ভাসানীর ধারা এবং প্রগতিশীলদের টেনশন

মোহাম্মদ রোমেল

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৩, ২০২০

২০০০-১ সালের দিকে যখন নতুন নতুন ভাসানী পাঠ শুরু করি তখন খেয়াল করি, ভাসানী মাওলানা বা ইসলামি হইয়াও কতটা সেকুলার ছিলেন, একদল তা প্রমাণ করতে যেয়ে বলতেছে, আসলে মাওলানার ধর্মকর্ম পালন ছিল তার পোশাকি জিনিস। আসলে উনি ছিলেন মনেপ্রাণে সেকুলার। কমিউনিস্ট বিপ্লবী। সারা জীবন শ্রমিক-কৃষকের মুক্তিই ছিল উনার আসল কাম। ফলে উনার ধর্ম-কর্মের পালন বা ধারণা জীবনে গৌণ বিষয় ছিল।

এই ধারা মূলত প্রগতিশীলদের ধারা বলে সমাজে প্রচারিত ছিল বা আছে। আমিও প্রথম দিকে এই চিন্তাধারার মধ্যেই ভাসানীকে বুঝায় সীমিত ছিলাম। পরে আরেকদল ভক্ত পাইলাম যারা বলতেছিলেন, মাওলানার ধর্ম-কর্মের ধারণাই তার রাজনৈতিকতার ভিত্তি। এখানে তার রাজনীতি আর ধর্ম আলাদা নয়, অভেদ। ফলে যারা উনাকে শুধুই শ্রমিক-কৃষকের নেতা হিসাবে পাঠ করেন তারা ভাসানীরে খণ্ডিত করেন। ভাসানী উভয়।

এই ধারা মূলত ভাসানীর ভক্ত তথা মুরিদের ধারা বলে জানলাম। পরে আরো খবর নিয়া দেখলাম, ভাসানীর হুকুমতে রব্বাবি বা রুববিয়াতের যে বয়ান তা তার আগের আলেমদের মধ্যও ছিল। ভাসানী যার ধারাবাহিকতা মাত্র। যেমন এই মুহূর্তে মাওলানা আজাদ সোবহানী এবং তার `বিপ্লবী নবি` বইটার কথা মনে পড়ছে। ভাসানীর নিজের বয়ানেও এইসব ইতিহাস লেখা আছে।

তো মাসখানেক যাবত খেয়াল করছি, কিছু ইতিহাস অসেচেতন তরুণ আলেম এবং ইসলামপন্থি লেখক নিজেদের `মূল ইসলামের অথরিটি`র জায়গায় বসাইয়া ভাসানীরে ইসলামের বাইরে শুধুই কমিউনিস্ট হিসাবে ট্যাগাইতেছে। খেয়াল করে দেখবেন, এই ট্যাগানোর পিছে তাদের চিন্তার যে প্যাটার্ন তা উপরে ভাসানীর প্রগতিশীল যে পাঠ সেই বয়ানেরই উল্টা পৃষ্ঠা। তারা উভয়ই মাওলানা ভাসানীকে `ইসলাম` বিযুক্ত করতে চান।

প্রগতিশীলদের টেনশনটা তো আমরা মোটা দাগে বুঝি। কিন্তু এই মাওলানারা বা ইসলামন্থি লেখকরা ভাসানীরে ইসলামের বাইরে ঠেলে দিতে এত তৎপর কেন? আমি কয়েকটা কারণ অনুমান করি। একটা কারন, ভাসানী তাদের বর্তমান জালিমি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামহীন বা রাজনীতিহীন শুধুই পুতপুত ধর্ম-কর্ম বা ইসলামের অথরিটি হইয়া থাকারে প্রশ্নে ফেলে দেয়।

আরেকটা কারণ, উনারা ক্রিস্টিয় লিগাসীর অনুরূপ ভ্যাটিক্যান সিটির মতো যে রূপের ইসলামের অথরিটি হইয়া উঠতে চান, তেমন অথরিটির বিষয়েও ভাসানী তাদের প্রশ্নে ফেলে দেন। এমনকি কতগুলা রিচুয়ালকেই ধর্ম বইলা জনগনের উপর আরোপের যে চেষ্টা, সেটাও বাধা পায় ভাসানীর জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ইসলামের ইমেজের কাছে।

ফলে মূলত `ঈমান-আকিদার ইসলাম` বলে তারা নিজেরা ইসলামের অথরিটি সেজে ভাসানীকে ইসলামের লিগ্যাসীর বাইরে ঠেলে দিতে চায়। আরো কিছু কারণ বলা যেত। কিন্তু জ্ঞানী পাঠকদের জন্য এই কয়েকটা উদাহরণই যথেষ্ট। শুধু শুধ কথা বাড়িয়ে ফায়দা কি? ইতিহাস সাক্ষী, দেওবন্দি মাওলানা ভাসানী পূর্ব আলেমদেরই ধারাবাহিকতায় হুকুমতে রব্বানির রাজনীতি ও ধর্মকর্ম পালন করে গেছেন। ইতিহাস থেকে আমরা এ সত্যের পাঠ নিতে পারি।