বামজোটের নির্বাচন ও কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

হাসান আজারকাত

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০১৮

এদেশে এক ধরণের রাজনৈতিক গোষ্ঠী আছে যারা সবসময় মনে করে থাকে তারা ছাড়া বাকি সবাই জোচ্চোর। এক মাত্র তারাই ক্ষমতায় বসলে দেশ সুষ্ঠুভাবে চলবে। এরা মাশরাফির আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন নেয়া হজম করতে পারে না। তাদের অপরিপক্ক কর্মীরা মাশরাফির সাথে ফার্মার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়ক বা ইয়াবা বদির সাথে তোলা ছবি শেয়ার করে মাশরাফির নামে ঘৃণা ছড়িয়ে "জনগণের ক্ষোভ" নামে চালিয়ে দেয়। এরা কাজের মাধ্যমে নয়, মিডিয়াকে ব্যবহার করে দ্রুত পরিচিতি পেতে যায়। জনগণের নায়ক হতে চায়। আমি মনে করি সেই গোষ্ঠির কিছু ব্যাপার সামনে উঠে আসা উচিত।

 

আমি আওয়ামী বা বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট বা যুক্তফ্রন্টের কথা বলছি না। আমি ইসলামী দল গুলোর কথা বলছি না। কারণ এসব ফ্রন্ট বা প্রধান দুই দলের চরিত্র সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই জানি। তারা যে জনগণের স্বার্থবিরোধী শক্তি সেটা তারা নিজেরাও জানে, জনগণও জানে। তাই পুরোনো কাসুন্দি আর ঘাটলাম না।

 

আমি বলছি খুব কাছ থেকে দেখা ও আমার জীবনের দুইটা বছর যাদের সাথে নষ্ট করেছি সেই বামজোটের কথা। যারা একই সাথে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলে আবার স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় জিইয়ে থাকা নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশ ও জাতির পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে। আমি মূলত বামদের সাথে উঠাবসার বহু আগ থেকেই কমিউনিজমের ব্যাপারে পড়াশুনা করেছি। মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ, চে`বাদ আমাকে বহু রাত অনেক কিছু ভাবিয়েছে। শোষণের অনেক অজানা ব্যাপার সম্বন্ধে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। কি ভাবে শোষণ মুক্তি সম্ভব তার অনেক উপায় দেখিয়েছে। যার ফলে কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রতি আমার তীব্র আগ্রহ জন্ম নেয় এবং আমি মনঃস্থির করি যে আমি রাজনীতি করলে বামপন্থি মতাদর্শের রাজনীতিই করব।

 

২০১৪ সালে আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় বামজোটের শরীক একটি বামপন্থি সংগঠনে যুক্ত হবার মাধ্যমে। প্রথম প্রথম খুবই ভাল লাগত। মিছিল-মিটিং, বিপ্লবী স্বপ্ন, আহা! কিন্তু কিছুদিন যাবার পর থেকে বুঝলাম যত যাই করি না কেন আমরা আমরাই। জনগণ বাড়ে না, মানুষ বাড়ে না। নিজেরা নিজেরাই চিল্লাচিল্লি করছি। আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুব ভাবাত, যা হল প্রেসক্লাব এবং শাহবাগের বাইরে দল গুলো কোনো কর্মসূচি নেয় না। এভাবে কয়েক দিন যাবার পর কয়েকটি ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। প্রথম ঘটনাটি হল "ব্যানার রাজনীতি"। স্টেজে ধাক্কাধাক্কি করে কোন সংগঠন কত পরিষ্কার ভাবে নিজেদের ব্যানার মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে উপস্থাপন করতে পারে তার একটি অদ্ভুত প্রতিযোগিতা, যা আওয়ামীলীগ বা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝেও দেখা যায় না। এটা দেখার পর আমার কাছে পরিষ্কার হল, কেন এই গোষ্ঠী শাহবাগ ও প্রেসক্লাবের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ তাদের মূল আকর্ষণ হল মিডিয়া। মিডিয়াকে ব্যবহার করে কিভাবে জনগণের কাছে পৌছাতে পারা যায় তারা সেদিকেই সর্বোচ্চ মনযোগ দিয়ে থাকে! এবং এই লোক দেখানো প্রবণতার তুমুল চর্চা আমি সংগঠন সমুহের ভেতরে লক্ষ্য করলাম। কাজ না করে কাজ দেখিয়ে ভাল পদ পাওয়ার প্রবণতা, একজন শ্রম দিয়ে কমিটি তৈরি করলে অন্য জনের সেই কমিটির কৃতিত্ব নিয়ে বাহবা আদায় করা এসব অহরহ চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম। এই ধরণের সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আর যাই হোক জনগণের স্বার্থে নিয়োজিত বিপ্লবী তৈরি হয় না।

 

আরো অবাক করার মত ব্যাপার হল কমিউনিজমের মূল নীতি, সমাজ পরিবর্তনের পাঠ এসব সংগঠনে দেয়া হয় না। কেউ কারো চেয়ে ভাল জ্ঞান লাভ করুক সেটা এসব সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা কোন নেতাকর্মীই চায় না। এইসব সংগঠনে সাংগঠনিক মুল নীতির অন্যতম একটি `গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা` প্রায় উহ্যই বলা চলে। এসব সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতাদের জবাব দিহিতার কোনো জায়গাই রাখা হয় না। কোন ধরণের অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তা সুকৌশলে এড়িয়া যাবার একটি চর্চা এইসব সংগঠনসমুহে ব্যাপক আকারে লক্ষ্য করা যায়। একটি কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার চর্চা ব্যাতীত কখনই আগাতে পারে না। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা বাদ দিয়ে একটি সংগঠন কখনোই কমিউনিস্ট পার্টি হতে পারে না, সংখ্যা গরিষ্ঠের স্বার্থের জন্য কাজ করতে পারে না। এই ধরণের বিশৃঙ্খলা যে সব সংগঠনসমূহে পরিলক্ষিত হয়, সেসব সংগঠন সমুহকে আর যাই হোক কমিউনিস্ট পার্টি বা বামপন্থি সংগঠন বা প্রলেতারিয়ানদের পথ প্রদর্শক বলা যায় না।

 

অথচ কমিউনিস্ট বা বামপন্থির বেশে এসব সংগঠন বছরের পর বছর ধরে এদেশের জনগণকে ঠকিয়ে আসছে। তারা আসলে কি করতে চায় সে সম্পর্কে তারা নিজেরাও অবগত নয়। আজ আওয়ামী লীগের সাথে আছে তো কাল বিএনপির সাথে। এরা ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন বলে বয়কট করে তো ২০১৮ সালের আরো খারাপ অবস্থায় আরো প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে। নির্বাচনের তারিখ পেছানো হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে একদিকে সংগঠনের নেতারা স্ট্যাটাস দেয়, টিভি টকশোতে ক্ষোভ ঝাড়ে আবার অন্যদিকে পোস্টারে আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে দোয়া কামনা করে, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায়। তারা দ্বান্দিক ভাববাদ ধারণ করেন এবং তাদের কাজে সেটার প্রতিফলনই ঘটান। দ্বান্দিক বস্তুবাদের আলোকে তারা চিন্তা করতে অক্ষম। তারা কমিউনিজমের আদর্শ থেকে এখন বহুদূরে। তারা নির্বাচনস্বর্বস্ব পেটি-বুর্জুয়া মতাদর্শ অনুযায়ী চলছে। তাদের এসব ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের কারনে এখনো পর্যন্ত তারা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেন নাই, সেইসাথে যারা প্রকৃত মার্ক্সবাদ, লেনিনিবাদ, মাওবাদী মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে চান বা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের উত্থানের জন্যও এই পেটি-বুর্জুয়া বামজোট একটি বিরাট সমস্যার কারণ। জনগণের উচিত এসব পেটি-বুর্জুয়া বামজোটের দেখানো আশার ফাঁদে পা না দেয়া। কিংবা আওয়ামী-বিএনপি জোটের চক্রেও ডুবে না থাকা।

 

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করার জন্য কোনো রাজনৈতিক দল এখনো তৈরি হয়নি, হুট করে তৈরি হওয়া সম্ভবও নয়। আওয়ামী- বিএনপি - বাম - ইসলামিক এসব জোটের মাধ্যমেও জনগনের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব না। জনগণের নিজেদেরকেই একটি নতুন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। আমি বিশ্বাস করি এদেশের অধিকাংশ জনগণই পরিবর্তন চান, সমাজব্যবস্থার সাথে সাথে নিজেদের অবস্থার উন্নতি চান। সমাজ পরিবর্তনে অংশ নিয়ে গর্বিত হতে চান। সে লক্ষ্যে জনগণের সর্বাগ্রে একটি মঞ্চ প্রস্তুত করা দরকার যেখান থেকে পরিবর্তন পরিচালনা সম্ভব হবে। যে মঞ্চে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা থাকবে, থাকবে প্রত্যেক কাজের জন্য জবাবদিহিতা, থাকবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চর্চা, থাকবে দ্বান্দিক বস্তুবাদের প্রতিফলন।

 

লাল সালাম।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।