বিপজ্জনক রবীন্দ্রনাথ!

মোহাম্মদ আলী

প্রকাশিত : মে ১২, ২০১৮

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সমাজে বিপজ্জনক। কারণ হিন্দু-সমাজের লেখকদের একটা অংশ রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসাতে চান, লেখক হিসেবে তারা তাঁকে দেখতে নারাজ। অন্যদিকে মুসলিম-সমজের লেখকদের কেউ কেউ তাঁর লেখা মুসলমান বিদ্বেষী কীনা তার গন্ধ খোঁজেন। তারা তাঁকে লেখক হিসেবে দেখেন না! রবীন্দ্রনাথকে অন্য একটা শ্রেণি লেখক নন, দার্শনিক বানাতে তৎপর। রবীন্দ্রনাথ এসবের কোনোটাই নন। তিনি কবি ও কথাশিল্পী।

তিনি দুই-দুটো দেশের জাতীয় সংগীত রচনা করেছেন। কিন্তু কোনো দেশেই তিনি জাতীয় কবির আসন পাননি। তিনি প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে ঘিরে দুই দেশেই তেমন একটা কিছু হয়নি। গবেষণাও হয়েছে কথিত আয়তনে। তাঁকে নিয়ে ভালো কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। কারণ বাঙালিদের কাছে তিনি এতটা গুরুত্বপূর্ণ নন। যে কারণে তাঁকে নিয়ে তারা বিশেষ ভাবনা ভাববে।

বাঙালিদের অনেকে দেশ-বিদেশে অনেক বিত্তশালী হয়েছেন, আরও দু-একজন নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সে সব অর্জন রবীন্দ্রনাথ থেকে বহু দূর। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যকে কতটুকু সমৃদ্ধ করেছেন, তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ এখনো হয়নি। তাঁর কাছ থেকে আমরা কবিতার সৌন্দর্য, আধুনিকতা ও গদ্যের রূপ-রস-গন্ধ নিতে পারি। পশ্চিমকে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা শিখতে পারি। তা না করে খণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ আমাদের জ্ঞানকে বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম রবীন্দ্র ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হতে পারি। রবীন্দ্র-ভাণ্ডার সম্পর্ক অপরিচিত থেকে যেতে পারি।

তিনি ক্রমশ বিকশিত হয়েছেন, নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। বদ্ধ থাকেননি নিজ সীমাবদ্ধতায়। দেশ-বিদেশ ঘুরে জ্ঞানার্জন করেছেন। তিনি `গোরা` উপন্যাসে শিখিয়েছেন অসাম্প্রদায়িকতা। `শেষের কবিতা`য় শিখেয়েছেন প্রেম। আমাদের এসব কতটুকু টানে? আমরা রবীন্দ্রনাথকে বুঝি, জানতে চেষ্টা করি গভীরভাবে? তাঁর যৌবনের কবিতা, গান ও শেষ দিকের সাহিত্যকর্ম এমন পরিপূর্ণ ভাণ্ডার, যা সৃষ্টি করেছে এক পরিণত সাহিত্য-জগৎ। তাঁকে ও তাঁর সাহিত্যকর্মকে গবেষণার মাধ্যমেই কেবল তা আবিষ্কার করা সম্ভব।

রাষ্ট্রকে রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে রাখলে একটি গোষ্ঠীর লাভ হয়, জনগণের হয় বিপুল ক্ষতি। কেননা তারা সংস্কারে বিশ্বাসী, জীর্ণতা তাদের গন্তব্য। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতাকে তারা চরম ভয় করেন। সেই জন্য তারা তাঁকে সামনে না রাখে, আড়ালে বসিয়ে রাখেন। প্রথাগতভাবে রবীন্দ্রনাথকে চেনা যাবে না, গবেষণার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে, করতে হবে আবিষ্কার। টলস্টয়, সেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ যুগে যুগে বারবার আসেন না। তাঁদের রেখে যাওয়া কর্ম-সত্য আবিষ্কার করতে হয়। জানতে হয়, নিতে হয় প্রগতিশীলতাকে।

তাহলে রবীন্দ্রনাথ সামনে এগিয়ে যান, পেছনে পড়ে থাকে প্রতিক্রিয়াশীলতা। প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে রবীন্দ্রনাথ বিপজ্জনক। যেমন পাকিস্তান-পর্বে তিনি ছিলেন নিষিদ্ধ, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে চরম শত্রু। প্রগতিশীলরা তাঁকে কতটুকু চিনেছেন? যতটুকু চিনলে মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায়। আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে চিনতে ও জানতে হবে। সাহিত্যকে না বুঝে কিভাবে সমাজকে বোঝা যায়, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেই প্রশ্ন কিন্তু বারবার আসে। আর সেই জন্যই বারবার রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হয়, হবে যেতে। রবীন্দ্রনাথের চারদিকে বিপজ্জনক শত্রু, তাঁকে শত্রুমুক্ত রাখতে হবে। তবেই বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব। আমরা যত রবীন্দ্র-বিচ্ছিন্ন হই, তিনি পরম স্নেহ-মমতা দিয়ে বলেন, `আমি তোমাদেরই লোক।`

৮ মে ২০১৮