ব্রাত্য রাইসু

ব্রাত্য রাইসু

ভদ্র সমাজ সবাইকে খাইতে পারে, রাইসুকে নয়

সাদ রহমান

প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০২৪

ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে আমার যোগাযাগ বা সম্পর্কের দশ বছর অতিবাহিত হইলো। এই পুরাটা সময় জুইড়াই আমার ব্যক্তি-বোধবুদ্ধি ও চিন্তাপ্রক্রিয়ার ওপরে ব্রাত্য রাইসুর প্রভাব ছিল অপরিসীম। যেই প্রভাব আশা করি আমার বাকি জীবনেও ধইরা রাখতে পারবো। আমার লেখালেখি ও ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্র শুধু নয়, আমার সামগ্রিক জীবন-প্রবাহের ওপরেই ব্রাত্য রাইসুর একটা গভীর নিয়ন্ত্রণ আছে। এবং যেই নিয়ন্ত্রণ ব্রাত্য রাইসুর দিক থেকে নয়। বরং আমি নিজেই নিজের জন্য বিধান কইরা রাখছি।

এক ধরনের সেল্ফ-মাস্টারি এইটা। কিন্তু অন্যের ছায়ায়। যার ফলে আমার বিপথগামী হওয়ার রিস্কটা একেবারেই কইমা যায়। এবং যার জন্য, নিত্যদিন ‘তার’ সঙ্গে আমার সাক্ষাতেরও প্রয়োজন পড়ে না। এই রকম। কগনিটিভ নিয়ন্ত্রণ সহজ বিষয় নয়। যখন এর সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ ও শ্রেণি এই সবকিছুরই গভীর সম্বন্ধ ও সংঘাত প্রতিনিয়ত চলতেছে। ফলে কী কারণে কী সিদ্ধান্ত, ক্যানোই বা এই সিদ্ধান্ত— তা বোঝার জন্য ছায়ার দরকার আছে। সেই ছায়া কেবলই অব্যর্থ হবে এমনও নয়, কিন্তু ছায়ার নিচে দাঁড়াইয়া নিজেকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা কইরা নিলে জীবনটা বেশ সহজই।

বহু বছর ধইরাই আমি এই সহজ জীবন কাটাইতেছি। এইজন্য, সামটাইমস, ব্রাত্য রাইসুর ইমেজের সামনে আমার একটা ডিপ ‘সেন্স অফ গ্র্যাটিটিউড’ তৈরি হয়। এবং একান্তে, এই ইমেজচর্চা ও ভাবচর্চার ভিতরেই, গভীর প্রশান্তিময় আরো আরো নতুন দিনের উন্মোচন ঘটতে থাকে। জীবন এইখানে স্ট্যাটিক, সম্মোহিত ও স্থির।

একটা প্রশ্ন অনেকদিন থেকেই আমি নিজেকে করি। এখন থেকে আরো দশ-এগারো বছর আগে আমার খুবই তরুণ বয়সে আমি ঠিক কী কারণে ব্রাত্য রাইসুর ব্যাপারে আকৃ্ষ্ট হইছিলাম? প্রশ্নের উত্তরটা রিসেন্টলি আমি একভাবে সাজাইতে শুরু করছি। আমার বাল্যজীবন ছিল কিছুটা দুঃখের। আমার বাপ ছিলেন কড়া ধরনের, অন্যদিকে আমি ছিলাম খুবই সেন্সিটিভ বা সফট ধরনের। একে তো পড়ালেখা করানোর জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটা বাধ্যবাধকতা আমাকে ধরাইয়া দিছিলেন তিনি।

দ্বিতীয়ত, আমার প্রিয় চাচার মৃত্যু হইছিল আমার সাত বছর বয়সে। তার মৃত্যু আমারে এক ধরনের ‘অভিভাবকহীন’ কইরা ফেলছিল। কারণ তিনি ছিলেন শাসনবিরোধী ঢাকাইয়া ভঙ্গির মানুষ। তৃতীয়ত, চাচার মৃত্যুর পরে ঢাকার পাড়া-কালচারে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ভিতরে অনিবার্যভাবে গইড়া ওঠা ভয়াবহ অ্যাংজাইটির খপ্পড়েও আমাকে পড়তে হইছিল। তার ফলে, খুব নিদারুণভাবে আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট তরুণ মায়ের বিষাদের ভারও আমি বহুদিন বহন করছিলাম। আট, নয়, দশ এই বয়সগুলাতে।

এইসব কিছু মিলাইয়া, ছোটবেলাতেই আমি সাহিত্যের দিকে ঝুঁকছিলাম। আমার মারা যাওয়া চাচার পরিত্যক্ত বইয়ের শেল্ফ, তার শূন্য ঘরে স্তূপ হইতে থাকা বাতিল আসবাবপত্রের ভিতরে কিছু একা একা সময় নিজের মতোন কাটাইতে থাকার মধ্য দিয়া আমার সাহিত্যমনের জন্ম হইলো। হুমায়ুন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ— ইনাদের মাধ্যমে।

আমার বয়স পনেরো-ষোল হইলে আমার মধ্যে পরিণত সাহিত্যের ভাব আসতে শুরু করলো। যদিও তার আগেই আমি ডায়রিতে লেখালেখি শুরু করছিলাম। সতেরো বা আঠারো বছর বয়সে পা রাখার পরে, ঢাকার একটা আধা-আরবান ভাষা ও সংস্কৃতির ভিতরে বড় হওয়া আমি; গলি-কালচার, গালি-কালচার, এবং এক ধরনের টেংড়ি ভাষার প্রতি আমার টান— এসব মিলাইয়া আমি যেই মননশীলতা লালন করতেছি তখন, তার মধ্যেই সন্ধান পাইলাম ব্রাত্য রাইসুর।

আমি স্পষ্টই মনে করতে পারি, ওই সময়টায় সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান বা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদদেরকে নেগেট করার ভিতর দিয়াই আমি ব্রাত্য রাইসুর প্রতি আকৃষ্ট হইছিলাম। তাকে ছাড়া আর কোথাও যেন আমার যাওয়ারই ছিল না, অনেকটা এইরকম ভাবে।

প্রথমে বিডিনিউজ পত্রিকায় উনার কিছু ইন্টারভিউ বা বিশেষ সম্পাদকের নোট পড়ছিলাম। একই সময়ে ফেসবুকেও তাকে পাইলাম। পর্যায়গুলা এখন কিছুটা বিবর্ণ। কিন্তু ব্রাত্য রাইসুকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুইঝা ফেলছিলাম, আমিও ঠিক ‘ভদ্র’ সাহিত্যের লোক না। ওই বুঝ বা আকর্ষণ থেকে তখন ফেসবুকে উনার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। তার কিছুদিন পরে আজিজ মার্কেটে উনার সঙ্গে আমার দেখা হইলো।

ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে দেখা হওয়ার মধ্য দিয়া, যেটা হইলো— বাল্যজীবন থেকে বহন কইরা আসা আমার সকল দুঃখ-কষ্ট-ট্রমার অবসান ঘটলো, এবং সেই স্থলে, জন্মাইতে আরম্ভ করলো আনন্দ, স্ফূর্তি আর নতুন সাহিত্যানুভূতি। এইভাবে আমার প্রফেশনাল লেখক-জীবনের আরম্ভ হইলো।

‘ভদ্র নয়’ এমন ভাষার প্রতি প্রেম থেকেই ব্রাত্য রাইসুর প্রতি আমার প্রাথমিক আকর্ষণ। এর পরে, আরো নিকটে গিয়া উনার ইমপ্যাথির দেখা পাইলাম। যার ফলে আমার স্থূল জীবন-সংবেদনের ভাব ইত্যাদি উবতে থাকলো। উনার আকর্ষণীয় জীবনভঙ্গি ও সাবলিলতার সন্ধান পাইতে থাকলাম। সেই ধারায়, আস্তে আস্তে আমার অতীত জীবনের ট্রমা যেমন বিবর্ণ হইতে লাগলো, তেমনই নতুন জীবন, নতুন সাহিত্যবোধ ইত্যাদি খুলতে থাকলো।

সিস্টেম চেইঞ্জের এই পুরা প্রক্রিয়াটাই, আমি বলবো— শুরু হইলো ব্রাত্য রাইসুর ভাষা-ব্যবহারের প্রতি আমার আকর্ষণ দিয়া। সেখান থেকে, এই ভাষা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া শুরু হইলো নতুন চিন্তা-প্রক্রিয়া। সেখান থেকে সমাজ-সংস্কৃতিকে নতুনভাবে দেখতে পাওয়ার আনন্দ। আর তার মধ্য থেকে উৎসারিত এক অপরিসীম আত্মবিশ্বাস, সাহিত্যজগতে আমার দুঃসাহসী হইয়া ওঠা, ইত্যাদি।

ভাষার জগতটা রিয়েল নয়, এইটা আমার মত। ভাষা হইলো ফিকশনাল ওয়ার্ল্ড। যদিও ভাষার পিছনে রিয়েল দুনিয়াটা একভাবে থাকে। কিন্তু প্রকাশিত ভাষা মাত্রই ফিকশনাল, সেকারণে ভাষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনের ফিকশনও বদলাইতে থাকে। ভাষা বদল হইলে যেমন জীবনও বদল হয়। তেমনই, ভাষা চয়েজের মধ্য দিয়া আমরা যেনো আমাদের জীবনটাকেই ফিকশনের মতো কইরা সাজাই। ভাষার দেখা পাইলে আমরা জীবনের দেখা পাই।  আল্টিমেটলি, সেই ফিকশনের জগতে আমরা আত্মবিশ্বাসের সহিত ঘুরতে-ফিরতে থাকি।

যাই হোক, এইভাবে ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে আমার মোলাকাত হইলো। এখন অবশ্য, ব্রাত্য রাইসুর দার্শনিক বিচার ইত্যাদি নানারকম পর্যবেক্ষণ আমি করতে পারি। যেহেতু বয়স হইছে। এই লেখায় আমার উদ্দেশ্য সেটা নয়। এইখানে আমি উনার দুইটা গুণের কথা উল্লেখ কইরাই লেখা শেষ করবো।  দুইটা কারণে— ব্রাত্য রাইসুকে আমি সময়ের আর সবার চাইতে আমার নিকটস্থ লেখক মনে করি।

নাম্বার ওয়ান, ব্রাত্য রাইসুর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর ক্রস-কালচারাল সিমপ্যাথি আছে। যেই মানুষের যেই সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ডই থাকুক না ক্যানো, সেটারেই অ্যাপ্রিশিয়েট কইরা তারে সংলাপের টেবিলে স্পেস কইরা দেওয়ার সচেতন গণতান্ত্রিক চর্চা উনার চাইতে সহজভাবে আমি আর কাউরেই করতে দেখি নাই।

নিজের সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা স্বীকার করা যে একটা ‘স্বীকারক্তিমূলক’ বিষয়, এইটা ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে আলাপ করার সময় আলাদা কইরা টেরই পাওয়া যায় না। এবং নিজের সাংস্কৃতিক গইড়া ওঠাকে ‘স্বীকার’ করার মধ্য দিয়াই যে নিজের ‘সাংস্কৃতিক অধিকার’ নিশ্চিত করতে হয়, এই সহজ বুঝটাও বুঝতে আর অসুবিধা হয় না।

আমার মনে হয়, তরুণদের চিন্তার ওপরে ব্রাত্য রাইসুর সহজাত প্রভাব তৈরি হওয়ার বড় কারণ এইটা। ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে আলাপ করার জন্য বা উনার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ গড়ার জন্য অফিসিয়ালিটির দরকার নাই, সিঁড়ি বা ধাপের প্রয়োজন নাই, যে কেউ যেখানে আছে সেখান থেকেই শুরু করতে পারে।

নাম্বার দুই, ব্রাত্য রাইসুকে আমার নিকটস্থ মনে হওয়ার আরেক কারণ, উনার মধ্যে একটা ‘নট টু বি টেকেন সিরিয়াসলি’ ভাইব আছে। নিজের ভাবগাম্ভীর্যের অন্তরালে নিজেকে ঢাইকা ফেলার বাবু-দার্শনিক ভঙ্গিটা উনার মধ্যে একেবারেই নাই।

যেকোন চিন্তাশীল মানুষের জন্যই কাজটা কঠিন। কারণ চিন্তা মানুষের মধ্যে একটা ইন্টারনাল গ্রেটনেস বা আভিজাত্য তৈরি করে। সেইটাকে পাবলিকলি ভাইঙ্গা দেওয়া সহজ কাজ বইলা মনে হয় না। এরজন্য, ভদ্র ও অভিজাত সমাজ-কাঠামোতে নিজেকে ‘ক্লাউনে’র বেশে হাজির করতে হয়। যেইটা কম্প্রোমাইজের বিষয়।

জীবিত বড় দার্শনিকদের মধ্যে আমি যাদেরকে চিনি, স্লাভয় জিজেক ছাড়া আর কাউরেই এরকম ‘ক্লাউন’-চর্চা করতে দেখি না। নিজেই যেনো নিজের প্রমিজ ভাঙতে পারেন, বা নিজেই নিজেরে হাসির বস্তু কইরা তুলতে পারেন, ভিতরে রাশি রাশি জ্ঞানবুদ্ধি নিয়াও— এই ধরনের একটা চেহারা তৈরি করতে গেলে বুঝবেন কাজটা আসলেও কত কঠিন।

ভদ্র সমাজ সবাইকেই খাইয়া ফেলতে পারে। খাইয়া ফেলেও। কিন্তু যুগে যুগে কিছু মানুষ থাকে ভদ্র সমাজ তাদেরকে খাইতে পারে না। আমাদের বাস্তব ইতিহাসে ব্রাত্য রাইসু সেই বিরল মানুষদেরই একজন। এইজন্য তাকে ভালোবাসা যতটা সহজ, ততটা ভদ্রতার বিষয় নয়।

লেখক: কবি