বলির পাঁঠা: রোহিঙ্গা শরণার্থী

নাসরিন সিরাজ

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৮, ২০১৭

কক্সবাজারে ১০ লাখের মতো বহিরাগত প্রবেশের ফলে স্থানীয় কাঁচামাল ও শ্রমবাজারে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে আলাপ করলে যে মতামত পাওয়া যায় তা হচ্ছে, শাকসব্জির দাম বেড়ে গেছে বা দিনমজুরদের মজুরি কমে গেছে। এজন্য একতরফাভাবে শরণার্থীরকে দোষ দেয়া হচ্ছে। কুতুপালংয়ে মাঠকর্ম করে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারে দরদামের যে একটা তারতম্য ঘটেছে সেটা আমরাও লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এজন্য দায়ী কে, সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে এ ধারণা থেকে সরে আসতে হবে যে, বাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। তখন আমরা দেখতে পাব, বাজারে চাহিদা, সরবরাহ, দাম এগুলো নির্ধারনের পেছনে কলকব্জা নাড়ে নানা ধাপের ক্ষমতাধর প্রভাবশালী মহল। এদের কাছে যুদ্ধ থেকে শুরু করে বাম্পার ফলন সব পরিস্থিতিতেই টাকা-পয়সার লাভ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সব চাইতে অবহেলার পাত্র হচ্ছে বিপদগ্রস্থ মানুষ। এরা স্থানীয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাজার ভারসাম্যহীন করে রেখেছে বাজারব্যবস্থার জন্মলগ্ন থেকেই। কক্সবাজারেও সাম্প্রতিকসময়ে এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। কিন্তু কুচক্রি মহলের তৈরি করা স্থানীয় পুরোনো বিপদে নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ায় বিরক্ত ও দিশেহারা স্থানীয়রা। তারা এখন দাঁড়িয়েছে বিপদগ্রস্থ বহিরাগত রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে। এমন না যে, বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরির এ মহলকে স্থানীয়রা চেনে না বা জানে না। কেউ কেউ সেই বাজারের কর্তা বা কর্মীও নয়। কিন্তু স্থানীয় বাজারের প্রবহমান টানাটানিতে অস্থির স্থানীয়রা তাদের হক বহিরাগতরা লোপাট করে নিচ্ছে, এ মতামতটিই দিচ্ছে। 
অথচ, কক্সবাজার জেলা শহরের ও কুতুপালংয়ের স্থানীয় লোকজন ও কুতুপালংয়ের দুটো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, স্থানীয় বাজারে বহিরাগত রোহিঙ্গারা বেশ বড় অংকের কাঁচা টাকা আমদানি করেছে। যেমন, তারা যে নৌকাগুলো বেয়ে নিয়ে এসেছে সেগুলো আসলে বাংলাদেশি স্থানীয় বাঙালিদের। প্রতি মাথা বাবদ রোহিঙ্গারা এই নৌকাগুলোতে পরিশোধ করেছে এক লক্ষ বার্মিজ টিঁয়া (রোহিঙ্গাদের ভাষায় মিয়ানমারের মুদ্রার নাম)। বাংলাদেশে ঢুকতে বিডিআরদের দিতে হয়েছে মাথাপ্রতি এক লক্ষ টিঁয়া। বাংলাদেশে এসে থাকার জন্য ছাপড়া প্রতি শুধু জমির দাম দিতে হয়েছে মাসিক ২০০ টাকাহারে। স্বর্ণ এক ভরি গেছে ৩৫ হাজার ও একটা গরুর দর গেছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। মায়ানমারের মুদ্রা টাকায় পরিবর্তিত করতে গিয়ে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবসায়ীরাও বেশ লাভবান হয়েছে। এক লক্ষ টিঁয়া ৮ থেকে ১০ হাজার বাংলাদেশি টাকায় কিনেছে তারা। এছাড়া এখনও প্রতিদিন স্থানীয়রা এসে স্থানীয়বাজারে দরের চেয়ে সস্তায় দেয়া নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের মায়ানমার থেকে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসা উপলক্ষে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কক্সবাজার এলাকাতে এতো টাকা-পয়সার লেনদেন, তাতে যে স্থানীয়রা লাভবান হয়েছে এটি অনুলেক্ষিত থাকছে। এর কারণ হয়তো এই যে, এ লেনদেন বিবেচিত হয় অবৈধ হিসেবে। কিন্তু এ লেনদেন যে ঘটেছে এবং এ লেনদেনে মূলত লাভবান হয়েছে স্থানীয়রা। সেটা মিথ্যা নয়। তবে এটা ঠিক যে, সেই লাভের ভাগ স্থানীয় সকলে সমানভাবে পায়নি। এখন দেখা যাচ্ছে, আমদানি হওয়া টাকা যে স্থানীয়ভাবে সকলে ভাগ পায়নি বা কিছু কুচক্রি মহল সেটার সিংহভাগ আত্মসাৎ করেছে সে নিয়ে অনেকে ক্ষুব্ধ। কিন্তু এ ক্ষোভ প্রকাশের সময় লোকে বিরোধিতার পক্ষ হিসেবে রাখছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। 
এবারে আসি বৈধ লেনদেনে। জানা যায়, শরণার্থীদের আগমনের কারণে ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, কেয়ার, অক্সফ্যাম, এ্যাকশান এইড, সেইভ দ্য চিলড্রেনের মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের দেশীয় মূল কার্যালয়ের অস্থায়ী সেল বসিয়েছে উখিয়ায়। এর ফলে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। স্থানীয় এক হোটেল মালিক জানান, আগামী এক বছরের জন্য কক্সবাজারের সব ভালো হোটেলগুলো এরা ভাড়া করে নিয়েছে। ফলে হোটেল ব্যাবসায় অফ-সিজন বলে এখন আরকিছু থাকলো না। কিন্তু  রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গ টেনে আনার সাথে সাথে রুটিনের মতো তিনিও বলে বসলেন, ওরা দেশের জন্য বোঝা। পর্যটন শহরের ভাঙা রাস্তা, আবর্জনাভর্তি নর্দমা, স্থানীয় মেয়েদের তথাকথিত বেহায়াপনা বৃদ্ধি এসব নিয়ে অতিষ্ঠভাব প্রকাশেও স্থানীয় অনেকে শরণার্থীদের দায়ী করেন। ‘ওরাআমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে।’
শরণার্থীদের সেবা দান একটা নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে স্থানীয়ভাবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে শিক্ষিত-বেকারের সংখ্যা এতো বেশি যে, সকলকে সংস্থান করতে পারেনি এ ক্ষেত্রটি। স্থানীয়দের মধ্যে যারা এ নতুন কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের আগে থেকেই বিরাজমান বেকারত্ব নিয়ে আকাশচুম্বী ক্ষোভ ও অষন্তোষ প্রকাশ করতে শরণার্থীদের উপস্থিতি যেন এখন নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। 
সব দেখে শুনে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে বলে পুরোনো প্রবাদটি মনে পড়ে যায়। একটা বহিরাগতের দল সামনে থাকলে স্থানীয়দের চলমান সংকটের দায় চাপাতে তাৎক্ষণিকভাবে বহিরাগতকেই যে লোকে দেখতে পাচ্ছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এটি চোখে পড়ল। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আলাপ করতে গেলেই বাংলাদেশের অনেকে ভীষণ রকমের কঠোর গলায় বলতে থাকেন, রোহিঙ্গারা তো বাংলাদেশের না,বহিরাগত। 
একবার এক সম্মেলনে মিয়ানমারের কয়েকজন উন্নয়নকর্মীর সাথে কথা বলতে গিয়েও শুনেছি, “রোহিঙ্গারা তো বাংলাদেশের, আমাদের না।” এ কথাগুলো শুনলে মনে হয়, কোন মানুষ কোন দেশের স্থানীয় আর কে বহিরাগত, সেটা যেন চিরকালই নির্ধারিত ছিল। এবং তথাকথিত জায়গার মানুষ তার নিজের জায়গাতে অনড় থাকলে বিদ্যমান নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সম্পদ নিয়ে টানাটানি আপনাআপনি সমাধান হয়ে যাবে। বাংলাকে ঘিরে স্থানীয় ও বহিরাগত এই শ্রেণিগুলো নির্ধারণকারী রাষ্ট্রীয় সীমারেখা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সেই বৃটিশ আমল থেকে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতি হয়েছে। সেই ঐতিহাসিক ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে তথাকথিত বহিরাগতদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় সীমানাকে রক্ষা করতে এখন গুলি করে মানুষ মেরে ফেলা পর্যন্ত আইনসম্মত। অনেক সাধারণ মানুষের কাছে মানুষের জীবন ও গতিশীলতার চেয়ে রাষ্ট্রীয় সীমানা আর তার ফলে তৈরি শ্রেণিগুলো রক্ষা হয়ে পড়েছে বেশি জরুরি। বিপদগ্রস্থ মানুষের প্রতি সহানুভূতি বোধ করতেও এগুলো যেন এখন বাধা দিচ্ছে!

লেখক: নৃজ্ঞিানী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা