বিষ্ণু দে’র কবিতা
প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০২১
কবি ও প্রাবন্ধিক বিষ্ণু দে’র আজ জন্মদিন। ১৯০৯ সালের ১৮ জুলাই কলকাতার টেমার লেনে তার জন্ম। বাবা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন উকিল এবং মা মনোহারিণী দেবী ছিলেন গৃহিণী। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
জল দাও
তোমার স্রোতের বুঝি শেষ নেই, জোয়ার ভাঁটায়
এ-দেশে ও-দেশে নিত্য ঊর্মিল কল্লোলে
পাড় গড়ে পাড় ভেঙে মিছিলে জাঠায়
মরিয়া বন্যায় যুদ্ধে কখনো-বা ফল্গু বা পল্বলে
কখনো নিভৃত মৌন বাগানের আত্মস্থ প্রসাদে
বিলাও বেগের আভা
আমি দূরে কখনো-বা কাছে পালে-পালে কখনো-বা হালে
তোমার স্রোতের সহযাত্রী চলি, ভোলো তুমি পাছে
তাই চলি সর্বদাই
যদি তুমি ম্লান অবসাদে
ক্লান্ত হও স্রোতস্বিনী অকর্মণ্য দূরের নির্ঝরে
জিয়াই তোমাকে পল্লবিত ছায়া বিছাই হদৃয়ে
তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া
তোমারই ঘাটের কাছে
ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে-ঘাটে বাগানে-বাগানে।
মাসি
মাসি, তোর কথা বেঁধে রাখ্ তোর খোঁপায়,
আমার ও কালো কম্বলই ভালো,
যতবার ধোবে রংছুট নয়, পাকা।
মাসি, তুই বৃথা বকিস্, আমের ঝাঁকা
মাথায় তুলে নে ঘরে জামবাটি ভ’রে
আমচুর খাস্, থাকুক্ আমার কালো।
কষ্টিপাথরে যাচাই করেছি প্রেম,
আমার রাতের কারার আকাশে জ্বেলেছে একটি তারা,
আমাকেই বলে তার দুচোখের একটি সন্ধ্যাতারা।
নির্ভয় বীর, বিরাট আঁধারে সে অমাবস্যা
ছদ্মবেশের চাঁদ,
আমাকে কি তুই করবি কথার বিজলিতে দিশাহারা?
কোনো আশা নেই, মাসি তুই ঘরে গিয়ে
হাটের লোককে শোনাস্ জ্ঞানের কথা,
সে কানে মানাবে এসব কথার ছাঁদ।
ছড়াস্ নে তোর মুক্তার মালা, হবে না রে অন্যথা,
সে যবে আসবে শহরের কাজ সেরে
তাকেই করব বিয়ে।
আসবে অনেকদিনের হারের মধ্যে লড়াই জিতে
অনেক মিছিলে সঞ্চিত সংগীতে,
আসবে আমার সহিষ্ণু সংবিতে।
উঠানের গাছ কেটে কচি কলাপাতে
ক্ষেতের ধানের ভাতে
ঘরে সরতোলা ঘি দেব এক ছটাক,
দীঘির পাড়ের নালিতা শাকের ব্যঞ্জন,
খাসের বাঁধা মৌরলা মাছ, পাটলীর দুধে ক্ষীর
ওরে মাসি আমি দেব সুখ নিজ হাতে,
দেখব অবাক চোখে,
খাবেন পুণ্যজন।
আমার কথায় এখন যে দেখি মাসি তুই অস্থির।
ঘোড়সওয়ার
জন সমুদ্রে নেমেছে জোয়ার,
হৃদয় আমার চড়া ।
চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি-
কোথায় ঘোড়সওয়ার?
দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী! বর্শা তোলো ।
কোন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোলো?
নয়নে ঘনায় বারে বারে ওঠাপড়া?
চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি?
হৃদয় আমার চড়া?
অঙ্গে রাখিনা কারোই অঙ্গিকার?
চাঁদের আলোয় চাঁচর বালির চড়া ।
এখানে কখনো বাসর হয় না গড়া?
মৃগতৃষ্ণিকা দূর দিগন্তে ডাকি?
আত্মাহুতি কি চিরকাল থাকে বাকি?
জনসমুদ্রে উন্মথি’ কোলাহল
ললাটে তিলক টানো ।
সাগরের শিরে উদ্বেল নোনা জল,
হৃদয়ে আধির চড়া ।
চোরাবালি ডাকি দূর দিগন্তে,
কোথায় পুরুষকার?
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর!
আযোজন কাঁপে কামনার ঘোর
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?
হালকা হাওয়ায় বল্লম উঁচু ধরো
সাত সমুদ্র চৌদ্দ নদীর পার-
হালকা হাওয়ায় হৃদয় দু-হাতে ভরো,
হঠকারিতায় ভেঙে দাও ভীরু দ্বার ।
পাহাড় এখানে হালকা হওয়ায় বোনে
হিম শিলাপাত ঝঞ্ঝার আশা মনে ।
আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশে
পায়-পায় চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
কাঁপে তনু বায়ু কামনায় থরথর ।
কামনার টানে সংহত গ্লেসিয়ার ।
হালকা হাওয়ায় হৃদয় আমার ধরো,
হে দূর দেশের বিশ্ববিজয়ী দীপ্ত ঘোরসাওয়ার!
সূর্য তোমার ললাটে তিলক হানে
বিশ্বাস কেন বহিতেও ভয় মানে!
তরঙ্গ তব বৈতরণী পার ।
পায়-পায় চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
আমার কামনা প্রেতচ্ছায়ার বেশে ।
চেয়ে দেখ ঐ পিতৃলোকের দ্বার!
জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার-
মেরুচূড়া জনহীন-
হালকা হওয়ায় কেটে গেছে কবে
লোক নিন্দার দিন ।
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর,
আযোজন কাঁপে কামনার ঘোর ।
কোথায় পুরুষকার?
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গিকার?
আলেখ্য
আঁটসাঁট বেঁধে আচল জড়ালো কোমরে,
মুগ্ধ চোখের এক নিমেষের দেরিতে
লঘু লাবণ্যে লাফ দিয়ে হল পার ।
কালো পাহাড়ের গায় চমকাল রেখা,
শাড়ির শাদায় কস্তাপাড়ের সিঁদুরে
কষ্টিতে ঋজু কোমল শরীরে তরল স্রোতের ছন্দ ।
এই লাবণ্যে এই নিশ্চিত ছন্দে
আমরা সবাই কেনইবা পার হব না
সামনের এই পাহাড়ের খাড়া খন্দ?
তুমিই মালিনী
তুমিই মালিনী, তুমিই তো ফুল জানি ।
ফুল দিয়ে যাও হৃদয়ের দ্বারে, মালিনী,
বাতাসে গন্ধ, উৎস কি ফুলদানি,
নাকি সে তোমার হৃদয়সুরভি হাওয়া ?
দেহের অতীতে স্মৃতির ধূপ তো জ্বালি নি
কালের বাগানে থামে নি কো আসা যাওয়া
ত্রিকাল বেঁধেছ গুচ্ছে তোমার চুলে,
একটি প্রহর ফুলহার দাও খুলে,কালের মালিনী! তোমাকেই ফুল জানি,
তোমারই শরীরে কালোত্তীর্ণ বাণী,
তোমাকেই রাখী বেঁধে দিই করমূলে
অতীত থাকুক আগামীর সন্ধানী–
তাই দেখে ঐ কাল হাসে দুলে দুলে