ব্যাচেলারনামা
মঈনুল ইসলাম তুহিনপ্রকাশিত : জুলাই ০৩, ২০১৯
সারা বিশ্বেই চাকরিজীবী নারীদের জন্যে মাতৃত্বকালীন ছুটি আছে। চাকরিজীবী নরদের জন্যে পিতৃত্বকালীন ছুটি আছে কিনা জানি না, অবশ্য থাকার তেমন দরকারও নাই মনে হয়। কারণ চাকরি করাটাই সম্ভবত পিতাদের `পিতৃত্বপালন`, ফলে চাকরিতে নিয়মিত থাকাই তাদের জন্যে `পিতৃত্বকালীন ছুটি`। অন্যান্য দেশ বা শহরের কথা মালুম নাই, অন্তত ঢাকা শহরের বেকার ছাত্রদের জন্য `ছাত্রত্বকালীন` বা `বেকারত্বকালীন`, কোনো একটা ক্যাটাগোরিতে কিছু বিশেষ ছুটি বরাদ্দ রাখা খুবই জরুরি বলে ইদানীং মনে হইতেছে।
বিশেষ ছুটির এই তালিকায় প্রথমেই `বাসস্থান পরিবর্তনকালীন ছুটি`র কথা ভাবা যাইতে পারে। এই ঢাকা শহরে ছাত্রের (এবং ছাত্র মানে তো অবধারিতভাবেই একজন ব্যাচেলর) বাসা খুঁজে পাওয়া যতটা মুশকিল, যখন তখন বিদ্যমান বাসাটা হারায়ে ফেলা ঠিক ততটাই আসান। আসানির বিবরণ দিয়া শুরু করা যাক।
আপনি ব্যাচেলর, এইটাই আপনার যখন তখন বাসা হারানোর সবচাইতে বড় কারণ হইতে পারে। বাড়িঅলা ব্যাচেলরদের নিয়া খুবই চিন্তিত থাকেন, এই তথ্যটা আমি প্রথম পড়ি আল মাহমুদের `আগুনের মেয়ে` উপন্যাসে। তখন অবশ্য এতটা বুঝি নাই, কী কারণে তাদের এই ব্যাচেলরভীতি। এখনও সবটা বুঝি তা না, কিন্তু ঢাকা শহরের ব্যাচেলরমাত্রেরই মেবি পঞ্চেন্দ্রিয়ের পরে ষষ্ঠেন্দ্রিয় থাকুক আর না থাকুক, একটা সপ্তমেন্দ্রিয় ঠিকই গজাইতে বাধ্য। এর নাম দেয়া যাক `ব্যাচেলরেন্দ্রিয়`। এই ইন্দ্রিয়ের বলে বাড়িঅলাদের ব্যাচেলরভীতির রীতিনীতি, কিছুটা পরিমিতিসহকারে অনেকখানি আন্দাজ করা যায়।
এইসব ভীতির কাতারে প্রথম সারিতেই থাকে `প্রণয়ভীতি`। বাড়িঅলার মেয়ে থাকুক আর না থাকুক, ব্যাচেলরটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি বা ছয় ওয়াক্ত সিদ্ধিসেবী হউক— বাড়িঅলাদের ধারণা, ব্যাচেলরমাত্রেরই মেয়েছেলেদের বাঁকা দৃষ্টিতে নাকাল করার এক অসীম ক্ষমতা আছে। বাড়িতে একটি ব্যাচেলর ওঠামাত্রই ঢাকা শহরের বাড়িঅলারা শহরের সমস্ত মেয়েরেই নিজের মেয়ে ভাবতে শুরু করেন বইলা ভ্রম হয়। মেয়ে-সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপারে ঢাকার বাড়িঅলারা এতটাই সতর্ক। আর যদি তার নিজের একটি বা দুটি কন্যা থাকেন, তাইলে তো কথাই নাই। বাঙলাদেশে কন্যা সন্তানের পিতা হওয়া খুবই ভয়ের ব্যাপার, এ তো সত্য কথাই। কিন্তু কন্যার ভবিষ্যতের চিন্তায় ভাঙাচোরা বাসের অযোগ্য বাসাটি কোনো ব্যাচেলররে ভাড়া না দিলেও তো চলে না। অর্থনীতি জিতে যায় ঠিকই, কিন্তু সমাজনীতিটিও ঠিক থাকে কাঁটায় কাঁটায়। ব্যাচেলর আফগানিস্তানের মতো খালি হারতেই থাকে।
মেয়েছেলে বাদ। বন্ধুবান্ধব নিয়া থাকবেন, সেই উপায়ও সীমিত। সব লোকের কান্ধে দুই ফেরেশতা থাকলেও, ব্যাচেলরের কৃতকর্ম লিপিবদ্ধ করতে সদাপ্রস্তুত তৃতীয় আরেকজন ফেরেশতা— তিনি বাড়িঅলা। বাসায় কালেভদ্রেও বন্ধুবান্ধবের আগমন ঘটলে, বাড়িঅলা টের পান, একদম সংখ্যাসমেত। তাতে লাভক্ষতি যাই হউক না-হউক, ব্যাচেলরের ঘোর বিপদ।
একা থাকবেন? বন্ধুবান্ধব, মেয়েছেলেহীন গহীন জীবনযাপন? আপনারেই খুঁজছে বাঙলাদেশ, মানে বাঙলাদেশ পুলিশ আরকি। একা একা থাকা জঙ্গিদের আলামতক্রমে অধুনা প্রকাশ পাইছে। একা একা জীবনানন্দগিরির চিন্তা তাই গোড়াতেই বাদ, কামুক বা বখাটের চাইতে জঙ্গি হওয়া ঢের বেশি বিপজ্জনক।
তাইলে আপনি কী করবেন? আবার বাসা খুঁজতে বের হবেন। বের হওয়ার পরে কী কী ঘটবে, তা বলা মুশকিল। এইটুকু বলা যায়, যেই জুতা পায়ে আগের বাসা ছাড়ছেন তা বাথরুমের জুতায় পরিণত না হইলে, যে গেঞ্জি গায়ে বাসা খুঁজতে বের হইছিলেন, তা বাসা মোছার ন্যাকড়ায় রুপান্তরিত না হইলে, যে মোবাইল পকেটে বাসা খুঁজতে নামছিলেন, তা গুলিস্তানের ফুটপাতে ব্যবসার কাঁচামাল না হইলে— বাসাটি আপনি পাইতেছেন নাহ। বাসা না পাওয়ার ক্ষেত্রেও মূল কারণ ওইটিই, আপনি ব্যাচেলর। যেহেতু ব্যাচেলরত্বই এতসব দুর্ভোগের একমাত্র কারণ, আপনার মনে বিয়ার ভাবনাও মাঝে-মইধ্যে উঁকি দিতে পারে। তাতে প্যারার কিছু নাই, জালনায় উঁকি দিয়া চাঁদ দেখার মতো ঘটনা স্মরণ কইরা ত্বরিৎ সান্ত্বনা নিয়া নিলেই হবে।
দুর্ভোগের ফিরিশতি অবশ্য আরো লম্বা। এসব কথা কাউরে কখনো বলা যায় না, নিজে নিজে গোপনে মনেও করা যায় না। ব্যাচেলরের বাসাখোঁজার দিনগুলির স্মৃতি পাঠায়ে দিতে হয় গুরু ফ্রয়েডের `অজ্ঞান মনে`। একজন ব্যাচেলর যখন ঢাকা শহরে বাড়ি খুঁজতে বের হয়, তখন শয়তান আর ফেরেশতা, সবাই তারে ছেড়ে পালায়। এই শালার না আছে কোন পাপের প্রবৃত্তি, না আছে কোন পূণ্যের সুমতি। এর আছে খালি ধান্দা, একটা বাসার ধান্দা। এর সাথে থাকার কোন অর্থ শয়তান বা ফেরেশতা, কারুরই খুঁইজা পাওনের কথা না। সম্ভবত কোন ব্যাচেলরের বাসাখোঁজার দিনগুলিতে আল্লাহ দুই কান্ধের ফেরেশতারে বাসা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ছুটি দিয়া দেন, শয়তানও কিছুদিন ছুটিতে থাকেন। হে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র, আপনারাও এই দিনগুলাতে ব্যাচেলরদের `ছাত্রত্বকালীন ছুটি` মনজুর করলেই কেবল, ব্যাচেলররা আবারও একটা আপাতঃবাসস্থান খুঁইজা পাওয়ার নশ্বর স্বপ্নটি দেখতে পারে।