ভীনদেশি তারা

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৮

জোয়ানা অফিস থেকে বেরিয়ে দাঁড়ায় রাস্তার মোড়টায় - সেই সকালে অফিসে ঢুকে পড়লে তারপর, রাতে বেরুলে কেবল মনে হয় পৃথিবীতে শুধু সন্ধ্যারাই রয়ে গ্যাছে । আর বাকি সব বাড়ি ফিরে গ্যাছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা এই  অফিসের উইন্ডোর মোটা গ্লাসগুলোয় রোদের ঝাপটা বাড়া-কমায় বোঝা যায় দিন কেটে সন্ধ্যা হচ্ছে । রাস্তা ভর্তি এখন মানুষের ঢল - বাড়ি ফেরত মানুষ । সবাই একটা বাসে কিংবা গাড়িতে উঠে পড়ে ঝিমুবে , অতি উৎসাহীরা বাড়ি ফেরার আনন্দে এই মানুষের চাপেও হাসবে, গান গাইবে। জোয়ানার বাড়ি ফেরার তাড়া নেই- জোয়ানা এগিয়ে যায় নাম না জানা কিসব মোটা থামের মত দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা নেমে যায় , সেদিকে । প্রতিদিন অফিস থেকে বেরিয়ে এই সময়টা সবাই দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করে- করবেই না বা কেনো ?
জোয়ানার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হয়না বলে অন্যদের হবে না নাকি ? ওই যে সাদা শার্ট পরা গোঁফওয়ালা ছেলেটা দৌড় লাগিয়েছে একটা বাসের পেছনে তার পেছনে আছে মধ্যবয়স্ক এক অফিস-ফেরত , ওর হাতে কিসব গৃহস্থালী জিনিস। বাড়িতে সবার জন্য কেউ না কেউ অপেক্ষা করে বুঝি ! রাস্তায় এখন নীল-সবুজ-লাল বাতির ছোটাছুটি চলবে অনেকক্ষণ -গাড়ি আর গাড়ি , ওর ভেতর থাকবে মানুষ । কফি শপটার ভেতর বসে জোয়ানা তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। অফিস শেষে রোজ এই কফি শপটায় বসে থাকে সে । রাত সাড়ে ন`টা পর্যন্ত , এইভাবে বসে- দু তিনটা কফি খায় সে, আর মনে পড়ে ওর, অনির্বাণের কথা ।
"আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলে কোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামের মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে?" - গানটা বাজছে কফিশপে । " তোমার তো কখনোই ক্লান্তি ধরে না , আমার ধরে যায় " - অনির্বাণ বলতো এমন করে । শেষ কবে এই কফি শপটায় আসা হয়েছিলো অনির্বাণের সঙ্গে ? মনে পড়ছে না । অথচ , এমনো বেশিদিন হয়নি ও দেশ ছেড়েছে । এই শহরে সবার ক্লান্তি আসে।
চোখ জুড়ে , শরীর জুড়ে, হাত-পা জুড়ে,ক্লান্তি আর ক্লান্তি, শুধু জোয়ানার কেনো আসে না ? জোয়ানা নিজেকে প্রশ্ন করে । " এই শহরে আর কোনো গল্প বেঁচে নেই আমার জন্য , জোয়ানা" - অনির্বাণ বলতো । অনির্বাণের ক্লান্তি আসতো খুউব করে , অনির্বাণ বলতো এই শহর তার সব চিন্তা আর শক্তি শুষে নিচ্ছে , জোয়ানা চুপ করে শুনতো সেসব অভিযোগের কথা, কত অভিযোগ ছিলো অনির্বাণের ! এই শহরের বিরুদ্ধে যত সব অভিযোগ । কফি শপের স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল ভেদ করে গাড়ির লাইটগুলোর দিকে নজর যায় জোয়ানার , একটা গতিতে শুধু গাড়িরা ছুটছে , আসছে আর যাচ্ছে । দৃশ্যটা সুন্দর - পুরো শহরভর্তি শুধু গাড়িগুলোকে ছুটন্ত আলোর মতো দেখা যাবে এখন, প্যারিসে ও যেখানে অনির্বাণ থাকে সেখানে ও কি এমন সব দুরন্ত গাড়িতে ভর্তি শহরটা ? অনির্বাণ কি মুক্তি পেয়েছে শহরের ক্লান্তি থেকে সেখানে ?
ওরা দুজন বসে থাকতো এই কফি শপটায় , ঠিক যেমন কোণের সবুজ চাদর দেয়া টেবিলে একটা ছেলে আর মেয়ে মুখোমুখি বসে আছে। ওদের চেহারায় ক্লান্তি , তবু হেসে হেসে কিসব গল্প করছে নিজেদের মধ্যে। মেয়েটার মতো জোয়ানা বসে থাকতো অনির্বাণের মুখোমুখি , ওর সব ক্লান্তি-অভিযোগ আর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বিদেশ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন - এসব গল্পই চলতো।
অনির্বাণ ও মাঝে মধ্যে চুপ হয়ে যেতো , তখন ওরা তাকিয়ে থাকতো ছুটন্ত গাড়ির দিকে।
একটা গাড়ি ছুটে যায় আবার ব্যাপক উৎসাহে হর্ন বাজিয়ে- জোয়ানার ভাবনায় ছেদ পড়ে, অনির্বাণের ওপর রাগ হয় মাঝে মধ্যে অকারণেই । অথচ, রাগ করবার মতো কিছুই সে করেনি, শুরু থেকেই অনির্বাণ এই শহর ছাড়ার গল্প করতো - তবে সত্যি একদিন এই শহর ছেড়ে যাবে সেটা কি অপ্রত্যাশিত ছিলো তাহলে জোয়ানার কাছে ? এমন দ্বন্দ-দ্বিধায় থেকে কি পেয়েছো ? -নিজেকে প্রশ্ন করে জোয়ানা। "কিচ্ছু না" অস্ফুটে বলে নিজেই নিজেকে। তাহলে অনির্বাণকে বাধা দাওনি কেনো ? কারণ ও আমার প্রেমিক ছিলো না, অধিকার ছিলো না- মিথ্যে কথা জোয়ানা- অনির্বাণ ও বলতে পারতো সে কথা- তুমিও পারতে , সম্পর্কের কি নাম থাকে আলাদা করে ? প্রশ্ন-আর উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলে প্রতিদিন জোয়নার, এই কফি শপে বসে।  নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা এভাবে প্রকট হয় তার, অনির্বাণ যখন থেকে দেশ ছেড়েছে। " এই শহরে আর নতুন কিছু নেই, তাই না ? " প্রশ্নটা মনে মনে অনেকবার করেছে সে অনির্বাণকে, উত্তর দেয়নি অনির্বাণ, শুনতে পেলে নিশ্চয়ই দিতো ।
এখন প্রায় ন`টা বাজে , উঠতে ইচ্ছে হয় না তবু , বাড়ি ফিরে কি হবে , বাড়ি ফিরলেই বরং বেশি ক্লান্তি আসে । একা থাকার অভ্যেস আছে তবু, বাড়ি ফিরলেই মনে হয় পৃথিবী জোড়া একাকীত্ব নেমে আসছে, অনির্বাণের মেইল আসে যেসব রাতে , অভিমান আরো গাঢ হয় সেসব রাতে। উত্তর না দিয়ে সেসব ফেলে রাখলে একটু ভালো লাগে তার। মনে হয় প্রতিশোধ নেয়া হলো , অথচ না ছিলো প্রেম না সম্পর্ক । তবু মানুষের ভালোলাগা আর সঙ্গ কি নামকরণের আশায় বসে থাকে ? সাড়ে ন`টা বাজতেই কফি শপের মালিক , আফরোজা বেগম এসে কাঁধে হাত রাখেন জোয়ানার , মিষ্টি হেসে প্রতিদিনের খদ্দেরকে জিজ্ঞেস করেন - " এই মেয়ে, বাড়ি ফিরবে না ? " বাড়ি ? হ্যাঁ , বাড়ি সে ফিরবে , মাথা ঝুঁকিয়ে হাসে জোয়ানা । দূর থেকে একজন তখন লক্ষ্য করে- বাদামী রঙ এর শাড়ি পরা এক মেয়ে কাঁচের দরোজা ঠেলে কফি শপ থেকে বেরিয়ে আসছে , ভীষণ ক্লান্তি ছেয়ে আছে মেয়েটার চোখে-মুখে ।