ভাষার রাজনীতি, ভাষার সংস্কৃতি

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০১৯

সম্প্রতি একটি বিতর্ক বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে যে, রমজান না রামাদান, কোন উচ্চারণটি সঠিক? এই বিতর্কের উৎস সন্ধান করা যাক। যত ঝামেলা আরবি বর্ণমালার ১৩ নম্বর বর্ণটি নিয়ে। কারো মতে এটি ‘দোয়াত’, কারো মতে ‘জোয়াদ’, আবার কারো মতে এটি না দোয়াদ, না জোয়াদ; দোয়াদ ও জোয়াদের মধ্যবর্তী একটি উচ্চারণ, যে উচ্চারণটি প্রকাশ করার জন্য বাংলা বর্ণমালায় কোনো বর্ণ নেই। ফলে এ নিয়ে বহুকাল ধরে বিতর্ক চলে আসছে বাংলার আলেম সমাজে। কোরআনের সূরা ফাতিহার সর্বশেষ আয়াতটি হচ্ছে, ‘ওয়ালাদ দোয়াল্লিন, আমিন।’ এটা দোয়াল্লিন হবে, না জোয়াল্লিন হবে― এ নিয়ে এদেশের আলেমসমাজ দুই ভাগে বিভক্ত।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের মূল স্রোত যখন প্রথম আসে, তখন তা ছিল প্রবলভাবে পারস্য ভাবধারায় প্রভাবিত। বাংলা ভাষায় রয়েছে বহু পার্সি শব্দ। পার্সিয়ানরা আরবি ‘রামাদান’ বা ‘রামাজান’কে বলতো ‘রমজান’। বাংলার মুসলমান সমাজ আরবি রামাদান বা রামাজানকে গ্রহণ না করে পার্সি রমজানকে গ্রহণ করে। এ নিয়ে কোনো মতানৈক্য ছিল না। বহু শতাব্দি ধরে এমনটাই চলে আসছিল। মতানৈক্য শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তরান্বিত করার জন্য আরবীয় ওয়াহাবিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তার মিত্ররা। নানা কৌশলে মুসলিম দেশগুলোতে তারা ওয়াহাবিবাদি তত্ত্ব প্রচারে কোটি কোটি টাকা ঢালতে শুরু করে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ওয়াহাবিবাদের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা― এই বক্তব্যের রেফারেন্স কী? রেফারেন্স হিসেবে ২০১৮ সালের ২২ মার্চ ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’কে দেওয়া সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের একটি বক্তব্য উদ্বৃত করছি। তিনি বলেছেন, ‘শীতল যুদ্ধের সময় সউদি আরবের পশ্চিমা মিত্ররা মুসলিম দেশগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রসর হওয়া ঠেকাতে উঠেপড়ে লাগে। মুসলিম দেশগুলো যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে চলে না যায়, সেজন্যই পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো গত শতকের ’৭০ এর দশকে সউদি আরবকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিল। তারই পরিণতিতে সউদি অর্থায়নে ওয়াহাবিবাদ ছড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়। বিভিন্ন দেশে মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থ ঢেলে ওয়াহাবি মতাদর্শের বিস্তারে কাজ শুরু করে সউদি আরব।’

সৌদি আরবের সেই ওয়াহাবিবাদ প্রচারে ঢেউ লাগতে শুরু করে বাংলা-ভারতেও। তিতুমীর ও হাজি শরীয়তউল্লাহ প্রচারিত তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া তত্ত্বের অনুসারীরা জেগে উঠতে শুরু করে প্রবলভাবে। ওয়াহিবরা শুরু করে কথিত বিশুদ্ধ ইসলাম বাস্তবায়নের তৎপরতা। বিশুদ্ধ ইসলাম বলতে তারা বোঝে সৌদি আরবের ওয়াহাবি তত্ত্ব। (ওয়াহাবিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়া যেতে পারে প্রবন্ধের বই ‘আঠারো দুয়ার খুলে/স্বকৃত নোমান/পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. ২০১৯)। বাঙালি মুসলমান আগে বলতো ‘খোদা হাফেজ’, ওয়াহাবিবাদের প্রভাবে একটা অংশ বলতে শুরু করল ‘আল্লা হাফেজ’। কারণ খোদা পার্সি শব্দ, আল্লাহ আরবি শব্দ। এই সময়েই শুরু হয় দোয়াল্লিন-জোয়াল্লিন, রমজান-রামাদান, কোরান-কোরআন, শবে বরাত পালন হালাল না হারাম, বাবা-মা বা মুরুব্বিদের পা ধরে সালাম করা হালাল না হারাম ইত্যাদি বিতর্ক। এই বিতর্কের এক পক্ষে পারস্যের সুফিবাদ ও ভারতীয় মরমীবাদ প্রভাবিত আলেম সমাজ, আরেক পক্ষে সৌদি আরবের ওয়াহাবিবাদ প্রভাবিত আলেম সমাজ। প্রথম পক্ষ রমজানের পক্ষে, দ্বিতীয় পক্ষ রামাদান বা রামাজানের পক্ষে। কারণ দ্বিতীয় পক্ষের কাছে ইসলাম মানে আরবি ভাষা ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধ অনুকরণ। ইসলামে তারা সৌদি আরব বা ওয়াহাবিবাদের বিরুদ্ধ কোনো বিষয় রাখতে নারাজ।

ভেজা মাটির এই বাংলায় এসে অনেক আরবি শব্দ বঙ্গীয় রূপ পায়। যেমন রাহিম হয়ে যায় রহিম, কারিম হয়ে যায় করিম, কামারুজ্জামান হয়ে যায় কামরুজ্জমান, আলী আকবার হয়ে যায় আলী আকবর, কোরআন হয়ে যায় কোরান। আরবিতে রামাদান বা রামাজান হোক, পার্সিয়ানদের প্রভাবে বাংলায় তা হয়ে গেছে রমজান। বাংলা-ভারতের মুসলমান রমজানকে সাদরে গ্রহণ করেছে। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ রমজান এখন আর বিদেশি শব্দ নেই, বাংলা শব্দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে; যেমন হয়ে গেছে চেয়ার। চেয়ার আর ইংরেজি শব্দ নেই, বাংলা শব্দ হয়ে গেছে। যারা মননে মরু আরবের অধিবাসী, যারা মনে করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা এই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের কাছে রামাদান বা রামাজান সঠিক। অপরদিকে যারা মননে বাঙালি, হোক মুসলমান, হিন্দু বা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের, তাদের কাছে রমজানই সঠিক। এখন সিদ্ধান্ত আপনার, আপনি কোনটিকে গ্রহণ বা বর্জন করবেন।

কেউ বলতে পারেন, এটা তো তুচ্ছ ব্যাপার। রামাদান বা রামাজান হলে কী, আর রমজান হলেই-বা কী? তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিতর্ক করে কী লাভ? হ্যাঁ, সঠিক কথা। একেবারেই তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু একটা কথা খেয়াল রাখা দরকার যে, ভাষারও রাজনীতি আছে, ভাষারও সংস্কৃতি আছে। কোনো জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য ভাষা ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি সবচেয়ে ধারালো হাতিয়ার।

টুকে রাখা কথামালা
০৭.০৫.২০১৯