জামাল আহমেদ
বুলবুল চৌধুরীর দুটি গল্প
প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০১৮
জলঝড়
মুখ সাপটানো স্বভাবের জোরে ফালান কৈবর্ত মাছ বেচায় গাহাকের গাঁটের কড়ি ভালোই আদায় করতে পারে সেই তুলনায় কার্তিক কৈবর্তের স্বর অনুচ্চই বলা যায়। তাই হাটবাজারে দৌড়ে যাওয়ার তাবৎ দায়িত্ব তার দিকেই বর্তায়। অবস্থাগতিকে জাল দেখা আর রান্নাবান্নার কাজ অনেকটা আগ বাড়ানো হাতেই সেরে নেয় কার্তিক। গতকাল দুপুরে প্রায় আধা খাড়ি মাছ নিয়ে ডিঙি ভাসিয়ে ফালান গিয়েছিল ছাদনার হাটে। সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরে সে কুপির আলোয় বসে মাছ বিক্রি বাবদ পাওয়া তিন শ বিরাশি টাকা পরপর তিনবার গুনল। তা লক্ষ করে কার্তিক প্রশ্ন তুলেছিল, ফালানদা, কী অত্ত হিসাব করতাছ! কোনোহানে ভুলনি হইছে?
না রে।
তাইলে?
ভাবতাছি মাছ বেইচা এক দিনে তিন শ বিরাশি টাকার তিন গুণ মুডে পাইলে লাভ হেইডারে কয়!
সঙ্গীর অমন উক্তিতে কার্তিকের চৈতন্যে স্মৃতিছবি খেলা করে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কৈয়া জাল বাওয়ায় গিয়ে প্রতি দফায় ডিঙির খোলভরা পুরাইন্না কই, মাগুর, শিং, গোলাইয়া, মেনি ইত্যাদি কত কী মাছ মিলেছে। অতীতে সেগুলো ধরতে জালের পাউয়া বড় করা হতো। কিন্তু জগৎময় মানুষের ঘরে মানুষের সংখ্যাই শুধু যোগ হওয়ায় সেসব মাছ গেছে তাদের পেটে। আজ সময় বুঝে ছোট আকারে মাছ আটকাতে জালের পাউয়া ছোটই বুনতে হয়। এ রকম বিচার টেনে নিয়ে কার্তিক বলেছিল, আগিলাকালের মাছ থাকলে হেই দিয়া ডিঙির খোল ভরান যাইত। এই দিনে জালে আটকে ছোডগুলান। ওই বেইচা তিন গুণ পয়সা পাওনের আশা স্বপন দেখনের সোমান।
তা শুনে ফালান জবাব দিয়েছিল, স্বপন না রে, স্বপন না। আরে, কইয়া জাল বাওয়া ছাইড়া ইলিশ মাছের বিহি ধরলে দেখবি বহুত টেকা আসতাছে।
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, সে কি সহজ ব্যাপার? ইলিশ কিনতে হলে প্রথমে যেতে হবে নরসিংদীর মৎস্য আড়তে। তারপর সেসব খাড়িতে বরফঢাকা করে তবেই বাসের ছাদে চড়িয়ে ফিরতে হয়। আর অতগুলো ইলিশ মাছ কিনে আনার টাকা কি দুই-একজনের কাছেও আছে! তাই সে চিন্তিত স্বরে শুধিয়েছিল, ফালানদা, হেইডা কেমনে সম্ভব।
কার্তিকের এহেন জিজ্ঞাসায় ফালান জানিয়েছিল, এবারে ছাদনার হাটে গিয়ে নাকি তার ঠাকুরদার মামার ঘরের নাতি সোমেনের সঙ্গে প্রথম চিনজান ঘটেছে। সে ইলিশ মাছ বেচেই বড় মহাজন হলো। তবে আত্মীয়তার সুবাদে ফালানকে এই ব্যবসায় লাগে কিছু অর্থের জোগান দেওয়া ছাড়াও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে তৈরি আছে সোমেন। তার কথা কানে গেলেও কার্তিকের মাঝে বিষয়টাকে ঘিরে কোনো চাঞ্চল্যই জাগেনি। কী দরকার তার খোঁজ নিয়ে যে, বহু বছর বাদে দুয়ের অমন পরিচয় হলো কোন সূত্র পেয়ে! এর চেয়ে কত বড় বিস্ময় তৈরি করল ফালান। মনে পড়ে, মাস দেড়েক আগের এক রাতে কার্তিককে নিয়ে সে ঢুকেছিল বিজন সাহুর বাড়িতে। আর তাকে একটা ঘরের পেছনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, এইদিক কেউরে দেখলে টিনের বেড়ায় টোকা দিবি।
হাঁ ঈশ্বর! মাঝবয়স্ক মানুষ বিজন সচ্ছল গৃহস্থ। তার ফরসা-মোটা আর গোলগাল মুখের ওই বউ গর্ভে ধরেছে দুই মেয়ে। কিন্তু বিজনের স্ত্রী কোন ঘোরে পড়ে পরমানুষকে লুকিয়ে দেহ দেয়! তবে এসব প্রশ্ন মনের গহনে তোলপাড় জাগালেও তা পাঁচ বছরের বড় ফালানকে শোনাতে বাদ রেখেছে সে।
তারপর প্রতিদিনের নিয়মে চুলোয় ভাত চড়াবার মুহূর্তে তার জাল বাওয়ার সঙ্গী ডেকে উঠেছিল, কার্তিক রে।
কী?
মাছ লইয়া হাটে যাওনের কালে বিড়ি আছিল না। একজনরে জিগাইতেই দেখাইয়া দিল পচিম-উত্তর কোনার পরান মিস্ত্রির টিনচালা ভিডাবাড়িখান। গিয়া কী পাইলাম জানস?
তার জিজ্ঞাসায় কার্তিক কৌতূহল প্রকাশ করতেই মিলেছিল ঘটনার পুরো বর্ণনা। বয়সের ভারে নুয়ে আসা পরান মিস্ত্রি হাতুড়ি-বাটাল চালাতে অসমর্থ। তার বউ মারা গেছে কলেরায় ভুগে। একমাত্র মেয়ের জামাই নদীতে জাল বাইতে গিয়ে জলের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে গেছে তা-ও অনেক দিন হয়। এখন ঘরে বসে চাল-ডাল-নুন-তেল, বিড়ি-সিগারেট, ম্যাচ ইত্যাদি সদাই বেচে দুয়ের অন্নসংস্থান চলে। সব শুনে কার্তিক ভেবেছে, ফাঁক বুঝে পরান মিস্ত্রি আর তার বিধবা মেয়েটিকে একবার দেখে নিলে হয়। আচ্ছা, কী নাম ওর! ফালানকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় উত্তর মিলত। তা-ও নিজের চাপা স্বভাবের কারণে বরাবরের মতো সে ছিল চুপচাপ।
রাতের রান্নাবান্না কার্তিক একা হাতেই সামলেছে। ভাতের পাশে সাজানো হয়েছে খানিক তিতাকলা ভাজি, চারটে মেনি মাছের ভুনা আর মসুরি ডালের চচ্চড়ি। খেতে খেতে ফালান বলেছিল, মাঝে মাঝে লাগে তর রান্ধা ছালুন আমার বউয়েরেও পিছ ফালায়।
গঠনের বিচারে ফালান দীর্ঘদেহী পুরুষই আসলে। তবে কিনা সে তালপাতার সেপাইয়ের মতো অমনই চিকন-চাকন একজন। তার বউও পেয়েছে জামাইয়ের প্রায় সমান উচ্চতা। অবশ্য স্বীকার করতেই হয়, ফালানের বউ নিশিন্দা পেয়েছে দোহারা বাঁধন যেমন, তেমনেরও বেশি লাবণ্য। সত্যি, সেদিকে চোখ গেলে ওই রূপ নির্নিমেষ দেখে নেওয়ারই সাধ জাগে। আবার প্রশ্ন ওঠে, নিশিন্দা বউদির মতো এমন মিঠে মেয়েলোক ছেড়ে কেন রাতগভীরে স্বামী ঢোকে হাতির মতো থপথপে পায়ে চলা বিজনের মোটা বউটির ঘরে!
রাতের খাওয়াদাওয়া হয়ে যেতেই ফালান একাকী গিয়েছিল জাল দেখতে। ফিরে এসে সে জানাল, জোয়ার থির ধরেছে। তাই মাছের চলাচল নেই। এ ক্ষেত্রে কার্তিক রাতভর ঘুম দিয়ে সকালে উঠে জালে নামলেই ঠিক হয়। অন্যদিকে সে নিজের ডিঙি বেয়ে ছুটে যায় বউয়ের কাছে।
আষাঢ়ের শুরুতে এই অঞ্চলে বেলাই বিল দিয়ে জোয়ারের আগমন ঘটে। ক্রমে ক্রমে নিজেদের গ্রাম ভেলতলী পেরিয়ে তা উজানমুখী হয়। তাই কইয়া জাল নিয়ে মাছ ধরতে তারা জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে এগোয়। কেননা, কম জলেই জাল খাটাতে হয়। আবার এসব হচ্ছে বড়ই বিরতিহীন কাজ। মাঝেমধ্যে বউয়ের নাম করে ফালান ঘরে ফিরলেও নিজে সংসারী না হওয়ায় কার্তিক কি সে রকম ছুটতে পারে! তবে জোয়ারের থির অবস্থানের কারণে মাছও গুটিয়ে যাওয়ায় রাতে ঘুরে ঘুরে জাল দেখার পর্ব ফুরোল। এমন অবকাশ পেয়ে সে গভীর ঘুম দিয়ে সকালে জাগল। ইতিমধ্যে পুব আকাশে সূর্য পূর্ণ আকার নিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে কার্তিকের একে একে মনে পড়ে গত রাতের কথা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ফালানের বলে যাওয়া পরান মিস্ত্রির নাম কেন তার মাঝে ফিরে ফিরে দেখা দেয়! তার বিধবা মেয়ে স্বামী হারানোর কী কঠিন বেদনাই না জানি পোহায়। ফের বাপের অন্নকষ্ট দেখা দেওয়াতে ঘরে বসে এটা-সেটা বিক্রি করার ধকল তো আছেই।
ডিঙি বেয়ে জাল তুলে তুলে গেলেও মাছ মিলল অল্প। সেগুলো নিয়ে কার্তিক গোলার টেকের ডেরায় পৌঁছাতেই চারজন গৃহস্থ এসে কিনে নিয়ে গেল। পরিমাণে বেশি হলে তা ডুলায় নিয়ে তাকে ছুটতে হতো আশপাশের কোনো বাজারে। তবে এই অবস্থায় হাতে পয়সা কম এলেও বিছানায় গা ছেড়ে গড়াগড়ি যাওয়ার সুযোগ তো পাওয়া গেল!
গত রাতের কিছু ভাত জল দিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন সেগুলো পাতে নিয়ে ডাল-চচ্চড়ির সঙ্গে লঙ্কা মিশিয়ে খায় কার্তিক কৈবর্ত। শেষে ডেরার ভেতর গা ছেড়ে সে ভাবে, পকেটে বিড়ি আছে যথেষ্টই। তা-ও ওসব কেনার ছল ধরে পরান মিস্ত্রির বাড়ি ঘুরে এলে কেমন হয়! আচ্ছা, ফালান যে ঘটা করে বর্ণনা দিল—ফাঁকে মেয়েটির দিকে তার কোনো লোভ কি পড়েছে! সত্যি, মানুষটার রকম-সকম বোঝা দায়।
ডেরার ভেতরে শুয়ে পশ্চিম-উত্তর কোণে তাকিয়ে পরান মিস্ত্রির ভিটেবাড়ি নজর করে কার্তিক। তবে বিড়ি কেনার নামে ওদিকে যাওয়ার চেয়ে গা ছেড়ে রাখলেই যেন তার শরীরের বিষ-বেদনা, ক্লান্তি অনেকাংশে মিলিয়ে যায়। কার্যত সে কিন্তু বিশ্রাম ছেড়ে নিশি পাওয়া মানুষের মতো ছুটে গিয়ে ডিঙিতে চড়ে বসে। আর দ্রুত হাতে লগি ঠেলে গিয়ে থামে পরান মিস্ত্রির উঠানে। কিন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে সে হাঁক ছাড়ে, কেডা আছেন গো বাড়িতে!
পরান মিস্ত্রির একখানা টিনের ঘরই সম্বল। তার আওয়াজ পেয়ে নিশিন্দা বউদির মতো লম্বা গড়নের একজন মেয়েমানুষ ঘরের দুয়ার ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। তারপর অপরিচিত একজনকে উঠানে দাঁড়ানো দেখে জানতে চায়, কী লাগব?
এক প্যাক বিড়ি যদি দিতেন!
এই কথা শুনে ও ঘরের ভেতর ঢোকে। পরিচয় জিজ্ঞেস না করলেও কার্তিক মনে মনে হিসাব কষে, এ নিশ্চয় পরান মিস্ত্রির বিধবা মেয়ে। এমনিতে রূপ পেলেও স্বামী হারানোর দুঃখ এবং অভাব-অনটনে ওর কমনীয়তা বেশ খুইয়ে এসেছে। স্বামী বেঁচে থাকলে ওর সিঁথিতে থাকত নিশি বউদির মতো সিঁদুরের মাখামাখি। পাশাপাশি মেয়েটির রূপও নিশ্চয় অধিক দল মেলত।
ঘর ছেড়ে পরান মিস্ত্রির বিধবা কন্যা বিড়ি হাতে নেমে আসে উঠানে। এতে আগে দাম মিটিয়ে দিয়ে ওর হাত থেকে বিড়ির প্যাকেটখানা নিজের দিকে তুলে নেয় কার্তিক। পরমুহূর্তে ঘরের ভেতর থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় নিশ্চয় পরান মিস্ত্রি ডেকে ওঠে, মালতী কই গো!
এতে সে সহজেই জেনে যায় মেয়েটির নাম। তবে কী জানি কী খেয়ালে কার্তিকের দিকে দু-চার ঝলক দৃষ্টি হেনে মালতী বলে, বাবার অসুখ যাইতাছে।
ওহ্, তাই কন। ডাক্তার-কবিরাজ কেউরে দেখাইছেন?
তার জিজ্ঞাসায় কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েটি হনহন পায়ে ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিচলিত বোধ করে কার্তিক। পরমুহূর্তে ডিঙি ভাসিয়ে ফিরতি পথ নেয় সে। আর ডেরায় উঠে বিছানায় গা ছাড়লেও কয়েক চকিতে দেখা মালতীর মুখচ্ছবি কেন ওর মনে বিষম রেখাপাত করে! ওর হাতে কি পরান মিস্ত্রির অসুখে অষুধ খাওয়ানোর মতো পয়সা নেই!
সূর্য খরখরে রোদ ঢেলে দিয়েছে পৃথিবীকে। কিন্তু মূলের ব্যাপার হলো, শ্রাবণ শুরুর আকাশ অঢেল অঢেল জল ধারণ করে থাকে। কখনো-সখনো সেসবের ভার সামলাতে না পেরে আকাশ মেঘে মেঘে ছাওয়াছাওয়ি হওয়া বাদেও ঘোর বর্ষণই ঢেলে দেয়। এখন ঊর্ধ্বাকাশ যে মেঘের অমন ঘনঘটাই বসিয়েছে। এবং সূর্য তারই আড়ালে মিশে যেতেই নেমে আসে ঝুপঝাপ বৃষ্টি। হঠাৎ হঠাৎ ডাকে মেঘ। বিদ্যুৎও একের পর এক চমক দেখায়। এতে সন্ধ্যার আবহ বিছিয়ে আসে চোখের সামনাটায়।
বর্ষণ বয় ঘনঘোর। এদিকে ফালান নেই পাশে। সে থাকলে এটা-ওটা আলাপে বেলা পেরিয়ে দেওয়া সহজ হতো। তার অনুপস্থিতিতে বৃষ্টির ঠান্ডা পরশ দেহে লাগায় ঘুম পায় কার্তিকের।
দুই.
মাঝ দুপুরে আকাশের মেঘ উড়ে উড়ে দূরে ধেয়ে যাওয়ার পর বর্ষণ থামে। গত রাতে জোয়ারের কোনো নড়াচড়া না থাকায় মাছের চলাচল থমকে ছিল। তবে বৃষ্টি নেমে আসায় ছোটাছুটি লাগার ফলে জালে সেসব বেশি বেশি আটকা পড়বে, এমন ভেবে নিয়ে ফালান দুপুরে গোলার টেকে পৌঁছায়। ডেরায় ফিরতি মুখে সে টিনের কৌটায় করে বেশ কতেক মুড়ি ও পরিমাণমতো আখের গুড় এনেছে। সকালে তার বউ খিচুড়ি রেঁধেছিল। তা থেকে বাটি ভরে কিছু খিচুড়ি কার্তিকের জন্য আনা হয়েছে। এখন সেসব সঙ্গীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ফালান ডাকে, কার্তিক রে।
কী?
আমার মনডা বহুত কালা কালা যাইতাছে।
ক্যান?
নিশিন্দার লগে আমার কাইজা চলতাছে।
অমন জবাব পেয়ে অন্যজন বড় বড় চোখ করে প্রশ্ন তোলে, বেকতের সংসারে কাইজা থাকলেও আইজতক তোমগো দুইজনের একজনরেও হেমুন পাই নাই। তাইলে?
শোন, ব্যাপার কী হইছে, বুঝবি তো পইল্লা।
হ, কও তাইলে।
আইচ্ছা, আমার লগে যে বিজন সাহুর বউডার মইজ চলতাছে, হেইতানের কোনোডা নি নিশিন্দার কানে দিছস তুই?
ফালানের এমন জিজ্ঞাসায় কার্তিক ভরাট এবং উচ্চলয়ে জবাব ফেরায়, ডাকাও নিশিন্দা বউদিরে আমার সামনে। তাইলেই টের পাইবা কেডা দায়ী।
হ, তর উপরে আমার বিশ্বাস আছে। তয় ব্যাপার হইলো, কয়ডা গোপন শেষতক গোপন থাকে! ওই, জালনি দেখছস?
হ, মেঘ নামনে পাইছি পরায় এক ডুলা মাছ।
ভালা খবরই পাইলাম রে তাইলে। ওই বেইচা কয়ডা টেকা জুডবনে। শোন, আমি দুইফরের খাওন খাইয়া তয়ই ফিরলাম। অখনে আমি যে খিচুড়ি আনছি, খা তুই পেড ভইরা। ফাঁকে আমি জালের ঘুরনডিডা সাইরা ফালাই।
শোয়া ছেড়ে উঠে বসে কার্তিক। কিছু সময়ের ভারী ঢলে চরাচর যেমন কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে, জোয়ারেও তেমন লেগেছে জলের বাড়। এতে মাছ অবশ্য কানকো ফুলিয়ে চলতে গিয়ে জালে বেশি বেশি আটকা পড়বে।
হ্যাঁ, মাছ চাই, অনেক অনেক মাছ। সেসব বেচার বেশি পয়সা দিয়ে বয়সে নিজের চাইতে দুই বছরের বড় বোন সুচিতাকে সহসা সহসাই পাত্রস্থ করা সম্ভব।
ফালানের আনা খিচুড়ি খেতে বসে কার্তিকের চোখ যায় আকাশে। সময় অনুপাতে সূর্য ঠিক ঠিক রোদ বিলিয়ে যাচ্ছে। তবে কিনা, দূর থেকে ভেসে আসা মেঘে হঠাৎ হঠাৎ ঢাকাও পড়ছে। এদিকে সে রকম হঠাৎ হঠাৎ মালতীর মুখখানা কেন ভেসে ভেসে এসে ঠাঁই নিচ্ছে তার দু-চোখের মণিতে। কার্তিকের শেষ জিজ্ঞাসায় পরান মিস্ত্রির বিধবা মেয়ে কোনো জবাব দেয়নি। বাবাকে ডাক্তার দেখাবার মতো পয়সা কি নেই ওর কাছে! তাই কি সংকোচ মেনে উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো মালতী!
দূর, বহু দূর থেকে মেঘের ডাক ভেসে এসে আছড়ে পড়ে কার্তিকের কর্ণকুহরে। আহ্! নতুন করে কি আকাশে বৃষ্টি জমা হতে শুরু করল! নামুক ঢল। নামুক শো শো হাওয়া। তাতে যেন অনুভব অধিকতর উন্মাতাল রূপ পায়।
খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় গা ছাড়ে কার্তিক। তারপর মালতীর কাছ থেকে কিনে আনা বিড়ির প্যাকেট খুলে একখানা বিড়ি জ্বালে সে। আর তাতে প্রথম সুখটান মেরে নিয়ে ভাবে, পরান মিস্ত্রির মেয়ে বয়সে তার চেয়ে বড়। তার ওপর বিধবা। আবার অভাব-অনটন তাদের পিছু ধাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে কার্তিকের মা-বাবা কিংবা আপনজন তাতে সম্মতি দেবে নাকি! বরঞ্চ সে গিয়ে মালতীর হাতে কিছু টাকা তুলে দিলে উচিত সাহায্য করা হয়।
মুহূর্ত কয়েক আগে সূর্য ঝলমলে রোদ দিতে পারলেও এক্ষণে মেঘ একে-অপরে মিলিত হওয়ার খেলায় দিনের আলো তারই অতলে তলিয়ে যায়। তারও বেশ বাদে ফালান ফিরে আসে ডুলাভর্তি মাছ নিয়ে। সেগুলো কার্তিককে দেখাতে দেখাতে সে বলে, মেঘ যাওনে এত্তডি মাছ পাইলাম। দিনডায় আবার পাউয়ালও করছে রে। হেমুন গেলে রাইতে রাইতে মাছ দিয়া খাড়ি ভরন যাইব। ওই, তর লগে বিড়ি আছেনি?
নিজের কাছে বিড়ি থাকা সত্ত্বেও পরান মিস্ত্রির ঘর থেকে ছল করে বিড়ি কিনে আনার বিষয়টা সে চাপা রেখে বলে, হ, যা আছে এই দিয়া রাইত চলব আমার।
খেয়াল কইরা দেখ, তেল-নুন-ডাইল—কিছুনি লাগব। না, হগলডাই আছে।
হইল, তাইলে আমি মাছ লইয়া ছুডি ছাদনার হাডে।
পরমুহূর্তে ফালান ডিঙিতে চেপে লগি ঠেলে ঠেলে এগোয় গন্তব্যের নিশানা ধরে। ইতিমধ্যে আকাশে জমে উঠেছে কালো মেঘসম্ভার। পাশে পাশে চলে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। হাওয়াও ক্রমে ক্রমে ঘনীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রবল দাপটে। ডেরার ভেতর শুয়ে এসব দেখতে পাওয়ার পাশে পাশে মালতীর মুখখানা কেন তার চোখে অত করে ফুটে ওঠে!
ঝড় বয় তুমুল লয়ে। তাতে বাতাসও যুক্ত হয় সমানে সমান। মাঝে বিছানায় গা ছেড়ে দিতেই ঘুম এসে জড়ায় কার্তিককে। তারপর তার কিছুই মনে নেই।
তিন.
মানুষের সুখ-দুখ কিংবা জীবনের মোচড় কখন কেমন গড়ায়, তা নিয়ে প্রকৃতি মোটে চিন্তিত নয়। এসবই চলে আপন খেয়ালে। তারই ধারায় বৃষ্টি উধাও হয়ে পশ্চিম আকাশে শেষ বিকেলে শেষ সূর্য উঁকি দিতেই কার্তিকের ঘুম ভাঙে। পরমুহূর্তে বাইরে দৃষ্টি ফেলতেই সে অনুমান করতে পারে, সন্ধ্যা নামতে আর বিশেষ সময় বাকি নেই। দুপুরে ফালান জাল দেখে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয় সেসবের পাউয়ায় পাউয়ায় নানা পদের মাছ আটকেছে। তাই মাছ দেখার কাজে তাড়া নিয়ে ডেরা ছেড়ে সে ডিঙি ভাসায় জলে।
মেঘের গর্জন কানে আসে। বিদ্যুৎ চমকায় নিশিন্দা বউদির চিকন ঠোঁটের মতো চিকন রেখায়। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি চলে কার্তিকের গা-গতর ঘিরে। বাতাসও গতিপথ হারিয়ে বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি জুড়ল বুঝি। ঘুরে ঘুরে জালের মাছ তুলতে গিয়ে তার দৃষ্টি জলের নিচে থাকা মাটিতে নিবদ্ধ হয়। প্রকৃতপক্ষে চারদিকে আমন, খামা ধানে সবুজ বেষ্টনীই প্রথম লক্ষণীয় বিষয়। তবে জমির আল ধরে পাতা জালের আশপাশ জুড়ে মাথা তুলে আছে হিঙ্গা, মামার কলা, ঘেচু, শাপলা ইত্যাদি নানা জলজ ঘাস। কার্তিক দেখে, বাতাসের কারণে জোয়ারের গায়ে ঢেউ লাগায় সেসব কেমন লতিয়ে লতিয়ে চলছে।
জালের পরিমাণ কম নয়। ওসব দেখা সারতে সারতে পশ্চিম আকাশের সূর্য লাল রং ছড়ালেও অচিরেই মুছেও যায় মেঘের গ্রাসে। কার্তিক ডেরার দিকে ডিঙির মুখ করলেও পরমুহূর্তে তাকায় পশ্চিম-উত্তর কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পরান মিস্ত্রির বসতভিটার দিকে। কে জানে বুড়োর জ্বর কেমন যাচ্ছে। মালতীই বা কী করছে এই ভরসন্ধ্যায়! জালে তো যথেষ্ট মাছই পড়েছে। তা থেকে কয়েকটা ওদের দিতে অসুবিধা কোথায়!
ডিঙি চলে পরান মিস্ত্রির বাড়ির পথে। এতে আবার লেগেছে হাওয়ার টান। কার্তিকের মনের কোণেও মালতীর জন্য কী জানি কী আকর্ষণও আছে অঙ্গাঙ্গি। এ বড় অদ্ভুত এক খেলাই আসলে। এর আগে কারও জন্য তার অমনটা টানাপোড়েন অনুভূত হয়নি।
চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার ঠাঁই নিয়েছে। চলছে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। হাওয়ার তোলপাড় গাছের ডাল-পাতাতেই বিশেষ ধায়। সেসব পেরিয়ে কার্তিক উঠে যায় পরান মিস্ত্রির উঠানে। ঠিক সে মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকে গেলে তারই আলোয় সে পলকের চাহনিতে দেখতে পায় ফালান ও মালতী বারান্দার মেঝেতে একে অপরের জড়াজড়ি হয়ে আছে। আচ্ছা, এ কি সত্য, নাকি তার কোনো বিভ্রম।
ফের বিদ্যুৎ চমকে উঠলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। হ্যাঁ, জলের তলায়, যেমন জলজ ঘাস ঢেউয়ে ঢেউয়ে লতিয়ে ওঠে, নর-নারীর কামনায় দেহের মিলন নিশ্চয় তেমনেরও বেশি ঝংকার তোলে। অন্যদিকে নিজে অমন পাওয়া দূরে থাকুক, কাছ থেকে এ রকম দৃশ্যও তো প্রথম দেখা হলো তার।
ঝড় ওঠে। সেই সঙ্গে বৃষ্টিও কম গড়ায় কই। তাতে একাকার হতে হতে কার্তিক ভাবে, নামুক আরও বেশি জল। বয়ে যাক আরও বেশি ঝঞ্ঝা।
মাছ
নতুন জোয়ারের জল থাকে কাচের মতো। টেবিলে কিংবা ঘাসের ওপর, বা যেখানেই স্থাপন করা হোক না কাচ, তা ভেদ করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিচে কী আছে, এমনকি ধূলিকণা পর্যন্ত। প্রথম প্রথম জোয়ার উঠে আসার কালে নযর করা যায়, নিচে কী মাছ চলাফেরা করছে, কী জলজ ঘাস বেড়ে উঠছে, শাপলা মাথা তুলতে কত সময় নেবে। আর একটা কথা, জোয়ার এলে তা অনুক্ষণ পিলপিল পায়ে উঠে আসে ওপরের দিকে? নদী ভরে যায় ও স্রোতময় হয়। জমিজমাও জলে ডুবে যায়, একসময় ভিটেবাড়ির কাছে লুটিয়ে আসে জল।
তাছাড়া বর্ষাকালে অন্তরীক্ষে থাকে ভেজা বাতাস। রাত্রি শব্দহীন হলে সেই বাতাস বৃক্ষের শাখাপত্র, ঘাসের ডগায় খেলে যায় মগ্ন চৈতন্যে। উঁকি দেয় ঘরের জানালায়, বেড়ার ফাঁকে এবং কখনো কখনো জল থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ বয়ে এনে প্রবল ঝাপটা মেরে যায়। মনে হয়, যত মাছ এসেছে এবারে, পাট ক্ষেতের ভেতর, কি ছন জমিনের ভেতর, কি সবুজ ধানের ফাঁকে ফাঁকে? যেখানে যত রকম, যত মাছই থাক না কেন, সব ভেসে উঠছে শরীরের আঁশটে গন্ধ বাতাস তুলে নিয়ে যাবে বলে। তাছাড়া মাছের এখন যৌবনপ্রাপ্তিও। আজ হচ্ছে কালরাত্রি। পেরিয়ে দিচ্ছে কোনো রকমে, কানকোয় পিছল নিয়ে, চোখ লাল করে, অনমনীয় দ্রুততা নিয়ে ঘুরছে-ফিরছে মাছ। একটা অন্যটাকে স্পর্শ করছে? মুহূর্তের জন্য তাও।
কালরাত্রি হলেও সেখানে নিশ্চিত সৌরভ থাকে। অনন্য সুর থাকে। টুপটাপ মিষ্টি শব্দপাত হয় স্নায়ুতে। কিন্তু যে রাতে এ রকম কিছুই ঘটে না, পাশে অস্তিত্ব থাকতেও সাড়া আসে না, শবের মতো সটান শায়িত থাকে মাত্র, আর কখনো শীতলতা বিলিয়ে দিয়ে যায়, সেই রাতটা কী!
ইদ্রিস অন্ধকারে ডান হাত বউয়ের গলায় রাখল। বেড়ার ফাঁকে ভেজা বাতাস উঁকি দিচ্ছে। ঘরের ঝাঁপ খোলা থাকলে এই বাতাসটা সরাসরি ভেতরে ঢুকে যেত। খেলত দুজনকে ঘিরে। অথবা চুপচাপ বুঝত, কি হচ্ছে।
আয়চান ঘুমিয়ে গেছে। তার ভয় হচ্ছিল। হয়তো বউ তার ঘুমিয়েছে ঠিকই, তবে সে ডাকলেই ফুঁস করে উঠবে। সাপের মতো ফণা তুলবে সহজেই। ভাবতেই সারা শরীর হিম হয়ে যাচ্ছিল ইদ্রিসের। তবুও, অনেক ইচ্ছেতে সে ডাকল, আয়চান!
ভয় বাড়ল তাতে। এই ভয়টা অচেনা নয়, তারই, কিন্তু জ্বরগ্রস্ত ইদ্রিসের। এবং সেই সঙ্গে পিপাসা? পিপাসায় কাতর হয়ে উঠছিল সে।
আয়চান একবার নড়েও উঠল না। মরণ ঘুম ওকে নিয়ে নিয়েছে। তাহলে মৃতার পাশে শুয়ে আছে ইদ্রিস! স্ত্রীর মৃতদেহের পাশে! গুলিয়ে এল সব। আর যেন পৃথিবীর কিছু কোনোদিন সে দেখতে পাবে না।
অনেকক্ষণ পর সে যখন উঠে বসল, তখন মনে হলো, কেউ যেন অপেক্ষা করছে। জিজ্ঞেস করল, কেডা?
আসলেই কি কেউ! সে তা জানে না। তবে মনে হলো, এক্ষুণি কেউ হাঁটবে বাইরে। সেই সঙ্গে তার নাম ধরে ডাকবে। সে হাঁটুর ওপর থুতনি চেপে রেখে বসে থাকে। কোনো দিকে না তাকিয়ে ইদ্রিস চুপচাপ বসে থাকে কারো ডাক শুনবার আশায়।
যায়, সময় গড়িয়ে যায়, তবুও কেউ ডাকে না। কোনো শব্দই মনে হয় না অনেকক্ষণ। তারপর গোয়ালঘরে গরুটা মশার কামড় খেয়ে লেজ ঘোরায়। দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঊর্ধ্বের আকাশ দেখে ইদ্রিস। সজিনা গাছের ওপরে মেঘলা আকাশ। বাতাস পেয়ে সেই গাছের ডালা মৃদু দোলে। আর কোথাও কিচ্ছু নয়। পাশে আয়চান ঘুমুচ্ছে। বালিশের নিচে দিয়াশলাই।
কিন্তু বাতি জ্বালবে কেন সে? বাতি জ্বাললেই আয়চানের মুখ দেখতে পাবে। দেখা যাবে, আয়চানের মুখ বৃষ্টিভেজা শাপলার মতো ফুটে উঠেছে।
তারচেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো, ঘুম আসুক।
ঘুম আসুক। অথচ ইদ্রিস জানে ঘুম আসবে না। চারদিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল সে। বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাতাস আছে? মাছের আঁশটে গন্ধ ভরা। সেই বাতাস তাকে ফিসফিস স্বরে ডাকল, আইও, জব্বর জোয়াইরা মাছ উডছে!
মাছ? ইদ্রিস কম্পিত হাতে দিয়াশলাই বের করল। গত বছর মাছের জন্য টেঁডা বানিয়েছিল সে। এই দিনে মাছ না উঠে যায় কই!
কিন্তু আয়চান হারিকেন রেখেছে কোথায়? কুপি জ্বেলে খানিক খোঁজাখুঁজি করতেই ঘরের পুব কোনার তাকের কলসির কাছেই পেয়ে গেল হারিকেন। টেঁডা আছে গোয়ালঘরে। কিন্তু খালুই? খালুইয়ের সেটা যে ভাঙা!
চিমনি মুছে, কেরোসিন ভরে, হারিকেন জ্বেলে, ঘরের ঝাঁপ খুলল ইদ্রিস। সিরাজের বোধহয় খালুই আছে।
সাবধানে, যাতে কোনো রকম শব্দ না হয়, ঘুম নষ্ট না হয় আয়চানের, তেমনিভাবে ঝাঁপ বন্ধ করে গোয়ালঘর থেকে টেঁডা বের করে হাতে নিল সে। সন্ধ্যাবেলা কিছু বৃষ্টি হয়েছিল। তারপর থেকেই আকাশ বুকে মেঘ নিয়ে খেলছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে ইদ্রিস বুঝতে চাইল, বৃষ্টি এক্ষুণি নামবে কি না। মেঘ দ্রুত উত্তরের দিকে চলে যাচ্ছে। তবে অন্ধকার দারুণ। গাছপালা, পথ, জলরেখা আলাদা করা যায় না। পথও পিছল, কাদাও জমেছে যত্রতত্র। সারা বর্ষা এমন থাকবেই, শুকোবে না মাটি। বৃষ্টি এখন শিশুর কান্নার মতো, যখন-তখন।
কেনুর টেকে শিয়াল ডাকছে। ডাকছে তো না, কাঁদছে। দূর এলাকায় আত্মীয় মরার খবর শুনলে যেমন কাঁদে মানুষ, তেমন কাঁদছে।
বাঁশের সাঁকো পেরুতে পেরুতে রাত কত তা অনুমান করতে চাইল। আকাশ দেখে তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মাঝরাতও হতে পারে। হতে পারে, কিছুক্ষণের মধ্যে একেবারে ফরসা হয়ে যাবে চারদিক।
সাঁকো পেরিয়েই টানের বাড়ি সিরাজের। কয়দিন আগে সিরাজের বউ বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। ভালো আছে শালা। বউ যখন পাশে নেই, তখন শালার ঘুম আটকায় কে? ইদ্রিস তার আঙিনায় দাঁড়িয়ে ডাকে, সিরাজ, ও সিরাইজা, সিরাইজা রে…।
কোনো জবাব আসে না। সিরাজ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ইদ্রিসের কাছে অবাক লাগে। এদিকে শালায় ভুবন বলে মাছে ভরে গেছে আর শালা ঘুমোচ্ছে। ঘুমোচ্ছে বড় ডুবে ডুবে।
দরজায় সে ধাক্কা দেয় জোরে জোরে। ডাকে, সিরাইজা রে, সিরাইজা…।
নাক ডাকা বন্ধ করে লোকটা জেগে ওঠে। জিজ্ঞেস করে, কেডা?
দরজাডা খোল দেখি!
একটুক্ষণের মধ্যে দরজার খিল খুলে সামনে দাঁড়ায় সিরাজ। আলো দেখে চোখ কচলায়। তারপর বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে।
বাইরে দাঁড়িয়ে ইদ্রিস বলে, বইলে চলতো না। ধরবি যদি, উইঠা আয়, জব্বর জোয়াইরা মাছ উডছে।
মাছ? যে লোকটা ঘুমের প্যাঁচে টলছিল, এখন সেই লোকটা সিধে হয়ে ইদ্রিসের হাতে থাকা বাতির দিকে তাকাল। স্পষ্ট ঘুমতাড়িত কণ্ঠে সে বলে উঠল, হাইনজার সোময় জব্বর মেঘ হইছিলো না? উডতেও পারে, তাইলে মাছ উডতেও পারে।
ইদ্রিস বলল, তরতরি খালুইডা লইয়া আ¹া। দুইজনে মিল্লা এক চক্কর মারি গিয়া।
সিরাজ উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে খালুই বের করে আনল।
আকাশের মেঘ এখন উত্তরে যাচ্ছে। অন্ধকার এখনো গাঢ়।
খালুই হাতে চলতে চলতে সিরাজ জানতে চাইল, আসমানে হাজ জমছে। মেঘ নামবোনি?
ইদ্রিস উত্তর করে দেখস না, উত্তরের ফাই কাইড্ডা যাইতাছে মেঘ। ওইতে ঢল নামবো মোন কয় না।
বিন্দাছড়ির কাঁচা সড়কে উঠে সিরাজ জিজ্ঞেস করল, কোফাই যাবি? কেনুর টেকে দেইখা আইছি চুপচুপা জোয়ার বাইতাছে। হেফি ঘুরন দিলে পাবি তো মাছ।
ইদ্রিস খানিক ভেবে নিয়ে জবাব দিল, কেনুর টেকে যাবি? আইচ্ছা, আয় যাই তাইলে হেইদিকে।
ঘাটের দিকে নেমে গিয়ে কোন্দায় চাপল তারা। হারিকেন ও টেঁডা হাতে ইদ্রিস বসে থাকে সামনে। সিরাজ লগি ঠেলে।
রাতের আঁধারে টলটলে বর্ষার জলও ঠেকে কি কালো। জলজ ঘাস, ধানি জমি সব এখন কালো আর কালো। যেন আয়চানের মতো, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, মরার মতো একটানা পড়ে থাকে।
আইজ গোলাপীরে যাইয়া আননের কথা আছিলো। তাও আমার যাওন হইলো কই?? সিরাজ যেন অন্তঃস্বর শোনাল। কাকে শোনাল সে কথাটা? নিজের বউকে নিয়ে আসার কথা ছিল আজ। যেতে পারেনি। সিরাজ বোধহয় নিজের কাছেই নিজেকে দায়ী এবং দুঃখী করতে চাইল।
ইদ্রিস তখন আয়চানের কথা ভাবছে। আয়চানের নয় মাস যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ওর। বিছানায় শুয়ে পড়ার সময় কেমন খুলে খুলে যায়। কেনুর টেকে কোন্দা এসে থামতেই সিরাজ তাড়া লাগায়, নাইমা আয়।
হারিকেন হাতে জোয়ারের পানি পেরুতে গিয়ে হঠাৎ ইদ্রিস দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েমানুষ শুয়ে থাকবে পাশে, তবুও তুমি হাত রাখতে পারবে না শরীরে। ভরা শরীর আয়চানের। ঠোঁট ভরা কথা। সেই আয়চানও কেমন যেন হয়ে গেছে। বর্ষার মতো শুধু বেড়ে আসে, শব্দ করে না। আবার ঠিকঠাক ধরাও যায় না বর্ষাকে।
ডান দিকের জমি নিলুজিতে ভরা। আধ হাত জল সেই জমিতে। আলো ফেলে ফেলে মাছ খোঁজে ইদ্রিস, ডান হাতে টেঁডা ধরে রাখে।
লাল রঙের একটা বড় শিং লেজ নাড়তে নাড়তে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিল। তক্ষুণি সেটা গেঁথে নিল ইদ্রিস।
কী রে?
হিং! বাজাইয়া লইছি।
মাছ তাইলে উডছে!
ততক্ষণে ইদ্রিস বেশ বড় আকারের টাকি মাছ গেঁথে ফেলেছে। বলল, হেমুনডাই লাগে।
তারা উলুছনের ফাঁকে ফাঁকে মাছ দেখল। মাছ, প্রচুর মাছ উঠেছে। তারই আঁশটে গন্ধ নিয়ে বাতাস মেতে উঠেছে। হারিকেনের আলো বাতাসের ঝাপটা খেয়ে মধ্যেমধ্যে নিবু নিবু।
সিরাজ জিজ্ঞেস করল, বাত্তি নিববো?
হারিকেন দোলাতে দোলাতে কেমন অচেনা কণ্ঠে ইদ্রিস জবাব দেয়, নিবুক বাতি।
কেনুর টেকের চারদিকেই জল। শুধু মাঝখানের ছন জমিটাই ডোবেনি। কেনুর টেকের ঝোপ-জঙ্গলও তলিয়ে গেছে। তারা ঘুরে-ফিরে মাছ ধরে। মাঝে ইদ্রিস কি একটা কথা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। সে বোধহয় খবরটা নিতে চাইছিল, তর বউডারে এত্তোদিন হউর বাড়িত ফালাইয়া থুইলি?
কিন্তু পরে ব্যাপারটা ভুলে গেল বড় একটা জাগুর মাছ জুইত্তা গাঁথা করতে গিয়ে।
কিছুটা পেছন থেকে সিরাজ বলল, ইস, বাতাসডায় কী জার জার! পিরানডাও লইতে গিয়া ফালাইয়া আইলাম ভুলে।
ইদ্রিসের মধ্যে তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। তার মনে হচ্ছে, বাতি ছাড়াই ঘোর অন্ধকারের মাঝেও সে মাছ গাঁথতে পারে। ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে ঘন অন্ধকার জেঁকে বসেছে। আকাশ থেকে শুরু করে তা জলের গভীরেও একই রকম, একই ধারায় শুয়ে আছে।
সিরাজের ভালো লাগছিল না আর। ইতোমধ্যে খালুই প্রায় ভরে উঠেছে মাছে। তবুও দ্রুত ঘুরে-ফিরে জুইত্তায় মাছ গাঁথছিল ইদ্রিস। বাতাসের গন্ধও ভালো লাগছে না। বাতিটাও নিভবে যেন। গোলাপী ঘরে থাকলে স্বামীকে ধরে রাখত। গোলাপী থাকলে বুকের সাথে, আঁচলের নিচে তার মুখটা জাপটে ধরে রাখে। সে ভেবে পেল না, কি কারণে বউকে আনতে যায়নি আজ। চারদিকে ভালো করে তাকানোর পর সিরাজের খানিক ভয় ভয় হলো কেন জানি। সে ডাকল, ইদ্রিস!
ইদ্রিস কোনো জবাব দেয় না। সিরাজ আর চলতে পারবে না মনে হচ্ছে। সে মনে মনে সঙ্গীকে গাল দিচ্ছে, শালারে যেমুন মাছে পাইছে!
সেই মুহূর্তে এক ঝটকা বাতাস এল। তারপর আর এক ঝটকা বাতাস আসতেই নিভে গেল আলো।
ভয় পেয়ে গেল সিরাজ। অস্ফুট শব্দ করল, ইদ্রিস রে!
আশ্চর্য! কোনো জবাব না দিয়ে হারিকেন ফেলে টেডা হাতে মাছ গেঁথে চলে ইদ্রিস।
সিরাজ ফের জোর চিৎকার করে ওঠে, ইদ্রিস রে…!
লোকটা দ্রুত ছুটে যায় সামনের অন্ধকার থেকে আরো গভীরতর অন্ধকারের দিকে। যেন তার পাশে কেউ নেই। কেউ আসেইনি সাথে। সিরাজ তখন নিজের মধ্যে নিজেই কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছে। ইদ্রিস কেনুর টেকের ঝোপ-জঙ্গলের দিকে হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শেষবারের মতো সে চিৎকার করল, ই-দ্রি-সা-রে…!
তার সেই চিৎকারে কালো জল, মেঘময় আকাশ, ধানি জমি একটুও প্রকম্পিত হলো না তাতে।