বাংলাদেশের নাট্যজগতের অশনি সঙ্কেত ও রাহুমুক্তির প্রচেষ্টা

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৪, ২০২২

বাংলদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকি যখন সর্বশেষ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, সেটা ছিল একটা অনিয়ম। কারণ সরকারি পদে বসে একজন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। কারণ ব্যাপারটা সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের জন্ম অনেকটা সরকার বিরোধিতা থেকে, ফলে সরকারের একজন কর্তাব্যক্তি সেই ফেডারেশানের কোনো পদে থাকবার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এসব নিয়মনীতির কে তোয়াক্কা করে? সকলে এখানে পরের সমালোচনায় পারদর্শী কিন্তু সেই কাজটি নিজে করতে লজ্জাবোধ করেন না। নাট্যজগতে বা শিল্প-সংস্কৃতির জগতে এ লজ্জাবোধ মনে হয় আরো কম। লিয়াকত আলী লাকি এর আগে দুবার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান ছিলেন, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার পর তার আর এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা নয়। বরং সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করার কথা ছিল মহাপরিচালকের দায়িত্বে। কিন্তু আমাদের ক্ষুধা সর্বগ্রাসী, যা পারি বা যতটা পারি দখল করতে চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’র কথা সেইক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে।

লিয়াকত আলী লাকির সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নাকি এমনই আকার নিয়েছে, শুনতে পাই দুদুকে তার বিরুদ্ধে বড়রকমের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। লিয়াকত আলী লাকি আসলে আমার আজকের আলোচনার মূল বিষয় নয়। মূল বিষয়, চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন। নাট্য আন্দোলন নিয়ে নীতিহীনতার বহু অভিযোগ উঠেছে অনেক আগে থেকেই। যারা অভিযোগ তোলেন, পরে আবার সুবিধা পেলে সেই দলের সঙ্গে হাত মেলান। নানান উদাহরণ আছে এমন। লাকির নামটা আজ এসেছে লাকি ক্ষমতায় বসে আছেন বলে। মূল প্রসঙ্গ আসলে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সেই গানের মতো, মাউন্ট ব্যাটেন তার সাধের ব্যাটন কারে দিয়ে গেল। লাকি যখন শেষবার নির্বাচনে অংশ নেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ নাট্য-ব্যক্তিত্বদের। কিন্তু তা হয়নি। বরং কামাল বায়েজীদ তার সঙ্গে মিলেই নির্বাচনে অংশ নেন। ক্ষমতার ভাগ পেতে নীতিহীতার থ ধরেছিলেন তিনি নিজেই। মামুনুর রশীদ ভাইর সঙ্গে আলাপ করে গতকালই জানলাম, যখন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান করার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়, মামুন ভাই নাকি বলেছিলেন এটা করা ঠিক হবে না। কারণ এটা একটা ব্রুক্রেটিক সংস্থা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মামুন ভাই সুদূর ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের প্রথম দিকটা খুব খারাপ ছিল না। নানারকম আন্দোলন, নাটকের উপর থেকে সেন্সর প্রথা তুলে দেয়া, নাট্যমঞ্চ স্থাপন এসবের জন্য গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ভূমিকা ছিল। রামেন্দু মজুমদার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে বেশ ভালো ভালো কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। বয়সে তখন তারা অনেক তরুণ ছিলেন, চাওয়া পাওয়ার হিসাবটাও তাদের তখন কম ছিল। বিশেষ করে রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, আতাউর রহমান এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ-এর নেতৃত্বে নাট্যকর্মীরা প্রচুর ত্যাগ-তিতিক্ষা দেখিয়েছিলেন সেই দিনগুলিতে। কিছু কিছু সমালোচনা করার দিক থাকলেও, সেই দিনগুলিতে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ইতিবাচক ভূমিকা কম ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা মঞ্চের নাট্যচর্চাকে তখনো কেউ বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি। কিন্তু ক্ষমতা এমন একটা ব্যাপার, কিছুদিন ক্ষমতা ভোগ করার পরেই ক্ষমতায় থাকা মহান লোকগুলির চেহারা পাল্টাতে থাকে। নিজেরা তখন আর সেটা বিবেচনায় আনতে পারেন না, দম্ভ তাঁদেরকে অন্ধ করে রাখে। ফলে সকলের সকল রকম ত্যাগ তিতিক্ষার পরেও কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, চারজনই হয়ে উঠেছেন গ্রুপ থিয়েটারের হর্তাকর্তা বিধাতা। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নেতৃত্বে থাকা চারজনই পরপর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করার পর, তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে তাদের জন্য বিশেষ অধিকার হিসেবে বিশেষ সদস্যপদ তৈরি করা হলো। মানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ তারা ছাড়তে চাইছিলেন না। কর্তৃত্ব ধরে রাখার এই উদাহরণটা খুব ভালো ফল আনেনি। গ্রুপ থিয়েটার ফেডরেশানের এই পর্বে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, নাট্যশিল্পীদের চেয়ে চাটুকার কিছু সংগঠকই প্রধান হয়ে উঠেছিল।

যারা বয়োজ্যেষ্ঠ্য তাদের স্মরণে থাকবে, দুই থিয়েটার দলকে নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ক্ষমতাবানদের রাজনীতি, কাকে সদস্য পদ দেবে আর কাকে দেবে না। পরবর্তীতে দ্বিধাবিভক্ত দুই লোকনাট্য দলকে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য পদ দেয়া না দেয়া; এসব নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডাশোনের কর্তা ব্যক্তিদের খামখেয়ালিপনার কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। নানান প্রশ্নে বা বিতর্কে শত শত প্রতিনিধিদের চেয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কতিপয় কর্তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন, পক্ষপাতিত্ব এবং তাদের ব্যস্ততা অনেক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দেয়নি। সম্মেলনে যোগদান করতে গিয়ে কর্তাব্যক্তিরা বলে দিয়েছেন দ্রুত তাদের ঢাকায় ফিরতে হবে। ফলে দায়সারাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বরিশালে কর্তব্যক্তিরা সকালে পৌঁছালেন সম্মেলনে যোগ দিতে, বিকালে তাড়াহুড়ো করে ফিরে এলেন। নিজেদের তখন তারা উন্নাসিকভাবেই বিশেষ সুবিধাভোগী মনে করতেন। ফলে সেই উন্নাসিক সংস্কৃতি সংক্রামিত হতে হতে পরের প্রজন্মে আরো ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে এতদিনে।

স্মরণে আছে, একবার যাকে সদ্য চেয়ারম্যান করা হলো, তিনি বললেন তিনি আর কাকে কাকে সেই পরিষদে চান। তিনি সেই তিন চারজনের নাম বললেন। কিন্তু পদ পেতে হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই তাদের আসবার কথা। কিন্তু নিয়ম মানতে রাজি নন, ক্ষমতাবান সেই নাট্যব্যক্তিত্ব। তিনি স্পষ্ট জানালেন, ফেডারেশান চালাতে তার সেই কয়জনকে চাই। বহু রকম আপত্তির পর সকলে সদ্য ঘোষিত চেয়ারম্যানের প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হলেন। পাপের বীজ তো এভাবেই বহু সময় ধরে আগে থেকেই রোপিত হয়ে আসছিল। প্রায় সময়ে দেখা গেছে, ফেডারেশানের সম্মেলনে কিছু ব্যক্তির জন্য বিশেষ বিলাসী হোটেলের কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, বাকি প্রতিনিধিদের জন্য অন্যরকম ব্যবস্থা। কিন্তু সেটা ছিল একটা অনিয়ম। কারণ সকল প্রতিনিধির সমান মর্যাদা পাবার কথা ছিল। কী কারণে এসব অনিয়ম হতে পারতো? সবটাই কি কর্তাব্যক্তিদের দোষ ছিল? না। ঢাকাসহ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের চাটুকারি মনোভাব, ব্যক্তিপূজার প্রবণতা, নিজেদের হীনমন্যতা; সবমিলিয়ে নানা অনিয়ম দিনের পর দিন বাড়ছিল আর নাট্যকর্মীরা বিভিন্ন জন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। নাটক করার চেয়ে নাটকের রাজনীতিটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। ফলে যারা সারাবছরে একটিও প্রদর্শনী করতো না, তারাও ছিল গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রতিনিধি। কারণ নাটক করার চেয়ে দলীয়করণটা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নাট্য ব্যক্তিত্বদের চেয়ে, গুণীজনদের চেয়ে যারা ফেডারেশানের ক্ষমতায় যাবার রাজনীতি ভালো বুঝতেন, ফেডারেশান তাঁদের দখলে চলে গেল। নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক বা সঠিক নাট্যবোদ্ধাদের হাতে থাকলো না ফেডারেশানের মূল চালিকাশক্তি। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের যুক্ত মানুষরা নাট্যচর্চার চেয়ে এসব দলীয়করণে বেশি আস্থা স্থাপন করেছিলেন।

যদি কেউ চল্লিশ বছরের নাট্যচর্চার ইতিহাস বা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারশানের দলগুলির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন এসব কথা জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের পরিষদগুলিকে কজন নাট্যকার, নির্দেশক বা ভালো অভিনেতা জায়গা পেয়েছেন? বরং নাট্য ব্যক্তিত্বদের সামনে জ্বী হুজুর বলার মতো মানুষরা বেশি জায়গা করে নিয়েছিলেন। ফল যা হবার তাই হলো, নাট্য আন্দোলন দ্রুত একটি মতাদর্শ থেকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সড়ক হয়ে দাঁড়ালো। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন নামক আত্মপ্রতিষ্ঠার কারখানাটিতে বহুরকম চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে। বহুজন এখন মনে করেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হচ্ছে একটি দাতব্যালয়, মন্ত্রণালয়ের  কাজ বা দায়িত্ব হচ্ছে নাট্যকর্মীদের বা তথাকথিত শিল্পীদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখা। ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! যদি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজ হয় নাট্যকর্মীদের বেকারভাতা প্রদান করা, বাংলাদেশের অন্য পেশার মানুষের ক্ষেত্রে তাহলে কী হওয়া দরকার? ভবিষ্যতে তাহলে বেকারভাতা পাবার জন্যই বহু বেকার মানুষ নাট্যকর্মীর খাতায় নাম লেখাবে। সকল নাট্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে এসব কথা বলছি না। যারা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ভোটের রাজনীতি করার জন্য সত্যিকারের নাট্যকর্মীদের যথাযোগ্য সম্মান নষ্ট করেছেন, আমার এ বক্তব্য তার প্রতিবাদ। নাট্যকর্মীরা এর আগে ত্রিশ চল্লিশ বছর সংগ্রাম করেছেন, নাট্যচর্চা করেছেন ভিক্ষাবৃত্তির কথা না ভেবে। তাদের সেই দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্যকে খাটো করা হয়েছে কিছু মানুষকে সামান্য কিছু ব্যক্তিগত অনুদান দেবার নাম করে।

মহারথীরা নিজেদের বড় বড় লুটপাটকে হালাল করার জন্যই বাকি কিছু মানুষকে মুষ্ঠিভিক্ষা দিয়ে নিজেদের লুটপাটকে হালাল করতে চান। নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচার করেন সরকারের তথা জনগণের টাকায়। সেসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে, যদি নিরপেক্ষভাবে তাকানো হয়, দেখা যাবে লুটপাট আর অনিয়মের এই নাট্যজগতে, গুরু না ধরতে পারলে এখানে উন্নতি নেই। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান হচ্ছে বাংলাদেশের নাট্যজগতে আত্মপ্রতিষ্ঠার একটি সিঁড়ি, এমন সিঁড়ি আরো আছে। সবগুলি সিঁড়ির নাম এখানে উচ্চারণ নাই বা করলাম। প্রশ্নটা হলো, এর কুফল। সত্যিকারের ত্যাগী আর গুণীরা এখানে ছিটকে পড়ে না হলে বহু কায়ক্লেশে একটু জায়গা মেলে। কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না, সার্বিক বিচারে বিশ শতকের চেয়ে একুশ শতকে অনেক তরুণ নাট্যকার, নির্দেশকরা বাংলাদেশের নাটককে নতুন পথ দেখিয়েছিলেন। নাট্য আন্দোলনের নামে সস্তা নাটক প্রদর্শনীর বদলে, কিছু দল সত্যিই মুগ্ধ হবার মতো নাটক মঞ্চায়ন করতে আরম্ভ করে। বিশ শতকে মুগ্ধ হবার মতো নাটক একেবারে হয়নি, তা বলা যাবে না। সংখ্যায় কম। কিছু দল তখন অকারণে প্রচার পেয়েছে, যা এখনো পেয়ে থাকে। কিন্তু বিশ শতকের শেষ দিক থেকে একুশ শতকে নাটক একটা ভিন্ন ধরনের পরিণতি লাভ করে এবং সেটা পরবর্তী তরুণ প্রজন্মের হাতে। কিন্তু সেই সব গুণী বা সৃজনশীল তরুণরা সেভাবে স্বীকৃতি পাননি। ভিন্ন দিকে সেই তরুণ প্রজন্মের অনেকেই নিজেদের মতাদর্শ ঠিক রাখতে পারেননি। বিভিন্ন রকম লোভের কাছে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছেন। প্রথম প্রজন্মের নির্দেশকদের মধ্যে দু-একজন একুশ শতকে উল্লেখ করার মতো দু-তিনটি নাটকের নির্দেশনা দিলেও, চল্লিশ বছরেও নাট্যজগতে কোনো মতাদর্শ দাঁড় করাতে পারলেন না। নাট্যজগতের সবচেয়ে ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত হলো এই যে, সকলেই প্রায় নতুন ধরনের সুবিধাবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। নিরপেক্ষ অবস্থানে প্রায় কেউ-ই থাকতে পারলেন না।

নাট্যকর্মীদের কাজকর্ম সম্পর্কে গতকালই রামেন্দু মজুমদার লিখেছেন, “নাটক নয় তথাকথিত ক্ষমতার রাজনীতিই প্রধান হয়ে উঠেছে তাদের কাছে।” খুব সঠিক মন্তব্য, যথাযথ মন্তব্য। তিনি আরো লিখেছেন, ফেডারেশানের ভোট লাভের আশায় নাকি কতিপয় নেতা, নাট্য দলগুলির  প্রতিনিধিরা ঢাকায় এলে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফেডারেশানে কী এমন মধু আছে আমি বুঝতে পারি না। প্রিয় রামেন্দুদার পরের বক্তব্যটা অবশ্য বিতর্কিত। মধু না থাকলে রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ প্রমুখ কেন এক সময়ে ফেডারেশানে পদ ধরে রাখতে চাইতেন? প্রশ্ন আসতে পারে, কী মধু ছিল আইটিআই প্রষ্ঠিানটিতে? সকলে কেন একদা সেখানে ভীড় জমাতেন? ঢাকায় বড় বড় সব সম্মেলন হতো। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনকে কী দিয়েছে সেইসব সম্মেলন। হঠাৎ করেই আর আই টি আই নিয়ে তেমন হৈ চৈ দেখি না কেন? সব কিছুর পেছনে সকলের রাজনীতি ছিল, সকলেরই উপরে উঠবার একটা স্বপ্ন ছিল এইসব কিছুর সঙ্গে যুক্ত হবার মধ্যে। কথা হলো, সত্যিকারের নাট্যচর্চার জন্য গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান বা আই টি আই কোনটারই দরকার নেই। বিশ্ব নাট্য সভায় নিজেকে কিছুটা পরিচিত করা বা জাতীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজের জায়গা করে নেয়ার জন্য এসবের দরকার হয়।  

রামেন্দুদা হয়তো এতদিন পর আর দেখতে পাচ্ছেন না, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে কিছু মধু রেখে গিয়েছেন তারাই, না হলে মামুন ভাই কেন আবার পরে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে লড়াই করে চেয়ারম্যান হতে চাইলেন? ফলে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান হবার, বিভিন্ন পদ-পদবী পাবার লোভ তারাই তৈরি করে দিয়ে গেছেন। ঠিক একই উদাহরণ মিলবে আই টি আই-এর ক্ষেত্রে। থোক বরাদ্দের বিরাট অঙ্কের টাকায় আই টি আইর উৎসব করা হলো। কিন্তু পুরো টাকাটা দেয়া যেতে পারতো বিভিন্ন দলগুলিকে নাট্যচর্চা করার জন্য। রামেন্দুদার গতকালকের চিঠির বক্তব্য অনুসরণ করেই তাঁর বক্তব্যের পক্ষেই কথাগুলি বলছি। সবাই তাঁরা এসময়ে যতো জাতীয় নেতা, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হতে ব্যস্ত ছিলেন, সামগ্রিকভবে নাট্যচর্চার কথা ভাবেননি। প্রান্তিক নাট্য দলগুলির দিকে ফিরে তাকাননি। বিরাট টাকা ব্যয় করেছেন উৎসব সম্মেলনের পেছনে নিজেদের নাম কিনতে। সত্য উচ্চারণে এখন তাঁদের অভিমান বা ক্রোধ হতে পারে আমার উপর। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে বলবো, ক্রোধ প্রকাশ না করে, সত্যের মুখোমুখী দাঁড়াতে হবে। সব দোষ অন্যদের, নিজেরা তাঁরা কিছুই ভুল করেননি এমন তো হতে পারে না। লাকির সময় হতেই সব দোষের আরম্ভ, তা কি হতে পারে? নাকি লাকিই আগের ধারাকে বহন করে চলেছেন? সকলের বিরুদ্ধে আমার মূল অভিযোগটা হচ্ছে, জবাবদিহিতার অভাব। নাট্য জগতের নেতৃত্বে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি কখনো ছিল না এবং আজও নেই। নিশ্চয় সেই পরিবেশ আগের চেয়ে এখন বহু গুণ খারাপ হয়েছে। সব কিছুর পর এটা স্বীকার করতে হবে, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফদের মতো সমমানের ব্যক্তিত্ব পাওয়া গেল না পরের ফেডারেশনে। সমমানের ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরে এসেছিলেন একমাত্র ম. হামিদ ভাই কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচনে হেরে গেলেন।      

যা হোক আনন্দের কথা, রামেন্দুদার গতকালকের চিঠির বক্তব্যে দূষিত পরিবেশ থেকে উদ্ধার লাভের বাস্তবসম্মত সুন্দর প্রস্তাব আছে। সকলের সেটা ভেবে দেখা দরকার। রামেন্দু মজুমদার গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বর্তমান সঙ্কটে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন, প্রস্তাবটি অভিনব। বর্তমান সঙ্কটকালে কার্যকরও বটে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সকল কর্মকাণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হোক। সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে রাখা হোক। রামেন্দু মজুমদার একই সঙ্গে একথাও বলেছেন, একটি প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে যাক তাও তিনি চান না। গণতান্ত্রিকভাবে যাতে সেটা হতে পারে সেব্যাপারে তিনি ব্যক্তিগত ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তিনি তার চেয়ে মূল্যবান কথা যেটা বলেছেন, সেটাই সবচেয়ে ইতিবাচক। তিনি লিখেছেন, ‘আসুন সকলে নিজ নিজ দলের নাট্যকর্মে মনোযোগ দিই। কারণ আমাদের প্রধান কাজ নাটক করা, নাটক নিয়ে রাজনীতি করা নয়।’  খুব মূল্যবান পরামর্শ। শেষ পর্যন্ত যদি সকলের বোধদয় হয় যে, ‘রাজনৈতিক নাটক করা যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই নাটক করা নিয়ে নোংরা রাজনীতি নয়’। রামেন্দুদার বক্তব্য প্রমাণ করে, নাটক করা নিয়ে রাজনীতি তাহলে হয়েছে। যা হয়নি তাহলো, নাটক করা নিয়ে যত্নবান হওয়া। রামেন্দুদা এখন সেই পরামর্শই রাখছেন, অতীতের ভুল পথ থেকে সরে আসার জন্য। রামেন্দুদার পরামর্শের সঙ্গে একমত হয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, রামেন্দুদা সকলেরই এবার আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। রাতারাতি ফেডারেশানের এই চেহারা হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে ফেডারেশানকে দায়ী করলেও হবে না, পুরো নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। নিজেদের কৃতিত্বকে বড় করে দেখাবার জন্য নাট্য আন্দোলনকে নানাভাবে তাঁরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেছেন। বাংলাদেশের এটাও মনে হয় একটা সমস্যা, যা কিছু আমরা করি সেটাকেই মনে করি শ্রেষ্ঠ কর্ম।

যখন নাট্য আন্দোলন হয়েছে, তখন তার ইতিবাচক আর নেতিবাচক দুটি দিকই থাকার কথা। কিন্তু নাট্যব্যক্তিত্বরা তার সঠিক মূল্যায়ন কখনো করেননি। সব সময় প্রশংসা শুনতে চেয়েছেন। নিজেরাও নিজেদের কাজকে বিরাট করে উপস্থাপন করার জন্য প্রতিযোগিতা করেছেন, যা সঠিক ছিল না। বাংলাদেশের নাট্যজগতে বড় মাপের কাজ খুব কম হয়েছে। নাট্যকার, নিদের্শক আর প্রযোজনার তালিকার দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হবে। চিরায়ত মাপের কাজ কয়টা হয়েছে? কয়জন নাট্যকারের কয়টা নাটক টিকে থাকবে ইতিহাসে? জোর করে আমি কাউকে পৃথিবীর সেরা নাট্যকার বানিয়ে দিলে হবে না। পৃথিবীকে তা মান্য করতে হবে। কাউকে আমি মহাআচার্য্য বানিয়ে দিলেও হবে না, বিশ্বের মানদণ্ডে তাঁকে স্থান পেতে হবে। চারশো বছর ধরে মঞ্চস্থ হবে এমন নাটক কি লিখতে পেরেছি আমরা? টেনেটুনে, রাজনীতি করে, দলবাজী করে কাউকে জাতীয় পুরস্কার বা নানারকম পুরস্কার পাইয়ে দিলে লাভ নেই। সাধারণ জনগণ তাঁকে গ্রহণ করেছে কি না, চারদিকের বিশ্ব তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে কি না সেটাই প্রধান। পুরস্কারের পিছনে যাঁরা ছুটে বেড়ান, পুরস্কার বা পদক পাওয়া নিয়ে মারামারি করেন; তাঁরা সত্যিকারের সৃষ্টিশীল মানুষ নন। সৃষ্টিশীল মানুষরা পুরস্কার পাবার লোভে সৃষ্টি করেন না, সৃষ্টি করেন ভিতরের তাড়না থেকে।

বাংলাদেশে যেন সরকারি পদক আর পুরস্কার ঠিক করে দেয় কারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। প্রয়াত কাজী আনোয়ার হোসেন সরকারী পদক পাননি তো কী হয়েছে? মানুষের অন্তরে তাঁর জায়গা হয়েছিল। মৃত্যুর পর সেটা টের পাওয়া গেল। তিনি কাজ করেছেন নিজের মতো করে, কারো দয়া দাক্ষিণ্যের কথা চিন্তা করে নয়। প্রকৃত সৃষ্টিশীল ছিলেন এঁরাই। গান গাইলেও খুব নামডাক হতো তাঁর। কিন্তু খুব বেশি নামডাক চাননি, তিনি ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছিলেন। ভিন্ন কিছু করবার লোক কমে যাচ্ছে, সকলেই চাইছে সস্তা জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন, চলচ্চিত্র নির্মাণ, শিল্প-সাহিত্য সবই খুব বেশি এখন সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে হাঁটছে। মনে করার কারণ নেই, গতকাল থেকে এটা শুরু হয়েছে। না, এর শুরু বহু আগে থেকেই, যখন বাজার সংস্কৃতির সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যে গাটছড়া বেঁধেছে। সকল সৃষ্টিশীলতার লক্ষ্য যখন গাড়িবাড়ির মালিক হওয়া; তখন সত্যিকারের সৃষ্টিশীলতা বলে কিছু থাকে না। নাট্যজগতের একজন আমার প্রিয় মানুষ, একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি একবছরে নাটক লিখে এককোটি টাকা কামাই করতে চান। খুব বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম, সেটা কি সম্ভব? পরের বছর তিনি আমাকে বললেন, তিনি হিসেব করে দেখেছেন তিনি লেখালেখি করে বছরে দুই কোটি টাকা আয় করতে পারেন। সৃষ্টিশীল রচনা কি সত্যিই এভাবে সম্ভব? সম্ভব নয়। তিনি প্রথম দিকে সৃষ্টিশীল খুব আলোচিত কিছু রচনা করতে পেরেছিলেন, মঞ্চের জন্য সবচেয়ে আলোচিত একটি নাটক লিখলেন। কিন্তু পরের রচনায় আর কখনো সেখানে পৌঁছাতে পারলেন না। কারণ তিনি লিখেছেন টাকা বানাবার জন্য।

কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে দুঃখজনকভাবে নাট্যজগতের নতুন প্রজন্ম আর পুরান প্রজন্ম সম্পূর্ণভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। মানুষ কখন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে? যখন তাঁরা সুবিধা নিতে চান, ক্ষমতাবানদের হালুয়া রুটির ভাগ পেতে চান। গত দশ বছরের নাট্য আন্দোলনের মূল চেহারাটা এমনই। ফলে এখন যেসব বিরোধ, বহিষ্কার, দুদুক-এ মামলা; এগুলির সবটাই তার স্বাভাবিক পরিণতি। গতকালই আকস্মিকভাবে দেখতে পেলাম, কামাল বায়েজীদ বহিস্কৃত হয়েছেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডরেশানের তাঁর পদ থেকে দুর্নীতির দায়ে। তিন বছর পর হয়ে গেছে আগেই। সকলের নিজ নিজ পদ ছেড়ে নির্বাচন দেবার কথা। কিন্তু বাদ পড়লো মাত্র দুজন। কামাল বায়েজীদ পদে বসে কী কী অপরাধ করেছেন বা সত্যিই করেছেন কি না, সেটা আদৌ জানি না। হঠাৎ এখন ফলাও করে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কারণ কী? ব্যাপারটা এমনই, যখন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন সকলেই আবার ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করেন।

মাসুদ আলম বাবুর স্বাক্ষ‌রিত চি‌ঠি‌তে যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা বলা হ‌য়েছে, সেখানে নানারকম অনিয়ম ধরা পড়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কামালকে বাদ দেয়ার পেছনে যতোটা না তার দুর্নীতি কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি ধরা পড়েছে প্রতিপক্ষের আক্রোশ। কামাল বা‌য়েজীদ তিন বছর ধ‌রে যখন নানারকম কুকর্ম কর‌ছিলেন, বা‌কি সদস্যরা তখন কী করেছেন ? চেয়ারম্যান, সভাপ‌তিমণ্ডলী, অন্যান্যরা কি তখন চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন? তাদের কি দা‌য়িত্ব ছিল তিনবছর চোখ বন্ধ করে বসে থাকা, তারপর হঠাৎ এক‌দিন জে‌গে ও‌ঠে কামাল বায়েজীদকে বরখাস্ত করা? গ্রুপ থি‌য়েটার ফেডারেশানের নির্বা‌চিত নির্বাহী প‌রিষদ এবং কেন্দ্রীয় পরিষদের সকল সদস্য য‌দি নি‌জ নিজ দা‌য়িত্ব স‌ঠিকভাবে পালন কর‌তেন, তাহলে কি কারো পক্ষে অনিয়ম করা সম্ভব? বায়েজীদ এমন কি একা একা সং‌বিধানের শব্দ পাল্টে ফেললেন, কেউ সেটা নি‌য়ে এত‌দিন কথা বললেন না, হঠাৎ তিন বছর পর জেগে উঠলেন। কথাগুলি পড়তে গিয়ে হাসি পাচ্ছিলো।  এত‌কিছু ঘটে গেল বা‌কিরা কেউ কিছু দেখলেন না, প্রতিকার করার জন্য সভা ডাক‌লেন না; এটা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য ? বা‌কি‌দের নির্বা‌চিত করা হয়েছিল কি নাকেতেল দি‌য়ে ঘুমাবার জন্য? যদি অনিয়ম হয়ে থাকে সকল সদস্যদের আসলে বহিষ্কার করা দরকার।

লাকির পক্ষ বলছেন, বায়েজীদ দুর্নীতিবাজ। ভিন্ন দিকে লাকির বিরুদ্ধে বিরাট দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে দুদুকে। যিনি নিজেই দুর্নীতির জালে জড়িয়েছেন, তিনি দুর্নীতির অভিযোগে বহিস্কার করছেন আর একজনকে। বিষয়টা নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে অনেক। যদি ধরে নেই লাকি নিজেও অপরাধী, লাভ কি? লাকি গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান আবার শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক। যারা শিল্পকলায় নাটক করতে আগ্রহী তাদের পক্ষে কি লাকির বিরুদ্ধে কথা বলা সম্ভব? লাকি কি তাহলে তাদের শিল্পকলায় নাটক করতে দেবেন? ফলে অনেকে সত্য জেনেও মুখ বন্ধ করে থাকবে। প্রশ্নটা হলো, এই সব বিভাজন বা কোন্দলে নাট্যজগতের মহারথীদের ভূমিকা কী। বিশ্বে রাষ্ট্রপ্রধানদের জগতে সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানরা গ্রুপ অব সেভেন বা জী সেভেন বলে পরিচিত ছিল, বাংলাদেশের নাট্যজগতে বহুদিন ছিল জী ফোর-এর রাজত্ব। পরে জোড়াতালি দেওয়া জী ফাইভ গঠিত হলেও টিকলো না বেশিদিন। বর্তমান সঙ্কটে দেখা যাক তাদের ভূমিকা কী দাঁড়ায়। সকলেই তাঁরা কিন্তু জীবিত আছেন।

বর্তমান আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলন কখনো কি জনগণের লড়াইয়ের অংশ ছিল, নাকি ছিল কতিপয় মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই? হ্যাঁ, সকলেই আত্মপ্রষ্ঠিার জন্য এই পথে আসেননি হয়তো সেটা ঠিক, বহু জন হয়তো জনগণের পক্ষে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেই নাট্য আন্দোলনে বা নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের জন্য আত্মত্যাগের উদাহরণ কি তাঁদের সামনে পূর্বের নেতারা বা নাট্য আন্দোলনের কেউ তৈরি করতে পেরেছিলেন? লক্ষ টাকার একটা প্রশ্ন আছে এখানে। বাংলাদেশের নাট্যজগতের জী ফোরের দিকে তাকান। জী ফোরের ক্ষমতা, পরিচিতির ব্যাপকতা, সহায় সম্পদের দিকে তাকান। পরবর্তী প্রজন্ম কি জী ফোরের ক্ষমতা, পরিচিতি এবং সহায় সম্পদ-এর দিকে তাকিয়ে নিজেরা তেমন জীবন লাভ করার ইচ্ছাটা বাতিল করবে? নাকি জী ফোরকে অনুসরণ করবে? নাকি জী ফোরকে বাতিল করে খেয়ে না খেয়ে জনগণের জন্য লড়াই করতে চাইবে? নতুন প্রজন্মের মধ্যে যাঁরা সৎ বা ত্যাগী কিংবা সংগ্রামী মানসিকতার তাঁদের সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো ব্যক্তিপূজার মোহ তারা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। ফলে তাঁদেরও মুক্তি ঘটে না। নাটক মঞ্চায়ন বা নাট্যচর্চা করার জন্য দলাদলি বাদ দিয়ে, ব্যক্তিপূজা বাদ দিয়ে দরকার গভীরভাবে পড়াশুনা বা চর্চা করা। নাট্যমঞ্চের বিকাশ তাহলে আর বাধাগ্রস্ত হবে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি দলের নাম ছিল ‘গ্রুপ থিয়েটার’। তার বাইরে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নাট্যচর্চা কী এ নিয়ে কারোই কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। পশ্চিমবঙ্গের ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নাট্যচর্চা ছিল একটা বিভ্রান্তি। উৎপল দত্তের মতন নাট্যব্যক্তিত্ব পর্যন্ত বুঝতে পারতেন না, এটা আবার কেমন ধারার নাট্যচর্চা। বাংলাদেশের নাট্যব্যক্তিত্বরা বুঝে না বুঝে পশ্চিমবঙ্গের সেই ধারা বাংলাদেশে অনুকরণ করতে যেয়ে সৃষ্টি করেছেন নানা বিভ্রান্তির। ফলে বাংলদেশে এমন কেউ নেই যে এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারবেন। ফলে গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চা কী সেটাই যখন সুনির্দিষ্ট নয়; তখন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনটাই বা আসলে কী? সব ব্যাপারটাই যখন ঝাপসা, তখন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান থাকার দরকারটাই বা কী? বরং যা হওয়া দরকার, সকলে মিলে মিশে নাট্যচর্চা চালিয়ে যাওয়া। সত্যিকরের মঞ্চনাটক করতে গেলে দরকার, সমাজ-ইতিহাস-মানুষ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আর নাটক লেখা এবং অভিনয় করার পারদর্শীতা বা দক্ষতা। যদি আমার সত্য ভাষণে কেউ আহত হন ক্ষমা প্রার্থী, কারণ সত্যের মুখোমুখী আমাদের দাঁড়াতেই হবে।