বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়

পর্ব ৩

খায়রুল এ. চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৩, ২০২২

আজকে যাব আহারবাল। এটি একটি হিল স্টেশন, শ্রীনগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে, দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার, যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগবে। আজকে আরেকজন নতুন ড্রাইভারের সাথে চলেছি আমরা, নাম আজহার সিদ্দিকী। দেখতে ভীষণ স্মার্ট, লম্বা, সুদর্শন, বয়স তেত্রিশ-চৌত্রিশের বেশি হবে না। পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে ক্রিম কালারের জ্যাকেট।

যথারীতি টুকটাক ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে শুরু হলো। শ্রীনগরেই বাড়ি আজহারের, জাগাটার নাম নওগাম, শ্রীনগরের শহরতলি। আজহার জানালো, আমাদের যাবার পথেই পড়বে তার বাড়ি। মূল শহর থেকে বের হয়ে দক্ষিণমুখে কিছুদূর যেতেই তার বাড়ির রাস্তাটা দেখালো সে।

শহর থেকে বের হয়ে হাইওয়েতে উঠতেই রাস্তায় দেখা মিললো একদল লোকের, দশ-বারোটা ঘোড়া নিয়ে পথ চলছে ওরা। আজহার জানালো, এরা হলো বকরওয়াল। মেষপালকদের এখানে বকরওয়াল বলে। এই বকরওয়ালরা পাহাড়ে থাকে এবং মেষপালনই তাদের জীবিকা আর ঘোড়া তাদের দৈনন্দিন চলার বাহন।

ভ্রমণে এলে দীর্ঘ যাত্রায় আমি ড্রাইভারের পাশে বসি ইচ্ছে করেই। প্রথমত, তাদের সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানা যায়, অনেকটা গাইডের মতো কাজ হয়। দ্বিতীয়ত, লম্বা জার্নিতে ড্রাইভারের সাথে কথা বললে তার চোখে ঘুম আসে না। দেখলাম, আজকের ড্রাইভার আজহারও গাড়ি চালাতে চালাতে আমাদের না-জানা না-চেনা জিনিশগুলো সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। দিনের শুরুটা ভালোভাবে হচ্ছে বুঝতে পারছি, একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে গেল মনে।

বিদেশিদের সাথে সাধারণত তাদের ভাষা আর ঋতু নিয়ে কথা বলা শুরু করি আমি। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। জিজ্ঞেস করলাম, তার মাতৃভাষা কি কাশ্মিরী? জবাব স্বভাবিকভাবেই হ্যাঁ সূচক হলো। জানতে চাইলাম, কি কি ভাষা জানে সে। দেখলাম অন্য প্রায় সব কাশ্মিরীদের মতো সেও কাশ্মিরী ছাড়া হিন্দি, উর্দু আর ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।

হেমন্তের সকাল। আকাশ মেঘলা। রোদের দেখা নেই। মাঝে মধ্যে দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। গাড়িতে গান বাজছে, হিন্দি গান। কাশ্মিরে চারটি ঋতু— শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম ও হেমন্ত। এখন হেমন্ত। সেপ্টেম্বর-নভেম্বর তিন মাস হেমন্ত, ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি তিন মাস শীত, মার্চ-এপ্রিল দুই মাস বসন্ত, আর মে-অগাস্ট চার মাস গ্রীস্মকাল। কাশ্মিরের প্রকৃতি এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে আসন্ন শীতের, যখন বরফে ঢেকে যাবে পুরো কাশ্মির।

পথের দু’পাশে রাজকীয় চিনার আর ওয়ালনাট গাছের সারি। চিনার গাছ যেন কাশ্মিরের আত্মা। কাশ্মিরজুড়ে দেখা মেলে এই অপরূপ সুন্দর গাছটির। কাশ্মির এসে চিনারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়নি এমন পর্যটকের দেখা মেলা ভার। এমনি জাদু তার অনন্য রূপে। গাছটি লম্বায় প্রায় ২৫ মিটার পর্যন্ত হয়। ম্যাপল গাছের পাতার সাথে চিনারের পাতার আশ্চর্য মিল আছে। হেমন্তের শুরুতে চিনারের পাতা হলুদ রং ধারণ করে, তারপর ধীরে ধীরে বাদামি এবং শীতের শুরুতে লাল হয়ে ঝরে যায়। চিনারের পাতার এই রং বদল ভূস্বর্গ কাশ্মিরের সৌন্দর্যকে অনন্যতা দিয়েছে। এখন চিনারের পাতাগুলো হলুদ হয়ে এসেছে, অন্যদিকে ওয়ালনাট গাছের পাতারাও হলুদ হতে শুরু করেছে। পথের দুই পাশের এ অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে সামনে চলেছি।

সামনের স্টেশনটার নাম পুলাভামা। পুলাভামার প্রবেশমুখে আজহার জানালো, এ এলাকাটি টেরোরিস্টদের ঘাঁটি। ২০১৯ সালে কাশ্মিরের উন্নয়নের কথা বলে সংবিধানের ৩৭০ আর ৩৫এ ধারা রহিত করা হয়েছে। আর এখন বেকারত্ব শতকরা ৪৬ ভাগের ওপর। মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে। রাত নটা দশটার পর কেউ বের হতে পারে না ঘর থেকে, দেয়ার ইজ নো নাইট লাইফ হিয়ার। রাতে ঘর থেকে বের হলে কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। ক্ষোভের আগুন দেখা যাচ্ছে আজহারের কথায়। আই অ্যাম নট এন ইন্ডিয়ান, আই এম কাশ্মিরী!

সামনের স্টেশনটার নাম শোপিয়ান, এটা একটা জেলা। শোপিয়ানের আরেক নাম ‘আপেল টাউন’। এখানেই কাশ্মিরের সবচেয়ে বেশি আপেল উৎপাদন হয়। শোপিয়ানে ঢোকার মুখে নিচু স্বরে জানায় আজহার, এটাও আরেকটা টেরোরিস্ট হাব! একথা বলে আবার আমাদের আশ্বস্ত করলো, ওরা শুধু সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে, ট্যুরিস্টদের কোনো ক্ষতি করে না, বরং সব কাশ্মিরীরাই অসম্ভব ভালো মানুষ, আর ট্যুরিস্টদের প্রতি সর্বোচ্চ যত্নশীল।

পথের দুই পাশে শুধু আপেল গাছ। লাল বড় বড় পাকা আপেল ঝুলে আছে গাছে। মনে হয় যেন স্বপ্ন দেখছি, বাস্তব নয়। আজহারকে বললাম, সম্ভব হলে একটা আপেল বাগান ঘুরে দেখতে চাই। বাগান মালিকরা আমাদের ঢুকতে দেবে তো? অবশ্যই, জানায় সে। অনতিবিলম্বে পথের পাশে একটা বাগানের পাশে গাড়ি পার্ক করে আজহার। আমাদের বাগানটিতে যেতে বলে সে। আশে পাশে কেউ নেই। বাগানে ঢুকে পড়ি আমরা, আজহার ছবি তুলে দেয় আমাদের। এমন সময় দুজন তরুণ কাছে এলে আজহার তাদের সাথে কথা বলে। ওরা আমাদের কাছে জানতে চায় আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি কিনা। হ্যাঁ বলার পর ওরা বাগান থেকে আমাদের আপেল নেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! আমাদের অবাক করে দিয়ে তারা নিজেরাই গাছ থেকে অনেকগুলো আপেল তুলে আমাদের উপহার দেয়। খুশি মনে সেগুলো গ্রহণ করে আমরা তাদের ধন্যবাদ দেই। আজহার মুচকি মুচকি হাসে, অর্থটা অনেকটা— দেখলে, বলেছিলাম না, কাশ্মিরীরা খুব ভালো মানুষ, অতিথিদের তারা সম্মান করে!

দেখতে দেখতে আহারবাল চলে এসেছি। আমাদের গন্তব্য আহারবাল হিল স্টেশন আর জলপ্রপাত। সামনের পথটা বনের ভেতর দিয়ে। দুই পাশে পাইন বন। কিছুদিন আগে মেরি অলিভারের কবিতা অনুবাদ করছিলাম। অলিভারের অসংখ্য কবিতায় পাইন গাছ আর বনের কথা এসেছে ঘুরে ফিরে। তখন আমার খুব ইচ্ছা হয়েছিল গাছটা স্বচক্ষে দেখার, কিন্তু আর হয়ে ওঠে নি। এখন দেখছি, দেখছি একটা গাছ না, বনের পর বন।

একটু পর শুরু হলো ভয়াবহ পাহাড়ি চড়াই উৎরাই। বামে তাকালে দেখা যায় গভীর গিরিখাদ। সামান্য একটু এদিক ওদিক হলে বাঁচার উপায় নেই। এমন ভীতিকর পাহাড়ি রাস্তার অভিজ্ঞতা আগে আর কখনো হয় নি আমাদের। বিপরীত দিক থেকে আরেকটি গাড়ি আসলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। আমাদের অবস্থা দেখে আজহার ভরসা দেয়, কোনো ভয় নেই, এ পথে বিশ বছর ধরে গাড়ি চালাই আমি, আমার ওপর আস্থা রাখো। সত্যি সত্যি দেখলাম অসম্ভব দক্ষতায় এক সময় আহারবাল হিল স্টেশনে পৌঁছলাম আমরা।

সাত হাজার চারশ চৌত্রশ ফুট উঁচু এ জায়গাটিতে একটা জলপ্রপাত আছে। জলপ্রপাতের জলের রং দুধনীল। এমন রংয়ের পানি কোথাও কখনো দেখি নি। পাশের পাহাড়ে দেখলাম মেঘের মুকুট, স্রোতের মতো ভেসে যাচ্ছে মেঘদল। বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুটও আছে এখানে।

অনেক ছবি তুললাম আমরা। কিছুক্ষণ ঘুরাফিরা করে ফেরার পথ ধরলাম। আজহারকে বললাম দুপুরের খাবার শ্রীনগরে গিয়ে খাব। সে জানতে চাইলো কাশ্মিরের সিগনেচার ডিশ ‘বাজওয়ান’ খেয়েছি কিনা। বললাম, না এখনো সুযোগ হয় নি। জবাবে বলল, আজ তোমাদের বাজওয়ান খাওয়াবো। শ্রীনগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। গাড়িতে জগজিৎ সিংয়ের গজল বাজতে শুরু করেছে। চলবে