বেগম বাজারের নীলছবি
আশিকুজ্জামান টুলুপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৮
ছোটকালের কথা, উদয়নে পড়ি। জীবনেও প্লেয়বয় ম্যাগাজিন দেখি নাই। প্রচণ্ড ইচ্ছা দেখার। দুয়েকটা চটিবই পড়েছি। তখনকার চটি বইয়ের চরিত্রগুলি পাশের বাসার বৌদিকে নিয়েই গড়ে উঠতে দেখা যেত এবং কিছু কমন নাম ছিল– নরেন, সুলেখা, পুষ্প। চটি বইয়ের আগে মাসুদ রানার বই পড়ে প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে, গল্পের মধ্যেও ১৮+ সিন থাকতে পারে। কারণ এসব পড়ার আগে তো গল্পের বই মানেই হচ্ছে রাজপুত্র রাজকুমারী ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্ধু উপল একদিন বললো ওর বাসায় যেতে, ওর কাছে প্লেবয় আছে। আমরা কয়েকজন মিলে ওর বাসায় গেলাম। সেন্ট্রাল রোডে বাসা, সাইকেলে করে দুই বন্ধু যাচ্ছি, আমি চালাচ্ছি আর ওই বন্ধু পিছের ক্যারিয়ারে বসা। কী এক উত্তেজনা, প্লেয়বয় দেখবো জীবনে প্রথম বারের জন্য! আরও দুই বন্ধু আসলো রিক্সায় করে।
উপলদের বাসাটা আমার চমৎকার লাগতো। আশির দশকের ধানমণ্ডি বা সেন্ট্রাল রোডের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের বাসার মতো। একতলা পুরনো বাসা, প্রায় ১০ কাঠা জায়গার উপর দাঁড়ানো। বাসার সামনে সবসময় ওর আব্বার পুরনো ভোক্সওয়াগন গাড়িটা থাকতো। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ফ্রন্ট ইয়ার্ড পার হয়েই সামনের প্রধান দরজা। সাধারণত কাউকেই দেখা যেত না বাসার সামনে। আমরা যেহেতু প্লেবয় সংক্রান্ত বিষয়েই বেশি যেতাম ওর বাসায়, সেকারণে কেমন একটা চোর চোর ভাব থাকতো আমাদের চোখে মুখে। স্বাভাবিকভাবে সালামও দিতে পারতাম না ওর আম্মা বা আব্বাকে। সারাক্ষণ মনে হতো, কোনদিন যে ধরা পইড়া যামু আর ঝাড়ি খামু, জানি না।
বাসার সামনের বড় চত্বর পার হয়ে বাঁয়ে গিয়ে উপলের রুমটা ছিল। ইসস, দেখতে কি ভালো লাগতো, ঐ বয়সে একার রুম। আর আমি তখনও আম্মার সাথে ঘুমাই, কোনো একার রুম নাই। মেঝো ভাইয়ের সাথে ওনার ঘরে ঘুমাতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি রাজি হন নাই। কারণ ওনার ঘর বলা ঠিক উচিত হবে না, বরং ক্লাব ঘর বললেই চলে। সারাক্ষণ ওনার বন্ধুদের প্রচণ্ড আড্ডা।
উপলের রুমটা খুবই এলোমেলো। ও হাতে করে বেশ কয়েকটা প্লেবয় এনে আমাদের সামনের টেবিলে ফেলে দিলো, ভাবখানা এমন, ‘দেখ হালারা, কত দেখবি, আমার এইগুলি মুখস্থ হইয়া গেছে।’ প্লেবয়ের বিষয় হলো, একবার মুখস্ত হয়ে গেলে আর ভালো লাগতো না। অর্থাৎ এক প্লেবয় বেশিদিন দেখতে ইচ্ছা করতো না। সবচাইতে সত্যি কথা হচ্ছে, সম্পূর্ণ অনাবৃত কোনো সৌন্দর্যই মানুষকে বেশিক্ষণের জন্য ধরে রাখত পারে না। আবৃত সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের থেকে যায় আজীবন কৌতূহল। আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম প্লেবয়ের উপর। দেখতে খুবই আশ্চর্য লাগলো যে, কিভাবে এরা এরকম ছবি তুলতে পারলো! উপল সবাইকে ঐ বইগুলো দিয়ে দিলো বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরা যে যার পছন্দ মতো বেছে নিয়ে বাসায় রওনা দিলাম।
এরপর আসি নীলছবিতে। নীলছবির নাম শুনেছি মাসুদ রানার গল্পে, কিন্তু দেখি নাই। খুবই দেখার ইচ্ছা। কোথায় দেখবো, কার সাথে দেখবো, এই নিয়ে চলতে থাকে জল্পনা কল্পনা। মনে মনে ভাবতাম, নীলছবির সিনগুলি বোধহয় নীল হয়। যে কারণে এই ছবির নাম নীলছবি। কিন্তু যেদিন প্রথম নীলছবি দেখলাম, একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম রেগুলার কালার দেখে। এধরনের একটু বোকা বোকা প্রশ্ন অনেকের মনেই থাকে। কিন্তু কেউ জানলে লজ্জা পাবে ভেবে কাউকে জিজ্ঞাসাও করে না এবং জানতেও পারে না।
একদিন এক বন্ধু বললো, ওয়, বুলু দেখবি, বুলু?
বুলু কি?
হালা বুলু বুঝস না? তোর দেখার দরকার নাই। তখনও ব্লুর প্রমিত সংস্করণ পর্ণো শব্দটা প্রচলিত হয় নাই ঢাকাতে, আমরা ব্লু ফিল্ম বলতাম আর ঢাকার বেগম বাজার এলাকায় ওটাকে বুলু বলতো। এখনতো আরও একধাপ এগিয়ে 18+ বলা হয়। বলে রাখা ভালো যে, তখন বেগম বাজারে টিভি ও ভিসিআর এর মাধ্যমে খুব গোপনে ব্লু ফিল্মের প্রদর্শন করা হতো এবং টিকেট বিক্রি হতো ১০ টাকা করে। গ্রেটার টোরান্টোতে একটা এলাকা আছে, যেখানে ঢাকার প্রচুর টাকাওয়ালা মানুষরা তাদের পরিবারের বাসস্থান গড়ে তুলেছেন এবং যে এলাকা এখানকার স্থানীয়দের মধ্যে বেগম বাজার নামে পরিচিত। ওই বেগম বাজার নামটা শুনলেই ছোট্ট বেলায় রিক্সায় ঢাকার বেগম বাজার এলাকার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় দাঁিড়ানো, লুঙ্গি পরা কিছু লোকের কথা মনে পড়ে যায় আর সাথে ওদের মুখের একটা ডায়লগ “অ্যায় বুলু, অ্যায় বুলু” মনে পড়ে যায়।
আমার বন্ধু আমাকে বুঝিয়ে বললো বুলু মানে কি। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। রক্তে নাচন দেখা দিলো। মনে মনে বারবার মনে হতে থাকলো, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন উড়ে, কালবোশেখির ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর।... যেহেতু জীবনে নতুন কিছু একটার সাথে পরিচয় ঘটতে যাচ্ছে সুতরাং এই গানটা খুবই যায় সিকোয়েন্সের সাথে। একটা রিক্সা নিয়ে রওনা দিলাম। পৌঁছে গেলাম বেগম বাজার। রিক্সা থেকে নামতে হলো না, আমাদের চেহারা দেখে ঐ লুঙ্গি পরা লোকগুলো মোটামুটি টেনে নামিয়ে নিলো, টিকেটের টাকা হাতিয়ে নিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকলো যেখানে শো হবে সেখানে। আমাদের মনে হলো রাম গোপাল ভারমার সাত্তিয়া দেখছি। এ গলি থেকে সে গলি, সে গলি থেকে অন্য গলি, আমাদের মোটামুটি এমন কয়টা চক্কর দেয়ালো যে আমরা ভুলেই গেলাম কোন দিক দিয়ে এসেছি। এটা করতো ওদের প্রাইভেসির কারণে। যাতে পরে পুলিশ নিয়ে হাজির হতে না পারি। খুব সরু স্যাতসেতে কর্দমাক্ত গলি দিয়ে যেতে থাকলাম, এক জায়গায় একটা পানির কল দেখলাম, অনবরত পানি পড়ছে তাতে কারো কোন বিকার নাই। একজায়গায় দেখলাম চারটা ছেলে সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে জুয়া খেলছে। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখলাম একটা ছোট্ট দোকান বিল্ডিঙের দেয়াল ঘেঁষে। ওখানে ঘুড়ি, লাটাই, মাঞ্জার সরঞ্জাম, চকলেট, বিস্কুট এবং মনোহারি দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এক মহিলা ঢাকাইয়া কুট্টিদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলছে। এই ভাষাটা বাংলা এবং পিকিউলিয়ার একধরনের উর্দুর সংমিশ্রণে গঠিত। যেমন, আমার বাড়িতে তোমার দাওয়াত, এটা কুট্টি ল্যাঙ্গুয়েজে বলা হয়, হামোকো বাড়িমে তোমোকো দাওয়াত।
অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে গিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে। ঘিঞ্জি একটা পুরান বাসার প্রধান ফটক পার হয়ে ছোট্ট একটা উঠোনের কোনায় গিয়ে দেখলাম একটা সরু অন্ধকার সিঁড়ি। লুঙ্গি পরা লোকটা সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে উঠে গেল। আমরা ওকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরণ করতে থাকলাম। বর্ণনাটা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে জয় বাবা ফেলুনাথের ভণ্ড সন্ন্যাসীকে ফলো করে সউমিত্রর পিছে পিছে ভীষণ পুরনো একটা বাড়িতে যাওয়া। একতলা দোতলা করে চারতলা পার হয়ে একটা ছাদে গিয়ে উঠলাম। আধা ছাদ খালি এবং বাকি আধায় বড় একটা ঘর, বাইরে দুটো দরজা। দরজাগুলি বন্ধ। আমাদের নিয়ে ও ঢুকিয়ে দিলো ভিতরে, ভিতরে অন্ধকার। বুঝতে পারলাম যে, অনেক মানুষ আছে ঘরটার মধ্যে। মেঝেতে ছালা বিছানো, সবাই ঐ ছালার উপরে বসে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে। ওদের পাছার নিচে ছালা আছে, না কিছুই নাই, সেটা বোঝার হুশ কারো নাই। অন্য সময় ঐ ছালায় বসতে দিলে কেউই বসতো না এবং তখন ফেসবুক থাকলে বিশাল বিশাল পোস্ট দিতো।
সবাই বুদ হয়ে নীলছবি দেখছে। আমি এবং আমার বন্ধু বসে পড়লাম ছালার উপর। আশপাশে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, আমি কোথায়? মনে হলো নরকে একেবারে পৌঁছে গিয়েছি। কারণ এভাবে সব বয়সের লোকজন, বিশেষ করে বাপের বয়সী লোকজনসহ আবাল বৃদ্ধ বণিতা একসাথে নীলছবি একমাত্র নরকেই অ্যালাও করা হয়। এবার চোখ গিয়ে আটকে গেল স্ক্রিনে। জীবনের প্রথম নীলছবি, ভীষণ একটা ধাক্কা খেলাম ঐ রকম নগ্ন জ্যান্ত নরনারী দেখে। মনের ভিতরটা কেন যেন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বিষাক্ত হয়ে গেল। খুব কষ্ট হলো দেখে। বানায় বলছি না, সত্যি কষ্ট হয়েছিল ভীষণভাবে। কিসের কষ্ট জানি না, কেন হলো তাও জানি না। হয়তো ওইটা মেন্টাল ট্রমা। তবে ঐ কষ্ট ঐ একবারের জন্যেই হয়েছিল। দেখতে থাকলাম নীল নামের রেগুলার রঙের ছবি। কখন যেন ডুবে গিয়েছি নীলছবিতে। হঠাৎ পিপ পিপ করে বাঁশির আওয়াজ। চারদিকে কেমন একটা অস্বস্তি। ঘরের লাইট জ্বলে উঠলো। দেখতে পেলাম ঘরভর্তি জনা পঞ্চাশেক বিভিন্ন বয়সের লোক। সবার চোখে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থা। এর মধ্যে একজন ষণ্ডা টাইপের লোক আরেকটা লুঙ্গি পরা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো, কিবে, ক্যাঠা আইছে দেখতো।
ছেলেটা দৌড়ে বাইরে গেল। আমি ও আমার বন্ধু একেবারে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি, ঠিক ঠাওর করতে পারছি না কি হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন মারামারি লেগেছে কোথাও। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো আমাদেরই কপাল খারাপ, সব জায়গায় একটা গ্যাঞ্জাম লাগবেই। ঐ লোকটা দৌড়ে এসে ঘরটায় ঢুকে চিৎকার করে বলে উঠলো, পুলিশ আইছে। দর্শকরা সবাই নির্বাক, কি করবে বুঝতে পারছে না। রা বললো কোন চিৎকার চ্যাচামিচি না করে চুপচাপ বসে থাকতে। এরপর পুলিশ আসার ঠিক আগে আগেই ওদের একজন বিদ্যুৎ গতিতে টিভিটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সাধারণত ভিসিআরটা ঐ বাসায় থাকতো না যেখানে প্রদর্শন হতো। ভিসিআরটা রাখা হতো ঐ বাসা থেকে কয়েকটা বাসা পার করে কোনো এক গোপন বাসায়, যেখানে পুলিশ খুঁজেও পেত না ভিসিআর। পুলিশের ঝামেলা হলে ওরা টিভিটা সরিয়ে ফেলতো। ব্যাস সব সমস্যা শেষ। তখন একটা ভিসিআরের দাম একলাখ থেকে দেড় লাখ টাকা ছিল।
হটাৎ এক লোক দ্রুত গতিতে সবার মাঝে বেশকিছু নামাজ পড়ার টুপি ছিটিয়ে দিল। কাউকে আর কিছুই বলতে হলো না বা শিখাতে হলো না যে ক করতে হবে এখন, ঠিক যেমন বাচ্চা হওয়ার পরপরই বাচ্চাকে শিখিয়ে দিতে হয় না কিভাবে মায়ের দুধ টানতে হবে। ইজ্জত বাঁচানোর জন্য যে যার মতো টুপি পরে নিলো, কোথা থেকে এক চুটকি দাড়িওয়ালা লোক জোগাড় হয়ে গেল এবং ঐ লোকও টুপি পরে মিলাদ পড়ানো শুরু করে দিলো। আমরাও ওনার সাথে কোরাসে মিলাদ পড়া শুরু করে দিলাম। আমার ভীষণ ভয় লাগছিলো, বারবার মনে হচ্ছিলো যদি পুলিশ আইসা ধইরা নিয়া যায় তাইলেতো শেষ। পরের দিনই পত্রিকায় আমার ছবিসহ খবর আসবে, বেগম বাজারে বুলু দেখতে গিয়ে ক্লাস টেনের ছেলে গ্রেফতার।
আসলে ঐ দাড়িওয়ালা লোকটা সামনেই বসে ছিলো, মনে হয় ওদেরই লোক হবে। ওর দাড়িকয়টা অকুপেশনের কারণেই রাখানো হয়েছে অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট বুলু বিষয়ক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি ওনাকে রিক্রুট করেছে পুলিশ বিষয়ক জটিলতা থেকে মুক্তির জন্য। কি কনভার্সন রে বাবা! এতক্ষণ বইসা বুলু দেখতেছিল, যেই পুলিশের কথা শুনসে, সাথে সাথে টুপি পইরা ভেল চেঞ্জ। তখনই বুঝতে পারছি যে, ঐ লোক হইলো দাড়িওয়ালা সাধারণ মানুষ, মৌলবি না। আমার এক বন্ধু আছে, যার বেশ সুন্দর সফেদ দাড়ি আছে কিন্তু ওর মুখ খুবই খারাপ এবং সারাক্ষণ গালাগালি করে, বাজে জোক বলে। ইনটেরেস্টিং বিষয় হলো, এসব বাজে কথা বলার পরপরই আবার আস্তাগফেরুল্লাহ বলতে থাকে। ওকে দেখে আমাদের এক মিউজিসিয়ান বড়ভাই বলেছিলেন, অমুক হলো দাড়িওয়ালা সাধারণ মানুষ। (যারা দাড়ি রাখেন তাদের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি যে, এটা দাড়িকে অসম্মান করার জন্য লিখি নাই, জাস্ট মজার ঘটনা হিসাবেই বলেছি। পুরো ঘটনাটা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে সব বিষয়গুলোকেই কাভার করতে হয়।) ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেই দাড়ি রাখা পছন্দ করি এবং নিজেরও দাড়ি আছে যেটাকে চলতি বাংলায় ভাষায় চুটকি দাড়ি বলে এবং ইংরেজিতে গোটি বলে যেটা আগে কোনদিন জানতাম না, মডার্ন বন্ধু এবং আমার স্ত্রীর কাছে শুনেছি। আমার এক আত্মীয় অবজেক্টিভ টাইপের সময়ে মেট্রিক পাশ করা লোক। যার কারণে ওনারা আমাদের চাইতে একটু মডার্ন বেশি। আমরা যেমন সাধারণ বিজ্ঞানের বইয়ে পড়েছিলাম আলোকের প্রতিসরণ, আর্কিমিডিসের সূত্র, সালোক সংশ্লেষণ, ওনারা এইসবের ধারে কাছেও যায় নাই, উনি এসবের নামই শুনেন নাই, পড়াতো সুদূর পরাহত। আমি সাধারণ বিজ্ঞানে মেট্রিকে লেটার পেয়েছিলাম। এখনও মনে আছে, কোনো বস্তু পানিতে কেন ভাসে। এর কারণ হচ্ছে, বস্তু দ্বারা অপসারিত পানির ওজন যদি বস্তুর চাইতে বেশি হয় তাহলে বস্তুটি ভাসিয়া থাকিবে। আর আত্মীয়কে বাপের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলেন, চারটা আব্বার নাম লিখে পাশে ক খ গ ঘ দিয়ে দাও, আমি টিক চিহ্ন দিয়ে দিচ্ছি। আমি মনে মনে ভাবি, এখন চাইরটা আব্বা পাই কোথায় যাদের নাম লিখবো! ” ।
নিচে ছোট্ট একটা সাক্ষাৎকার দেয়া হলো একজন ছাত্রের সাথে:
স্যার: মেট্রিকে তোমার টোটাল মার্ক্স কত?
ছাত্র: ৯৯৯ পাইছি ১০০০ এর মধ্যে।
স্যার: ভবিষ্যতে কি করতে চাও?
ছাত্র: ভবিষ্যতে আমি আরও ভালো করতে চাই।
স্যার: তুমি এখন কি পড়তে চাও?
ছাত্র: আমি লাল সার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরতে চাই।
যাই হোক, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪/৫ জন পুলিশ এসে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলো যখন আমরা মিলাদ পড়ায় ব্যাস্ত। পুলিশরা হতবাক হয়ে গেল আমাদের ধর্মভীরুতা দেখে। কি ধার্মিক আমরা যে চারতলার ছাদের উপর এতগুলি মানুষ একসাথে বসে মিলাদ পড়ছি দুপুরের খাড়া রোদে। পুলিশ যে কি বলবে ঠিক খুঁজে না পেয়ে গজ গজ করতে করতে চলে গেল। পুলিশ যাওয়ার ঠিক ১৫ মিনিট পরে আবার কোথা থেকে টেলিভিশন এসে জায়গা মতো বসে গেল। লাইট অফ হয়ে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। টিভি চালু হয়ে গেল এবং ঠিক আগের ঐ জায়গা, যেখানে ভিসিআর বন্ধ করা হয়েছিল, সেখান থেকেই ঝাকানাকা শুরু হয়ে গেল। জীবনের প্রথম নীলছবি দেখতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, তা আর কোনোদিন ভোলা হলো না।
চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। আমারও একই দশা হলো। এত ঘটনার পর আবারও নীলমুখি হলাম এবং সেই বেগম বাজারে। সাথে ঘনিষ্ঠ সেই বন্ধু যে আমাকে এ’পথে এনেছিল এবং যার সাথে প্রথমবার বেগম বাজারে নীলছবির সাথে পুলিশও দেখেছিলাম এবং কোনমতে বাইচ্চা আইছিলাম। ওর সাথে আবার দ্বিতীয়বারের জন্য গেলাম নীলকর দিতে। তবে এই দ্বিতীয়বারই আমার জীবনের শেষবার ছিল বেগম বাজারে যাওয়া। যথারীতি সেই একই ঘটনা অর্থাৎ এই গল্পের প্রথম কয়েকটা প্যারাগ্রাফে যা হয়েছিল, সেগুলি আবার পুনরাবৃত্তি হলো। তবে এবার আমাদের যেতে একটু দেরি হওয়ায় শো শুরু হওয়ার প্রায় ১০ মিনিট পরে তড়িঘড়ি করে চারতলার ছাদের আধা রুমে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ঢুকলাম। ভীষণ অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কোনোরকমে একটা জায়গায় গিয়ে অনেক লোকের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছালায় বসে পড়লাম। ওদিকে তো পুরোদমে ঝাকানাকা চলছে। টান টান উত্তেজনা, কেউ কোনো সিন মিস করছে না।
আরও আধা ঘণ্টা পর হটাত লাইট জ্বলে উঠলো। ঐসব বুলু শো তে আবার সিনেমার মতো হাফ টাইমও থাকতো ১০ মিনিটের জন্য। আলো জ্বলার সাথে সাথে চারিদিকে ফকফকা হয়ে গেলো। সবাই সবার চোখ পিট পিট করা চেহারা দেখতে পেলাম। ঘরভর্তি পোস্ট শিশু, আবাল, বৃদ্ধ, সব বয়সের মানুষই আছে ওখানে। কেউ কারো দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকাই না, আমি আর আমার বন্ধু আবার একটু বেশি সাবধান বিধায় মাথা নিচু করে রাখি, পাছে কে চিনা ফালায়, বলা তো যায় না। কারণ সব জালিমের দলই তো আসে এইখানে বুলু দেখার জন্য। হটাৎ কি মনে করে আমাদের পাশের লোকটার দিকে আমার এবং আমার বন্ধুর চোখ পড়লো। বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। আমি আর আমার বন্ধু উইঠা দরজার দিকে দৌড় দিলাম, স্যান্ডেল ট্যান্ডেল কিচ্ছু নেই নাই, এক দৌড়ে চাইরতালার ছাদ থেইকা সিঁড়ি দিয়া নিচে আইসা রাস্তা দিয়া চোচা দৌড়। দেইখা মনে হইতেছিল আমরা কারো পকেট মাইরা দৌড় দিছি। ফাস্ট হইছে বন্ধুটা। যদিও ওরে জীবনে কোনোদিনও দৌড়াইতে দেখি নাই। কারণ ও ছিলো অসম্ভব অলস। তবে ও আজ দিল খুইলা দৌড় দিছে। দেশবাসীকে দেখায়া দিসে বেগম বাজারের ওই রকম চিপিচাপা দিয়া ক্যামনে ৮০ মাইল স্পীডে দৌড়াইতে হয়। তখনই মনে হইছিল, অলিম্পিকে আমাদের দেশের সোনা না হইলেও রুপা জেতার একটা সমূহ সম্ভবনা আছে। শুধু বেগম বাজারে একটু বুলু দেখার ব্যবস্থা এবং ওইরকম কারো সাথে দেখা করাইয়া দিতে পারলেই খেইল খতম। দৌড়াইয়া হিমালয়ে উঠতেও সময় লাগবো না। মজার বিষয় হইলো, আমরা শুধু দৌড় দেই নাই, আমাগো লগে বিদ্যুৎগতিতে উনিও দৌড় দিছে যার সাথে আমাদের চোখাচোখি হইছিল। আমরা বাইর হইছি এক দরজা দিয়ে আর উনি বাইর হইছে আরেক দরজা দিয়া। তবে নিচে আইসা আমাদের স্পীড এত বাইড়া গেছিল যে, ভিড়ের মইদ্যে দূরে ছোট হইয়া হারাইয়া গেছিলাম। ওনারে আর দেখি নাই, কে যে কোনদিকে দৌড় দিছে জানি না। জানেন ঐ ভদ্রলোক কে ছিলো? আমার ঐ বন্ধুর সব চাইতে বড় ভাই অর্থাৎ ওর বড় আরও তিন জনের পর উনি ছিলেন এবং সারা ফ্যামিলতে উনি ছিলেন সবচাইতে বড়। তখন বুঝি নাই মাগার এখন বুঝি উনি কেন গেছিলো ওইখানে, সবাইতো সুখী হতে চায়, কেউ সুখী হয় কেউ হয় না...