বিবেকানন্দ ও বাংলাদেশের কট্টর মুসলমান
পর্ব ১
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ০৩, ২০২১
স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র ভারতবর্ষে খুবই সম্মানিত মানুষ। বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের কাছেও তিনি খুব শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। কিন্তু তার এই সম্মান বা শ্রদ্ধা কীসের জন্য? কখনোই এটা কি মূল্যায়ন করা দেখা হয়েছে যে, তাঁর মহত্ব নিয়ে যেসব কথাবার্তা হয় তার মূল কারণটা কী। মূলত তিনি ছিলেন হিন্দুধর্মের বা বেদ বেদাঙ্গের পুনরুত্থানবাদীদের দলে। বাংলাদেশের কট্টরপন্থী কিছু মানুষ যেমন চায় কুরান আর সুন্নাহ অনুসরণ করে দেশ চালাতে, নারীর শিক্ষা-কর্মসংস্থান বন্ধ করতে; বিবেকানন্দ তেমনই চেয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের কিছু ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া মুসলমান ইতিহাসকে যেমন পিছনের দিকে টানতে চাইছেন, বিবেকানন্দ ঠিক তাই চাইতেন। বিবেকানন্দ একা নন, বাংলার উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রায় সকল হোতারাই চাইতেন প্রাচীন ভারতে ফিরে যেতে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা সনাতন ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে। ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক হতে পেরেছিলেন খুব কম মানুষ। নবজাগরণের পাণ্ডারা বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে উন্নত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখলেও তাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন কুসংস্কার আচ্ছন্ন, হিন্দুত্বের প্রর্বতক। ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সৃষ্টিতে এঁদের অনেকেরই কমবেশি অবদান ছিল। বাংলার তথাকথিত নবজাগরণের সেইসব মহারথীরা একদিকে সনাতন হিন্দুধর্মকে ফিরিয়ে আনতে চাইতেন, ভিন্ন দিকে মনে করতেন ভারতে ব্রিটিশ শাসন ঈশ্বরের আশির্বাদ। রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ সকলেই এ ব্যাপারে সমগোত্রীয়। খ্যাতিমানদের মধ্যে সেখানে বিশেষভাবেই ব্যতিক্রম ছিলেন মধুসূদন দত্ত।
ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষের তকমা দেয়া হয় যে রামমোহন রায়কে, তিনি কিন্তু ধর্ম বর্জন করেননি। তিনি ভারতের তেত্রিশ কোটি দেবতার জায়গায় একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। সেটাকে কি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষরা খুব প্রগতিশীল চিন্তা বলবেন? ইসলাম ধর্ম তো এই একেশ্বরবাদ-এর চিন্তা নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিল ইহুদি এবং খ্রিস্টধর্মের পরে। রামমোহন ইংরেজ শাসনের পক্ষে ছিলেন এবং নীলকরদের পক্ষে কাজ করেছেন। সেটা কি তাঁর প্রগতিশীলতা? রামমোহন অবশ্য ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। ধর্ম হিসেবে একেশ্বরবাদ মানলেও, তিনি প্রাচীন ভারতের বৈদিক ধর্মে ফিরতে চাননি, জীবন থেকে আবার ধর্মকে বিসর্জন দিতে চাননি। সকল ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সমালোচনাও ছিল। তিনি বিভিন্ন দিক থেকে যথেষ্ট আধুনিক মানুষ ছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরও তাই, তিনি ইংরেজ শাসনকে ভারতের জন্য আশির্বাদ মনে করলেও, সেভাবে ধার্মিক ছিলেন না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি বা ধর্মের প্রচার বা হিন্দুত্বের পক্ষে কথা বলেননি। রাজনারায়ণ বসু, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ বহু রকম আধুনিক কথাবার্তা বললেও শেষ পর্যন্ত সকলেই চূড়ান্ত বিচার বৈদিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং সেই ধর্মের প্রচার এবং প্রসারের পক্ষে ছিলেন। হিন্দুত্ব বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকদের একজন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার তথাকথিত নবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা আসলে ধর্ম বিসর্জন না দিয়ে তার সংস্কার চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর ও মধুসূদনসহ সামান্য কজন মানুষ তার ব্যতিক্রম ছিলেন। বাকিরা ইংরেজদের জ্ঞানবিজ্ঞান বা চিন্তার আলোকে কিছুটা প্রগতিশীল হতে চাইলেও, শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ মুক্তমনের মানুষ ছিলেন না। নানারকম স্ববিরোধী চিন্তা আর কর্মের ভিতর দিয়ে সময় পার করেছেন।
বাংলার নবজাগরণবাদীরা সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখলেও, ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধে তাঁদের ভূমিকাটাই প্রধান। ভারতবর্ষকে যে-অভিশাপ বর্তমানেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ‘বাঙালি মুসলমান এবং মুসলমান কালচার’ প্রবন্ধে বাংলার তখনকার প্রগতিশীল বিদগ্ধ সমাজ সম্পর্কে গোপাল হালদার লিখেছেন, হিন্দুত্ব ও হিন্দু রীতিনীতিকে সহজভাবে তাঁদের কাছে মনে হলো ‘জাতীয়’ ধারা। বাস্তবে এ এক শোচনীয় ভুল ছিল। মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিরা হিন্দু-মুসলমান জনগণের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছিল বলেই এ ভুল হলো। সমস্ত উনিশ শতকের নবজাগ্রত প্রগতি আন্দোলন এই মারাত্মক ভুলের বশে এক ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের আশ্রয় গ্রহণ করলো। হিন্দু শিক্ষিত সাধারণ কবি, ঔপনাসিক সকলেই তখন ‘হিন্দু ঐতিহ্যের’ কাঠামোকে আশ্রয় করে সৃষ্টিতে অগ্রসর হলেন। হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতি মর্যাদা পেল না তাঁদের কাছে, মর্যাদা পেল বরং তার পাশ্ববর্তী সেই ‘হিন্দু ঐতিহ্যের’ অংশ। রাজনারায়ণ, বঙ্কিম-বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকলেই সর্বভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্যের প্রবল ধারাকে হিন্দু ঐতিহ্যের খাতে বহাতে সাহায্য করেছেন। (গোপাল হালদার, ‘বাঙালি মুসলমান ও মুসলিম কালচার’) হালদার তাঁর প্রবন্ধে রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকলকে বলছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা আর বলছেন তাঁদের সৃষ্টিকর্ম ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে। কথাগুলি এর আগে পরে ভারতে আরো বহুবার আলোচিত হয়েছে। বাংলার নবজাগরণের যাঁদের ধারক-বাহক বলা হয়, তাঁদের বড় অংশটাই ছিলেন হিন্দুত্বে পুনর্জাগরণ বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে। বর্তমান প্রগতিশীলদের চিন্তায় হিন্দু জাতীয়তাবোধের পক্ষের মানুষগুলিকে দেখা হচ্ছে, বিদগ্ধ মানুষ হিসেবে। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে ওয়াহাবি ঘরানার বা আরবের ইসলাম কিংবা খাঁটি মুসলমান হবার চিন্তাকে দেখা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলতা হিসেবে। বর্তমান বিদগ্ধ সমাজের এই চিন্তা কতোটা যুক্তিযুক্ত?
বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একদল খুবই কট্টর। বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে যারা কট্টর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, শাস্ত্রের বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং ধর্মীয় অনুশাসনকে কঠোরভাবে মেনে চলা। ধর্মের অনুশাসন ও নির্দেশাবলিকে নিবেদিত চিত্তে বিশ্বাস করতে হবে, এই হলো তাদের কথা। ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে এরা সমাজের অগ্রগতির পথকে বিপর্যস্ত করছে। তাদের আক্রমণের মূল্য লক্ষ্য মানুষের ‘যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানচেতনা’। ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে তারা প্রবাহমান সমাজের গতিধারাকে রুদ্ধ করে দিতে চাইছে। ইসলামের প্রাচীন রীতিনীতিগুলিকে পুনরায় আক্রে ধরে সভ্যতার অগ্রগতির অভিমুখটিকে পিছনে ফেরাতে চাইছে। মুসলমান কট্টরপন্থীরা ইসলামের শুদ্ধিকরণের নামে আরব ভূমির আদি পবিত্রতার উৎস সন্ধানে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশে এবং মুসলিম বিশ্বে এ ঘরানার লোকরা যথেষ্টভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। ইসলামের বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে ও সারা বিশ্বের মুসলমানদের অধিকার রক্ষার নামে মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা এবং মুসলিম ধর্মীয় নেতারা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধের ধারণাকে সামনে আনছে। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। কিন্তু তবুও মুসলমানদের কট্টর নেতারা মনে করছেন বাংলাদেশে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত নয়। যদি তাদের দেয়া পশ্চাদপদ বিভিন্ন দাবি মেনে নেয়া হয়; তাহলেই বাংলাদেশে ইসলাম সুরক্ষিত হবে। জাতীয়তাবোধ অপেক্ষা ইসলামবোধের ধারণাটিকে তারা সামনে আনতে সচেষ্ট। মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই ধর্মীয় নেতারা সকল মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে না। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা কিন্তু ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের ধর্মীয় আবেগে গা না ভাসিয়ে বা কট্টর ধার্মিকদের খপ্পরে না পড়ে তাঁরা সহিষ্ণুতার পথ বেছে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কিছু সংখ্যক মানুষ ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশ অনেক সময় বিনাবাক্যে গ্রহণ করে। কখনো কখনো দাবি দাওয়ার প্রশ্নে হিংস্র হয়ে ওঠে। বিশ্বে কোনো ধর্মই হিংস্রতা সমর্থন করে না। বিশেষ করে ইসলাম কথাটির অর্থ হলো আত্মসমর্পণ বা শান্তি। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার নির্দেশ আছে ইসলাম ধর্মে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম নিয়ে নানান ধরনের বাড়াবাড়ি চলে বাংলাদেশে। ইসলাম ধর্মে নারীর শিক্ষা আর কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কট্টরপন্থী মুসলমানরা নারীর শিক্ষাদান এবং কর্মসংস্থানের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের কট্টর ধার্মিকরা খুবই রক্ষণশীল আর প্রতিক্রিয়াশীল। মানুষের ধর্মনিষ্ঠাকে তারা প্রতিক্রিয়াশীলতার চাদরে মুড়ে দিতে চায়। নিজধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের নামে হিংসার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে এরা প্রতিদিন। বাংলাদেশের বর্তমানের ধর্মীয়ভাবে কট্টর মুসলমানদের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হচ্ছে নারীকে মর্যাদা না দেয়া। নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করা। বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মের এসব চরমপন্থীরা সর্বদা পুরানো দিনের ইসলামের গৌরব নিয়ে বিভোর আর তার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চায়। ইংরেজ শাসনে অবিভক্ত বাংলায় ঠিক একইভাবে শুরু হয়েছিল হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের তত্ত্ব। বিদগ্ধ হিন্দুরা তখন মনে করতেন হিন্দুত্ববাদের পুরনুজ্জীবনের মাধ্যমে ফিরে যেতে হবে প্রাচীন ভারতের এক কল্পিত স্বর্ণযুগে। ১৮৭২ সালে রাজনারায়ণ বসুর ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ শীর্ষক বক্তৃতা থেকেই হিন্দু পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, বিবেকানন্দ প্রমুখ এই হিন্দু জাগরণের আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন।
বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে যারা কট্টর, যারা নানাভাবে ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবনের কথা বলে; বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষ তাদেরকে সামান্য সম্মান দেখান না। কিন্তু খুবই বিস্ময়কর যে, বাংলার হিন্দু পুনরুজ্জীবনের প্রবর্তকরা সকলেই খুব সম্মানিত এখানে এবং ভারতবর্ষে। বিবেকানন্দের সম্মান তো সারা বিশ্বব্যাপী। যিনি ছিলেন কট্টর হিন্দু। তিনি বক্তৃতার মঞ্চে বহুসময় মানুষের অন্তর বিগলিত করার মতো সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন কিন্তু দিনের শেষে তিনি ছিলেন নির্ভেজাল ধর্মান্ধ হিন্দু। ভারতবর্ষে হিন্দুত্বের প্রচার আর প্রসারের জন্যেই তাঁর এ সম্মান। হিন্দু ধর্মপ্রচারের জন্য যদি তিনি সম্মান পেতে পারেন, তাহলে ভিন্ন মানুষরা কেন খ্রিস্টান ধর্ম বা ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য সম্মান লাভ করবেন না? বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের সকল পশ্চাদপদতা আর কুসংস্কারকে কেনাবেচা করেছেন। তিনি যদি সেটা করেই সমগ্র ভারতবর্ষে এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসন লাভ করতে পারেন, মুসলমান একজন ধর্মীয় নেতা খাঁটি ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য নানারকম কুসংস্কারকে আগলে ধরলে তিনি সেই সম্মান পাবেন না কেন?
বাংলাদেশের গোঁড়া মুসলমানদের পক্ষ নেয়া বক্ষ্যমান প্রবন্ধকারের লক্ষ্য নয়। কিন্তু ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধান করতেই হবে। মূল বক্তব্য হলো, প্রায় একই দোষে দোষী দুপক্ষকে দুভাবে বিচার করবার কারণটা কী। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের সম্মানের চোখে দেখা আর মুসলামান প্যান ইসলামিক দলকে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে ভাবাটা কি ন্যায়বিচার হতে পারে? যদি বাংলাদেশের মুসলমানরা কট্টরতার জন্য নিন্দনীয় হয়; বিবেকানন্দ বা তাঁর মতো সকলে সেটা হবেন না কেন? স্বামী বিবেকানন্দ যদি পশ্চাদপদ-কুসংস্কার আচ্ছন্ন হিন্দুত্বের বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রচার করে নায়ক হতে পারেন, ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য তাহলে কেন একজন মুসলমান নেতা প্রগতিশীলদের চোখে খলনায়ক বনে যাবেন? বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানবাদীদের দলে, বিবেকানন্দ লেখাগুলি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে তাই দাঁড়ায়।
রাজনারায়ণ বসুকে বলা হয়েছে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের প্রবর্তক। তিনিই উৎসাহ দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বাংলায় ঠাকুর বাড়ির অর্থানুকূল্যে ১৮৬৭ সালে ‘হিন্দুমেলা’ চালু করেছিলেন। হিন্দুমেলার মধ্য দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার বার্তা দেয়া হয়েছিল। বাংলার মুসলমানকে সেখানে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয়নি। রাজনারায়ণ বসু ভারতের মুসলমানদের ভারতীয় জাতীয়তাদের বাইরে রাখতে চেয়েছেন। ভারতের জাতীয়তাবাদ তাঁদের চোখে শুধু হিন্দুদের; যা হিন্দু জাতীয়তাবাদ। হিন্দুমেলার নামকরণের মধ্য দিয়ে ভাবীকালের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা লক্ষ্য করে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষন সম্পাদিত মাসিক ‘আর্যদর্শন’ পত্রিকায় ‘আধুনিক ভারত’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘আমরা মেলার অধ্যক্ষদিগের নিকট করজোড়ে এই ভিক্ষা চাই, তাহারা যেন এই মেলাকে কোন সঙ্কীর্ণ ভিত্তির উপর ন্যস্ত না করেন। আমাদিগের ভিক্ষা তাহারা যেন এই মেলাকে এখন হইতে হিন্দুমেলা নাম না দিয়া ভারতমেলা নাম দেন। যেন ইহা হইতে ভারতবাসী মাত্রেরই উৎসব স্থান হয়। হিন্দু ভিন্ন অন্য কোন জাতি ইহাতে যোগ না দেন; আমরা কাঁদিব। কিন্তু ভারতবর্ষীয় কোন ভ্রাতার বিরুদ্ধে ইহার দ্বার অবরুদ্ধ রাখিব না।’ (মাসিক আর্য্যদর্শন, মাঘ ১২৮৩) পরবর্তী সময় হিন্দুমেলার নাম করণ করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি মেলা। পরবর্তীকালে আর্যদর্শন পত্রিকাটিও তার এই অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাব রক্ষা করতে পারেনি। শীঘ্রই পত্রিকাটি হিন্দুত্বের প্রচারক হয়ে দাঁড়ায়। এক দশক বাদেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাবল্য দেখা এই পত্রিকায়। (অমর দত্ত, ঊনিশ শতকের শেষার্ধে বাঙলাদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদ) চলবে