে সেটা সে অনুভব করে। কিন্তু মানুষ কি তা পারে? মানুষ যা নির্মান করে তা কি অনুভব করতে পারে! খৈনিতে চুন মাখিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে যে লোকটা সে মোটেই সুবিধার না। মুজাফফার সব জেনে বুঝেই তার দিকে এগোচ্ছিলো। এগারো মাস বাদে কারখানা খুলেছে, মুজাফফার দু দিন বাদে এসে দেখে তার প্রতিদিনের মেশিন আর তার নেই। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় লাইনে। হাতের তালু সাদা হয়ে যাওয়া লোকটা ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, তার মেয়ের বিয়েতে মালিক একটা গাড়ি দিয়েছে গত বছর। এই লোকটা একটা সুরাহা মুজাফফরের জীবনে আনতে পারে। পাঁচশ টাকাতে একটা রফা করার প্রস্তাব এলো। মুজাফফরদের কথা মুজাফফররা জানে আবার জানেও না। এতো বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তারাও বিচ্ছিন্ন এক একটা মাংসপিন্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। যাদের হারানোর যা ছিলো সব হারিয়ে ফেলেছে। এই রূপান্তরের পিছনে তো কেউ আছে! যে মুজাফফর না। অন্য কেউ।
 
 
                                                                (ঘ)
 
 বাস্তবতার কথা তুলে ছিলো একদল। বাস্তব হলো মেহেবুব, গফফর, মুজাফফররা নিজেদের একটা মস্ত শত্রু নিজেরা বানিয়েছে। তারা যে একে একে নিজেদের জীবন্ত দেহটাকে বেচে আসে এক বিমূর্ত চুক্তি আকারে সেটা আসলে তাদের গোরস্থানের ছাড়পত্র। ঘুপচি কুটীরের শ্বাসরোধী স্থবিরতা তারা পেয়েছে একটা অট্টালিকা নির্মাণের বিনিময়ে। এমন অট্টালিকা যেখানে তারা কোনদিন প্রবেশ করতে পারে না। কারখানা গেটের বাইরে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে সে এই কথা গুলো গফফর, মেহেবুব, মুজাফফরদের মাঝে মাঝে বলে। আরও কত কথা সে বলে চলে এক নাগাড়ে। ভাঙা হিন্দীতে এই কথা গুলো মুজাফফরদের ভারি ভালো লাগে। দিনের পর দিন এই আসা-যাওয়া, তাদের কথা শোনা আর তাদের কথা বলার ফলে এক প্রকার বিশ্বাস জন্মেছে, ওরা এখন চোখ রাঙানি দেখলে পাল্টা চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে। খণ্ডিত মাংস আর সময়ের মূল্য গুলো নিজেদের দখলে রাখার আশা জাগে ওদের মধ্যে। দখলের প্রশ্নটা ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, তাদের নির্মিত ‘শত্রু’ আর সেই ‘শত্রু’-র দখল কার হাতে আছে- সেই ক্ষমতার প্রশ্নটা। যে প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে পুলিশ হরতাল ভাঙে, যে প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে মেহেবুবদের ফাঁসির আদেশ দেয় বিচারপতি, যে প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে মুক্তির কথা বলা গফফরদের জেলে যেতে হয়, যে প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে ফর্শা নেতা বারবার মালিকের পক্ষ নেয় – সেই প্রশ্নটা আসলে ক্ষমতার; মেয়েটি আরও স্পষ্ট করে বলেছিলো ‘রাজনৈতিক ক্ষমতার’। গফফর প্রথমটা ধরতে না পারলেও সামসুল বুঝে গেছিলো ব্যাপারটা। স্যাঁতস্যাঁতে গলির ধারে ধারে কবরের দরজা গুলো আলগা হতে থাকে, মেহেবুবরা একে একে কবর থেকে ওঠার চেষ্টা করে। তারা এতো দিন ধরে যা নির্মাণ করেছিলো, যা তাদের দেহের মূল্যের সমষ্টি রূপে বাস্তব হয়েছিলো সেটাকেই উপড়ে ফেলে দেবে বলে। সত্যি একদিন সেই দিনটা আসবে।