বুদ্ধিবৃত্তির কথা: অবরুদ্ধ সময়

এহসান হাবীব

প্রকাশিত : আগস্ট ৩০, ২০১৮

কাকে বলে ফ্যাসিবাদ, কাকে বলে স্বৈরাচার? কাকে বলে একনায়কতন্ত্র আর কাকে বলে অবরুদ্ধ সময়? শব্দের পোস্টমর্টেম আজ আমরা করবো না। আমরা শুধু আমাদের চিহ্নিত করবো। আমাদের সময়ের পোস্টমর্টেম করবো। আমরা আমাদের চোখ দিয়ে দেখতে চাই আমাদের যাপিতজীবন। যে মৌল মানবিক প্রশ্নের ফয়সালায় আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম, ঠিক কতটুকু তার কাছাকাছি আমরা যেতে পেরেছি? স্বাধীন কি আমরা হতে পেরেছি? নাকি বিদেশি প্রভুদের তাড়িয়ে আমরা দেশীয় খোদার দাস হয়েছি কেবল?

প্রশ্ন তো একটা রয়েই গেছে, প্রভুত্বের অবসান কি আমরা ঘটাতে পেরেছি? ৮০’র দশকে স্বৈরাচার খেদাও আন্দোলনে সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হয়েছিল। আমরা দেখেছি আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ, লেখকসমাজ, শিল্পীসমাজ ও সাংবাদিকসমাজ একতাবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, কথা বলেছে, প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ করেছে। সেই পর্বতপ্রমাণ আন্দোলনের অশ্বডিম্ব প্রসবের পর আমরা দেখলাম বাংলাদেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্রণের উন্মেষ ঘটেছে। পরবর্তীতে আমাদের এই সুধী সমাজকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে দেখি। কিন্তু সেই প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থেকে গেল। প্রভুত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছি কি আমরা?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, আরো ভয়াবহভাবে প্রভুত্বের শেকলে বন্দি হয়েছি, দাস থেকে দাসতর হয়ে পড়ছি আমরা। আগে যেমন আমরা দাস ছিলাম কিন্তু মেনে নেইনি, প্রতিবাদ করেছি। এবার আরো যখন প্রত্যক্ষ দাসে পরিণত হয়েছি তখন সেটা আমরা মেনে নিয়েছি এবং সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। শুধু তাই নয়, নিজের এই গোলামিকে আমরা গৌরবভরে জাহির করছি। ফলে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ, লেখকসমাজ, শিল্পীসমাজ ও সাংবাদিকসমাজের অংশগ্রহণ যে মানবমুক্তির জন্য নয়, সেটা আজ প্রমাণিত। বরং নতুন এক সত্য আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তা হলো, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পুঁজিপতিদের, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিকদের ভাড়াটে হয়ে তারা একযোগে রাস্তায় নেমেছিল। যেহেতু বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বড়ো দুটি প্রতিনিধিত্বশীল শক্তি ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে ছিল, সেজন্য তারা ক্ষমতাকাঠামোতে নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্যই তাদের লেজুড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকে সহজেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল। যেহেতু বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের একটা বৃহৎ অংশ প্রকাশ্যে, গোপনে, ছদ্মবেশে এই দুই বুর্জোয়া গণণতান্ত্রিক দলের সাথে নিজেদের ভবিষ্যৎ জুড়ে দিয়েছিল, সেহেতু তাদের চ্যালেঞ্জ করার জন্য বাংলায় আর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের উপস্থিতি ছিল না। স্বৈরাচারের কেনা যে দু’একটা ছিল, তারা হালে তেমন পানি পায়নি। ফলে আশির দশকে বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ‘স্বৈরাচার বিরোধী’ হিসেবে নিজেদের ইমেজ পোক্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু আজ ত্রিশ বছর পর এই প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আবার আসছে যে, তাদের স্বৈরাচার বিরোধিতা কীসের স্বার্থে হয়েছিল? মানুষের স্বার্থে? নাকি মানবের আবরণে লুকায়িত তারা যে সমস্ত দানবদের সাথে নিজেদের আখের জুড়ে দিয়েছিল, তাদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য? এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া আজ জরুরি।

উনিশশো একানব্বই থেকে দুই হাজার ছয় সাল পর্যন্ত আমরা আমাদের শ্রম ও সমস্ত বোধ বুদ্ধি দিয়ে বাংলাদেশে দ্বিদলীয় ক্ষমতাকাঠামো গড়ে তুলেছি। আমরা এইটা মোটামুটি নিয়তিই বানিয়ে ফেলেছিলাম যে, ক্ষমতার পালাবদল মূলত দুইটি দলকে কেন্দ্র করেই ঘটবে। এই দেড় দশকে বাংলাদেশ স্রেফ দুইটি দলের দাসে পরিণত হয়েছে। বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজও এই দুইদলের গোলামি কবুল করে নিয়েছে। ফলে এই পনেরো বছরে আমরা দেখতে পাই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের কর্মকাণ্ড এই দুইদলের ক্ষমতাকাঠামোর নিরবচ্ছিন্ন পাহারাদারের ভূমিকা পালন করছে।

বলে রাখা ভালো, এর বাইরে যে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের একটা বিচ্ছিন্ন অংশ গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছেন এদের আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়ে ছেড়েছি। আমরা এদের অচ্ছ্যুৎ বানিয়ে রেখেছি। আমি এইখানে তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীর উমর, আবুল কাশেম ফজলুল হক, আনু মুহম্মদ, নুরুল কবির, আসিফ নজরুল, সৈয়দ আবুল কালাম প্রমুখ। যেহেতু এই অংশটি গণমানুষের কথা বলে, মুক্তির কথা বলে, সেহেতু তাদের কর্মকাণ্ড দ্বিদলীয় ক্ষমতাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে আমরা দেখি, ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের ভাড়াটে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিটি কখনো কখনো তাদের সুবিধা অনুযায়ী এদের সুরে সুর মিলিয়েছে। কিন্তু যেহেতু এরা সংগঠিত নয় এবং এদের সাথে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক গোষ্ঠি না থাকায় (প্রকৃত পক্ষে পড়তে হবে, বাংলাদেশে এরূপ বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব না থাকায়) এদের কর্মকাণ্ড উপর্যুক্ত দেড় দশকে অরণ্যে রোদন হয়ে ফিরেছে। ফিরে আসি পূর্বের কথায়, এই পনেরো বছরে বাংলাদেশের বৃহৎ দুইটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল প্রতি পাঁচবছর অন্তর একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করতো এবং পালাক্রমে ক্ষমতায় আসতো। ফলে এরা নিজেদের স্বার্থেই পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে জনসাধারণকে কিছুটা হলেও ছাড় দিতো। যেমন, উপর্যুক্ত পনেরো বছরে এই অঞ্চলের মানুষেরা সীমিত বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের সুযোগ পেয়েছে। বিরুদ্ধ মতবাদ এই সময়ে প্রচার করা না গেলেও অন্তত মডারেটররা মোটামুটি কথা বলতে পেরেছেন। বেসরকারি মিডিয়ায় টক শো, রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ অন্তত এগুলো জনসাধারণ করতে পেরেছে। যদিও এই সময়ে জঙ্গিগোষ্ঠির উত্থান ঘটেছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষের দিকে ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০১ সালে সিপিবির সমাবেশে ও রমনার বটমূলে বোমা হামলা, অন্যদিকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সমাবেশে গ্রনেড হামলা, ২০০৫ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা। উপর্যুক্ত পনেরো বছরে বাংলাদেশ এইসমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষণের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরুদ্ধ মত দমন, অর্থ পাচার, নিপীড়ন, লুটপাট ও ভোট ডাকাতির পাশাপাশি গণতন্ত্রহরণও বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু এসব ঘটনার কোনোটাই বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিটির তরফ থেকে আনচ্যালেঞ্জড থাকেনি। একদম সরকারের পা-চাটা ব্যতিরেকে আর সব শ্রেণির লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, কথা বলেছে, প্রতিবাদ করেছে। অন্ততপক্ষে করতে পেরেছেও।

কিন্তু গত প্রায় এক যুগে বাংলাদেশ এক ভিন্ন এবং ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করেছে। ২০০৭ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসককূল বাংলাদেশকে এক অন্য বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত করে তুলছে। সেইসাথে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিটিও আজ সদলবলে ক্ষমতার পাপাচার, নিগ্রহ, লুটপাট আর নিপীড়নের বিশ্বস্ত কুকুরে পরিণত হয়েছে। এর শুরুটা হয়েছিলো সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের দেয়া বিবৃতিদানের মধ্য দিয়ে। কতটুকু নির্লজ্জ আর বেহায়া হলে পরে এরূপ বিবৃতি প্রদান করা যায়! ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর বাংলাদেশে পূর্বের ধারাবাহিকতায় লুটপাট, অত্যাচার, দমন পীড়নের নতুন মডেল চালু হয়। পূর্বের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থেকে একধাপ এগিয়ে এবার শুরু হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায়, ভয়, পীড়ন আর লুটপাটের কার্যক্রম। সংসদে আইন পাশ করে কুইক রেন্টাল চালুর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় উন্নয়নের নামে শুরু হয় লুটপাট। দেশে উন্নয়নের নামে বহুগুণ বেশি ব্যায়ে চলছে উন্নয়ন কার্যক্রম। রাষ্ট্রীয় কোষাগার ফাঁকা করে এই উন্নয়নের আড়ালে উন্নয়ন চলছে একটি বিশেষ শ্রেণির। আর বাংলাদেশ ক্রমশ ঋণ আর করের ভারে ন্যূব্জ হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলো কারা ফাঁপা করে দিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর সকলের জানা থাকলেও সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিটি থেকে টুঁ শব্দটিও উঠছে না। কারণ এই শ্রেণির একটি বৃহৎ অংশ এই দুর্নীতির সঙ্গে পরোক্ষ/প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। আর যে অংশটি ক্ষমতাবলয়ের বাইরে আছে তারা ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। এবং তারা পুনরায় নিজেদের ক্ষমতাকাঠামোতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পথ খোঁজা ছাড়া নিজেদের ব্যক্তিগত এজেন্ডার বাইরে গণমানুষের এইসব দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে নারাজ বা বলছে না। কথা যা দুয়েকটা বলছেন, সেই ক্ষীণতর ধারার বুদ্ধিজীবীরাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, আবুল কাশেম ফজলুল হক, আনু মুহম্মদ, নুরুল কবির, আসিফ নজরুল, সৈয়দ আবুল কালাম এরাই। তবে এবার এদের সঙ্গে কিছু নতুন মুখও যোগ হয়েছে, মনির হায়দার, গোলাম মর্তোজা, আনিস রায়হান প্রমুখ। নতুন মুখের এরা সবাই সাংবাদিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু বাকি শ্রেণির মানুষ যারা বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চার সঙ্গে জড়িত সেইসব লেখক, শিল্পী, কি বুদ্ধিজীবী এরা এই সময়টাতে আশ্চর্য রকমের নীরবতা পালন করছে। অবশ্য কারণও আছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করে যখন মানুষের কথা বলার অধিকারকে কেড়ে নেয়া হয় আর ভয়ের সংস্কৃতি চালু করা হয় তখন ব্যক্তিগতভাবে একলা একা হয়ে কথা বলাটা ভয়ংকর হয়ে যায়। এই সময়টার আমরা দেখি চারটি বেরসরকারি চ্যানেল ও একটি দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে সরকার তার ক্ষমতার জোর দেখিয়েছে। এবং সাংবাদিক সমাজে চাকুরিচ্যুতির ভয় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। অপরদিকে ২০১৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে ৫৭ ধারাকে একটি ভয়ংকর কালো আইনে পরিণত করেছে। যার সাহায্যে আনু মুহম্মদ, আসিফ নজরুল, গোলাম মর্তোজাদের কণ্ঠে যে প্রতিবাদ ধ্বণিত হয় তা যাতে অবগুণ্ঠিত, ক্রুদ্ধ, অবরুদ্ধ মানুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বণিত হতে না পারে সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ৫৭ ধারার মাধ্যমে শুধু কথা বলার অপরাধে দেশে হাজারেরও উপর মামলা করা হয়েছে। আর যিনি এই মামলা খেয়েছেন তার জেল খাটাটাও এক ধরণের নিশ্চিত। এ এক মামলা, যার সাহায্যে ওয়ারেন্ট সমন ছাড়াই একজন পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করতে পারে। আর ধারাটি অজামিনযোগ্য হওয়ায় আসামির জেল খাটতেই হয়। এই সময়ে সরকারী দমন পীড়নে যুক্ত আরো একটি অনুচ্ছেদ, গুম। বিরুদ্ধ মতের লোকদের চিরতরে ভয় পাইয়ে দিতেই এই গুমের অবতাড়না। অপহরণ এবং গুম সমানতালে চলতে থাকে। বিরুদ্ধ মত ও দলের লোকদের একের পর এক অপহরণ ও গুম করা হলেও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিটি একেবারে চুপ হয়ে পড়ে। এটা কি ভয় না প্রভুভক্তি তা নির্ণয় করার জন্য আমাদের দেখতে হবে ২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পরের পরিস্থিতি।

২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় শাসন ব্যবস্থা পাকাকরণের পথেই এগুচ্ছে। এই সময়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিভিত্তিক শ্রেণিটির সিংহভাগই সরকারের সাথে তাদের ভবিষ্যত জুড়ে দিয়েছে। ফলে আমরা প্রথমেই দেখি এইরকম একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, কবি, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকরা বিনা চ্যালেঞ্জেই ছেড়ে দিয়েছে। ফলে সরকার একধরণের নৈতিক ভিত্তি পেয়ে যায়। এসময়ে সরকার তার বাহিনী ব্যবহার করে বিরোধিদলকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেয়নি। মানুষের সভা সমাবেশ এমনকি একত্রিত হওয়ার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। আর এভাবে বিরোধী দলকে চূড়ান্তভাবে দমন করে সরকার মনযোগ দেয় বিরোধী মত দমনে। সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের মতো একটি অরাজনৈতিক আন্দোলনও সরকার দমন করেছে নির্মমভাবে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে তারা আন্দোলনকারীদের ঘরে তুলে দিয়েছে। এই বিরোধী মত যদি সরকারের অনুকূলের কারো থাকে সেও এ থেকে রেহাই পায়নি। এর সবচে বড়ো প্রমান বিচারপতি এসকে সিনহা। সিনহার পরিণতি সমগ্র বাংলাভূখণ্ডকে একটি ভয় ও বোবার রাজ্যে পরিণত করে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপর ভর করে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে সিনহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে সরকার এই বার্তাটিই দিতে চেয়েছে যে, এদেশে বিরুদ্ধ মতের কোন স্থান নেই। বাংলাদেশের কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির মানুষ এই ঘটনাটির ন্যূনতম প্রতিবাদও করেনি। বিরোধীদল নিজেদের স্বার্থে কিছুদিন চিৎকার চেঁচামেচি করে হালে পানি না পেয়ে তারাও বাড়ি ফিরে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক সমাজের তরফ থেকে ঘটনাটির বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া না দেখানো শুধু সিনহাকে নয় আসলে বিপন্ন করে তুলছে সমগ্র ব-দ্বীপকে। সরকারের এই ব্লান্ডারটি আনচ্যালেঞ্জড হওয়ায় সরকার ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষাখাত ধ্বংস, বিদ্যুতের অনিয়ম, সড়ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, পরিবহন সেক্টরে সরকারি দলের অরাজকতা, ব্যাংকের ভল্ট থেকে রিজার্ভ গায়েব, স্বর্ণ গায়েব এইভাবে সমগ্র বাংলাদেশকে যখন ক্রমশ জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে তখনো বাংলার বিবেক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিটি নিশ্চুপ। এমনকি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জ্বলজ্বলে ক্ষত হয়ে ওঠা চট্টগ্রামের একরাম হত্যাকাণ্ড, যেখানে একরামের স্ত্রী ও কন্যাদ্বয়কে ফোনের অপরপ্রান্তে লাইভে রেখে ট্রিগার টেনে দেয়া হয়েছে একরামের মাথায়। আর একরামের স্ত্রী কন্যার মর্মস্পর্শী কান্না এদেশের কোটি মানুষ শ্রবণ করেছে, গুমড়ে ওঠেছে। কিন্তু সেই কান্না তাদের বুক চিরে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তখনো তারা এই সরকারের বিরুদ্ধে রা-টি করেনি। একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী যাদের পুরোধা, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ। এরা বিরোধীদল দমনে, খুন, গুমে চুপ থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারের অপকর্মের একপ্রকার বৈধতাই দিয়ে গেছেন, তাদের কেউ কেউ আবার যখন আগুন তাদের ঘরে লেগেছে তখন একটু আধটু ফোঁস করে উঠতে চেয়েছেন, কিন্তু পরক্ষণেই আবার অলীক ইশারায় মিইয়ে গেছেন। এই অবস্থার মধ্যে এই ভয়ের ট্যাবু হঠাৎ করে করে ভেঙে ফেলে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও উই ওয়ান্ট জাস্টিস আন্দোলন। এই আন্দোলনে সরকারের দমন পীড়নের মাত্রা এতোটাই ভয়াবহ ও নৃশংস ছিলো যে, এর বিরুদ্ধে সারা বাংলার মানুষ এককাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই আন্দোলনে সরকারি দল এবং সরকারি বাহিনী যুগপৎ নৃশংসতা চালিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে, প্রকাশ্যে শহীদ মিনারে নারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করা হয়েছে, ছাত্র হাত চালিয়ে দিয়েছে শিক্ষকের উপর। এই অবস্থায় ঘুমন্ত মানুষের বিবেক জেগে ওঠেছে। আমাদের পরীক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিটি এখানে সরকারে লেজ রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের আরো একবার লেজুড়বৃত্তির পরিচয় দিয়েছে। আমরা এই দুটি আন্দোলনে, কোটা সংস্কার ও সড়ক দুর্ঘটনাকে ইস্যুর প্রতিক হিসেবে দেখতে চাই। আমরা পরিষ্কার জানি প্রভুত্ব, আধিপত্য আর ক্ষমতার দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এই দুই প্রতিকী ইস্যুর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এই আন্দোলনও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বাহানায় চাপা দেয়া হযেছে। কিন্তু মানুষের ক্ষোভ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কি চাপা দেয়া গেছে? ৫৭ ধারা, গুম, খুন, অপহরণ, চাকুরিচ্যূতির ভয় দেখিয়ে মানুষের কণ্ঠ কি খুব বেশিদিন রোধ করা যায়? এই সময়টিকেই আমরা বলতে চাই অবরুদ্ধ সময়। বলতে চাই এটাই ফ্যাসিবাদ। এটাই একনায়কতন্ত্র। এইটাই স্বৈরাচারি শাসন।

বাতিল বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নিজেরাই নিজেদের জাত চিনিয়ে দিয়ে গেছে। নিজেরাই নিজেদের শাসক শ্রেনির দালাল হিসেবে চিহ্নিত করছে। এই সময়ে আরো যারা নিশ্চুপ আছেন। যারা এই বিপন্ন, অবরুদ্ধ, ক্রুদ্ধ মানুষের মুখে রবীন্দ্রনাথের নন্দনতত্ত্ব তুলে দিতে চান, যারা সাংস্কৃতিক আফিম নিয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন, যারা বুদ্ধের অহিংস বাণী নিয়ে ওৎ পেতে আছেন, যারা আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, লুটপাট নিশ্চিদ্র করতে চান, তারা আসলে একই পথের পথিক। তারা দালাল। এই দালাল শ্রেণিটিকে আমরা প্রত্যাখান করছি। বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির বিপরীতে যদি একজন নিরক্ষর শ্রমিকের পেশি এই অবরুদ্ধতার, এই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে ফুলে ওঠে ফুঁসে ওঠে, তাহলে ওই নিরক্ষর শ্রমিকইটিই আমাদের নেতা। আমরা তার নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত। কারণ সময় এখন এমন যে, প্রতিবাদের ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা এ মুখে রুচবে না।

লেখক: কবি