ভালোবাসা দিবসের আড়ালে বাণিজ্যের ফাঁদ
ছায়াবীথি শ্যামলিমাপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কডিয়াস ছিলেন যুদ্ধবাজ। যুদ্ধ আর রক্তের বন্যায় তিনি আনন্দ পেতেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান তরুণদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কডিয়াস বিয়ে ও বাগদান বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করেন। সম্রাটের এ নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধাচরণ করে শহিদ হন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।
কিন্তু আজকের দিনে সে ইতিহাস বিস্মৃত। এ যুগে ভ্যালেন্টাইন ডে মানে কপোত-কপোতির ‘হু-আহা’ টাইপের ভালোবাসা। হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ানো, আর কফিশপে বসে টাকার শ্রাদ্ধ করা। এ সুযোগটাই চেয়েছিল পুঁজিবাদী কোম্পানিগুলো। মূর্খ প্রেমিক-প্রেমিকার আমি-তুমির ওপর নির্ভর করে কোটি কোটি টাকার পণ্য বিক্রির বাজারও নির্দিষ্ট করে ফেলেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
এ বাজার শুধু পশ্চিমা বিশ্বে নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকেও গ্রাস করে ফেলেছে। অথচ আমরা জানি, বাঙালি আবেগী জাতি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভালোবাসার মতো পবিত্র একটি অনুভূতি এখন এ জাতি ধার করছে ইউরোপের কাছ থেকে। বাঙালি যে হুজুগে জাতি, এ বিষয়ে তো সন্দেহ নেই। হুজুগ একটা তুলতে পারলে হয়, বাঙালি তা লুফে নেবে। যে মহান আদর্শের জন্যে সাধু ভ্যালেন্টাইন আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, তা আজ হয়ে গেছে মুনাফা লাভের বিস্তৃত বাজার।
সত্যি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালেন্ডারে শুধুই দিবসের ছড়াছড়ি। ও দেশে প্রায় প্রতিটি দিনই কোনও না কোনও বিশেষ দিবস। এ দিবসগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার জন্যেও রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষ থেকে বিশাল বাজেট। এরকম একটি দিবস হচ্ছে হিস্ট্রি ডে, যার স্পন্সর ‘হিস্টরি চ্যানেল’। লাখো লাখো তরুণ-তরুণীর হৃদয় রাঙানো দিবস ভ্যালেন্টাইনস ডে’র স্পন্সর করে হলমার্ক, আর্চিস, ডিজনিল্যান্ড ইত্যাদি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। এসব কোম্পানি ফ্রেন্ডশিপ ডে নামের একটি দিবসেরও প্রবর্তক। কেননা, নতুন নতুন যত দিবস ঘোষণা করা যাবে, তত বাণিজ্যের প্রসার বাড়বে। তত মুনাফা। শুধু ভ্যালেন্টাইনের দিন দশ কোটির ওপরে হলমার্ক কিম্বা আর্চিসের কার্ডের ব্যবসার হিসেব-নিকেশ করতে গেলে অঙ্কের সংখ্যায় সেটা বলা কঠিন। একটি নতুন দিবস ঘোষণা দেয়ার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের রীতিমতো ঘুষ দ্যায় এসব বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
কিন্তু কথা হচ্ছে যে, এত এত টাকা খরচা করে একটি দিবস ঘোষণা করা কেন? পাঠক, লক্ষ্য করুন, যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইবিজওয়ার্ডের দু’হাজার নয় সালের দেয়া হিসেবমতে, ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে দেশটিতে সাতশো ছিয়াশি কোটি পঁয়তিরিশ লাখ ডলার শুধু ডিনারের পেছনে ব্যয় হয়। ভ্রমণের পেছনে দুশো কোটি দশ লাখ ডলার, গ্রিটিং কার্ডের পেছনে সাতাত্তুর কোটি চল্লিশ লাখ ডলার, জামাকাপড় কেনার পেছনে ১১ কোটি ৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার, ক্যান্ডির জন্যে দুশো ৪৯ কোটি ৯৩ লাখ ডলার, জুয়েলারির পেছনে একশো ৩৭ কোটি ১৮ লাখ ডলার, ফুলের জন্যে একশো ৪২ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। এই তালিকার সঙ্গে আরও কিছু ব্যবসার ক্ষতিয়ান পাঠক নিজেই যুক্ত করতে পারেন। তা হলো, এ ব্যবসাগুলো করতে গিয়ে আরও শত শত আয়-ব্যয়ের খাত। এ তো গেল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার হিসেবনিকেশ। পাঠক একবার আন্দাজ করুন তো, সারা বিশ্বে এ ব্যবসার পরিমাণ কত হতে পারে?
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমাজ থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে তাকেই আবার সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দ্যায়। ব্যক্তিতে ছুটিয়ে দ্যায় নিরন্তর ভোগের দিকে। যার মধ্যব্যক্তি হয়ে ওঠে পুঁজিপণ্য মুনাফা করার মেশিন। এ মুনাফা যত বাড়ে, পুঁজিপতির হাত তত শক্তিশালী হয়। আর বিপরীতে ব্যক্তি হয়ে ওঠে আরও বিচ্ছিন্ন সত্তা, একা, নিঃসঙ্গ মানুষ। এ সুযোগটি আবার কাজে লাগায় পুঁজিপতিরা তাদের মুনাফা দ্বিগুণ করার মওকা হিসেবে। পুঁজি তখন বিভিন্ন সামাজিক অনুষজ্ঞ তৈরি করে ব্যক্তির একাকিত্ব ঘোচানোর জন্যে। তৈরি হয় পর্নো ব্যবসা, পর্নো বাজার। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে বৃহত্তর আর্থিক খাতের অন্যতম হলো পর্নোব্যবসা। যে সামাজিক অভিঘাত থেকে ব্যক্তি একা ও নিঃসঙ্গ হয়, সেই সমাজপতিরা আবার সে সুযোগে ব্যবসা হাতিয়ে নেয়। একদিকে পরিবার, প্রেম, বিবাহ ভেঙে পড়ছে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে। আরদিকে ভালোবাসার জন্যে আলাদা দিবস তৈরি করে তাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে ব্যবসা করার পথ তৈরি করছে।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে জয়েস সি, হলমার্ক যখন হলমার্ক নামের দোকান খুলে কার্ড ব্যবসা শুরু করেন, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, গড়ে উঠছে ব্যক্তির একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। আলবেয়ার কাম্যুর লেখা দ্য আউটসাইডারের প্রধান চরিত্রের মতোই একটি নিঃসঙ্গ চরিত্র তৈরি হওয়ার মধ্যে দিয়ে হলমার্ক আর আর্চিশের বাজার বেড়ে যায় বহুগুণে। কারণ হলমার্ক তার কার্ড বেচার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছিল, তাহলো মানুষের আবেগ-অনুভূতি মর্মস্পর্শী করে কার্ডে প্রকাশ করা। এর মধ্যে দিয়ে কার্ডের ওপর কবিতা, অনুভূতি ছাপা হতে শুরু হলো। নিঃসঙ্গ মানুষও হুড়মুড় করে কিনতে শুরু করল। মানুষের ভালোবাসা বেচা শুরু করল হলমার্ক। অতীতের মতো আজকের নাগরিক মানুষ ভালোবসার প্রতি তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে না প্রিয়তামার জন্যে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এরও ব্যতিক্রম আছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা শেষপর্যন্ত ভালোবাসার মতো কোমল অনুভূতিও ভোঁতা করে দিচ্ছে। আর এ সুযোগে দিবসনির্ভর ভালোবাসার প্রচলন শুরু হয়। যার স্রষ্টা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কডিয়াসের স্বৈরাশাসনের আদেশের বিরুদ্ধে যে জীবন আত্মোৎসর্গ করেছিলেন সাধু ভ্যালেন্টাইন সম্মিলিত মানুষের ভালোবাসার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে, সেই ভালোবাসা থেকে আজকের ভ্যালেন্টাইন কত দূরে...