বোয়াল মাছ, কনডম এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী
মারুফ ইসলামপ্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২০
মাত্রই গতমাসে খুলশি থানায় বদলি হয়ে এসেছেন রুবেল হোসেন। জি, চট্টগ্রামের খুলশি থানা। পুরো এলাকা এখনো দস্তুরমতো চেনা হয়ে ওঠেনি তার। এরই মধ্যে আলিফ লায়লার ঈগলের মতো বিশাল ডানা ঝাপটিয়ে যেন আকাশ থেকে নেমে এলো করোনা। পুরো এলাকা ঢেকে গেল আতঙ্কের চাদরে।
উপর থেকে নির্দেশ এলো, পুরো এলাকা লকডাউন। ঘর থেকে কেউ বের হতে পারবে না। উপরমহলের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সিএমপি কমিশনার যুক্ত করলেন নিজের সিদ্ধান্ত— জনগণের জরুরি সেবা ঘরে পৌঁছে দেবে পুলিশ। এজন্য থাকবে পুলিশের জরুরি সেবা নম্বর। নম্বরগুলোতে ফোন করে জরুরি সাহায্য চাইবে মানুষ।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠে নেমে পড়লেন রুবেল সাহেবরা। মাথার উপর খাঁ খাঁ রোদ। চৈত্রের দুপুর। পুলিশের জাম্বুশ পোশাক গায়ে দিয়ে কুলকুল করে ঘামছেন এসআই রুবেল। হঠাৎ তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। কপালের ঘাম মুছছিলেন তিনি। ঘামেভেজা হাত দিয়েই ফোনটা রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা নারী কণ্ঠ।
পুলিশ ভাই বলছেন?
জি, আমি এসআই রুবেল। কে বলছেন আপনি?
আমার নাম জান্নাতুল মাওয়া।
জি বলেন।
একটা জরুরি দরকারে ফোন করেছি।
জি জি বলেন।
আপনারা তো আমাদেরকে বের হতে দিচ্ছেন না। কিছু কেনাকাটা...
আমরা আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস বাসায় পৌঁছে দেব। কী দরকার বলেন।
আমার একটা বোয়াল মাছ দরকার।
কী?
রুবেল সাহেব মনে করলেন, তিনি সম্ভবত ভুল শুনেছেন। চৈত্রের দাবদাহ সম্ভবত তার কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী?
বোয়াল মাছ। বোয়াল মাছ। দুইবার শব্দটা উচ্চারণ করলেন জান্নাতুল মাওয়া। তারপর বললেন, হয়েছে কি, উনার হঠাৎ বোয়াল মাছ খাইতে ইচ্ছা করছে। উনি, মানে আমার হাসবেন্ড হঠাৎ বলল, একটু শিমের বিচি দিয়ে বোয়াল মাছ রান্না করো না! এদিকে ফ্রিজ খুলে দেখি, কোনো বোয়াল মাছ নাই।
ফ্রিজে রান্না করার মতো আর কিছু নাই? চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলেন এসআই রুবেল।
আছে তো। কয়েক দিন আগেই দেশি মুরগি, পাকিস্তানি কক, গরু, খাসি, রুই মাছ, চিতল মাছ, পাবদা মাছ, ইলিশ, হাবিজাবি সব কিনে আনছি। জানতাম, সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে, করোনা ফরোনা কি যেন আসছে, যদি পরে না পাই, এজন্য সব বেশি বেশি করে কিনে ফ্রিজ ভর্তি করে রাখছি। কিন্তু কপাল খারাপ, বোয়াল মাছ কিনতে ভুলে গেছি। এখন উনি বোয়াল মাছ খেতে চান। কি করি বলেন তো!
রুবেল সাহেবের মেজাজ ফুটন্ত জলের মতো টগবগ করে ফুটছিল। তিনি অতিশয় কষ্টে মাথা ঠাণ্ডা করলেন। শান্ত গলায় বললেন, আমরা এখন শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ যেমন ওষুধপত্র এইসব কিনে দিচ্ছি। অন্যকিছু নয়।
সুগৃহিনী জান্নাতুল মাওয়া তা মানতে নারাজ। তিনি প্রায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আকুতি জানিয়ে বললেন, পুলিশ ভাই, একটু দয়া করেন। এই করোনা ফরোনার মধ্যে উনি যদি মইরা যায়, বোয়াল মাছ খাইতে চাইয়া উনি যদি মইরা যায়, তাহলে আমি এ কষ্ট ক্যামনে সহ্য করব! সারাজীবন এই কষ্ট আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে। প্লিজ পুলিশ ভাই, প্লিজ...।
মুখের উপর দরজা বন্ধ করার মতো মুখের উপর ফোন কেটে দিলেন রুবেল সাহেব। তিনি প্রবলভাবে প্রস্রাবের চাপ অনু্ভব করছেন। তলপেট খালাশ করতে রাস্তার ঢাল বেয়ে জঙ্গলের দিকে নেমে গেলেন খুলশি থানার এসআই রুবেল হোসেন। প্যান্টের জিপার খুলেছেন মাত্র, ওমনি ফোনটা বেজে উঠল আবার। তিনি ফোন পিক করলেন। এবার ধেয়ে আসল একটা পুরুষ কণ্ঠ।
ভাই, পাঁচফোড়ন লাগবে। পাঁচফোড়ন। বউ তো ডাল রান্না করতে পাত্তেছে না।
কোনো কথা না বলে ফোনের লাইন কেটে দিয়ে প্রাকৃতিক কর্মে মন দিলেন রুবেল সাহেব।
সারাদিনে এ রকম অর্ধশত ফোনকল পেলেন তিনি। কারও বাচ্চা কাঁদছে, খেলনা কিনে দিতে হবে, কারও শ্যালিকার মুখে ব্রন উঠেছে, এখনই মলম লগবে, কারও প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে, এই মুহূর্তেই রিচার্জ করতে হবে, কারও ভীষণ রকম লুডু খেলেতে ইচ্ছে করছে, তাই লুডুর বোর্ড কিনে দিতে হবে ইত্যাদি।
এইসব শুনতে শুনতে রাত হয়ে গেল ঢের। আজকের মতো ডিউটি শেষ এসআই রুবেলের। তিনি সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছেন। বাসার উদ্দেশে রওনা হবেন। অফিস থেকে দেয়া মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করতে যাচ্ছেন। ঠিক তখনই বেজে উঠল ফোনটা। প্রচণ্ড বিরক্তি ফুটে উঠল তার চেহারায়। কিন্তু পুলিশের চাকরি, জনগণের বন্ধু, বিরক্ত হলে তো চলবে না। তিনি ফোনটা ধরলেন। কেউ একজন খুব বিনয়ী গলায় ইতস্তত করতে করতে কথা শুরু করলেন, ইয়ে মানে...কীভাবে যে কথাটা বলব! আপনাদের বিরক্ত করা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। আমার আসলে খুবই দরকারি একটা জিনিস দরকার। ইয়ে মানে... হয়েছে কি, বাসায় একটিও প্যাকেট মানে নিরোধক প্যাকেট নেই। ভেবেছিলাম স্টকে আছে, এখন দেখছি একটিও নেই...ইয়ে মানে...।
রুবেল সাহেব নিঃশব্দে হাসতে হাসতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ফোনকরা ভদ্রলোকের এই প্রয়োজন আসলে ‘নিত্যপ্রয়োজন’ এর অধীনে পড়ে কিনা তিনি বুঝতে পারছেন না! এ ব্যাপারে তো উপরমহল থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি।