‘বালিহাঁসের ডাক’ বাস্তবের চিরচেনা কাহিনি
মুনশি আলিমপ্রকাশিত : মে ৩১, ২০২০
স্বকৃত নোমান বর্তমান সময়ের খুব আলোচিত এবং প্রধান সারির একজন কথাসাহিত্যিক। তার `বালিহাঁসের ডাক` নামক গল্পগ্রন্থটি ২০১৬ সালে অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে বের হয়। এটি তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। এতে মোট চৌদ্দটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলোর পরতে পরতে উঠে এসেছে নিটোল বাস্তবতার সুঘ্রাণ। তার গল্পের চরিত্রেরা একেবারেই চিরচেনা। বাস্তবের মানুষ। যদিও কল্পনার শৈল্পিক মিশেলে গল্পগুলো রচিত তবু তার গল্পগ্রন্থ পাঠে মনে হবে—এ কল্পনা যেন বাস্তবেরই সহোদর!
‘আচ্ছা, মাদ্রাসায় পতাকা তোলা হয় না কেন?’ ‘সেই কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে?’—চরিত্রদ্বয়ের মধ্য দিয়ে সময়ের সাহসী উচ্চারণ তথা দেশপ্রেমের স্বরূপটিই ইঙ্গিতবহ হয়ে উঠেছে। গল্পকার স্বৃকত নোমান চিত্রশিল্পী নন, কথাশিল্পী। কিন্তু তার লেখনির শৈল্পিক ছোঁয়ায় বালিহাঁসের ডাক গ্রন্থের গল্পগুলোও চিত্রের মতো করে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। ভাষার সরলীকরণ ও জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পছোঁয়ায় পাঠক বিগলিত হয়। মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে যায় তার গল্প থেকে গল্পান্তরে। এটা বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না যে, গল্পগুলোকে প্রাণদান করতে তার উপকরণ ও কৌশল দুই-ই প্রশংসার দাবি রাখে।
তার গল্পগুলো যথাক্রমে আর জনমে, বাঁলিহাসের ডাক, বরাত, পুরুষ, মানুষ, উড়নচণ্ডীর কবুল, বৃষ্টিমুখরতায়, যেখানেই যাও, জ্বলে ওঠা বারুদ, যে আগুন, তেত্রিশ বছর, লাল-সবুজের শত্রু-মিত্র, দেহের দিকে, আবদুল আহাদের মুখ প্রভৃতি।
আর জনমে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আমিন ফকিরের পঞ্চ ষাড়। পশু ও মানুষের নিবিড় ভালোবাসাই এ গল্পে রঙ্গ-ব্যঙ্গের মাধ্যমে ফুটে ওঠেছে। গৃহপালিত প্রতিটি পশুপাখিই গৃহকর্তার কাছে সন্তানতুল্য। আর তা বিক্রি করার আগে ও পরে গৃহকর্তার মনের যে অবস্থা হয় সে অবস্থাকেই লেখক এ গল্পে তুলে এনেছেন নিখুঁত শব্দতুলির আঁচড়ে। যদিও ষাড়গুলোকে একটু বেশিই শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়েছে তবু শিল্পরসের প্রয়োজনে তা খুব একটা অযৌক্তিক মনে হবে না। তাছাড়া অযোগ্য সাংবাদিকদের লাইভ টেলিকাস্ট বাস্তবতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
‘বালিহাঁসের ডাক’ গল্পটি চৌধুরী আজাদুর রহমান নামক লেখকের লেখালেখিকে কেন্দ্র করে। জাপানের কেনযাবুরো ওয়ের পুত্রের জীবনকাহিনির সঙ্গে চৌধুরী’র গল্পের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য খুঁজতে গিয়ে গল্পটিতে উঠে এসেছে বর্তমান সময়ের পঠনপাঠনহীন সমালোচকদের চিরচেনা রূপটি। রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তির ঘৃণ্য দিকটিও তিনি কৌশলে গল্পে তুলে এনেছেন। শেষতক সুস্মিতা ও সুজনের বাক্প্রতিন্ধী পুত্র নিশানের কথা বলার ঘটনাটি পাঠকের চোখেমুখে তৃপ্তির বন্যা বইয়ে দিবে বলেই আমার বিশ্বাস।
‘বরাত’ গল্পে ‘আবুল কালাম নামক’ চরিত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষার করুণ পরিণতির দিকটিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘অতি লোভে যে গাঁজন নষ্ট’—এ গল্পে তারই প্রমাণ রয়েছে। চরিত্র হিসেবে মমিন ও আবুল কালাম খুবই সক্রিয়। ‘পুরুষ’ গল্পটিতে রয়েছে নাটকীয় ঘনঘটা। কেন্দ্রীয় চরিত্র মাদল; যার পরিবারের সদস্যসংখ্যা প্রায় এক ফুটবল টিমের সমান! অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের বন্ধন, মনমানসিকতা, আচার-আচরণ, পড়াশোনা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাব কেমন হয় এ গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক সে দিকটিই তুলে ধরেছেন। গল্পের সরসতা ও কাহিনির ঘনঘটা এমন যে পাঠক নিঃসন্দেহে বুঁদ হয়ে থাকবে। মূলত মাদলের মধ্য দিয়ে সঙ্গ ও নিঃসঙ্গ পুরুষের মানসিক ও শারীরিক প্রবৃত্তির স্বরূপটিই গল্পের প্রধান দিক হিসেবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; যা বাস্তবতারই নামান্তর।
‘মানুষ’ গল্পটিকে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা দিয়েছেন লেখক। কেন্দ্রীয় চরিত্র আসাদুজ্জামান। লেখকের প্রচ্ছন্ন স্নেহে চরিত্রটি পেয়েছে মহামানবের মহিমা! এমন চরিত্র মানুষ কামনা করে, কিন্তু শেষতক হয়ে ওঠা কঠিন হয়ে যায়। কেননা, আমাদের রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থায় জনপ্রিয়দেরও হিংসার কোপানলে পড়তে হয়। তবু শেষতক আসাদুজ্জামানই হয়ে উঠবে পাঠকের কাছে আইডল। ‘উড়নচণ্ডীর কবুল’ গল্পটি অনেকটাই সিনেমাটিক; কিন্তু সংলাপ আর চরিত্রগুলোকে মনে হয় বেশ পরিচিত। গল্পের প্রয়োজনেই আজাদ, তানিম চরিত্রগুলোকে সংযোজন করা হয়েছে; যাদের ভূমিকা খুবই ক্ষীণ। মৌমিতা সুলতানার সঙ্গে শিমুলের কাকতালীয় বিয়েতে পাঠক খুশিই হবে। তবে চরিত্র হিসেবে শিমুল উঠন্তি সূর্যের মতোই; যার দীপ্তি অনেকটাই ম্লান।
‘বৃষ্টিমুখরতা’ গল্পটিতে রয়েছে কাব্যিক ঢং। পুরো গল্পটিই উত্তমপুরষে বর্ণিত। বাসে যেতে যেতে হঠাৎ এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয়। যার বাড়ি চলবিলের পাশে। প্রকৃতিকে জানতে হলে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে হয়, কৃত্রিমতায় ডুবে থাকলে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ সত্যিকারভাবে উপভোগ করা যায় না। এ গল্পে সেদিকটিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘যেখানেই যাও’ গল্পে সাইকো চরিত্র হিসেবে মনোয়ার হোসেন খুবই উজ্জ্বল। এ গল্পে কাহিনির ঘনঘটা সৃষ্টিতে লেখকের দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। খায়রুল বাশার নামক এক পঠনপাঠনহীন কবির লেখালেখির কাহিনিকে ‘জ্বলে ওঠা বারুদ’ গল্পের মুখ্যবিষয় করা হয়েছে। আবুল মনসুরের ফুড কনফারেন্স গল্পগ্রন্থের চরিত্রগুলোর মতোই তির্যক ব্যঙ্গাত্মক করে ফুটিয়ে তুলে বর্তমান সময়ের পঠনপাঠনহীন অথচ আত্মঅহমিকায় ভরপুর এমন লেখকদের চরিত্রের স্পষ্ট নবায়ন করেছেন। বিদ্যুতের আলোর কাছে যেমন মোমবাতির আলো ম্লান তেমনই পঠনপাঠনকৃত লেখকের কাছে পঠনপাঠনহীন। গল্পে শেষতক খায়রুল বাশারের বোধোদয় হয়েছে।
‘যে আগুন’ গল্পটিতে ছোটো কলেবরে লালসালু’র প্রতিচ্ছবিই ভেসে ওঠে। বেলায়েত শাহের কবরে আগুনের লেলিহান শিখাকে কেন্দ্র করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের কর্মকাণ্ডই এ গল্পের মূল বিষয়। গল্পশেষে মূল রহস্য উন্মোচিত হয়। গ্যাসকুপের মুখই ছিল বেলায়েতশাহের কবর। এ গল্পটিতে রয়েছে চুম্বকরস! নিঃসন্দেহে পাঠক এ রসে সিক্ত হবে। ‘জহির রায়হান: জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক পিইচডি গবেষণাকে কেন্দ্র করে ‘তেত্রিশ বছর’ গল্পে মূলত স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা উত্তর সমাজবাস্তবতাকেই তুলে ধরা হয়েছে। এ গল্পে সংলাপ ও নাটকীয়তা উভয়ই পাঠককে মোহিত করবে।
সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়। বদলে যায় সমাজ-সভ্যতার রীতিনীতি, বদলে যায় মানুষের মনমানসিকতা। পরিবেশ এবং বই পঠনপাঠন যে মানুষের মনকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে ‘লাল-সবুজের শত্রু-মিত্র’ গল্পের অনিকেত নঈমই তার প্রমাণ। বেলায়েত মাওলানার মতো পাকিস্তানপন্থীর ছেলে হয়েও ইতিহাসের গভীর পঠনপাঠনে তার ছেলে অনিকেত নঈমের চিন্তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। চরিত্র হিসেবে মিনহাজ খুবই উজ্জ্বল এবং তার কর্মকাণ্ড বাস্তবতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
‘ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনায় সিদ্ধ ‘দেহের দিকে’ গল্পটি। প্রেম যে নিষ্কাম নয় এ বিষয়টিই গল্পে ধারণ করা হয়েছে। তবে গল্পটি লেখকের আরও একটু নিবিড় ভালোবাসায় অন্যরকম হয়ে উঠতে পারত। ‘আবদুল আহাদের মুখ’ নামক শেষগল্পটি শুরুর চেয়ে শেষাংশটি বেশি হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ওয়াসেত এবং বাংলাদেশি পটুয়াখালীর ডিসি আবদুল আহাদের মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে কাকতালীয় সাক্ষাৎ গল্পটিকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা। চৌত্রিশ বছর পর করাচিতে জুমা মসজিদের অজুখানায় তাদের এ অনাকাঙিক্ষত দেখা এবং কথোপকথন নিঃসন্দেহে পাঠককে নিয়ে যাবে মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়ার্ত দিনগুলোর দিকে। চিত্রের মতো পাঠকের সামনে একের পর এক উপস্থাপিত হতে থাকবে লোমহর্ষক ঘটনাগুলো। ঘটনার আকস্মিকতায় পাঠক হৃদয় দলিত-মথিত হবে। একজন কালজয়ী লেখকই কেবল পারে পাঠকহৃদয়কে দলিত মথিত করতে।
গল্পের প্লট, ভাব-ভাষা, কথার গাঁথুনি, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সময়ের ঐক্য, ঘটনার পরম্পরা থেকে শুরু করে ঘটনার ঘনঘটায় রস সৃষ্টি তথা আবেগ সৃষ্টি ও কাহিনি গভীর থেকে গভীরতর করে তুলতে গল্পকার স্বকৃত নোমানের জুড়ি মেলা ভার। সব গল্পেই কাহিনি থাকবে; তবে শুধু কাহিনি বর্ণনাই সার্থক গল্প নয়। আবার গল্পগুলোকে চুইংগামের মতো টেনে বড়ো করলেও তা সার্থক হয় না, বরং জাবরকাটাই হয়। সার্থক গল্পের জন্য প্রয়োজন শিল্পবোধ। একজন গল্পকারকে হতে হয় পরিশ্রমী, বাস্তবঘেঁষা, সময়সচেতন, রাজনীতিসচেতন। এককথায় ত্রিকালদর্শীর মতো বিচক্ষণ! পঠনপাঠনসহ বিচারবিশ্লেষণে তাকে হতে হয় সিদ্ধহস্ত। আর এরূপ হলেই তখন কল্পনা ও বাস্তবতার শৈল্পিক সমন্বয়ে তার চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে সর্বজনীন। এদিক বিবেচনায় স্বকৃত নোমানের `বালিহাঁসের ডাক` গল্পগ্রন্থের চরিত্রগুলোকে বৈষ্ণব গানগুলোর মতোই মনে হয় চিরচেনা।
`বালিহাঁসের ডাক` গল্পগ্রন্থে শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় সংযোজিত হয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সংস্কার-কুসংস্কার-দর্শন এবং বিশ্বপ্রকৃতির নানা অনুসঙ্গ। একজন প্রকৃত লেখক প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙেন, আবার গড়েন। আর প্রতিনিয়ত ভাঙা-গড়া তথা নিজেকে উতরে যাওয়ার মধ্যেই সার্থকতা নিহিত। এছাড়াও গল্পগ্রন্থটির ভাষাবুননের শৈল্পিকতা ও কাহিনির গতিশীলতা পাঠকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করবে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে গল্পের প্রকৃত রসদ পেতে হলে রিভিউ নয়, পাঠককে মূল বই ধরেই এগোতে হবে।