বুড়িচাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮
ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। রোদের কড়কড়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে চারদিকে। থেকে থেকে বয়ে যাচ্ছে ঝিরঝির হাওয়া। দুলে উঠছে গাছের পাতা। উঠোন ছাওয়া ঘাসবনে নানা রকমের গাছ। আম, কাঁঠাল, তেঁতুল, লিচু, সফেদা এরকম। বেশিরভাগ গাছই এখনও ফল ধরার বয়সে পৌঁছেনি। গাছে গাছে পাখি ওড়াউড়ি করছে। আর নানা স্বরে ডেক যাচ্ছে। কোনও গাছ থেকে ভেসে আসছে কুককু কুককু, আবার কোনও গাছ থেকে কাঠঠোকড়ার একটানা ঠকঠক শব্দ। ডাকছে বনটিয়া। সবুজ দেহটি নিয়ে উড়ে যাচ্ছে এডালে-ওডালে। কত যে পাখি এই বাড়িটা ঘিরে! সকাল দুপুর বিকেল কেবলই চারদিক কিচিরমিচির।
ঘাসবনে প্রজাপতি উড়ছে। চৌকাঠে বসে আমি চেয়ে আছি। দু’ধাপ সিঁড়ির নিচে মাটিতে ঝিঁঝিপোকার কয়েকটি গর্ত। ঝুরঝুর মাটি তুলে গর্তের মুখে গোল ঢিবির মতো বানিয়ে ফেলেছে। একটানা তারাও ডেকে যাচ্ছে। আর কোনও শব্দ কোথাও নেই। সুনসান। কিছুই ভাবছি না আমি। বসেই আছি। দু’পা সিঁড়ির ওপর ছড়িয়ে দেখছি, নির্জন দুপুরের ছবি। শুনছি দুপুরের শব্দ। যা দেখছি, যা শুনছি, তা-ই আমার ভাবনার শাদা কাগজে ছবি হয়ে ফুটে উঠছে। অথচ যা ছবি, তা তো আমার সামনেই। তবে আর ছবি কেন? তাহলে কি মানুষের ভেতরে ও বাইরে দুটো চোখ রয়েছে?
এই যখন ভাবছি, দেখি যে, মেহগুনি আর বুনো ঝোপঝাড়ের ভেতর সরু পথটুকু দিয়ে এক লোক হেঁটে আসছে। গ্রামে প্রত্যেক ভিটের ওপর দিয়ে এরকম চলার পথ আছে। তবে তা খুব ঘনিষ্টজন ছাড়া ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। কিন্তু ফেরিঅলা এ পথ দিয়ে কেন? আমি চেয়ে রইলাম তার দিকে। কাছাকাছি এসে আমার থেকে একটু দূরে ঘাসের ওপর সে নামিয়ে রাখল ঝাঁকা। দেখলাম, স্তূপীকৃত খাতা। ও আচ্ছা, লোকটা তাহলে কাগজ কেনে। কিন্তু ঝাঁকা দেখে তো মনে হচ্ছে ভর্তি, আর কাগজ কিনে রাখবে কোথায়?
ঝাঁকার সামনে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। কী যেন বিড়বিড় করছে। আমার দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। মানে কী এসবের? আমি হাঁক দিলাম, এই যে ভাই, আমি কাগজটাগজ কিছু বেচব না। আপনি যান।
ফেরিঅলা আমার দিকে তাকালো না। যেন শুনতেই পায়নি। ঝাঁকার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। আমি উঠলাম। তার সামনে গিয়ে বললাম, কী ব্যাপার, কথা শুনতে পাচ্ছেন না আপনি? আপনাকে তো যেতে বলেছি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
লোকটা আমাকে দেখল না। তবে আমি দেখলাম, তার চোখে টলটল করছে পানি। লোকটা কাঁদছে। আর কী যেন বিড়বিড় করছে। আমি কান পাতলাম। মনে হচ্ছে কী একটা কবিতা যেন সে পড়ছে বিড়বিড় করে। আমি শুনতে চেষ্টা করলাম:
পৃথিবীর সব অক্ষর মৃত, আর মৃত গোধূলির রঙ
গাছের পাতার সবুজ, নরম রোদের বিকেল কিংবা
শিশুদের খেলার মাঠ অক্ষরের ভেতর দিয়ে
আমাদের অনুভূতি হয়ে ওঠে, আর তখন যে রঙ আমরা দেখি
যা দেখি, তাই কেবল জীবিত
এভাবে সবকিছুই, পৃথিবীর যা যা রঙ
যা যা বস্তু, সবকিছু
ছেঁকে তুলে আনে অক্ষর
যা তুলে আনে
অক্ষরের বাইরে তা কত মূল্যহীন
মানুষ পৌঁছতে পারে না তার সৌন্দর্যে
যদিও চোখের সামনে সব, সব কিছুই
তবু আড়াল রাখে চোখ
যতটা পারে তুলে আনে অক্ষর আমাদের অনুভূতি রাঙিয়ে
এরপর পড়ে থাকে রঙ ও বস্তুর ফসিল
মানুষের কাছে যা মৃত
এভাবে মৃত হয়ে ওঠে অক্ষর, আর
জীবিত হয়ে বেঁচে থাকে যা এসেছিল অক্ষরের ভেতর দিয়ে, তা
মানুষের অনুভূতির অসীমত্বে।
বিড়বিড় করতে করতে লোকটা বসে পড়ল ঝাঁকার সামনে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা ঘুঘু। চড়া রোদে লোকটা ঘেমে উঠেছে। ঘামতে শুরু করেছি আমিও। একটু আগেই আমি ভাবছিলাম যে, মানুষের ভেতরে ও বাইরে দুটো চোখ রয়েছে। আর সে কথাই লোকটা বলে ফেলল কী সুন্দর বানিয়ে বানিয়ে। লোকটা তো তাহলে কবি, ফেরিঅলা নয়। আবার মনে হলো, ফেরিঅলা হলেই কী সে কবি হতে পারে না? লোকটা হয়তো দুটোই। একইসঙ্গে কবি, একইসঙ্গে ফেরিঅলা। কিন্তু এসব কাগজ কি? ঝাঁকার ওপর একটু ঝুঁকে আমি কাগজের লেখাগুলো পড়তে চেষ্টা করলাম। মুহূর্তে টের পেলাম, শিরশির ঠাণ্ডাস্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধরাস ধরাস শব্দ শুনতে পাচ্ছি। যেন আমি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছি। তবে বাকরুদ্ধ। কাগজের একটি বাণ্ডিলের ভাঁজে আমি লেখা দেখলাম, আবু তাহের সরফরাজ। আমার চোখের পাতা পড়ছে না। আমি আরও দেখলাম, নামটার ওপরে ছোট হরফে লেখা সুখিয়া। মুহূর্তে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা দেহে। আরে, এ যে আমারই লেখা উপন্যাস। সময়ের স্থিরতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে যা আমি লিখেছি। চারদিকে বয়ে গেছে জীবনের স্রোত। তার ভেতর স্থির হয়ে আমি বসে থেকিছি, একা। জীবনের সব লেনদেন গুটিয়ে নিয়ে সংসারে থেকেও আমি বসে থেকেছি নিজের মুখোমুখি। আর লিখে গেছি। আমার আরেক আমিকে যেভাবে দেখেছি, সুখিয়া উপন্যাসে তাকে সেভাবেই আমি লিখে গেছি।
গভীর গভীরতর যন্ত্রণার ভেতর থেকে তুলে আনা আমার সেইসব মুহূর্তগুলো এই সুখিয়া। লোকটার কাছে এ পাণ্ডুলিপি গেল কীভাবে? আরসব বাণ্ডিলগুলোতে কীসের কাগজ? তড়াক করে গা ঝাড়া দিয়ে আমি কাগজের বাণ্ডিল একটা একটা করে খুলে ফেলতে লাগলাম। আর বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতে যেতে দেখলাম, কাগজগুলোতে আমারই সব লেখাপত্তর। এতকাল যা আমি লিখে গেছি। একদিকে জীবনের বিষ পান করেছি, আরদিকে লিখে গেছি সে বিষকে উগড়ে দিতে। যা আমি লিখিনি, ভবিষ্যতে লিখব, সেইসব অনুভূতির শব্দেরাও সারদিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাগজে। আমারই হাতের লেখা।
দৌড়ে ফিরে এলাম ঘরে। বইয়ের ট্রাঙ্কেও ওপর দেখলাম, খাতাগুলো নেই। তীরের ফলার মতো আবার বেরিয়ে এলাম লোকটার কাছে। লোকটা তখন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে খাতাগুলোতে। দাউদাউ জ্বলে উঠছে কাগজ। আমার শিরা-উপশিরায় ছুটছে আগুন। আমি ঝাপ দিয়ে পড়লাম ঝাঁকার ওপর। লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আর বলল, পুড়ে যাচ্ছে শিল্প। পুড়ে যাচ্ছে জীবন। আমার একজীবনের সঞ্চয়। আমি সরাসরি পৌঁছতে চাই ওইসব বস্তু আর রঙের ভেতর। অক্ষরের শাসন আমি মানি না।
এবার যেন আমি মুহূর্তে জমে গেলাম। কী বলল লোকটা? তার একজীবনের সঞ্চয়? সেই কী তবে আবু তাহের সরফরাজ? তবে আমি কে? আমিও তো আবু তাহের সরফরাজ। আমার চোখের সামনেই তো সে রয়েছে। সে তো আর ছবি নয়। অথচ আমার কথা সে শুনতে পাচ্ছে না। আমার হাত ঝলসে গেছে। ঝাঁকা ছেড়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর ঝাঁ করে একটা ভাবনা ছুটে গেল মাথায়। আমিই তাহলে আমার লেখা পুড়িয়ে ফেলছি। আমার জীবনের শ্রম। আমার বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু তা কী করে? সকাল ৯টার দিকে ছায়াবীথিকে নিয়ে রিপা স্কুলে বেরিয়ে গেল। আমি গোছল দিয়ে কোরআনের তাফসির পড়তে বসলাম। এরপর চৌকাঠে বসে সিগারেট জ্বাললাম। এরমধ্যে খাতাগুলো কখন পোড়ালাম? বেশ একটা ধন্দে পড়ে আমি লোকটাকে দেখতে লাগলাম। দেহের গঠন হালকা-পাতলা। মাথায় টাক। মাঝারি গড়ন। মুখে চাপদাড়ি। গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল। তবে দেখতে খুব শার্প। কিন্তু লোকটা তো আমি নই। তার চেহারা আমার মতো নয়। আমার চেহারাও তার মতো নয়। তাহলে দুজন একজন কীভাবে হলাম?
বিষয়টি ভৌতিক। সুতরাং আমি ভয় পেলাম। কিছু সময় পরই রিপা ইসকুল থেকে ছায়াবীথিকে নিয়ে ফিরবে। এসে যখন এ দৃশ্যের মুখোমুখি হবে, তারপর কি ঘটবে? আমি একজন নই, আমি দুজন। একইভাবে আবার, আমি দুজন নই, আমি একজন। এ হিসেব বেচারি মেলাতে পারবে না। ভয়ানক আতঙ্ক খেয়ে যাবে।
লোকটা আর কাঁদছে না। চোখের পানি মুছে ফেলেছে। এখন সে হাসছে। ভোরের আলোর মতো ঝরঝরে হাসি তার মুখে। আমার মনে হলো, লোকটি এ মুহূর্তে গভীরভাবে তৃপ্ত। শিল্প পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ঝিরঝির হাওয়া ছুটে এলো। ঝুরঝুর ছাই উড়িয়ে নিয়ে গেল। গভীর তৃপ্তির সাথে লোকটা হাসতে লাগল, আর মাথা দোলাতে লাগল। মুখে ঘাম।
আমি নিশ্চিত হলাম, এই মানুষটাই আসলে আবু তাহের সরফরাজ। নিজের সত্তাকে পুড়িয়ে ফেলার যন্ত্রণায় যে মানুষটা একটু আগেও কাঁদছিল। আর এখন সে হাসছে। এরকম ইচ্ছে তো কতবার আমারও হয়েছে। কিন্তু পারিনি। অথচ এই মানুষটা পেরেছে। পেরেছে বলেই রিপার কাছে এই মানুষটা সৃষ্টিছাড়া একটা কিছু। আমি কীভাবে তাকে বোঝাবো যে, শিল্প হচ্ছে ওই মানুষটার আত্মার প্রকাশ। যা আসলে ওই মানুষটাই। এর বাইরে তাকে যেরকম দ্যাখা যায়, তা তার নিয়তিতাড়িত জীবন। যে জীবন তাকে যাপন করতে হয়। যদিও তা সে চায় না। যা চায়, তার প্রকাশ সে করে তার শিল্পে। সেই শিল্পই যখন মানুষটি পুড়িয়ে ফ্যালে, ভাবতে পারো, জীবনের লেনদেন থেকে কীভাবে সে মুক্ত হয়ে যায়?
আমি জানি, নির্বিকার মুখে রিপা বলবে, এই মুক্তি কি ভালো? এভাবে যে মুক্ত হয়ে যায়, সে তো পাগল!
হ্যাঁ, পাগলই তো। আমিও নির্বিকার মুখে স্বীকার করে নেব। হয়তো বলব, কিন্তু ভেবে দ্যাখো, সে কিন্তু মুক্ত। আর একারণেই সে আনন্দিত। জীবন থেকে কোনও কিছু গেলেও তার ক্ষতি নেই, কোনও কিছু এলেও তার লাভ নেই। মানুষের সমাজে কোনও পাগল এরকম আছে, কখনও দেখেছো? জগৎ-সংসারে মানুষ এক ধরণের অভ্যস্ত জীবন-যাপন করে। এর বাইরে কোনও কিছু তারা নিতে পারে না। অথচ খালিচোখে যা মানুষ দ্যাখে, তার সীমা বিন্দুবৎ। মানুষের দেখার বাইরেই রয়ে গেছে বৃহত্তর জগৎ। সে জগতের সঙ্গে যখন কারও যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়, মানুষ তাকে বলে পাগল।
আর তাই, এই পাগলটাকে রিপার মুখোমুখি হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু পাগলা তো আমার কথা শুনছে পাচ্ছে না। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। কীভাবে তাকে চলে যেতে বলব? কিছু ভেবে উঠতে পারি না আমি। চড়া রোদে ঘাম ঝরছে কপাল দিয়ে। আমার বিস্ময় লাগে লোকটাকে। আমাকেও, আমিই তো আসলে লোকটা। কিন্তু আমরা দুজন।
যেপথে এসেছিল, সেপথে লোকটা হাঁটা ধরল। আমি ডাকলাম, দাঁড়ান, বলে যান আপনি কে?
লোকটি আমার কথা শুনল না। আমি তার পিছু নিলাম। জংলাপথ ছেড়ে লোকটা গিয়ে উঠল রাস্তায়। পেছনে আমিও। ডাক দিলাম, এই যে ভাই, আপনি কে?
লোকটা শুনলোই না যেন। হাঁটতে লাগল, নদী যেদিকে, যেদিকে।
রোদের তাপ বাড়ছে। দরদর করে আমি ঘামছি। লোকটাও ঘামছে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমি জিগেশ করলাম, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?
জবাব নেই। কেউ যে একজন তাকে কিছু বলছে, সে হুশও নেই। বেশ বিটকেল ব্যাপার তো!
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরেছে রিপা আর ছায়াবীথি। বেশি সময় আমি বাইরে থাকলে রিপার জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই। দিনরাত দিয়ে বাড়িতেই থাকি। লিখি। পড়ি। ঘুমোই। ছায়াবীথির সঙ্গে খেলি। এই হচ্ছে রিপার কাছে আমার জীবনের ছক। এর বাইরে বের হলে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। লোকটার পিছু পিছু এভাবে না হেঁটৈ বরং বাড়িতে ফিরে যাওয়া ভালো। লোকটা তো আমাকে গ্রাহ্যই করছে না। ডাকছি, শুনছেও না। এরচে ফিরে যাই। এরকম ভাবছি, কিন্তু ফিরেও যেতে পারছি না। লোকটা আমাকে টানছে। একটি ধাঁধার ভেতর দিয়ে সে আমাকে টানছে। আর আমার মন বলছে, লোকটা কে, আমাকে জানতে হবে। চুম্বকের মতো যেন এই টান।
প্রখর দুপুর। মোড়ের মাথায় পৌঁছে লোকটা বসল মুদি দোকানটার শানদেয়া বেঞ্চে। দোকান বন্ধ। মোড়ে লোকজনও নেই। এ সময়টাই থাকেও না খুব একটা। রাস্তার পাশে সর্ষেখেত। ছোট ছোট হলুদ ফুল ফুটে আছে। রোদে ঝলসে উঠছে ফুলের সৌন্দর্য। লোকটা এসব দেখছে। আমি এসে বসলাম তার পাশে। আমাকে সে খেয়ালও করল না। তারমতো চেয়ে রইল। খেতটা পেরিয়েই নদীর তীর। নদী বলতে কুমার নদ। এখন সরু খাল। রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতাদের পকেটে এখন প্রবাহিত এ নদ। প্রবাহমান দেহটি ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেছে। কিছু দূর পরপর উঠে গেছে বাঁধ। পনেরো-বিশ বছর আগে থেকেই শুরু হয় নদের এই দেহ ব্যবচ্ছেদ। চাষ করা হয় হাইব্রিড মাছ। কুমার নদ অনেক আগেই হারিয়ে বসেছে তার চরিত্র। এখন হয়ে গেছে হাইব্রিড নদ। স্থানীয় লোকজন বলে, কাটাখাল। এ খালে নদীর প্রাকৃতিক মাছ এখন হয়ে গেছে হাইব্রিড মাছ। মৎস্যজীবীরা পেশা বদলে ফেলছে। আর এদিকে রাজনীতির বাইরেও সামাজিক দায়িত্ব হিশেবে পাতিনেতারা মৎস্যজীববী হয়ে যাচ্ছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মাছের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন এ জাতীয় লোকজন। অথচ নদটা যদি আগের অবস্থায় থাকত, তাহলে এসব নেতাদের এত কষ্ট করে জাতির সেবা করতে হতো না। কে না জানে, প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ভেতর দিয়েই নদীতে বিপুল মাছ পাওয়া যায়।
লোকটা উঠল। রাস্তা ছেড়ে নেমে গেল সর্ষেখেতে। এরপর আল ধরে এগিয়ে গেল তীরের দিকে। আমিও নেমে পড়লাম। লোকটা কোথায় যাচ্ছে? থাকে কোথায় সে? লোকটা একা, নাকি তার আর কেউ আছে? এসব কৌতূহল ভর করল আমার মনে। যদিও আমি জানি যে, লোকটার নাম আবু তাহের সরফরাজ। সে আর আমি, আসলে একজনই। আমার তো রিপা খাতুন আছে। ছায়াবীথি আছে। আর আছে... সে থাক। গূঢ়কথা বলতে সুফিদের নিষেধ আছে। লোকটারও কি এরকম আছে? কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল, যদি তা লোকটার থাকে, তবে সে আর আমি তো একজনই। এই হলো কৌতূহল।
রোদ টলটল করছে পানিতে। ছোট ছোট ঢেউ ভেসে যাচ্ছে। ওপর দিয়ে উড়ছে কয়েকটা মেছোবক। হঠাৎ হঠাৎ ছোঁ দিয়ে ঠোঁটে মাছ তুলে নিয়ে উড়ে এসে বসছে তীরে। গাছে গাছে নানা স্বরে ডেকে যাচ্ছে পাখি। গাছপালার ছায়ার ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটছি। লোকটি একটু আগে, আমি পেছনে। লোকটা এখন আমার চোখের সামনে একটা বিস্ময়চিহ্ন। লোকটিই যদি আবু তাহের সরফরাজ হয়, তবে এই আমি কে? লোকটি আমাকে দেখতে পাচ্ছে না, শুনতেও পাচ্ছে না আমার কথা, কেন? অথচ সে কীনা আমিই। এ রকম অনেক ধন্দই এই জীবনে আমি বহন করে বেঁচে থেকেছি। ধন্দের গেরো খুলতে যখন বসেছি, বারবার আতঙ্কিত হয়েছি। গেরো যত খুলছি, তত নতুন নতুন ধন্দ বেরিয়ে পড়ছে আমার সামনে। ঠকঠক কাঁপুনি তৈরি হয়েছে আমার ভেতরে। আবিষ্কার করেছি, জগতের কোনও কিছুই কোনও কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। একটা আরেকটার সঙ্গে আত্মিকসূত্রে বেঁধে বেঁধে আছে। দৃশ্যত যা বিচ্ছিন্ন, অদৃশ্যত তা অবিচ্ছিন্ন।
কিন্তু এই যে এখন, যে ধন্দের ভেতর দিয়ে আমি যাচ্ছি, এখানে আমার আর ওই লোকটার মাঝখানে গ্যাপটা কীসের? দুজন মানুষই একজন, অথচ তার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি, তার কথা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু সে পাচ্ছে না। এরকম কি হয়? দেখেছে কেউ কখনও? অথবা হতে পারে আমার দৃষ্টিভ্রম। নির্জন দুপুরে ভুতে পাওয়া মুহূর্তের ভেতর দিয়ে আমি যাচ্ছি। এরকম কথা তো আছেই, ঠিক দুপ্পুর বেলা, ভূতে মারে ঢ্যালা।
চারপাশ দেখতে দেখতে ধীরপায়ে লোকটা হেঁটে চলেছে। আমি তার পেছনে। ডাঙা থেকে একটু দূরে পানির ওপর মাছ পাহারা দেয়ার টংঘর। বাঁশের চারটে খুঁটির ওপর ছোট্ট একখানি শনের ঘর। টংঘর ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা গিয়ে দাঁড়ালো বাঁকে, যেখানটায় কাটাখালের বুকের ওপর দিয়ে উঠে গেছে মাটির বাঁধ। পায়ে চলার রাস্তা। এরপরই আড়াআড়ি বয়ে গেছে চিকন দেহের ব্রক্ষপুত্র নদ। এটাও প্রায় শুকনো। বুক পর্যন্ত হবে পানি। ঢালু দুই পাড় ধরে নরম সবুজ ঘাসের বিছানা।
এই বাঁকেই পাটকাঠির বেড়া দেয়া একটা কুঁড়ে। নদীর দিকটা খোলা, তিনদিকে বেড়া। ওপরে টিনের চালা। দরজা নেই। লোকটা গিয়ে দাঁড়ালো ঘরটার সামনে। কিন্তু ঘরটা এখানে ছিল না। ছায়াবীথিকে নিয়ে প্রায়ই বিকেলে আমি বাঁকটায় এসে বসি। টকটকে লাল সূর্যটা নীলিমার সব রঙ শুষে নিয়ে ছড়িয়ে দ্যায় রক্তিম নরম আভা। ছায়াবীথি খিলখিল হাসে। কিন্তু কখনও এই ঘরটাকে আমরা দেখতে পায়নি। দেখে তো মনে হচ্ছে, অনেক দিনের পুরনো ঘর। ভেতরে একটা চোকি পাতা। খড়ের বিছানা। তেল চিটচিটে বালিশ। আর কিছু নেই ঘরটাতে। দরদর ঘামছে লোকটা। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে কপাল মুছে তাকালো নদীর ওপর দিয়ে, দূরে। রোদের উত্তাপ কমতে শুরু করেছে। শাদা শাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কয়েকটা বক উড়ছে নদীর ওপর। কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে পানিতে। পারে ঘাস খেতে থাকা একটা গরু মুখ তুলে ডেকে উঠল, হাম্বা।
চারপাশের এইসব ছবি আর শব্দের জগৎ আমার দেখা। কিন্তু এই ঘরটা দেখিনি, কেন দেখিনি? এখন কেন দেখছি? ধাঁধার গোলকে ঘুরতে ঘুরতে আচমকাই স্থির হয়ে দাঁড়ালাম। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফয়সালা এখন কে করবে? আহ! মানুষের জ্ঞান কত ক্ষুদ্র! অথচ মানুষ কেবলই বুঝতে চায়। জগতের সবকিছু বুঝে নিতে চায়। কিন্তু বুঝতে যাওয়ার পথে গিয়ে মানুষ পড়ে যায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে। আমিও আগে পড়তাম। এখন পড়ি না। আমি জেনেছি যে, বিশ্বাসই প্রেম। প্রেমই আল্লাহ। তিনিই একমাত্র পরম পবিত্র। তার আত্মাই তিনি ফুঁ দিয়ে আদমের মুখে ঢুকিয়ে দেন। এরই ফলে প্রাণস্পন্দন ঘটে আদমের দেহে। এই আত্মার গতি সবসময়ে ঊর্ধ্বদিকে। পরম আত্মা, মানে পরম সৌন্দর্যের সাথে লীন হয়ে যেতেই
সে ব্যগ্র থাকে। মানুষের দেহ মাটি দিয়ে তৈরি। মাটির স্বভাব নিম্নমুখি। দেহ তাই ভোগ চায়।
সুতরাং আত্মা সু, আর দেহ কু। দেহের, মানে বস্তুজগতের ব্যপ্তি সীমিত। এর বাইরে জগতের কত কত রহস্য। মানুষ তার কতটুকুই বা জানে? সু হচ্ছে বিশ্বাস, কু হচ্ছে অবিশ্বাস। অবিশ্বাসীরা জ্ঞানের সীমিত ধারণাকেই সারসত্য জেনে বিভ্রান্তি ছড়ায়। আর বৃহত্তর মানুষ তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেহেতু জনগণ ভোগ চায়, স্ফূর্তি চায়। যেহেতু তারা মূর্খ, জগৎ বিষয়ে উদাসীন। আবদুল গনি হাজারীর কবিতার দুটো বাক্য মনে এলো আমার। বিড়বিড় করলাম, হে আমার বিশ্বাসীদের উত্তরপুরুষ/আমরা আজও হেমলকের বিষভা- নিঃশেষ করে যায়...
বিশ্বাসীদের উত্তরপুরুষ হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঘরটার সামনে। লোকটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। আমি দাঁড়ালাম ঘরটার খোলা দিকে। দেখি যে, লোকটা শুয়ে পড়েছে। কী যেন একটা গান ভাজছে গুনগুনিয়ে। পরিতৃপ্তি চোখমুখে। ঝিরঝির হাওয়া ছুটে এলো নদীর ওপর দিয়ে। পাশ ফিরে লোকটা ঘুমিয়ে পড়ল।
এবার কি? মাল তো ঘুমিয়ে পড়ল। কখন জাগবে তার তো কোনও নিশানা নেই। তবে কি আমি দাঁড়িয়ে থাকব, নাকি ফিরে যাব? এরপর আবার যখন আসব, পাব তো লোকটাকে? এই যেমন এখন পাচ্ছি।
খর দুপুর। নদীর ঢালুতে কয়েকটা গরু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘাস খাচ্ছে। তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে একটা বাছুর। পানির ওপর কালো জাল গুটিয়ে নিয়ে বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে আছে জেলেদের মাঝধরা ভেসাল। বাঁশের গোড়ায় নদীর মাঝামাঝি বাঁধা ছোট নৌকা। মানুষজন কোথাও নেই। ঝিম ধরে আছে দুপুর। দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।