বাংলা‌দেশ ও ভার‌তের মধ্যে উত্তেজনার কারণ ইতিহাস না জানা

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪

বাংলা‌দেশ ও ভার‌তের সাধারণ জনগ‌ণের ম‌ধ্যে সামগ্রিকভা‌বে কখ‌নো আমি সাম্প্রদা‌য়িকতার ম‌নোভাব খুঁজে পাইনি। ন‌্যূনতম চ‌ল্লিশবার বি‌ভিন্ন কার‌ণে আমি ভারত ভ্রমণ ক‌রে‌ছি বি‌ভিন্ন কার‌ণে। চ‌ল্লিশবার ভ্রম‌ণে ভার‌তের সকল ঐতিহা‌সিক জায়গাগু‌লো ঘু‌রে দেখা ছিল প্রধান লক্ষ‌্য। ভারত ভ্রমণ কর‌তে প্রথমবার যাই ১৯৮৩ সা‌লে এক‌টি আন্তর্জা‌তিক চল‌চ্চিত্র উৎস‌বের ‘সম্মা‌নিত প্রতি‌নি‌ধি’ হি‌সে‌বে। প‌রে বহুবার গি‌য়ে‌ছি বইপত্র কিন‌তে এবং প‌শ্চিমব‌ঙ্গের মঞ্চের নাটক দেখ‌তে। পিএইচ‌ডি গ‌বেষণার কা‌জে কলকাতা দি‌ল্লিতে গি‌য়ে‌ছিলাম ক‌য়েকবার। পরবর্তী সময় ভারত গি‌য়ে‌ছি নানান কার‌ণে: নাট‌্যদ‌লের উৎস‌বে আম‌ন্ত্রিত হ‌য়ে, বিশ্ব‌বিদ‌্যাল‌য়ে স‌ম্মেলন আয়োজন করার প্রশ্নে, বি‌ভিন্ন বিশ্ব‌বিদ‌্যাল‌য়ে বক্তৃতা দি‌তে, বাংলা ও ভার‌তের শিক্ষা নি‌য়ে গ‌বেষণার কা‌জে। ব‌্যক্তিগতভা‌বে বি‌য়ের আমন্ত্রণে যোগ দি‌তেও গি‌য়ে‌ছি।‌

প্রায় প্রতিবারই বি‌ভিন্ন জায়গায় ঘুরবার চেষ্টা ক‌রে‌ছি। বি‌ভিন্ন প্রদেশ ঘুর‌তে গি‌য়ে সেখানকার একদম সাধারণ মানু‌ষের স‌ঙ্গে মি‌শে কখ‌নো তা‌দের ম‌ধ্যে সামান‌্য সাম্প্রদা‌য়িক ম‌নোভাব লক্ষ‌্য ক‌রি‌নি। শি‌ক্ষিত মানুষ‌দের ম‌ধ্যেও আমি দেখে‌ছি আন্ত‌রিকতা। যাদের ম‌ধ্যে আমি কখ‌নো কখ‌নো বাংলা‌দেশ বি‌দ্বেষ দে‌খে‌ছি, লক্ষ‌্য ক‌রে‌ছি বাংলা‌দেশ সম্প‌র্কে তারা ভুল তথ‌্য পা‌চ্ছেন। খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভুল তথ‌্য প‌রি‌বেশন করা হ‌চ্ছে মানু‌ষের মধ্যে। শি‌ক্ষিত কিছু মানুষ তা বিশ্বাস কর‌ছেন এবং ক্ষুব্ধ প্রতি‌ক্রিয়া ব‌্যক্ত ক‌রছেন বাংলা‌দেশ সম্প‌র্কে। যারা ক্ষুব্ধ প্রতি‌ক্রিয়া ব‌্যক্ত কর‌ছেন, তাঁ‌দের বে‌শির ভাগ কখ‌নো বাংলা‌দে‌শে বেড়া‌তে আসেন‌নি। বাংলা‌দে‌শের মানু‌ষের স‌ঙ্গে মেলা‌মেশা করার সু‌যোগ পান‌নি। বাংলা‌দে‌শে বেড়া‌তে এসে যারা বাংলা‌দে‌শের মানু‌ষের স‌ঙ্গে মেলা‌মেশা ক‌রে‌ছেন, সময় কা‌টি‌য়ে‌ছেন তাঁ‌দের ম‌ধ্যে এরকম ক্ষুব্ধ প্রতি‌ক্রিয়া লক্ষ‌্য ক‌রি‌নি।

ভার‌তের কিছু মানু‌ষের বাংলা‌দেশ সম্প‌র্কে যে ক্ষুব্ধ প্রতি‌ক্রিয়া র‌য়ে‌ছে, সেটার আরো কিছু কারণ আছে। যার মূল কথাটা হ‌লো তাঁ‌দের কা‌ছে ভুল তথ‌্য যা‌চ্ছে। সব‌ক্ষে‌ত্রে ম‌নে রাখা দরকার, প্রতিটা দে‌শের সাধারণ জনগণ আর এক‌টি দে‌শের সাধারণ মানু‌ষের বন্ধু। সরকা‌রের চ‌রিত্র বা নী‌তি দি‌য়ে সেই দে‌শের সাধারণ মানুষ‌দের বিচার করা ঠিক নয়। প্রতি‌টি দে‌শের প্রেক্ষি‌তে একথাটা সত‌্য।

বাংলা‌দেশ ও ভার‌তের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ কর‌ছে, স‌ত্যিকারভা‌বে সেটা হ‌চ্ছে একটা ভুল বুঝাবু‌ঝি। কিছু মানুষ সেই ভুল বু‌ঝাবু‌ঝি নি‌জে‌দের স্বা‌র্থে ইচ্ছাকৃতভা‌বে সৃ‌ষ্টি ক‌রে‌ছে। রাজ‌নৈ‌তিক হীন উদ্দেশ‌্য র‌য়ে‌ছে তার পিছ‌নে। বাংলা‌দে‌শের বাঙালি‌দের স‌ঙ্গে সব‌চে‌য়ে প্রধান ভুল বুঝাবু‌ঝিটা ভার‌তের বাঙালি‌দের, সেটাই সব‌চে‌য়ে আশ্চর্যজনক। খুব ঠাণ্ডা মাথায় প‌রিকল্পিতভা‌বে এই ভুল বুঝাবু‌ঝিটা তৈ‌রি করা হ‌য়ে‌ছে। বি‌শেষ ক‌রে পঁয়‌ত্রিশ বছ‌রে সেটা খুব জ‌টিল আকার নি‌য়ে‌ছে। দুই দে‌শের বাঙালি‌দের ম‌ধ্যে ভুল বুঝাবু‌ঝি তৈ‌রি করার পেছ‌নে কারণটা কী? দুই বাংলার মানু‌ষের ম‌ধ্যে যা‌তে সুসম্পর্ক গ‌ড়ে না ওঠে।

স্মরণ রাখ‌তে হবে, বাংলাভাষায় কথা ব‌লে এমন মানু‌ষের সংখ‌্যা বি‌শ্বে এখন চ‌ল্লিশ কো‌টির কাছাকা‌ছি হ‌বে। বাংলা ভাষার স্থান সেভা‌বে বিচার কর‌লে ষষ্ট স্থা‌নে এসে দাঁড়াবে। সেই বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ম‌ধ্যে যা‌তে কো‌নো সুসম্পর্ক গ‌ড়ে না ওঠে, সেটার দি‌কে বহু জ‌নের নজর র‌য়েছে। খুব দৃঢ় নজর র‌য়ে‌ছে। বাঙালির ম‌ধ্যে যে কো‌নো ধর‌নের সৌহার্দ‌্যকে ভয় পায় তারা। এটা আজ থে‌কে নয়, ব্রিটিশ শাসন থে‌কে। বাংলার শাসকরা মুঘল যু‌গে, তুর্কী শাস‌নে পাত্তা দেয়‌নি দি‌ল্লির কেন্দ্রকে। বাংলা ছিল মধ‌্যযু‌গে সব‌চে‌য়ে ধনী অঞ্চল, বাংলা ছিল ব‌্যবসা বা‌ণি‌জ্যে সব‌চে‌য়ে এগি‌য়ে। বলা হয় সিরাজ‌দৌলার শাসনকা‌লে জগৎ শেঠ ছি‌লেন তখন বি‌শ্বের সব‌চে‌য়ে ধনী ব‌্যক্তি। বাংলা তখন নি‌জের আলাদা শ‌ক্তিশালী ভাষা তৈ‌রি ক‌রে নি‌য়ে‌ছে। বাংলার রাজস্ব না পে‌লে চল‌ছে না দি‌ল্লির। কিন্তু তুর্কী কিংবা মুঘল শাসকরা বাংলা‌কে দ্বিখ‌ণ্ডিত করার কথা ভা‌বেন‌নি। ব্রিটিশরা বাংলা‌কে দুই টুক‌রো কর‌তে চে‌য়ে‌ছিল ভয় পে‌য়ে। বাঙালি‌কে বিভক্ত করার খেলা আজ‌কের নয়।

বাংলা ব্রিটিশ শাস‌নে ছিল শিক্ষা দীক্ষা, শিল্প সা‌হিত‌্য সর্ব‌ক্ষে‌ত্রে এগি‌য়ে। ফ‌লে অন‌্যান‌্য প্রদেশ থে‌কে তখনই আওয়াজ উঠে‌ছিল বাংলার বিরু‌দ্ধে। মধ‌্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ তখন বাংলার বিরু‌দ্ধে বি‌ষোদগার ক‌রে। পি‌ছি‌য়ে থাকা অন‌্য প্রদে‌শের প্রতি‌নি‌ধি স‌্যার সৈয়দ আহমদ ক্ষুব্ধ ক‌ণ্ঠে ব‌লে‌ছি‌লেন, আমরা কি বাঙালি‌দের পা চাট‌বো? নিশ্চয় পি‌ছি‌য়ে পড়া প্রদে‌শের মানুষ হি‌সে‌বে তা‌দের ক্ষো‌ভের যু‌ক্তি ছিল। রাজধানী কলকাতা সব সু‌যোগ সুবিধা পা‌চ্ছিল। বি‌ভিন্ন প্রদে‌শের ধনী হিন্দু মুসলমানরা তখন বাংলার বিরু‌দ্ধে ক্ষোভ জানায়। খুব স্বাভা‌বিক ছিল সেই ক্ষোভ জানা‌নো। দুর্ভাগ‌্যজনক যে, বি‌ভিন্ন প্রদে‌শের সেই ক্ষোভ কম‌বে‌শি আজও র‌য়ে গে‌ছে বাঙালিদের নি‌য়ে। ব্রিটিশরা যখন দেখ‌তে পেল, শিক্ষায় সংস্কৃ‌তি‌তে এগি‌য়ে থাকা বাংলায় শীঘ্রই ব্রিটিশ বি‌রোধী আন্দোলন দানা বাঁধ‌তে পা‌রে, বহু রকম ষড়য‌ন্ত্রের পর তাই বাংলা‌কে ভাগ করা হ‌লো ১৯০৫ সা‌লে।

বঙ্গভ‌ঙ্গ র‌দের সে লড়াইয়ে অন‌্য প্রদে‌শের সমর্থন ছিল না। বঙ্গভ‌ঙ্গ রদের প‌ক্ষে স্ব‌দেশি আন্দোলন‌ সম্প‌র্কে জওহরলাল নেহরু ব‌লে‌ছি‌লেন, চাক‌রি না পাওয়া শি‌ক্ষিত বেকার‌দের ক্ষোভ এটা। যা্ হোক, বঙ্গভঙ্গ রদ হ‌লো জ‌মিদার ও শি‌ক্ষিত সমা‌জের আন্দোল‌নের ভিতর দি‌য়ে। কিন্তু খুব কৌশ‌লে তা আবার ভে‌ঙে ফেলা হ‌লো ১৯৪৭ সা‌লে। কারণ বাংলা এক থাক সেটা গান্ধী, নেহরু ও আসা‌মের তৎকালীন সরকার চাইছিল না। য‌দি গান্ধী নেহরু সে‌দিন মন্ত্রী মিশ‌নের প‌রিকল্পনা বা‌তিল না কর‌তেন, তাহ‌লে দুই বাংলা আর আসাম মি‌লে গ‌ঠিত হ‌তো বাংলা প্রদেশ। ভারত ভাগ না হ‌য়ে ১৯৪৬ সা‌লেই অখণ্ড ‘ভারত যুক্তরাষ্ট্র’ গঠিত হ‌তো। সেখা‌নে প্রদেশগু‌লি কে‌ন্দ্রের অধীন না হ‌য়ে হ‌তো স্বায়ত্বশা‌সিত। মন্ত্রী মিশ‌নের প্রস্তা‌বে বলা ছিল, প্রদেশগু‌লি য‌দি কে‌ন্দ্রের স‌ঙ্গে থাক‌তে না চায় দশ বছর পর আলাদা হ‌য়ে যে‌তে পার‌বে। জিন্নাহ তা মে‌নে নি‌লেও কিন্তু কং‌গ্রেস তা চায়‌নি। কং‌গ্রেস চে‌য়ে‌ছে প্রতি‌টি রাজ‌্য বা প্রদে‌শের ওপর কে‌ন্দ্রের একা‌ধিপত‌্য। জিন্নাহর রাজনী‌তি ছিল তার বিপরীত, প্রদে‌শের উপর কে‌ন্দ্রের আধিপত‌্য নয়।

বাংলা‌দেশ ও ভার‌তের ম‌ধ্যে আজ‌কের যতটুকু উত্তেজনা তার প্রধান কারণ ভারত ভাগ এবং অন‌্যান‌্য বিষ‌য়ে স‌ঠিক ইতিহাস না জানা। বিশ শত‌কের প্রথম দি‌কে অনেক বিকৃত ইতিহাস লেখা হ‌য়ে‌ছে, সেখা‌নে এক পক্ষ এক‌টি দল সকল ভা‌লো কা‌জের কৃ‌তিত্ব নি‌য়ে‌ছে। বহু‌দিন পর্যন্ত র‌চিত ইতিহা‌সে ভারতভা‌গের দায় মুসলমান‌দের ঘা‌ড়ে চাপা‌নো হ‌য়ে‌ছে। সেসব ইতিহা‌সে তুর্কী মুঘল ‌মুসলমান শাসক‌দের দেখা‌নো হ‌য়ে‌ছে দখলদার, ভার‌তে অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু এখন স‌ঠিক ইতিহাস পাওয়া যা‌চ্ছে। সেখা‌নে দেখা যা‌চ্ছে, ভার‌তে আর্য, শক, কুশান, তুর্কী, মুঘল সবাই বি‌দেশি এবং অনুপ্রবেশকারী। সবাই কা‌লের বিবর্ত‌নে আবার ভারতীয় হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছিল। ইং‌রেজ‌দের মতন তারা বি‌দেশি হি‌সে‌বে ভার‌তের সম্পদ বাইরে পাচার ক‌রে‌নি। প্রাচীনকা‌লের ইতিহা‌সে দেখা যায় আর্যরা যখন বৈ‌দিক ধর্মের মাধ‌্যমে সমাজ দৃঢ়ভা‌বে শোষণ প্রতিষ্ঠা ক‌রে‌ছিল, চার্বাকরা প্রতিবাদ জা‌নি‌য়ে‌ছিল মনুর বিধান এবং বে‌দের শোষ‌ণের বিরু‌দ্ধে।

চার্বাক‌দের তখন কচুকাটা ক‌রে ব্রাহ্মণরা এই বি‌দ্রো‌হের জন‌্য। পরবর্তীকা‌লে সেখা‌নে মহাবীর ও বু‌দ্ধের  নতুন ধর্মমত প্রচার ছিল বৈ‌দিক ধর্মের বিরু‌দ্ধে এক‌টি রাজনী‌তি। ক‌য়েক‌শো বছর ধ‌রে ভারতব‌র্ষে সব‌চে‌য়ে ভয়াবহ দাঙ্গা হ‌য়ে‌ছে ব্রাহ্মণ‌্য ধর্মের স‌ঙ্গে বৌদ্ধ ধ‌র্মের। বরং মুসলমান‌দের শাস‌নে ‌হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা ছিল না। মুসলমানরা তরবা‌রির দ্বারা ধর্ম প্রচার ক‌রে‌নি। ভার‌তের মানুষ যেভা‌বে খ্রিস্টান হ‌য়ে‌ছে শাসক‌দের জুলুম ছাড়া মিশনারী‌দের দ্বারা, ভার‌তের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ক‌রে‌ছে একই কার‌ণে। মধ‌্যযু‌গে ভার‌তের মুসলমান শাস‌নে সব বড় বড় পদ ভোগ কর‌তেন হিন্দুরা, যেমন মান‌সিংহ, জয়‌সিংহরা ‌ছি‌লেন সৈনাপ‌তি। হিন্দুরাই বড় বড় ভূস্বামী এবং জ‌মিদার ছি‌লেন। বাংলার ১৯ জন বড় জ‌মিদা‌রের ম‌ধ্যে ১৭ জন ছি‌লেন হিন্দু এবং ১৫ টি ছোট জ‌মিদা‌রির ম‌ধ্যে ১৩ জন জ‌মিদার ছি‌লেন হিন্দু। ফ‌লে ইং‌রেজ বা অন‌্যদের প্রচার মুসলমানরা হিন্দু‌দের উপর জুলুম ক‌রে‌ছে, মুসলমান শাস‌নে হিন্দু মুসলমান সম্প্রী‌তি ছিল না; এসব স‌ত্যি নয়। সেই সত‌্যগু‌লো জানার জন‌্য স‌ঠিক ইতিহাস পড়‌তে হ‌বে।

স‌ঠিক ইতিহাস কারা লি‌খে‌ছেন? লি‌খে‌ছেন অনেকেই, সবার গ্রন্তের কথা আমার জানা নেই। আমার জানা ম‌তে ভার‌তের যেসব লেখক‌দের ইতিহাস বই এক্ষে‌ত্রে স‌ঠিক চিত্র দে‌বে তাঁরা হ‌লেন: ব‌ঙ্কিমচন্দ্র চ‌ট্টোপাধ‌্যা‌য়, অক্ষয়কুমার মৈ‌ত্রেয়, দা‌মোদার ধর্মানন্দ কোসাম্বী, ধর্মানন্দ দা‌মোদার কোসাম্বী, হরবংশ মু‌খিয়া, র‌মিলা থাপার, মান‌বেন্দ্রনাথ রায়, জওহরলাল নেহরু, দী‌নেশচন্দ্র সেন, সুপ্রকাশ রায়, প্রমোদ সেনগুপ্ত, অন্নদাশংকর রায়, দেবীপ্রসাদ চ‌ট্টোপাধ‌্যায়, শৈ‌লেশকুমার ব‌ন্দ্যোপাধ‌্যায়, সুনী‌তি কুমার ঘোষ, শ‌্যামলী সুর, সতীশ চন্দ্র, পর‌মেশ আচার্য, রণবীর চক্রবর্তী, শ‌্যামল চক্রবর্তী, গোপাল হালদার, নী‌রোদচন্দ্র চৌধুরী, সন্দীপ ব‌ন্দ্যোপাধ‌্যায়, হি‌তেশরঞ্জন স‌্যান্নাল, সনৎকুমার নস্কর, দ‌ক্ষিণারঞ্জনশাস্ত্রী, গৌতম ভদ্র, পঞ্চনন সাহা, অমর দত্ত, অবনী লা‌হিড়ী, অম‌লেন্দু দে,  সুর‌জি দাশগুপ্ত, অঞ্জন গোস্বামী, শিবাজী ব‌ন্দ্যোপাধ‌্যায়, সিদ্ধার্থ গুহ রায়, জয়া চ‌্যাটার্জী, ধ্রুব কর ও বুম্বা দে, সঙ্গীতা ব‌্যানার্জী ও বিমলচন্দ্র বেতাল, রাজলক্ষ্মী কর, য‌শোবন্ত সিংহ, বিমলানন্দ শাসমল এইরকম আরও অনেকের লেখা।

সবার নাম এই মুহূ‌র্তে ম‌নে পড়‌ছে না। এসব লেখা পাঠ কর‌লে দেখা যা‌বে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অন্তত ভার‌তে সাধারণ হিন্দু-মুসলমান‌দের ম‌ধ্যে সম্প্রী‌তির অভাব ছিল না। হিন্দু মুসলমান‌দের দাঙ্গার ক্ষে‌ত্রে মূল ভূ‌মিকা কা‌দের সেটা ব‌লে দে‌বে উপ‌রের বইগু‌লো। য‌শোবন্ত সিংহসহ অনেকের ভারত ভাগ নি‌য়ে লেখা পাঠ কর‌লে দেখা যা‌বে, ১৯৪৭ সা‌লের দাঙ্গার জন‌্য সম্পূর্ণ দায়ী ছিল মাউন্ট ব‌্যা‌টেন। মাউন্ট ব‌্যা‌টেন প‌রিক‌ল্পিতভা‌বে এই দাঙ্গা লাগাবার ব‌্যবস্থা ক‌রেন কংগ্রেস সভাপ‌তি মওলানা আজাদও একথা স্বীকার ক‌রে‌ছেন। সারা বি‌শ্বের কা‌ছে মাউন্ট ব‌্যা‌টেন প্রমাণ কর‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন, ভারতীয়রা ক‌ত উগ্র ও অসভ‌্য। নি‌জে‌দের ম‌ধ্যে কীরকম হিংস্র রক্তপাত ঘটা‌তে পা‌রে এই জা‌তি। ব্রিটিশ শাস‌নেই ভারতীয়রা ভা‌লো ছিল এবং কিছুটা সভ‌্য হ‌য়ে‌ছিল। মাউন্ট ব‌্যা‌টে‌নের মতন কুচিন্তা করার লোক বর্তমান ভারত, বাংলা‌দে‌শেও র‌য়ে‌ছে। বি‌শেষ ক‌রে প‌শ্চিমব‌ঙ্গে স‌ঙ্গে বাংলা‌দে‌শের বাঙালি‌দের সুসম্পর্ক না হোক সে চেষ্টাটা অনেকের।

ভার‌তে প‌শ্চিমব‌ঙ্গের উপর কে‌ন্দ্রের প্রভাব বহু বছর ধ‌রে কম। সে কার‌ণে প‌শ্চিমব‌ঙ্গের বাঙালিরা ভিন্নরকম রাজনী‌তির শিকার হ‌চ্ছে যা বাংলা‌দে‌শের স‌ঙ্গে তা‌দের সুসম্পর্ক কর‌তে দি‌চ্ছে না। ভার‌তের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বা খারাপ সম্পর্ক নি‌য়ে প্রচ‌লিত যেসব ধারণা আছে, সেসম্প‌র্কে উল্লি‌খিত‌দের গ্রন্থ পাঠ থে‌কে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যা‌বে। ভার‌তের ধনী বা উচ্চব‌র্ণের হিন্দু এবং সাধারণ হিন্দু এক কথা নয়। ব্রিটিশ শ‌ক্তির দ্বারা বাংলা দখ‌লের পর, বাংলার বাবুরা ছি‌লেন তখন অবশ‌্য ব্রিটিশ শ‌ক্তির দালাল। ১৮৫৭ সা‌লের মহা‌বি‌দ্রো‌হে সারা উত্তর ভার‌তে যখন দাবানল জ্ব‌লে ওঠে বাংলার ইং‌রে‌জি শি‌ক্ষিতরা তখন ব্রিটিশ সরকা‌রের দালালি ক‌রে‌ছে। বাংলার রাজনী‌তির চেহারা কেমন ছিল তখন? ব্রিটিশ শাসক আর বর্ণ‌হিন্দু বা শি‌ক্ষিত ভদ্রলোকরা তখন শাসক‌শ্রেণি। ভিন্ন দি‌কে বাংলার সাধারণ ‌হিন্দু-মুসলমানরা শো‌ষিত‌শ্রেণি।

বাংলার তৎকা‌লের ইতিহা‌সে দেখা যা‌বে, সাধারণ হিন্দু মুসলমানরা একস‌ঙ্গে লড়াই কর‌ছে। কার বিরু‌দ্ধে লড়াই কর‌ছে? ব্রিটিশ শাসক আর ইং‌রে‌জি শি‌ক্ষিত বাবু এবং চিরস্থায়ী ব‌ন্দোব‌স্তের জ‌মিদার‌দের বিরু‌দ্ধে। ‌ব্রিটিশ শা‌সিত বাংলায় তাই সাম্প্রদা‌য়িক বিভাজন ছিল না। সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা একপ‌ক্ষে ছিলেন। ‌ভিন্ন দি‌কে ছিলেন ধনী হিন্দু আর ব্রিটিশ শাসকরা। স্পষ্ট দুটা ভাগ: শো‌ষিক সাধারণ ‌হিন্দু-মুসলমানরা একটা পক্ষ। ধনী হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসক‌দের দালাল হি‌সে‌বে ভিন্ন পক্ষ। সারা ভারতের রাজনী‌তি‌তে এই ঘটনাই ঘটে‌ছিল। বর্ণ হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসক‌দের স‌ঙ্গে এক‌দি‌কে, ভিন্ন দি‌কে সাধারণ হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা। সামান‌্য কিছু ধনী মুসলমানরা তখন দোদুল‌্যমান। পরবর্তী‌তে ধনী‌ হিন্দু‌দের স‌ঙ্গে পাল্লা দি‌তে চায় তখন তারা। ফ‌লে শেষ বিচা‌রে এঁরাও সাধারণ হিন্দু-মুসলমা‌নের স‌ঙ্গে ছিল না। ধনী হিন্দু মুসলমা‌নের ম‌ধ্যে ক্ষমতালা‌ভের যে প্রতি‌যো‌গিতা, সেটাই অনেক সময় সাম্প্রদা‌য়িক রূপ নি‌য়ে‌ছিল।

সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা এই সব ঘটনার স‌ঙ্গে যুক্ত ছিল না। মি‌লিতভা‌বে লড়াই ক‌রে‌ছে তারা ভারতভা‌গের প্রাক্কা‌লে তেভাগার লড়াই পর্যন্ত। য‌দি ভার‌তের ইতিহাস নির‌পেক্ষভা‌বে পাঠ করা যায়, স‌ঠিক ইতিহাস জানা যায়, তাহ‌লেই বাংলা‌দেশ ও ভার‌তের মধ‌্যকার সকল উত্তেজনা কে‌টে যা‌বে। কারণ বিশ্ব‌বিদ‌্যাল‌য়ের, মহাবিদ‌্যাল‌য়ের শিক্ষার্থীরা য‌দি স‌ঠিক ইতিহাস জানার সু‌যোগ পায়, তারাই তখন তা সর্বস্ত‌রে তা ছ‌ড়ি‌য়ে দে‌বে। মানুষ তখন অনেক ভুল তথ‌্য জানার হাত থে‌কে রক্ষা পা‌বে। দুই দে‌শের সাধারণ মানুষরা যখন স‌ঠিক ইতিহাস জে‌নে স‌ঠিক সিদ্ধান্ত নে‌বে, কুচক্রীরা আর উত্তেজনা সৃ‌ষ্টি করার সু‌যোগ পা‌বে না।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ