অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার
বারবার এক দৃশ্য
আইয়ুব আল আমিনপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৯, ২০১৮
সবেমাত্র জনকণ্ঠে ঢুকেছি। থাকি ধানমন্ডিতে। ওখান থেকে বাসে করে শাহবাগ আসি। শাহবাগ থেকে বাংলামোটর হয়ে জনকণ্ঠ অফিস। আমার অফিস টাইম তিনটা থেকে শুরু। সেজন্য দুপুরে বাসা থেকে বের হই। সেদিন প্রচণ্ড রোদ। ফাল্গুন মাস। রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। জ্যামের কারণে আজিজ সুপার মার্কেটের সামনেই নেমে গেলাম। তপ্ত পিচঢালা পথ। গনগনে সূর্য তাপ দিচ্ছে একদম খাড়াভাবে। মাথা ভনভন করছে। মেজাজও বিগড়ে আছে। ভাবলাম, একটা লাল গোল্ডলিফ ধরাই। বিষে বিষ ক্ষয় করি। তো হাঁটতে হাঁটতে পিজি মেডিকেল মার্কেট ক্রস করে পূবালী ব্যাংকের সামনে না যেতেই দেখি, একটা জটলা। খেয়াল করলাম না। আর একটু কাছে যখন গিয়েছি তখন বুঝলাম ঝগড়া হচ্ছে। এ আর কি! ঢাকার রাস্তায় এমন হামেসাই চোখে পড়ে।
এরপর আমি যখন ওই জটলার আরও খানিক কাছে চলে গেছি তখন দেখলাম, এক মধ্যবয়সী মহিলা আর তার ২০/২১ বছরের এক কন্যা ঝগড়া করছে আর একজন মধ্যবয়সী লোকের সাথে। লোকটার পরনে লুঙি। মাথার চুল তেল দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ানো। মহিলা শাড়ি আর মেয়েটা সালোয়ার কামিজ পরা। এদের দুজনকে দেখে মোটামুটি ভালো ঘরেরই মনে হলো। তো আমি যখন ওদের একদম কাছাকাছি চলে গেছি তখন তাদের ঝগড়াটা চরম পর্যায়ে। এমন সময় ওই লোকটি মেয়েটিকে বলে ফেললো, তোকে চুদবো। এবং সাথে সাথে, একদম সাথে সাথেই মেয়েটি টান দিয়ে তার পরনের সালোয়ারটা খুলে ফেলে বলল, চুদ, একখন, এইখানে চুদবি। লোকজন সবাই হতভম্ব।
আমার চোখ মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল। সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণ আশপাশের কিছুই আমি দেখতে পেলাম না। লোকজন এবং তার মা প্রচণ্ডভাবে চেষ্টা করছে মেয়েটির পাজামাটা পরিয়ে দেবার জন্যে। মেয়েটিকে কোনোভাবেই কেউ আটকাতে পারছে না। ভর দুপুরবেলায় শাহবাগের মতো জায়গায় এ ঘটনা দেখার পর আমি আর অফিসে যেতে পারলাম না। কোনোভাবেই এ ঘটনা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। মাথার ভনভনিটা প্রচণ্ড আকার ধারণ করলো আরও। বাসা থেকে খেয়েও বের হইনি। ভাবলাম চোখে মুখে পানি দিয়ে কিছু খাই। খেতে গিয়ে বমি করে ফেললাম। শাহবাগ, টি এস সি, চারুকলা কোথাও ভালো লাগলো না। বাসায় ফিরে গিয়ে শুয়ে পরলাম। রাতে প্রচণ্ড জ্বর এসে পড়লো। পরদিন আরও বেশি। এভাবে সাতদিন পার হয়, জ্বর কমে না।
আপা আমাকে নিয়ে গেল আদ-দ্বীন হাসপাতালে। ব্লাডটেস্ট করে দেখলাম, টাইফয়েড। ডাক্তার বলল মেডিকেলে ভর্তি হতে। আমি বললাম, একমাসের অসুধ কি কি লাগে দিয়ে দেন ভর্তি হব না আমি। ডাক্তার মন খারাপ করে অসুধ ইন্জেকশন কি কি লাগে সব দিয়ে দিল। নিয়ে পরদিন সকালে বাড়ি চলে গেলাম। এই সাতদিন আর একটা ঘটনা ঘটেছে। বাইরে বের হলেই দেখি, ওই মেয়েটা তার মায়ের সাথে রিকসা, নয়তো বাসে, নয়তো হেঁটে যাচ্ছে। ওই একই জামা সালোয়ার পরা। তার মায়ের পরনেও ওই একই শাড়ি। এবং দেখলেই আমার গা কাঁপুনি দিয়ে উঠতো। মনে হতো আবার বমি হবে এখুনি। বাড়িতে গিয়ে অবস্থা আরও খরাপ। বিকেল হলেই জ্বর একশো চার ডিগ্রি হয়ে যায়। কোনও হুঁশ থাকে না। আম্মা ২৪ ঘণ্টা আমার মাথায় পানি ঢেলেই যাচ্ছে। এটা দেখে আমারই বিরক্তি লেগে যাচ্ছে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তার কোনও বিরক্তি নেই। মাঝে মাঝে আচমকা শরীর জোরে ঝাকি দিয়ে ওঠে। তখনি দেখতে পাই আমি শাহবাগে পূবালী ব্যাংকের পাশে। সেখানে ওই মেয়েটি আর তার মা রাস্তার ওপর বসে আছ। তার সামান্য দুরেই একটা লোক হাউ মাউ করে কাঁদছে।
বারবার এই একই দৃশ্য দেখছি। কোনোভাবেই এই দৃশ্য মাথার ভেতর থেকে বের করতে পারছি না। অসুধ ইন্জেকশন কোনও কাজই করছে না। আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছি এটা আমি বুঝতে পারছি। এবং এটাও বুঝতে পারছি, এভাবে আর কয়দিন গেলে আমি সত্যি সত্যি মারা যাব। কী করি... কী করি... কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। শেষমেষ একটা বুদ্ধি মাথায় আসলো এবং আমি সেটা করেও ফেললাম। কীভাবে তখন কাজটা করেছিলাম এখনো আমি ভেবে পাই না।
যাইহোক, তার পরদিনই আমার আর কোনও জ্বর নাই। একদম সুস্থ। কিন্তু এখনো ওই ঘটনা মনে পড়লেই বুকটা আমার ধক করে ওঠে। ওই মেয়েটা কোন কারণে বা কিসের তাড়নায়, কীভাবে অমন জনাকীর্ণ শহরে ভরা দুপুরবেলা ওই কাজটা করতে পারলো! এর মনস্তাত্ত্বিক বা সামাজিক ব্যাখ্যাই বা কি! ভেবে পাই না আজও!!!