বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়
পর্ব ৬
খায়রুল এ. চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০২২
ভূস্বর্গ থেকে এক সন্ধ্যায় নেমে এলাম সৌন্দর্যের শহর চন্ডিগড়ে। প্লেনে যাত্রিদের উদ্দেশে জানানো হলো, চন্ডিগড় বিমানবন্দরটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পর্শকাতর স্হাপনা হওয়ায় এখানে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। তাই সবাইকে ছবি তোলা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো। আগে কখনো অন্য কোনো বিমানবন্দরে এমন ঘোষণা শুনিনি, তাই একটু খটকা লাগলো। ভালো যোগাযোগ না থাকায় এখানে আগেভাগে কোনো গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারিনি। তবে, যেহেতু ফোনে রোমিং কাজ করবে এখানে তাই অন্তত উবার-ভরসা তো ছিলই। কিন্তু বেশি চিন্তা করতে হলো না, লাউঞ্জ থেকে বের হবার মুখেই দেখলাম প্রিপেইড ট্যাক্সি কাউন্টার। গন্তব্য বলতেই তারা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিল। এত সহজে ট্রান্সপোর্ট পেয়ে স্বস্তি পেলাম। তরুণ ড্রাইভার। যেখানে যাব সে জায়গাটি চিনে কিনা জিজ্ঞেস করতেই বলল, চিনি, তবে আমি না চিনলেও অসুবিধা কী, গুগল তো চিনে। অনেকটা পথ একসাথে যাব, তাই দুএকটা কথা বলে জড়তা কাটানোর জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু বুঝলাম হিউমার আছে ছেলেটার। আমি হিন্দি বলতে পারি না, কিন্তু বুঝতে পারি। তাই আমাদের কথাবার্তা হিন্দিতে না হওয়ায় আমরা যে ভারতীয় না তা মোটামুটি আন্দাজ করেছে সে।
সোজা জানতে চাইলো, কোথা থেকে আসছি আমরা। ভালোই কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানে সে। একটু পর বললো, জানো আজকে আমাদের এয়ারপোর্টের নতুন নামকরণ হয়েছে? ভাবলাম বিজেপি সরকার তো অনেক নামই বদলাচ্ছে সে রকমই কিছু করেছে হয়তো।
ও, তাই নাকি! কি নাম হলো এখন?
ভগত সিং এয়ারপোর্ট। আজ তার জন্মদিন।
চমকে উঠলাম আমি! আমাদের তরুণ বয়সে ভগত সিংয়ের কথা জেনেছি আমরা। বিপ্লবী ভগত সিংয়ের নামে বিমানবন্দরের নামকরণ হয়েছে জেনে খুব ভালো লাগলো।
পৃথিবীর আর কোনো শহর একসাথে দুটি রাজ্যের রাজধানী আছে কিনা জানা নেই, তবে চন্ডিগড় শহরটি একইসাথে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা এ দুই রাজ্যেরই রাজধানী। বিষয়টা ইতিহাসের ঘোরপ্যাঁচের। স্বাধীনতার সময় পাঞ্জাবের তৎকালীন রাজধানী লাহোর পাকিস্তানের ভাগে পড়লে ভারতীয় পাঞ্জাবের নতুন রাজধানী হিসাবে নির্মাণ করা হলো চন্ডিগড়। পন্ডিত জওহারলাল নেহেরু এটিকে মডেল করতে চেয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে এনেছিলেন আর্কিটেক্ট আলবার্ট মায়ারকে। উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার মুক্ত স্থাপত্য কলায় গড়ে তুলবেন নতুন শহর, যা আদর্শ হিসাবে পথ দেখাবে সদ্য স্বাধীন ভারতবাসীকে।
মায়ারের সিটি অব বিউটির স্বপ্নের সাথে নেহেরুর আকাঙ্ক্ষাও মিলে গিয়েছিল। কিন্তু আকস্মিক বিমান দুর্ঘটনায় সহকর্মী পোলিশ আর্কিটেক্ট মেসিজ নওভিস্কির মৃত্যুর পর বিশাল এ কর্মযজ্ঞে আর আগ্রহ পাননি মায়ার। পরে হাল ধরেন আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা সুইস-ফ্রেঞ্চ স্থপতি লো কহবুসিয়ে (দ্য আর্কিটেক্ট) নামে বিখ্যাত চার্লস এডওয়ার্ড। নিজ হাতে গড়ে তোলেন পৃথিবীর সবচেয়ে পরিকল্পিত আধুনিক ও নান্দনিক শহর চন্ডিগড়।
একাশিটি সেক্টরে ১১৪ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় যে মাস্টারপ্ল্যানে হিমালয়ের শিভালিক পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে এ উত্তর-ঔপনিবেশিক নগর। তাকে মানবদেহের সাথে তুলনা করা যায়। এর আছে মাথা (ক্যাপিটল কমপ্লেক্স), হার্ট (সিটি সেন্টার), ফুসফুস (পার্ক), মগজ (শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান), রক্ত সংবহন (পরিবহন ব্যবস্থা) এবং নাড়িভুঁড়ি (শিল্পকারখানা)। চারটি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে এ নগর— বসতি, জীবিকা, শরীর ও মনের যত্ন এবং সঞ্চলন। আবাসিক সেক্টরগুলো নিশ্চিত করেছে বসতি; ক্যাপিটল কমপ্লেক্স, সিটি সেন্টার আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে গড়া সেক্টরগুলি নিশ্চিত করেছে জীবিকা। অন্যদিকে পার্ক, বাগান, বোটানিক্যাল গার্ডেন আর খোলা সবুজ চত্বরের সেক্টরগুলো করা হয়েছে শরীর ও মনের যত্নের জন্য। শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে নিরাপদ ও অবাধ চলাচলের অসুবিধাগুলো মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নগরের সঞ্চলন ব্যবস্থা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স রাখা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাপিটল কমপ্লেক্স থেকে দূরে। গাড়ি চলাচলের রাস্তা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শব্দ ও পরিবেশ দূষণ থেকে বাসাগুলো মুক্ত থাকে।
এক কথায় বলা যায়, লো কহবুসিয়ে শুধু একটা আধুনিক নগরই নির্মাণ করতে চাননি, চেয়েছেন স্বপ্নের মতো একটা নগর বানাতে। বলাই বাহুল্য, তার হাতে গড়া চন্ডিগড় আজ রূপ লাবণ্যে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। লো কহবুসিয়ে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা স্থপতিও। খোলা হাতকে উপজীব্য করে যে শিল্পকর্ম বানিয়েছেন তিনি দাঙ্গা বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন ভারতের পাঞ্জাবের রাজধানীর জন্য সে হাত দেয়ার এবং নেয়ার, শান্তি ও সম্প্রীতির। তার অসাধারণ এই শিল্পকর্মটি স্থান পেয়েছে ক্যাপিটল কমপ্লেক্সে। তার এই ভাস্কর্যটি এখন চন্ডিগড়ের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার হয়। তবে, ক্যাপিটল কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা ঘেরাটোপ পার হয়ে মূল স্থাপত্য নিদর্শনটি এবার দেখা হয় নি আমাদের।
রাস্তার দুই পাশ জুড়ে আছে বিশাল বিশাল গাছ— শাল, মেহেগনি, শিরীষ, বহেরা, জুনিপার, সপ্তপর্ণি, রুদ্রাক্ষ, রক্তকাঞ্চন, হিজল, নিম, ইউকিলিপটাস সহ আরো নাম না জানা কত গাছ! মানুষ এখানে বাস করে উদার প্রকৃতির নৈকট্যে, মুক্ত হাওয়ায়। বেশিরভাগ বাড়িই দুই কিংবা তিনতলা, কোনো হাইরাইজ স্কাইস্ক্র্যাপার নেই এখানে। রাস্তায় নেই কোনো ট্রাফিক জ্যাম। বেশির ভাগই ব্যাক্তিগত গাড়ি। উবার কার পাওয়া যায় খুব সহজে। আমাদের মতো অনাবিল, তুরাগ, আবাবিল এসব নামের প্রাইভেট গণপরিবহনের দৌরাত্ম্য নেই। আছে কেবল চন্ডিগড় ট্রান্সপোর্ট আন্ডারটেকিং, মানে সরকারি গণপরিবহন ব্যবস্থা। কোনো ভিড়-ধাক্কাধাক্কি নেই। নির্দিষ্ট স্টপেজে দাঁড়িয়ে বাসে নামতে উঠতে হয়। আর অল্প দূরত্বে যাবার জন্য আছে অটো।
চন্ডিগড়ের রক গার্ডেন আর সুকনা লেক বেশ বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। রক গার্ডেনটি মূলত চল্লিশ একর জায়গা জুড়ে পাথরে নির্মিত ভাস্কর্যের এক আশ্চর্য প্রদর্শনী। শিল্পী নেক চাঁদ সাইনি প্রথমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলেন পাথর ভাস্কর্যের এ বাগানটি, পরে এখন জাতীয় সম্পদ হিসাবে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে। সুকনা লেকটিও লো কহবুসিয়ের আরেক সৃষ্টি। নাগরিকদের বিনোদন এবং শরীরচর্চ্চার সুবিধার জন্য শিভালিক পাহাড়ের পাদদেশে তিন বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে এ লেকটি। সূর্যাস্তের সময় দূর সবুজ পাহাড়ের পটভূমিতে লেকের মনোহর দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিন প্রচুর নগরবাসীদের সমাগম হয় এখানে।
দেখা হলো জাকির রোজ গার্ডেন। ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জাকির হোসেনের নামে উৎসর্গীকৃত এ গোলাপ বাগানটি করা হয়েছে ১৯৬৭ সালে। চল্লিশ একরের ওপর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই গোলাপ বাগানটি। ৩২ হাজার পাঁচশ বৃক্ষ পরিবেষ্টিত এ বাগানে প্রায় ৮ শ পঁচিশ জাতের গোলাপ আছে। গোলাপ বাগানের পাশেই চন্ডিগড় ললিতকলা একাডেমি। ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী চলছে। ছবিগুলোর রং আর ভাবনা মনে দাগ কাটে, ভাবায়। ছবির উজ্জ্বল রং আশা আর আকাঙ্খার দরোজা খুলে, ভাবনাগুলো কল্পনাকে মূর্ত করে আমাদের মনোজগতে।
দেখা হলো হিবিসকাস গার্ডেন। আট একর জায়গায় ৪০টিরও বেশি জবাফুলের প্রজাতির সমন্বয়ে ১৯৭৪ সালে গড়ে তোলা হয়েছে এ বাগানটি। চন্ডিগড়ে ৩১টি ১০০ বছরের বেশি বয়সি গাছকে হেরিটেজ গাছ হিসাবে চিহ্নিত করে সেগুলো বিশেষ যত্ন দিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তাদেরই একটি বিশাল কড়ই গাছ দেখা হলো এখানে। তারপর গেলাম Leisure Valley বাগানে। বিশাল এ বাগানে সময় যেন স্থির হয়ে থাকে, কারো কোনো তাড়া নেই। বিশাল এলাকা জুড়ে বড় বড় গাছ, মাঠভরা সবুজ ঘাস। মানুষের কাজ হলো সময়ের দ্রুত ধাবমান গাড়ি থেকে নেমে শুধু এখানে বসে থাকা। এখানে মাঠের ভেতর অলস শুয়ে থাকা একটা বিরাট পাথরের দিকে হঠাৎ চোখ গেলো। সামনে এগিয়ে দেখলাম তাতে খোদাই করে লেখা WHAT MATTERS IS NOT TO ADD YEARS IN YOUR LIFE, BUT TO ADD LIFE TO YOUR YEARS— ALEXIS CARREL।
হোটেলে ফেরার পথে উবার নিলাম। গাড়িতে ওঠার পর ড্রাইভার পেছনের সিটের যাত্রিদেরও সিট বেল্ট বাঁধতে অনুরোধ করে বলল, চন্ডিগড়ে নিয়ম কানুন বেশ কড়া, কিছু মনে কোরো না। বেশ ভালো ইংরেজি বলে ড্রাইভার। বললাম, এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ কড়াকড়ি দেখছি! জবাবে জানালো, শিখ, বৌদ্ধ এদের সবার মূলই হিন্দুত্বে এটা কেউ মানতে রাজি না হলে সমস্যা তো হবেই। বুঝলাম একেবারে মূলে হাত দিয়েছে সে। চন্ডিগড়ে বেশ কজন শিখ উবার ড্রাইভারের সাথে দেখা হয়েছে, যাত্রির সাথে সাধারণত কোনো বলে না তারা। উনি হিন্দু। জিজ্ঞেস করলাম, আর ইউ ফ্রম চন্ডিগড়? বলল, না, থাকি এখানে কিন্তু বাড়ি রাজস্থান। আমরা কোথা থেকে আসছি জানতে চাইলো সে। বাংলাদেশ জানার পর বললো, জগতের সব মানুষই এক, সৃষ্টিকর্তা একজনই। আমাদের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত আমরা মানুষ, কি বলো?
চন্ডিগড় মূলত একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। এখন জীবন এখানে চলছে ঠিক, কিন্তু কোথায় যেন অভাব আছে প্রাণস্পন্দনের। সে কথা বলব পরের কিস্তিতে। চলবে