ভাষা আন্দোলন: অর্জন ও কবিগুরুর কবিতার ছন্দ

মো. আব্দুল আহাদ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮

দুর্বল মোরা কত ভুল করি অপূর্ণ সব কাজ
নেহারি আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতা আপনি যে পাই লাজ।

বিচিত্র পৃথিবীর বিচিত্র রঙের মানুষ। নানা রঙে রঞ্জিত দেহের গঠন। আকার, মন, আচরণ, কৃষ্টি-সভ্যতা ও বাচনভঙ্গি নানা ধরণের। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাক্ষি দ্যায়, রাজার সুনীতিকে রাজনীতি বলে। সে কথা আজ বাসি। দেশ স্বাধীনের আগে ও পরে সংক্ষিপ্তসারে যা করেছি, দেখেছি, শুনেছি- সবকিছুর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও ভেজাল বিদ্যমান। ভেজালে আক্রান্ত হলে গাছপালা, ফলমূল, জীবজন্তু ও মানুষের মৃত্যু ঘটে। মানুষ ভেজাল হলে সমাজে সে মূল্যহীন ও অপ্রিয় হয় আর রাজনীতি ও রাজনীতিবীদদের মধ্যে ভেজাল হলে গোটা সমাজ, রাষ্ট্রে তার ছোঁয়ায় ক্যান্সার রোগের চেয়েও ভয়াবহ হয়। এসবের মূল কারণ হচ্ছে, মিথ্যা ও মিথ্যাচার তথা দুর্নীতি।

ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ধান ফুরালো পান ফুরালো বর্গি এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?
এ ছন্দ গানের মর্মার্থ সেই সময়ে সঠিক বুঝতে না পারলেও তা মধুর সুরে বুলবুলির কণ্ঠে গেয়ে বেড়াতাম। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের কণ্ঠে শুনেছিলাম, এদেশ ছাড়বি কীনা বল? নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল। কিম্বা ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত, বাঁধার বৃন্দাচল ইত্যাদি স্বরে-সুরে আমরাও স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তান নামের একটি দেশের অংশ পূর্ব পাকিস্থান পেলাম। পাক শাসন-শোষনের জাঁতাকলে অক্টোপাসে বাঁধা মানুষগুলো আবার তেজে জ্বলে উঠল। গেয়ে উঠল, বিচারপতি তোমার বিচার করবে কারা, এই জনতা এই জনতা। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে অকাতরে প্রাণ দিল আসাদ, বরকত, জব্বার, রফিক আরও কতজন।

৬৯-৭০ এর গণ অভ্যুত্থান। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে মাখা মানচিত্র সবুজের দিগন্তজোড়া এক নতুন প্রাণবন্ত বাণী একযাত্রা এক নতুনের হাতছানি। ৭ মার্চ বজ্রকণ্ঠে ভেসে উঠল রেসকোর্স ময়দানে লাখো-কোটি জনতার ঐক্যমেলা, শ্লোগান, গগন বিদারী আওয়াজ, আর যদি একটা গুলি চলে, আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল, তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... দিগবিজয়ী হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কণ্ঠে মুক্তির নিঃশ্বাস ও জীবনের বিশ্বাস। ৬ দফা বাস্তবায়নের স্বপ্ন পূরণ হলো। স্বাধীন বাংলার স্থপতি মহান নায়ক শেখ মুজিব রাষ্ট্র প্রধান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস।

২১ এসেছিল ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে। ২১ এর বইমেলা কী সুন্দর আয়োজন, ব্যতিক্রমধর্মী ইতিহাস। তাজা খুনের মূল্য দিয়ে এর স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ৩১তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। ভাষার মাঝে আশার আলো, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তথা সুস্থ ধারার রাজনীতি ও মানব সেবার মতাদর্শই আমাদের দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক। বাঙালির গর্ব-স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম জাতিসংঘের সম্মেলনে বাংলা ভাষার বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ভাষা মর্যাদার ভিত্তি স্থাপন করেন।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, ইসলামি আদর্শ যেমন সর্বজনীন তেমনিভাবে ভাষা-বর্ণও সর্বজনীন। আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষার চর্চা করি, প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলি, মনের ভাব প্রকাশ করি এবং জাতীয় দিবসগুলোতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে একুশের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তবে কি আমরা ভাষা ব্যবহারে সচেতনতার পরিচয় দিতে পেরেছি? একাত্তরের চেতনায় আমাদের লক্ষ্য, দেশ গড়ার। আমরা গণতন্ত্রের ঢাকঢোলে পাকা! স্বচ্ছতা তথা জাতীয় মূল্যবোধে অনেক পিছনে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাজনীতিতে আমাদের দলের নামগুলো কেন জানি একুশের চেতনার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি এমনকি মিডিয়াতে দেখি বিটিভি, এনটিভি, এটিএন ইত্যাদিতে বাংলা শব্দের যৎসামান্যও পরিচয় নেই। একুশ ভক্ত, নায়ক-নায়িকা, দেশ কর্ণধার, অভিজাত শ্রেণির ছেলেমেয়ের নাম রাখছি, বিউটি, বেবি, তেরেসা, লিটন, মিল্টন, জার্মান, বিলাত, নাইস, সুইটি এবং সম্মোধনসূচক ডাক, মাম্মি, ড্যাড, বাপ্পি, আংকেল, সিস্টার ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাংলা একমাত্র ভাষা যা ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। একুশ মানে ভাষা রক্ষার সংগ্রাম, বায়ান্ন, একাত্তর, স্বাধীন দেশের রাঙা রবি পতাকা বিশ্ব মানচিত্রে মর্যাদার আসনে আসীন ভাষা তথা বর্ণমালা। বাংলা ভাষার শিক্ষা চর্চার পাশাপাশি অন্য ভাষা শিক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যাতে আমরা আমাদের ভাষা ধারণ করে অন্য ভাষার মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশে আমাদের দেশ, জাতি, বর্ণমালা দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের পরিচয় তুলে ধরতে পারি। এটা বিশেষ প্রত্যাশা ও সময়ের দাবি।

লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী