বাইস্যা কাল

রহিমা আক্তার কল্পনা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৯

‘অত বেইল পর্যন্ত ঘরের ঝাঁপ বন্ধ রাহনডা অলক্ষ্মীর চিন্। লক্ষ্মী আইয়া ঘরে ঢুকতে না পাইয়া ফিরা যায়, হেই সুযোগে দৌড়াইয়া আইয়া খাপ পাইত্যা থাহে বালা মুসিবত।’ একা একা বিড়বিড় করে মায়মুনা খাতুন। বউ-ছেলেদের বে-আক্কেল আয়েশপ্রিয়তা তাকে অসন্তুষ্ট করে। বিরক্ত হয়ে মাটির মালশার আগুনটা উস্কে দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে থাকে সে। বৃষ্টির বিরাম নেই।
 
খানিক পরে কী ভেবে একটা কোমল মমতা জাগে তার ভেতরে। জোয়ান পোলা, কম বয়সী তাজা বউ দুজনেরই। বড় বউ পয়লা পোয়াতি, দিন ঘনিয়ে এলো প্রায়, সামনের মাস পেরুবে না। এসময় বউরা বড় স্বামী-সোহাগী হয়ে ওঠে। ছোটটি তো বিয়েই করেছে অল্পদিন, ‘মাইয়া মানুষের শইল্যের ঘেরান চিনবার’ ঘোরই কাটেনি এখনো, আর এমন বৃষ্টির দিনে পাখির ছানার মতো ওম ছড়ানো বউটাকে বুক থেকে ছাড়ে কোন পুরুষ? থাকুক, ওরা ঝাঁপ বন্ধ করেই থাকুক।
 
দুশ্চিন্তাটা দূর করে দেয়া যায় না। সপ্তাহখানেক ধরে অঝোরে বৃষ্টি। একটানা অনেকক্ষণ ধরে চলতে চলতে কিছুক্ষণের জন্য থামে, কিন্তু আকাশের মেঘলা মুখ আর পরিষ্কার হয় না। একটু পরে আবার নামে। পুরোপুরি থামার কোনো লক্ষণ নেই। ডোবা-নালা-পুকুর সব ভেসে গেছে, খেতের আইলের উপরও পানি। ঘরে বসে থেকে থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। আর এভাবে বসে থাকার নিরাপদ ঠাঁই-ই বা ক’জনের আছে, কিংবা ঠাঁই থাকলেও দু’মুঠো নুনভাত? দূর দূর অঞ্চল থেকে সাধারণত মারাত্মক বুকেও কাঁপুনি ধরায়। ভয়ের কাঁপুনি। এ অঞ্চলে সাধারণত মারাত্মক বন্যা হয় না। কিন্তু সারাদেশ যদি ডুবে যায়, তখন?

‘এই গাঁওডা কি হারাডা দ্যাশের বাইরে?’ মায়মুনা খাতুন তার নিজস্ব ধারায় চিন্তা করে, প্রশ্নটা মাথা থেকে তাড়াতে পারে না। তার পাশে শুয়ে বারো বছরের এতিম নাতি রবি ষাটোর্দ্ধ মতো কাশতে থাকলে খানিক আগের ‘সারাদেশ ডুবে যাবার’ দুশ্চিন্তাটা তার মগজের ভেতর ফিকে হয়ে আসতে থাকে। বরং সে বাইরের দাওয়ায় ছনের একফালি ছাউনির নিচে বসে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে থাকা লোকটিকে নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে শুরু করে।

ভোররাতে, ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি এখানে এসে বসেছে। করগাঁও অঞ্চলের ধনী গিরস্ত মোমিনউদ্দিন ভুঁইয়া। এই লোকের কত নাম শুনেছে মায়মুনা। মানী মানুষ। অথচ এখন তার অবস্থা দেখে কে বলবে সে নিতান্ত দীন দুঃখী নয়। উদভ্রান্ত চেহারা। দামি কিন্তু ময়লা লুঙ্গি-শার্ট পরনে। রবির গায়ের উপর ঘরের শুকনো কাঁথা-কাপড় সব জড়িয়ে ঘাড়ের কাছে পিঠের কাছে গুঁজে দেয় মায়মুনা, যেন বিরূপ ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির ছোবল থেকে নাতিকে সে সবটুকু ওম দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে। কী মনে করে বাইরের লোকটিতে সে বলে, ‘আপনে ভিতরে আইয়া বওহাইন।’

প্রৌঢ় লোকটি যেন ভেতরে ভেতরে মরে গেছে। মায়মুনার কথায় সে চমকে ওঠে। তারপর নিঃশব্দে সংকীর্ণ ঘরটিতে এসে বসে। প্রায় শোনা যায় না, এমন নিচু গলায় বলে, ‘আমার বিপদডা...’
‘আমিও বিপদে আছি গো বাবা। কামডা পারবাম বইল্যা মনে আয় না, তবু দেহি কি করন যায়। পোলারা উডোক।’ মায়মুনার ছেলেদের ঘুম থেকে ওঠার কথা শুনে লোকটি আবারো চমকে উঠে বিবর্ণ হয়ে যায়, কিন্তু কথা বলে না। তার সমন্ত বৃত্তান্ত শুনেছে মায়মুনা, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

রবির কাশিটা থেমেছে, তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে সে। বড় ছেলে সাইফুল আর ছোট ছেলে শহীদের ঘরের ঝাঁপ বন্ধ। ‘অত বেইল পর্যন্ত ঘরের ঝাঁপ বন্ধ রাহনডা অলক্ষ্মীর চিন। লক্ষ্মী আইয়া ঘরে ঢুকতে না পাইরা ফিরা যায়, হেই সুযোগে দৌড়াইয়া আইয়া খাপ পাইত্যা থাহে বালা মুসিবত।’ একা একা বিড়বিড় করে মায়মুনা খাতুন। বউ-ছেলেদের বে-আক্কাল আয়েশ-প্রিয়তা তাকে অসন্তুষ্ট করে। বিরক্ত হয়ে মাটির মালশার আগুনটা উসকে দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে থাকে সে। বৃষ্টির বিরাম নেই।

মায়মুনা তো লক্ষ্মীর জন্য দরজা খুলেই আছে, হোক তার ছনের দোচালাটা এ বাড়িতে সবচাইতে জীর্ণ আর পুরনো, তবু তারই তো বাড়ি। তার সন্তানদের যে সময়টা যে বয়সটা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, মা হয়ে সে তা কেড়ে নিতে যাবে কেন? বাইরে বৃষ্টির ছাঁট তেরছা হয়ে ঝাপটা মারে ঘরের ভেতরের মানুষগুলোকে। ক্লান্ত রবি এক কোনায় ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই থেকে থেকে কাশছে। বুক ঝমঝমানো শুকনো কাশি। লোকটি অনড় বসে আছে। মায়মুনার ভেতরে তুমুল দ্বিধা। এলোমেলো ভাবনা। ‘আসমান ভাইঙ্গা নামছে ম্যাঘ, ভাদর মাইস্যা এই ডলকের মইধ্যে কুত্তাডাও ঘরের বাইর অয় না’ মায়মুনা বিড়বিড় করতে করতে একটু দম নেয়। বিপন্ন প্রৌঢ় লোকটি কোনো কথা বলে না, নিথর বসে থাকে। তাকে দেখে আচমকা বাজ পড়ে মাথা গুঁড়িযে যাওয়া তালগাছের কথা মনে পড়ে। মায়মুনা তবু সদয় হতে গিয়েও পারে না। একরকম অনিশ্চিত তেতো গলায় বলে, ‘ঘরে আমার পোয়াতি পুতের বউ, দিন কাছাইছে। অহন এমুন কামডা আমি ক্যামনে পারবাম বাবা।’

লোকটি সর্বস্ব হারানো অসহায়ত্বের সঙ্গে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘এইডা কি কইতাছুইন?’ মায়মুনা প্রবল অস্বস্তিতে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে ফেরাতে শক্ত গলায় বলে, ‘আমারে মাফ করুইন।’ মায়মুনার গলার দৃঢ়তায় লোকটি চকিতে নড়ে ওঠে। তার দু’চোখে কাতর আর্তি। অনুনয়। সে মুখে আর কোনো কথা বলবার শক্তিই বুঝি হারিয়ে ফেলেছে। একটি নিরেট পাথরের মতো ভারি সময় দুজন প্রৌঢ় মানব-মানবীর মাঝখানে যেন অনন্তকাল থেকে থাকে। অস্বস্তিকর, নিঃশব্দ থেমে থাকা সময়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সময় বড় দ্রুতই বয়ে যাচ্ছিল, একসময় তারই তাগিদে নিরুপায় মুখ খোলে প্রৌঢ়, ‘আমি নিজে বাপ অইয়া আইছি। আপনে না গেলে আমার মান ইজ্জত... আমার বেবুঝ মাইয়াডা...’

লোকটির কথা শেষ হয় না। গলা বুজে আসে। মায়মুনা প্রচণ্ড বিরক্তিতে ধারালো হয়ে উঠতে চায়, ‘বেবুঝ মাইয়া, না? প্যাট বাজাইয়া বইয়া রইছে, তবু মাইয়া বেবুঝ।’

‘এমুন লান্নত দিয়া কথা কইন না যে গো মা। আল্লার কিরা, মাইয়া আমার হাছাই বেবুঝ। আল্লার কিরা, আল্লার কিরা...।’ লোকটা কাঁদতে কাঁদতে কপাল চাপড়ায়। মায়মুনার কপালের বলিরেখার সঙ্গে এবার আরো কিছু বাড়তি রেখার তাঁজ দেখা যায়। দুশ্চিন্তার তাঁজ।

আকাশ একটু, ফর্সা হলে, বৃষ্টিও তখন ধরে এসেছে, প্রথমে বড় ছেলে সাইফুল তার ঘরের ঝাঁপ খোলে। মায়মুনা উদ্বিগ্ন মুখে উঁচু গলায় বলে, ‘অত বেইল কইরা উঠলা ব্যাডা!’

সাইফুল অপ্রস্তুত মুখে আড়মোড়া ভাঙে, ‘বাদলা দিন মা, উইঠ্যা কী করবাম।’ ‘ভালাই কইছস। বউ বেডির শইলডা ভালা নি রে বাজান?’
‘জ্বে আম্মা, আমি ভালাই আছি।’
বড় বউ উঠে এসেছে। সাইফুলের পেছনে দাঁড়ানো শরমিন্দা চেহারার বউটাকে দেখলে মায়া লাগে। শরীর ভারি। আট মাস হয়ে গেছে। আর ক’দিন পর থেকেই আলগা হতে শুরু করবে পেট। হাঁটাচলা কামকাজে চালু না থাকলেই এই সময় হাতে পায়ে পানি আসার ভয়। বউ অবশ্য খুবই হুঁশিয়ার, ধাইয়ের কাজে অভিজ্ঞ শাশুড়ির কথার বাইরে এক পা বাড়ে না। আল্লাহর রহমত, এখন পর্যন্ত কোনো ঝামেলা দেখা দেয়নি। গত মাসেও মনজিল ডাক্তারকে দেখানো হয়েছে। সবই স্বাভাবিক। সব ঠিকঠাক থাকলে, মায়মুনা আশা করে নিজের হাতেই এই ভিটাতে ছেলে-বউয়ের সন্তানকে দুনিয়ার প্রথম আলো দেখাবে।
আচমকা রবি প্রচণ্ড কাশতে শুরু করে। কাশতে কাশতে শোয়া থেকে উঠে বসে। বুক চেপে ধরে অবিরাম কাশিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে ঝুঁকে পড়ে সামনে। মুখ রক্তবর্ণ। মায়নুনা ছুটে গিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নাতিকে। পাশের মালশায় রাখা তুষের আগুনে পিতলের বাটিতে বসানো গরম সরিষার তেল সাবধানে আঙুলের ডগায় ছোঁয়া দিয়ে তুলে বুকে মালিশ করে। চারপাশের দুনিয়া ঝাপসা হয়ে গেছে রবির চোখে। নানির বুকে মাথা এলিয়ে টেনে টেনে নিঃশ্বাস নেয় সে। গরম তেলের মালিশে কিছুক্ষণের জন্য কমে কাশিটা।
কিন্তু সে হাঁপাতে থাকে, ‘নানিবুজিরে, আমি আর সইয্য করতাম পারি না।’

মায়মুনার চোখে পানি এসে যায়, ‘নারে ভাই, আর বেশিদিন এই কষ্ট তোমার করন লাগতো না। আমি তোমারে বড় ডাকতর দেহামু। তুমি ভালা অইয়া যাইবা।’
‘কবে ভাল অমু নানি? কবে দেহাইবা বড় ডাকতর?’
‘এই তো কয়দিন পরেঅই। তুমি অহন আমার বুকটাতে মিশশা ঘুমাও নানাভাই।’

নানিকে জড়িয়ে রবি ঘুমাবার চেষ্টা করে। মায়মুনা খাতুন তার মৃত কন্যাসন্তান ফিরোজার মুখটা পরিষ্কার দেখতে পায়। রবির মা। রবির দু’বছর বয়সের মাথায় দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ধনুষ্টংকারে মারা গিয়েছিল। সঙ্গে বাচ্চাটাও। আর এখন মায়মুনা কত কিছু জেনেছে নতুন করে। সারাজীবনের জানা ধাত্রীবিদ্যার সঙ্গে কত নতুন জ্ঞান যোগ হয়েছে! ‘মাত্র দুইটা টিটেনাস ইঞ্জেকশন যদি দেয়া থাকত, আমার ফিরোজা মরত না।’ আর মেয়েটা মারা যাবার বছর পার না হতেই তার ঘাড়ে রবিকে ফেলে রবির বাবা কী অনায়াসে কালাম চৌকিদারের মেয়ে শামিলাকে বিয়ে করে ফেলল। শুধু কি বিয়ে করা? বউ নিয়ে সুনামগঞ্জ না কোথায় চা বাগানে চলে গেল। রবি আর তার বাবার কথা মনে হলেই একটা কথা খুব মনে পড়ে মায়মুনার, ‘মা মরলে বাপ তালই, ভাই অইল বনের পালই।’
ছেলে কিংবা ছেলে-বউদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করে না মায়মুনা। ঘর বসা মানুষটাকে সাইফুল আর শহীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘তানি করগাঁওয়ের মানী মানুষ মোমিনউদ্দিন ভুঁইয়া। সেলাম দ্যাও বাজান।’
ছেলেরা আদবের সঙ্গে সালাম দিলে মোনিউদ্দিন সালামের জবাব দিতে দিতেও নিজের ভেতরে টলোমলো অবস্থা টের পায়। মহিলা কি তার ছেলেদের আরো কিছু বলবে? অথবা ছেলেরা যদি কিছু একটা জিজ্ঞেস করে বসে?

‘আপনেরা তো নামি ডাহি মানুষ চাচাজান। আপনের কথা কইট্টাদির (কটিয়াদী) বাজারো হগলেই কয়...’
মায়মুনার ছোটছেলে শহীদের কথাগুলো শুনতে শুনতে দম আটকে আসে আতঙ্কে। এরপরে কী? আরো কিছু কি জানতে চাইবে ছেলেটা? কেন সে এই ভোরবেলা এ বাড়িতে...?
সাইফুল ঘরের ভেতর থেকে জোর গলায় বলে, ‘অহন ক্ষ্যান্ত দে রে ভাই। রুগীর খবর লইয়া আইছুইন এইলা, অত কথা কইয়া ত্যক্ত করিস না।’
শহীদ অপ্রস্তুত মুখে থেমে যায়।

মায়মুনা খুব দ্রুতই তৈরি হয়ে আসে। নাতি রবি আর বড় বউকে দেখাশুনার দায়িত্ব পড়ে ছোট বউয়ের ওপর। বড় বউকে রওনা হবার সময় বারবার সাবধান করে শাশুড়ি মায়মুনা। কোনো কারণে ‘পিছলা’ খেয়ে যেন পড়ে না যায়, অসতর্কে ‘ওষ্ঠা’ও যেন না খায়। সারাদিনের খাওয়া দাওয়া যেন নিয়মমতো হয়।
কারগাঁও পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়। শিমুলিয়া ইউনিয়ন বোর্ড থেকে করগাঁও এমন কিছু বিরাট দূরত্বের জায়গা নয়। মাইল আটেক হবে। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা বড় খারাপ। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা রিকশায়, খানিকটা আবার রাস্তা ডুবে যাওয়ায় কোষা নৌকাতে করে যেতে হল। চারপাশে থই থই করছে পানি। মাঝখানে বাড়িটা একটা দ্বীপের মতো। বাড়িটা ঘিরে কিছুটা টান জমি ফল ফলাদির গাছে ভরা। এটা একটা বাড়তি নিরাপত্তা। চার পাশের এই টান জমি না ডুবলে বাড়িতে কখনো পানি ঢুকবে না।
বাড়ির সীমানার শেষ মাথায় যে বড় জামগাছাটা, তার কাছে একটা ছাতা হাতে মাথলা মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল আধবুড়া একজন মানুষ। বয়সী, গাট্টাগোট্টা- পাথরের মত মুখ। বোঝা যায়, গৃহকর্তার অপেক্ষাতেই সে এখানে দাঁড়িয়ে। ওরা বাড়ির গোপাটে পৌঁছলে লোকটি দ্রুত এগিয়ে পৌঁছলে লোকটি দ্রুত এগিয়ে আসে। মোমিনউদ্দিন ভূঁইয়ার হাতে একটা ছাতা থাকা সত্ত্বেও লোকটি তার জন্য হাতের ছাতাটি মেলে ধরে।
মোমিনউদ্দিন বলেন, ‘এইলারে পথ দ্যাহাইয়া বাইত লইয়া যা। আমি একটু দক্ষিণের পাইড়টা দেইখ্যা আই।’
‘জ্বি ভাইজান।’

লোকটি মোমিনউদ্দিনের চাইতে বয়সে অনেক বড় হালেও তাকে সমীহের সঙ্গে সম্বোধন করছে, খেয়াল করে মায়মুনা। লোকটি নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করলে মায়মুনা তার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। বিরাট আয়তনের ‘বাইর বাড়ি’ পার হয়ে বাড়ির কাছাকাছি যেতে তার চোখ পড়ে পাশের বাংলা ঘর বা বৈঠকখানায়।
পড়ন্ত বেলা, আকাশে সূর্য নেই। কিন্তু ভূঁইয়া সাহেবের বাড়ির ‘বাংলা ঘর’ (বৈঠকখানা) আনন্দে উজ্জ্বল। মায়মুনা লক্ষ্য করে, বারান্দাসহ বৈঠকখানা ঘরের নানান জায়গায় নানান কিসিমের খেলা হচ্ছে। অষ্টা, ষোলঘুটি, বাঘবন্দি, লুডু। মুড়ি আর কাঁঠালবিচি ভাজা খাচ্ছে কেউ, একজনের হাতে দেখা গেল সিমবিচি ভাজা। বিশাল বৈঠকখানাটিতে নানান স্থানে চার পাঁচজনের ছোট ছোট জটলা করে খেলা, খাওয়া দাওয়া চলছে। এদের মধ্যে বাড়ির জোয়ান ছেলেরা আছে, তবে বেশিরভাগই কামলা। বছইরা মুনিষও আছে আট-দশজন।
বাড়ির ভেতরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভুঁইয়াগিন্নি। বারান্দাওয়ালা চৌচালা ঘরের ঝকঝকে টিনের চাল থেকে সার দিয়ে পড়ছিল বৃষ্টির ধারা। গৃহকর্ত্রীর চোখের ভেতরে যেন থেমে ছিল সেই বৃষ্টিরই মজুদ। মুখ তার থমথমে। মায়মুনাকে বারান্দায় পৌঁছে দিয়ে প্রৌঢ় লোকটি মাথা নিচু করে বলে, ‘ভাবিজান, কবিরাজ।’

মায়মুনা ‘ভাবিজান’কে সালাম দেয়, ‘আস্সালামালাইকুম।’ সালামের কোনো জবাব আসে না।
ভূঁইয়াগিন্নি যেন মায়মুনাকে বহুকাল ধরে চেনেন, এরকম গলায় বলেন, ‘আইয়েন। পথঅ খুব কষ্ট অইছে, না?’
‘না না। বাইস্যা কাল, এমুন তো অইবোই।’
‘আগে বোরকা খুইল্যা হাতমুখ ধুইয়া কাপড় বদলাইন।’
পরমুহূর্তেই কাউকে ডাকেন, ‘কাবিলের মা, ভাত বাড়ো। মেহমানের খাওন আগে দাও।’
মাঝবয়সী ঘোমটা টানা কাবিলের মা বলে, আব্বাজান...’
তোমার আব্বাজানও আসছেন। উনির খাওনও তয়ার আছে, আমার ঘরে দেও।’

মায়মুনা কিংবা মোমিনউদ্দিন ভূঁইয়ার কেউই হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া শেষ করতে তেমন সময় নেয় না। এরপর মোমিনউদ্দিন চলে যান মূল ঘরের লাগোয়া ভিটায় অন্য ঘরটিতে। তার স্ত্রী মায়মুনাকে নিয়ে ভেতরে আসেন। এই প্রথম মোমিনউদ্দিনের মেয়ে সিতারাকে দ্যাখে মায়মুনা। দেখেই চমকে ওঠে। কী সুন্দর ফুটফুটে পরীর মতো মেয়ে। চোখে মুখে কী নিষ্পাপ সরল ভাব! বয়স পনেরো-ষোলর বেশি হবে না। মায়মুনা ভেবেছিল হয়তো আরেকটু সোমত্ত মেয়ে হবে। তার বাড়িতে বসে মোমিনউদ্দিনের আহাজারি এই মুহূর্তে কানে বাজতে থাকে, ‘মাইয়া আমার হাছাই বেবুঝ। আল্লার কিরা, আল্লার কিরা...’ আশ্চর্য মমতায় ভরে যায় তার অন্তর। মায়মুনার অভিজ্ঞ চোখ কয়েক মুহূর্তেই অনেক কিছু দেখতে পায়। মেয়ের চোখের নিচে গাঢ় কালি, কণ্ঠার হাড় আলগা, মুখচোখ ফ্যাকাশে। মেয়ের সঙ্গে অনেক সতর্কভাবে আলাপ করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কায়দা করে কথা বের করতে হলো। জানা গেল, গর্ভকাল দুই মাসের বেশি। মায়মুনা বিপদের আঁচ পায়।
আরে অভাগী মাইয়ারে, কে করল এই সর্বনাশ... বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল মায়মুনা। চকিতে তার চোখে ভেসে উঠল ‘বাইর বাড়ি’র জটলাগুলোর মগ্ন ছবি। মোমিনউদ্দিনের ভাতিজা, ভাগ্নেরাও ক’জন ওখানে আছে। ওদেরই কেউ না তো?