‘বিদ্যাসাগর’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলা
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯
২৬ সেপ্টেম্বর ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মদিন। এ উপলক্ষে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের লেখা ‘বাঙালি মনীষীদির ছেলেবেলা’ বই থেকে বিদ্যাসাগরের ছেলেবেলার অংশটুকু দেয়া হলো। বইটি এ বছর প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ। বাঙালির প্রাণপুরুষ, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা
বনমালিপুরের ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের পাঁচ ছেলের একজনের নাম রামজয়। ভুবনেশ্বরের মৃত্যুর পর সংসারে ভাঙন ধরল। ভাইদের হাতে চলে গেল সংসার কর্তৃত্ব। সংসার ছেড়ে দিয়ে রামজয় হয়ে গেলেন নিরুদ্দেশ। বাড়িতে রেখে গেলেন স্ত্রী দুর্গা, দুই ছেলে ও চার মেয়ে। শ্বশুরবাড়িতে বেশিদিন টিকতে পারলেন না দুর্গা। চলে গেলেন বাপের বাড়ি হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে। উমাপতি তর্কসিদ্ধান্তের মেয়ে তিনি। উমাপতি মস্ত পণ্ডিত। বয়স হয়েছে তার। সংসার দেখাশোনা করেন তাঁর ছেলে আর ছেলেবউ।
অল্পদিনের মধ্যেই দুর্গা বুঝতে পারলেন, তাকে সইতে পারছে না তার ভাই ও বউদি। কথায় কথায় বউদি কটুকথা বলেন। মেয়ের প্রতি ছেলে ও ছেলেবউয়ের এমন আচরণ দেখে উমাপতি নিজের বাড়ির কাছাকাছি একটা কুঁড়েঘর তুলে দিলেন মেয়ের জন্য। ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই ঘরে থাকতে লাগলেন দুর্গা। সুতা কেটে সামান্য কিছু আয় করেন। উমাপতি মাঝেমধ্যে কিছু সাহায্য করেন। কিন্তু এ দিয়ে তো আর সংসার চলে না।
দুর্গার বড়ো ছেলে ঠাকুরদাসের বয়স তখন চৌদ্দ কি পনেরো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় গিয়ে টাকা রোজগার করে মা-ভাই-বোনের দুঃখ দূর করবেন। মায়ের অনুমতি নিয়ে একদিন চলে গেলেন কলকাতায়। আশ্রয় নিলেন জগন্মোহন ন্যায়ালঙ্কারের বাড়িতে। বেশ কিছুদিন বেকার থাকার পর জগন্মোহনের সহযোগিতায় দুই টাকা বেতনের একটা কাজ জুটিয়ে নিলেন। দু-তিন বছর কাজ করার পর বেতন বেড়ে পাঁচ টাকা হলো।
ওদিকে রামজয় তখন বাড়ি ফিরে এসেছেন। এতদিন নানা তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। তার ছিল অপার সাহস আর আগাধ শক্তি। কয়েকদিন বীরসিংহে কাটিয়ে কলকাতায় গেলেন। বড়োবাজারের ভাগবতচরণ সিংহের বেশ ভালো অবস্থা। রামজয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার। রামজয়ের সমস্ত ইতিহাস শুনে তিনি বললেন, ঠাকুরদাসকে আমার কাছে রেখে যান। রামজয় অমত করলেন না। বাবার কথামতো ঠাকুরদাস উঠে এলেন ভাগবতচরণের বাড়িতে। মাসে আট টাকা বেতনে ঠাকুরদাসকে আরেকটা কাজ জুটিয়ে দিলেন ভাগবতচরণ। তার বাড়িতেই দিনে দুই বেলা ভাত খান ঠাকুরদাস।
ঠাকুরদাসের বয়স তখন তেইশ কি চব্বিশ। গোঘাটের রামকান্ত তর্গবাগীশের মেয়ে ভগবতীর সঙ্গে বিয়ে হলো তার। ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ঠাকুরদাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হলো। তিনি তখন কোমরগঞ্জে, মঙ্গলবারের হাটে। সুখবরটা ছেলেকে জানাতে কোমরগঞ্জে রওনা হলেন রামজয়। পথেই ছেলের সঙ্গে দেখা। বললেন, একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে।
ঠাকুরদাস ভাবলেন বাড়ির গোরুটির বাচ্চা হয়েছে বুঝি। বাড়ি ফিরেই তিনি গোয়ালঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন। রামজয় তখন হাসতে হাসতে বললেন, ওদিকে নয় ওদিকে নয়, এদিকে এসো। এঁড়ে বাছুর দেখাচ্ছি।
ছেলেকে নিয়ে আরেক ঘরে ঢুকলেন রামজয়। নবজাতককে দেখালেন। বললেন, একে এঁড়ে বাছুর বললাম কেন জানো? এই এঁড়ে বাছুরের মতো একগুঁয়ে হবে। যা ধরবে তাই করবে, কাউকে ভয় করবে না। ও হবে ক্ষণজন্মা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, প্রথিতযশা, দয়ার অবতার। ওর জন্য আমার বংশ ধন্য হবে। ওর নাম রাখলাম ঈশ্বরচন্দ্র।
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে ভর্তি করানো হলো গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায়। পড়াশোনার প্রতি ঈশ্বরের টান আছে, পাশাপাশি দুষ্টুমিতেও তাঁর তুলনা নেই। তাঁর জ্বালায় পাড়ার মানুষ অস্থির। পাড়ার বাগানে ঢুকে চুপেচুপে ফল খান। কেউ রোদে কাপড় শুকাতে দিলে ছোটো লাঠি দিয়ে তাতে ময়লা লাগিয়ে দেন। ধানখেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাঁচাধানের শিষ খানিকটা মুখে দিয়ে চিবান, খানিকটা ফেলে দেন। একবার যবের শিষ খেতে গিয়ে গলায় আটকে গেল যবের কাঁটা। তাঁর ঠাকুরমা অনেক কষ্টে গলায় আঙুল দিয়ে সেই কাঁটা বের করে দিলেন।
পাঠশালায় যাওয়ার পথে প্রায় প্রত্যেকদিন পাড়ার মথুরামোহন মণ্ডলের মা আর বউকে বিরক্ত করার জন্য মথুরামোহনের বাড়ির দরজায় পায়খানা করে রাখেন ঈশ্বর। মথুরামোহনের মা পার্বতী আর বউ সুভদ্রা নিজ হাতে সেসব ময়লা পরিষ্কার করে। কোনো কোনোদিন সুভদ্রা বিরক্ত হয়ে বলত, দুষ্ট বামুন, রোজই তুমি পাঠশালায় যাওয়ার সময় আমার দরজায় পায়খানা করে যাবে? আর কোনোদিন করলে তোমার গুরুমশায় ও ঠাকুরমাকে বলে দেবো। তারা তোমাকে শাসন করবে।
শুনে সুভদ্রার শাশুড়ি পার্বতী বলত, ছেলেটি সহজ নয়। ওর ঠাকুরদা বারো বছর বিবাগী হয়ে তীর্থক্ষেত্রে জপতপ করে দিন কাটিয়েছেন। সাক্ষাৎ ঋষিতুল্য মানুষ। তার মুখে শুনেছি এই বালক অদ্বিতীয় শক্তিসম্পন্ন হবে। তুমি বিরক্ত হয়ো না বউমা। আমি নিজে তার মলমূত্র পরিষ্কার করব। এই বালক কে, তা ভবিষ্যতে জানতে পারবে।
দুষ্টুমি করে বেড়ালেও পড়ালেখায় কোনো ত্রুটি রাখেন না ঈশ্বর। আট বছর বয়স পর্যন্ত কালীকান্তের পাঠশালায় পড়ালেখা করলেন। কালীকান্ত একদিন ঠাকুরদাসকে বললেন, আমার পাঠশালার পড়া শেষ হয়েছে, এবার তাকে কলকাতায় নিয়ে যান। কলকাতায় নিয়ে ইংরেজি শেখালে ভালো হয়।
এরই মধ্যে মারা গেলেন রামজয় তর্কভূষণ। পিতৃকৃত্য সেরে কলকাতায় যাওয়ার সময় ঈশ্বরকেও সঙ্গে নিলেন ঠাকুরদাস। বীরসিংহ থেকে কলকাতা কাছের পথ নয়। সঙ্গে আরো চলল আনন্দরাম গুটি ও কালীকান্ত। পথ চলতে চলতে ঈশ্বর ক্লান্ত হয়ে পড়লে আনন্দরাম তাঁকে কাঁধে তুলে নেয়।
হাঁটতে হাঁটতে সিয়ালখালার কাছে সালিখার বাঁধা রাস্তায় উঠে এলো সবাই। ঈশ্বর খেয়াল করে দেখলেন, রাস্তার একপাশে মরিচ বাটার পাটার মতো একটা পাথর পোঁতা। কিছুদূর পরপর এক একটা পাথর পোঁতা মাটিতে। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই শিলাগুলো কী বাবা?
ঠাকুরদাস বললেন, শিলা নয়, এগুলোকে বলে মাইলস্টোন।
মাইলস্টোন কী বাবা?
মাইলস্টোন ইংরেজি শব্দ। এক মাইল হলো আমাদের আধক্রোশের সমান। স্টোন অর্থ পাথর। কলকাতা থেকে প্রত্যেক এক মাইল অন্তর এরকম এক একটি পাথর পোঁতা আছে। প্রত্যেক পাথরে লেখা আছে কলকাতা থেকে ওখান পর্যন্ত কত মাইল পথ। কলকাতা থেকে এক মাইল দূরে যে পাথরখানা পোঁতা আছে তাতে ইংরেজিতে ‘এক’ লেখা আছে। আর দেখো, এখানে লেখা আছে উনিশ। মানে কলকাতা এখান থেকে উনিশ মাইল। সাড়ে নয় ক্রোশ।
বাংলা অঙ্কের হিসাব জানেন ঈশ্বর। উনিশ লেখা পাথরটি তিনি ভালো করে দেখে নিলেন। একের পিঠে নয়, মানে উনিশ। পাথরে হাত দিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইংরেজিতে কি এটা এক আর এটা নয়, বাবা?
বাবা বললেন, হ্যাঁ।
ঈশ্বর মনে মনে ঠিক করলেন, পথে যেতে যেতে ইংরেজি অঙ্ক শিখে ফেলতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা মাইলস্টোনের কাছে এসে থামল। সেটিতে লেখা দশ মাইল। মানে পাঁচ ক্রোশ। ঈশ্বর বললেন, বাবা, আমি ইংরেজি অঙ্ক চিনে নিয়েছি। এক থেকে দশ পর্যন্ত শিখে ফেলেছি।
বাবা বললেন, সত্যি সত্যি শিখে ফেলেছ? পরীক্ষা করে দেখা যাক তাহলে।
নয় নম্বর পাথরটি দেখিয়ে ঠাকুরদাস জিজ্ঞেস করলেন, এটা কত বল তো?
ঈশ্বর বললেন, নয়।
আট নম্বর পাথরটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কত?
ঈশ্বর বললেন, আট।
সাত নম্বর লেখা পাথরটি দেখিয়ে ঠাকুরদাস জিজ্ঞেস করলেন, এবার বলো এটা কত?
ঈশ্বর উত্তর দিলেন, সাত।
ঠাকুরদাসের মনে সন্দেহ জাগল। দশের আগে নয়, নয়ের আগে আট, আটের আগে সাত। হয়তো ইংরেজি অঙ্ক চেনে না ছেলে, নিশ্চয়ই চালাকি করে উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। বুদ্ধি করে তিনি ছয় নম্বর পাথরটি ঈশ্বরকে না দেখিয়ে গোপন করে গেলেন। পাঁচ নম্বর লেখা পাথরটির সামনে এসে বললেন, এবার বলো এটা কত?
ঈশ্বর বললেন, বাবা, এটা ছয় হওয়া উচিত। কিন্তু ভুলে পাঁচ লিখে রেখেছে।
ঠাকুরদাস খুশি হলেন। বললেন, সত্যি সত্যি তুমি ইংরেজি অঙ্ক চিনেছ। ওটা ঠিকই আছে। ছয় নম্বর পাথরটি আমি তোমাকে দেখাইনি।
কালীকান্তও খুশি হলেন। ঈশ্বরের চিবুক ধরে আশীর্বাদ করে ঠাকুরদাসকে বললেন, ঈশ্বরের পড়াশোনার ভালো ব্যবস্থা করবেন। বেঁচে থাকলে ও মানুষের মতো মানুষ হবে।
কলকাতার ভাগবতচরণ সিংহের একমাত্র ছেলের নাম জগদ্দুর্লভ। ভাগবতচরণ মারা গেছেন। জগদ্দুর্লভই এখন সংসার দেখাশোনা করেন। তার বাড়িতেই থাকেন ঠাকুরদাস। বাবার সঙ্গে ঈশ্বর এই বাড়িতেই উঠলেন। বাড়ির কাছে শিবচরণ মল্লিকের বাড়িতে একটা পাঠশালা বসে। গুরুমশায়ের নাম স্বরূপচন্দ্র দাস। ঈশ্বরকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো এই পাঠশালায়। অঘ্রান, পৌষ, মাঘ― মোট তিন মাস এখানে পড়ালেখা করলেন ঈশ্বর। ফাল্গুনের গোড়ার দিকে অসুখ হলো তাঁর। কবিরাজি চিকিৎসায় অসুখ ভালো হলো না। খবর পেয়ে তাঁর ঠাকুরমা কলকাতায় এলেন। দু-তিন দিন কলকাতায় থেকে ঈশ্বরকে নিয়ে তিনি বীরসিংহে চলে গেলেন। এখানে এসে ওষুধ ছাড়াই মাত্র সাত-আট দিনে সুস্থ হয়ে উঠলেন ঈশ্বর। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে আবার তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হলো।
প্রথমবার কলকাতায় আসার পথে মাইলস্টোন দেখে ঈশ্বর কেমন সহজে ইংরেজি অঙ্ক শিখেছেন, ঠাকুরদাসের মুখে কয়েকজন সেকথা শুনল একদিন। সবাই বলল, তবে তো তাকে ইংরেজি পড়ানো উচিত। হেয়ার সাহেবের স্কুলে ভর্তি করানো যেতে পারে। বেতন দেওয়া লাগে না। যদি ভালো শিখতে পারে, হিন্দু কলেজে বিনা বেতনে পড়তে পারবে। হিন্দু কলেজে পড়লে ইংরেজিটা ভালো করে জানতে পারবে। মোটামুটি ইংরেজি জানলে অনায়াসে সাহেবদের অফিসে চাকরি পেয়ে যাবে।
কিন্তু ঠাকুরদাস ছেলেকে ইংরেজি পড়াবেন না। সংস্কৃত শেখার ইচ্ছে ছিল তার। অভাবের কারণে পারেননি। তিনি ঠিক করে রেখেছেন ছেলেকে সংস্কৃত শেখাবেন। চাকরি করে সংসারের অভাব ঘোচাবে সেজন্য তিনি ছেলেকে কলকাতায় আনেননি। তার ইচ্ছা, সংস্কৃতশাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে ছেলে গ্রামে গিয়ে একটা টোল খুলবে। অনেক চিন্তাভাবনার পর ছেলেকে তিনি সংস্কৃত কলেজেই ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৮২৯ সালের ১লা জুন, মাত্র নয় বছর বয়সে, সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হলেন ঈশ্বর। বড়োবাজারের বাসা থেকে বাবার সঙ্গে পটলডাঙার কলেজে যান। ছুটির পর বেলা চারটার সময় আবার বাবার সঙ্গেই বাসায় ফেরেন। কিছুদিন পর বাবাকে আর সঙ্গে যেতে হয় না, ঈশ্বর একা একাই কলেজে যাতায়াত করেন।
ঈশ্বর দেখতে ছোটোখাটো। কিন্তু মাথাটি দেখতে সেই তুলনায় বড়ো। সহপাঠীরা তাই ঠাট্টা করে বলে, ‘যশুরে কৈ, কসুরে জৈ।’ ঈশ্বর রেগে যান। যত বেশি রাগেন, সহপাঠীরা তত বেশি খ্যাপায়।
রোজ রাতে বাবার কাছে পড়া দিতে হয় ঈশ্বরকে। পড়ায় ভুল হলে রক্ষা নেই। লেখাপড়া ছাড়াও কাজের শেষ নেই তাঁর। সকালবেলা গঙ্গাস্নান সেরে আসার পথে বাজার করে আসতে হয়। তারপর মসলা বাটতে হয়, মাছ-তরকারি কাটতে হয়। রান্নাও করতে হয় তাঁকেই। চার-পাঁচজনের রান্না একাই করেন। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে পরে তাঁকে খেতে হয়। ফেলে-ছড়িয়ে খাওয়া যাবে না। একটি ভাত পাতের পাশে পড়ে থাকলে ঠাকুরদাস রেগে যেতেন। খাওয়ার পর সবার থালাবাসন মেজে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, তারপর যান কলেজে।
ঠাকুরদাসের আয়-রোজগার বেশি নয়। টেনেটুনে কোনোরকমে সংসার চালাতে হয়। রোজ দুই বেলা ভাত জোটে না। জুটলেও সব সময় পেট ভরে খেতে পান না। অনেক সময় শুধু লবণ দিয়ে ভাত খেতে হয়। যখন মাছ-তরকারি জোটে তখনও ঘটা করে মাছ-তরকারি খাওয়ার উপায় নেই। এক বেলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত, আরেক বেলা ভাত আর তরকারি। মাছটুকু খাওয়া হবে পরের দিন। পরদিন ঐ মাছ দিয়েই অম্বল রান্না হতো। অম্বল দিয়ে ভাত খাওয়া।
রান্নাঘরটা ছিল অন্ধকার। একফোঁটা রোদ ঢোকে না। তার উপর রান্নাঘরের পাশে একটা ময়লার ভাগাড়। মলমূত্র আর কৃমিকীটে ভরা। দুর্গন্ধ তো আছেই। তার চেয়ে বিশ্রী ব্যাপার, খাবার সময় ঈশ্বরকে এক ঘটি জল নিয়ে বসতে হয়। নইলে ভাত খাওয়ার উপায় নেই। দলে দলে কৃমি থালার দিকে এগিয়ে আসে। ঘটি থেকে জল ঢেলে ঈশ্বর কৃমির দলকে ভাসিয়ে দেন, সরিয়ে দেন।
রান্নাঘরে আরশোলার খুবই উৎপাত। একদিন খেতে বসে ঈশ্বর দেখল, তরকারির মধ্যে একটা আরশোলা। কাউকে বললেন না সেকথা। বললে তো কারো খাওয়া হবে না। আরশোলাটা যদি পাতের পাশে ফেলে দেয়, অন্যদের চোখে পড়বে। কী করা যায়? অন্যদের যাতে অসুবিধা না হয়, কেউ যাতে কিছুই টের না পায়, তরকারির সঙ্গে আরশোলাটাও খেয়ে ফেললেন তিনি।
সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হওয়ার দেড় বছর পরে ১৮৩১ সালের মার্চ মাস থেকে ঈশ্বর মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি পেতে শুরু করলেন। কৃতী ছাত্ররা কলকাতায় বাসা খরচের জন্য এই বৃত্তি পেত। যারা বৃত্তি পেত তাদের বলা হতো পে-স্টুডেন্ট।
ঈশ্বর ভর্তি হয়েছিলেন ব্যাকরণ তৃতীয় শ্রেণিতে। ভালো করে লেখাপড়া শেখার জন্য তাঁর চেষ্টার কমতি নেই। বাবাকে প্রায়ই বলতেন, রাত দশটার সময় খেয়ে উঠে শুয়ে পড়ব। বারোটা বাজলে আমাকে জাগিয়ে দেবেন, নইলে পড়া হবে না। খাওয়া শেষ করে তাই দুই ঘণ্টা বসে থাকতেন বাবা। আরমনি গির্জায় রাত বারোটার ঘণ্টা শুনে ছেলেকে জাগিয়ে দিতেন। ঈশ্বর সারারাত পড়তেন।
মাসিক বৃত্তির টাকা বাবার হাতে তুলে দিতেন ঈশ্বর। ঠাকুরদাস একদিন বললেন, তোমার এই টাকায় জমি কিনব। দেশে একটা টোল করে দেবো। দেশের লোক যাতে লেখাপড়া শিখতে পারে তুমি সেই ব্যবস্থা করবে। শেষ পর্যন্ত তাই করলেন তিনি। কাঁচিয়াগ্রাম অঞ্চলে কয়েক বিঘা জমি কিনলেন। কিছুদিন পর বললেন, বৃত্তির টাকায় যেন ঈশ্বর তার প্রয়োজনীয় বইপুস্তক কেনে। বাবার কথামতো ঈশ্বর তাই করলেন।
ঈশ্বর যখন বীরসিংহে যান, কারো বাড়িতে আদ্রশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হলে তাঁর উপর নিমন্ত্রণের কবিতা লেখার ভার পড়ে। নিমন্ত্রণে আসা পণ্ডিতরা তাঁর সঙ্গে ব্যাকরণের বিচার করেন। বিচারকালে ঈশ্বর সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেন। পণ্ডিতরা অবাক হয়ে যান। ক্রমে দেশে প্রচার হয়ে গেল ঈশ্বর অদ্বিতীয় পণ্ডিত।
সংস্কৃত কলেজে ‘অলংকার শ্রেণি’তে পড়ার সময় ঈশ্বর রোজ কলেজ ছুটির পর বিকেল চারটার সময় ঠনঠনিয়ার চৌরাস্তার কাছে তারাকান্ত বিদ্যাসাগর, তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও মধুসূদন বাচস্পতির বাসায় যেতেন। তারা তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। সেই বাসায় ঈশ্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত সাহিত্যদর্পণ পত্রিকা পড়তেন। একদিন ঐ বাসায় এলেন প্রখ্যাত প-িত জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন। ঈশ্বরকে সাহিত্যদর্পণ পড়তে দেখে তিনি তো অবাক। এই অল্পবয়সি বালক কী করে সাহিত্যদর্পণ বুঝতে পারে? বাচস্পতি বললেন, কীরকম শিখেছে জিজ্ঞেস করে দেখুন। ঈশ্বরকে সাহিত্যদর্পণের রসের বিচার জিজ্ঞেস করলেন জয়নারায়ণ। ঈশ্বরের ব্যাখ্যা শুনে তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, এই বালক বড়ো হলে বাংলাদেশের মধ্যে অদ্বিতীয় লোক হবে। এত অল্প বয়সে এমন পণ্ডিত আমি কখনো দেখিনি।
উঁচু শ্রেণির ছাত্রদের মাঝেমধ্যে সংস্কৃতে গদ্য-পদ্য লিখতে হতো। সংস্কৃত রচনা লিখতে সাহস হতো না ঈশ্বরের। রচনার সময় এলেই পালিয়ে যেতেন। ১৮৩৮ সালে সংস্কৃত কলেজে নিয়ম চালু হলো, স্মৃতি, ন্যায় ও বেদান্ত শ্রেণির ছাত্রদের বার্ষিক পরীক্ষার সময় গদ্য-পদ্যে সংস্কৃত রচনা লিখতে হবে। গদ্য যার সবচেয়ে ভালো হবে সে পাবে একশো এবং পদ্য যার ভালো হবে সেও পাবে একশো টাকা পুরস্কার। গদ্য-পদ্যের পরীক্ষা একই দিন হবে। দশটা থেকে একটা পর্যন্ত গদ্যরচনা এবং একটা থেকে চারটা পর্যন্ত পদ্যরচনা পরীক্ষা।
সেবার গদ্য-পদ্য পরীক্ষার দিন সব ছাত্র ঠিক সময়ে এলো, দশটার সময় লিখতে শুরু করল, অথচ ঈশ্বর এলেন না। অলংকার শাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ খুব ভালোবাসেন ঈশ্বরকে। তিনি জোর করে ঈশ্বরকে ধরে নিয়ে পরীক্ষায় বসিয়ে দিলেন। কিন্তু সংস্কৃত রচনা লিখতে তো ঈশ্বরের কিছুতেই সাহস হয় না। কী করেন তিনি? প্রেমচন্দ্র বললেন, যা পারো কিছু লেখো। নইলে সাহেব খুব রাগ করবেন।
সাহেব মানে ইংরেজ মার্শাল সাহেব। তিনি সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি। ঈশ্বর বললেন, সবাই দশটার সময় লিখতে শুরু করেছে, এখন বাজে এগারোটা। এই অল্প সময়ে আমি কী লিখব?
বিরক্ত হয়ে প্রেমচন্দ্র বললেন, যা ইচ্ছা লেখো।
প্রেমচন্দ্র চলে গেলেন। ‘সত্য কথনের মহিমা’ সম্পর্কে সংস্কৃতে গদ্যরচনা লিখতে হবে। বারোটা পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইলেন ঈশ্বর। কিছুই লিখতে পারল না। খোঁজ নিতে এসে প্রেমচন্দ্র দেখলেন ঈশ্বর কিছুই লেখেননি। চুপচাপ বসে আছেন। তিনি রাগ করলেন। ঈশ্বর বললেন, কী লিখব, কিছুই ঠিক করতে পারছি না। প্রেমচন্দ্র বললেন, ‘সত্যং হি নাম’ এই বলে শুরু করো।
‘সত্যং হি নাম’ লিখতে শুরু করলেন ঈশ্বর। অনেক কষ্টে অনেক ভেবেচিন্তে এক ঘণ্টায় কয়েকটি লাইন লিখতে পারলেন। একটার সময় নাম সই করে কাগজ জমা দিলেন। পুরস্কার তো দূরের কথা, ঈশ্বর মনে মনে ভাবলেন, রচনার নমুনা দেখে পরীক্ষকেরা নির্ঘাত হাসাহাসি করবেন। কিন্তু তাঁর ধারণা সত্য হলো না। গদ্যরচনার জন্য সেবারই পুরস্কার পেলেন তিনি।
১৮৪১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজের সার্টিফিকেট পেলেন ঈশ্বর। সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়েই তাঁর নামের শেষে জুড়ে গেল একটি উপাধি― বিদ্যাসাগর। পরবর্তীকালে তিনি বিখ্যাত হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে।