বলদবৃত্তান্ত
দুর্বারপ্রকাশিত : এপ্রিল ০১, ২০১৮
গালিব যাবে কাঁটাবনে। সেখানে নাকি কিছু কুকুর-বিড়ালের দোকান আছে। আপাতত তার ভাগনি মীমের জন্য একটি ছোটখাটো কুকুরের বাচ্চা কিনতে হবে। পিচ্চি ভাগনিটার জন্মদিন আগামীকাল। ছোট কুকুর খুব পছন্দ মেয়েটার। আগের দিনের বাচ্চাদের একটি মেকানোসেট কিম্বা টেডিবিয়ার ধরিয়ে দিলেই হতো। এখন দিন পাল্টেছে। জ্যান্ত জিনিস চাই এখন তাদের। যেগুলো কিনা লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে পেছনে পেছনে ঘুড়বে। মাঝে মাঝে মিঁউ মিঁউ, ঘেউ ঘেউ করে ডাকবে। জিভ দিয়ে চেটে চেটে আদর করবে আর রাত হতেই পেটের ভেতর ঢুকে ঘুমিয়ে যাবে। ব্যাটারি লাগবে না। তাই ব্যাটারির অভাবে খেলনাটা শোকেসেও পড়ে থাকবে না। সেদিন মীম চোখ মুছতে মুছতে তার অতীত জীবনের সকল খেলনাগুলোর শেষ পরিণতি শেয়ার করেছে তার মামার সাথে। অধিকাংশই নষ্ট হয়েছে ব্যাটারির অভাবে। ছোট মেয়েটার চোখের পানি মোটেই ভালো লাগেনি গালিবের। সেদিনই একটা কুকুরের বাচ্চা চেয়ে বসে মেয়েটা। গালিবও ঠিক করে ফেলেছিল, যত কষ্টই হোক একটা কুকুরের বাচ্চা এবার সে দেবেই তার ভাগনিকে। তার নিজের অবশ্য কুকুরের নামেই এলার্জি। সকাল থেকে দু’বার গোসল করে ফেলেছে। তাও হাতপা সমানতালে চুলকোচ্ছে।
প্রায় ১০-১৫ মিনিট ধরে রিকশা খুঁজেও খালি রিকশা পাচ্ছে না গালিব। কিছুটা অবাক লাগতে শুরু করে তার। আজকে কি কোনও বিশেষ দিন? চারপাশের সব রিকশায় শুধু জোড়া-শালিক। এর একটাই মানে, হয় আজ কোনও বড় মানুষের জন্মদিন নয়তো মৃত্যুদিন। বাঙালি জাতি উৎসবপ্রিয় জাতি। শোকের দিনকেও কিভাবে আনন্দের সাথে পালন করতে হয়, তা তারা খুব ভালোভাবে শিখে গেছে। নেহায়েত ভাগ্য ভালো ছিল বলেই হয়তো একটি রিকশা পাওয়া গেল আর খুবই দ্রুত কাঁটাবনে এনে নামিয়ে দিল গালিবকে। কাঁটাবন এসে গালিব পুরো থ! একটি দোকানও খোলা নেই, সব বন্ধ। মেজাজ গরম হবার জায়গায় নিজেকে কেমন যেন বলদ বলদ লাগতে শুরু করলো গালিবের। এই অনুভূতিটা নতুন না। নওশীনের কথা মনে পড়ে গেল তার। সারাক্ষণ বলদ বলদ করে তাকে। যখন একা থাকে তখন, যখন চারপাশে মানুষজন থাকে তখনো। কথাগুলো তখন অনেকটা এমন হয়, আমি জানতাম এমন কিছু একটাই করে আসবা তুমি। বলদের সাথে থাকতে থাকতে আমি নিজেও একটা বলদ হয়ে যাইতেছি। এখন যদি চারপাশে তোমার বন্ধু-বান্ধবরা না থাকত তাহলে আমি তোমাকে কি বলতাম জানো? বলতাম, তুমি একটা বলদ। একে বলদ। বলদ দুগুণে বলদবলদ। বলদ তিনে বলদবল... আঙুল গুণে গুণে দশের ঘর পর্যন্ত বলে শেষ দেবে সে। গালিবের কেন জানি হাসি পায় সে কথা মনে পড়লে। মনে মনেই হাসে। নওশীনের সাথে বন্ধুত্ব সেই ছোট থেকেই। একসাথেই বড় হওয়া। সম্পর্কটা যদিও শুধুই বন্ধুর মতো তবুও মনে মনে গালিব পছন্দ করে নওশীনকে। গালিবের মনে বড্ড আশা, একদিন তার ব্যাপারটা নওশীন বুঝবে। যেমন কদিন আগে নওশীন রাত দেড়টায় ফেসবুক চ্যাটে বললো, আমার খুব মাথাব্যথা করতেছে। ঘুমোবো। সেই ম্যাসেজের রিপ্লাই না দিয়ে গালিব ডিসপ্রীন নিয়ে নওশীনের বাসার সামনে হাজির। এত রাতে নওশীনের আম্মু গালিবকে দেখে অবাক। উনি বললেন, আরে গাব্বু? (ছোট থেকে আদর করে গাব্বু ডাকেন গালিবকে) এত রাতে? কিছু লাগবে? গালিব মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে উত্তর দিয়েছে, কিছু লাগবে না চাচি। দিতে এসেছি। আপনার মেয়ে মাথাব্যথায় মরে যাচ্ছে। এই নেন এই অষুধটা খাইয়ে দেন, যান। গেলাম। এই বলে হালকাভাবে সেখান থেকে চলে আসে গালিব। সে পিছনে ফিরে তাকায়নি। তবে ঠিকই বুঝতে পারছিল নওশীনের আম্মু কী অবাক হয়েই না তাকিয়ে আছে। উনি নিশ্চয়ই এখন গিয়ে তার মেয়েকে বলবেন, এই নে এই অষুধটা খা। তোর নাকি মাথাব্যথা? গাব্বু এসে দিয়ে গেছে। এই সেবাটুকু পেয়ে কি নওশীনের একটুও মন গলবে না তার জন্য! এইসব ভেবে আপনাতেই প্রশান্তি চলে এসেছিল সেদিন গালিবের মনে।
বিকেলে ম্যাসেজ আসলো নওশীনের নাম্বার থেকে গালিবের ফোনে। লিখেছে, তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে তুমি ভালোবাসো কি?
কেমন যেন বাংলা সিনেমার মতো মনে হতে লাগলো সবকিছু গালিবের কাছে। এই মেয়ে বাংলা সিনেমা কবে দেখা শুরু করেছে আল্লাহ মালুম। তবে ম্যাসেজ দেখার পর কি রিপ্লাই দেবে ভেবে পাচ্ছে না সে। একটা রিপ্লাই লিখলো আবার কেটে দিল। আরেকটা লিখলো সেটাও কেটে দিল। জীবনের প্রথম ভালোবাসার ম্যাসেজ একটু রোমান্টিকভাবে না লিখলে হয়! তাই ভাবলো ভালোমতো রিসার্চ করে পরেই ম্যাসেজের রিপ্লাই করবে সে। গুগলে সার্চ করলো এটা লিখে, How to respond when someone propose you and want to know your answer। আশানুরূপ তেমন কিছু না পেলেও হাল ছাড়ল না গালিব। চেষ্টা চালিয়ে গেল। এদিকে রাত ১১টা বাজতে চললো। হুট করেই সিদ্ধ্বান্ত নিলো গালিব প্রথম ভালোবাসার কথা ম্যাসেজে কেন বলতে যাবে সে? তার চেয়ে ভালো কল দিয়ে জানাবে। নওশীন তো মেয়ে মানুষ, তাই বলতে লজ্জা পেয়েছে। সে শুনেছে ছেলেদের লজ্জা পেতে নেই। দুবার রিং বাজার পর কল ধরলো নওশীন।
হ্যালো নশু, কেমন আছো?
এত রাতে কেমন আছি জানতে কল দিয়েছো? তুমি কি মজা করো আমার সাথে?
ঘুমিয়ে গেছিলা নাকি?
না, কি বলবা বলো।
তুমি জানো না বুঝি কি বলবো? হা হা...
বলদের মতো হাসবা না। না জানি না।
বিকেলের ম্যাসেজে যা জানতে চেয়েছো তার উত্তর লিখতে গিয়ে রাত পার হয়ে গেল। ভাবলাম কল দিয়ে জানিয়ে দেই। হয়তো তোমার আমার দুজনেরই সময় বাঁচবে।
বিকেলের কোন ম্যাসেজ? অহ আচ্ছা, হা হা। সেটা তো এপ্রিল ফুল ছিল। আজ সারাদিনই এপ্রিলের ১ তারিখ ছিল, সেই খেয়াল আছে? তোমাকে সাধে বলদ বলি? আসলেই তুমি একটা বলদ। মজাও করা যাবে না মজার দিনে। সিরিয়াসলি নিয়ে রাত শেষ করে ফেললে ম্যাসেজ লিখে! আসলেই তুমি একটা বলদ। একে বলদ, বলদ দুগনে বলদবলদ, বলদ তিনে বলদবল...
আস্তে করে কলটা কেটে দিল গালিব। কখনো লক্ষ্য করেনি গালিব, তার জানালা দিয়ে আকাশের একটি অংশ দেখা যায়। গালিব বুবুক্ষের মতো তার ছোট্ট আকাশে চাঁদটাকে খুঁজতে লাগলো।
পাগলের মতো কল দিয়ে যাচ্ছে নওশীন গালিবের নাম্বারে। গালিব কল ধরছে না। বলদটা কল কেন ধরে না? এপ্রিল ফুল সে বানিয়েছে গালিবকে, তবে সেটা গালিব কল দেবার পর। তবে ম্যাসেজটা তো সত্যি ছিল। আফসোস নওশীনের, সেটা কোনোদিন গালিবকে জানাতে পারবে না।
লেখক পরিচিতি
জন্ম: ১৮ অক্টোবর, ১৯৯৬, কিশোরগঞ্জে। পড়াশোনার খাতিরে ঢাকায় বসবাস। ভালোবাসেন বই পড়তে। এরই ফাঁকে চেষ্টা করেন লেখালেখির।