প্রতীকী ছবি
বাদশাহ তালুত ও জালুতের গল্প
ঐশী ফারজানাপ্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২০
খ্রিস্টের জন্মের এগারোশো বছর আগের কথা। বনি ইসরাইলিদের মাঝে আল্লাহ দাউদকে (আ.) নবি হিশেবে পাঠালেন। দাউদ ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও শক্তিশালী। ভয়টয় তার ভেতর তেমন ছিল না। তার এই সাহসের কথা সকলেই জানত। বনি ইসরাইলের লোকজন প্রায়ই বিভিন্ন উপজাতীয় কাফির দ্বারা আক্রান্ত হতো। কাফিররা বেশ শক্তিশালী ছিল। সেই তুলনায় বনি ইসরাইলের লোকরা ছিল দুর্বল। একবার তারা শক্রদের কাছে পরাজিত হলো। ফলে বনি ইসরাইলের লোকরা অসহায় হয়ে পড়ল। এই দুর্দিনে তালুত নামের এক ব্যক্তি তাদের বাদশাহ হয়ে বসলেন। তিনি একাধারে ধার্মিক ও সাহসী ছিলেন। কাফিরদের অত্যাচার প্রতিরোধে তিনি সাহসী উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা করলেন। এজন্য প্রথমে তিনি নিজেদের শক্তি বাড়ানোর কথা ভাবলেন।
শক্তি তো ভাবলেই হয় না! রাজা তালুত শক্তিশালী সেনাদল গঠনের কাজে হাত দিলেন। এজন্য তিনি বেছে বেছে লোক এনে জড়ো করলেন। দেখতে দেখতে এক বিরাট সেনাদল গঠন হয়ে গেল। এবার তালুত শত্রুর সাথে লড়াই করতে অগ্রসর হলেন। তালুতের সেনাদলে দাউদের (আ.) বড় ভাইয়েরা অংশ নেয়। দাউদের (আ.) বয়স তখন খুবই কম। তাই তিনি তালুতের সেনাদলে যোগ দিতে পারলেন না। তবে একদিন তাঁর সেই সুযোগ অনায়াসে এসে গেল। দাউদের (আ.) পিতা তাঁকে ভাইদের খবর নিতে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠালেন। দাউদ (আ.) যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে ভাইদের খোঁজ শুরু করলেন। এমন সময় তাঁর কানে এক লোকের ডাকা ভেসে এলো। শব্দ ভেসে এলো। লোকটি বনি ইসরাইলিদের ডেকে বলছেন, কে আছ পালোয়ান, যে একা আমার সাথে লড়বে? আমি ওয়াদা করছি, আমি যদি হেরে যাই তাহলে আমাদের দলের সবাই তোমাদের গোলাম হবে। আর যদি তোমাদের লোক হারে, তবে তোমরা আমাদের গোলাম হবে।
বালক দাউদ (আ.) লোকটির খোঁজ নিলেন। নাম তার জালুত। কাফেরদের সেনাপতি। প্রায় দুটো মানুষের সমান লম্বা এই কাফের নেতা। শুধু লম্বা কেন, জালুত ছিলেন বিশালদেহী একটা আস্ত দৈত্য। প্যালেস্টাইনের বাসিন্দা এই সেনাপতি খ্যাতনামা যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। ভয়ঙ্কর প্রকৃতির এই সেনাপতি জালুতের সাথে একা লড়াই করার সাহস কারো ছিল না। তিনি চল্লিশ দিন ধরে এভাবে লড়াইয়ের জন্য ডেকেছেন, কিন্তু কোনো বনি ইসরাইল তার সাথে লড়তে এগিয়ে আসেনি। প্রাণের মায়া কার না আছে!
হযরত দাউদ (আ.) এগিয়ে গেলেন। প্রথমে বাদশাহ তালুতকে এসে বললেন, রাজা মশায়, আমি জালুতের সাথে লড়তে চাই। আমাকে অনুমতি দিন।
দাউদ (আ.) তখন ছোট্ট বালক। সে নাকি জালুতের সাথে লড়বে! বালকের কথা শুনে বাদশাহ আশ্চর্য হলেন। বলে কী ছেলেটা? বাদশাহর কাছে দাউদের (আ.) কথা বিশ্বাস হলো না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
আমার নাম দাউদ। আমার বড় ভাইয়েরা আপনার ফৌজে ভর্তি হয়েছেন। বাবা আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। ভাইদের খবর নিতে এসেছি।
রাজা বললেন, তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষ। জালুত সাহসী এবং ভয়ঙ্কর লোক। তার সাথে লড়াই করা অত্যন্ত কঠিন ও বিপদজনক। বড় বড় পালোয়ানরা যেখানে সাহস পাচ্ছে না, আর তুমি লড়বে জালুতের সাথে? তুমি কী ভেবে দেখেছ, কী বলছ তুমি?
দাউদের জবাব, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ সহায় হলে আমি নিশ্চয়ই জালুতকে মারতে পারব।
বালকটির কথা তালুতের মোটেও বিশ্বাস হলো না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে ছোকরা, তুমি কী কখনও লড়াই করেছ?
না, করিনি। তবে আমি একদিন মেষ চড়াতে মাঠে গিয়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একটা সিংহ এবং ভালুক এসে আমাদের মেষপালের মধ্যে পড়ল। আমি সিংহটার কেশ ধরে এক আছাড় মারলাম, আর ভালুককে দিলাম এক থাপ্পড়। এতে সিংহ ও ভালুক দুটোই মারা গেল। আমার আস্থা, যিনি শক্তিশালী ও হিংস্র সিংহ ও ভালুকের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন, তিনি জালুতের হাত থেকেও আমাকে রা করবেন।
দাউদের (আ.) কথার এরূপ দৃঢ়তা, মনের সাহস ও বিশ্বাস দেখে বাদশাহ তালুত মুগ্ধ হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বালকটি সাধারণ কেউ নয়। আশ্চর্য বালক সে। অবশ্যই তাঁর ওপর আল্লাহপাকের বিশেষ অনুগ্রহ আছে। তাই তিনি দাউদকে জালুতের সাথে লড়াই করার অনুমতি দিলেন।
আসার সময় দাউদ (আ.) খেলার জন্য কয়েকটি পাথর কুড়িয়ে এনেছিলেন। সাথে ছিল মেষ তাড়ানোর লাঠি। এগুলো নিয়েই তিনি লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়লেন। বালক দাউদকে (আ.) দেখে জালুত তো হেসে খুন। এক সামান্য ছোকরা এসেছে লড়তে! আবার ঢাল নেই, তলোয়ার নেই। তাই জালুত বালকটিকে বিদ্রুপের ঢঙে বললেন, ওহে ছোকরা, তুমি কী যুদ্ধ করতে এসেছ, না পাখি মারতে? তোমার হাতে তো কেবল ঢিলই দেখছি!
বালক দাউদ (আ.) জবাবে বললেন, তোমাকে মারতে এই ঢিলই যথেষ্ট। আল্লাহর মর্জি থাকলে এই ঢিল দিয়েই তোমাকে ঘায়েল করতে পারব।
এ কথা শেষ হতে না হতেই দাউদ (আ.) জোরে একটি ঢিল ছুঁড়লেন। একেবারে জালুতকে লক্ষ্য করে। ঢিল জালুতের কপাল ভেদ করে একেবারে তার মগজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। হতভাগ্য জালুত এতে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বেহুঁশ হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ল। ক্ষণিকের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটল।
কাফির সেনারা এতক্ষণ সবই দেখছিল। সেনাপতিকে এভাবে মরতে দেখে সেনারা ভয় পেয়ে গেল। তারা সাহস ও শক্তি হারিয়ে যে যার মতো ময়দান ছেড়ে পালাতে লাগল। বনি ইসরাইলের লোকরা জালুতের হাত থেকে রা পেয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল।
বাদশাহ তালুত হযরত দাউদের (আ) কাজে যারপরনাই খুশি হলেন। বাদশাহ দাউদকে পুরস্কৃত করার কথা ভাবলেন। এত বড় কাজের কী পুরস্কার আর তিনি দেবেন! তিনি বরং তার কন্যাকে বালক দাউদের সাথে বিয়ে দিলেন। বাদশাহ তালুতের ইনতেকালের পর দাউদ (আ.) দেশের সিংহাসনে আরোহণ করেন। দাউদ (আ.) একজন বুদ্ধিমান ও ন্যায়বান শাসক ছিলেন। তাই তাঁর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হলেন।
দাউদের (আ.) অনেক গুণ ছিল। শক্ত লোহাকে হাতে নিয়ে গলাতে তিনি দ্ক্ষ ছিলেন। এ কারণে সহজেই তিনি অস্ত্র বানাতে পারতেন। তবে এসব অস্ত্র তিনি অন্যায় কাজে প্রয়োগ করতেন না। সত্যের পথে লড়াই করার কাজে তিনি অস্ত্র ব্যবহার করতেন। এছাড়া তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ মিষ্টি। এমন সুমধুর কণ্ঠ আর কারো ছিল না। তিনি সকাল ও সন্ধ্যায় মধুর সুরে আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন করতেন। এ সময় সমস্ত সৃষ্টিজগৎ তাঁর সাথে জোরে জোরে আল্লাহর প্রশংসায় মেতে উঠত। দাউদ (আ.) পাখির ভাষাও বুঝতে পারতেন।
হযরত দাউদ (আ.) চল্লিশ বছর বয়সে নব্যুয়ত লাভ করেন। আল্লাহর বাণী প্রচার এবং মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি অকান্ত পরিশ্রম করেন। আল্লাহ তাঁকে ঐশীগ্রন্থ জবুর দান করেছিলেন।