বন্দে আলী মিয়ার গল্প ‘আজব পোশাক’

প্রকাশিত : জুন ১৭, ২০২০

বন্দে আলী মিয়ার আজ মৃত্যুদিন। ১৯৭৯ সালের ১৭ জুন রাজশাহীতে মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ১৯০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত ‘আজব পোশাক’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

এক দেশে ছিল একজন রাজা। রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। সিহাহী-সামন্ত লোকলস্করে রাজপুরী গমগম। রাজার ধন-দৌলতের শেষ নেই।

রাজা ছিল সৌখিন আর খামখেয়ালি। খুব জাঁকজমক পোশাক-পরিচ্ছদ পরা তার শখ। নিত্যনতুন জামাকাপড় পরে রাজদরবারে যেতে না পারলে তার মনটা খুঁতখুঁত করতো।

রাজা হঠাৎ শুনতে পেল, তার রাজ্যের একজন তাঁতির কথা। তাঁতিটি নাকি খুব চমৎকার কাপড় বুনতে পারে। সেই কাপড়ের সুখ্যাতি দেশে-বিদেশে। রাজা তৎক্ষণাৎ সিপাহী-পাইক পাঠিয়ে দিলেন তাঁতিটাকে দরবারে হাজির করার জন্যে।

তাঁতি কাঁপতে কাঁপতে এসে রাজাকে সেলাম জানালো। রাজা বললেন, ওহে, তুমি কি আমার জন্যে খুব মিহি সুতোয় কাপড় তৈরি করে দিতে পারবে?

তাঁতি জবাব দিল, নিশ্চয়ই পারব মহারাজ। আপনি হুকুম করলেই আমি বুনতে আরম্ভ করবো। এমন সরু আর পাতলা কাপড় আমি তৈরি করতে পারি যে, বোকা লোকেরা তা দেখতেই পারবে না।

রাজা খুশি হয়ে বললেন, ঠিক কথাই বলেছো বটে, বোকা লোকেরা তা তো পারবেই না। আমি তেমনি মিহি কাপড়ের কথাই তোমাকে বলছি। যদি পারো তবে অনেক সোনাদানা বখশিস দেব। আজ আগাম এক হাজার মোহর নিয়ে যাও।

রাজা এই কথা বলে খাজাঞ্চিকে ইঙ্গিত করলেন। খাজাঞ্চি কয়েক তোড়া মোহর এনে তাঁতির সামনে রাখল। তাঁতি মোহরের তোড়াগুলো নিয়ে দরবার থেকে চলে গেল।

তারপর দিনের পর দিন কাটতে লাগল। এমনি করে প্রায় দু’মাস চলে গেল। রাজা আশা করে রয়েছেন। একদিন তার উজির আর নাজিরকে তাঁতির বাড়িতে পাঠালেন।

এদিকে তাঁতি সেই মোহরগুলো নিয়ে খুব আরামে মাংস-পোলাও খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। আজ হঠাৎ উজির আর নাজিরকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল। এতদিনে সে এক টুকরো কাপড়ও তৈরি করেনি। শুধু আমোদ আর মজা করে দিন কাটিয়েছে। তাঁতি আর একটুও দেরি করল না। তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁতের কাছে বসলো। এদিকে সুতো দেয়ার সময়ও আর নেই। অগত্যা সে সেই খালি মাকুটা তাঁতের মধ্যে চালিয়ে কাপড় বোনার ভান করতে লাগল।

ততক্ষণে উজির আর নাজির সেখানে এসে হাজির। তাঁতি তাড়াতাড়ি উঠে তাদের দুজনকে বসার জন্যে দুটো আসন দিল। তারপর আবার সে কাপড় বোনার ছল করে খালি মাকুটা ঠকঠক করে চালাতে লাগল। উজির আর নাজির সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল, কিন্তু কোনো কাপড়-টাপড় তারা দেখতে পেল না। সে সময়ই তাদের মনে পড়ল তাঁতির কথা। রাজদরবারে সে রাজার কাছে বলেছিল, যারা বোকা তারা এ কাপড় দেখতে পায় না। সুতরাং দুজনের কেউই বোকা হতে চাইল না। তাই উজির হঠাৎ বলে উঠল, বহুৎ চমৎকার কাপড় তৈরি করছে তো তাঁতি ভায়া!

নাজির তাকে সায় দিয়ে বলল, কাপড়ের যেমন জমিন তেমন নকশা। এমন না হলে রাজামশায়ের পছন্দ হবে কেন? তবে জলদি জলদি কাপড়টা শেষ করে দা তাঁতি ভায়া।

তাঁতি একগাল হেসে জবাব দিল, আর একটুখানি বাকি আছে হুজুর। সাত দিন পরে আমি কাপড় নিয়ে রাজদরবারে হাজির হবো।

তাঁতির কথা শুনে উজির আর নাজির খুশি হয়ে চলে গেল।

ঠিক সাতদিন পরে তাঁতি চলল রাজদরবারে। দরবারে পৌঁছে রাজার সামনে হাঁটু পেতে বসলো, এরপর নত হয়ে কাপড় নামিয়ে রাখার মতো ভঙ্গি করলো। রাজা সেদিকে চেয়ে খুব খুশি হয়ে চিৎকার করে উঠল, বাহ, কী সুন্দর কাপড়! এরপর একজন সিপাহীর দিকে হুকুম করলেন, একজন দরজিকে জলদি হুকুম করো। সিপাহী ছুটতে ছুটতে গিয়ে শহরের একজন খুব নামজাদা দরজিকে ডেকে আনলো। দরজি এসে হাতজোর করে দাঁড়ালো। রাজা বললেন, এই কাপড় দিয়ে খুব ভালো দুটো জামা তৈরি করে দ্যাও।

দরজি কোনো কাপড় কিন্তু দেখতে পেল না। এরপরও সে হাতজোড় করে বলল, জি মহারাজ, এখুনি তৈরি করতে আরম্ভ করছি। এই কথা বলে সে কাঁচি বের করে রাজদরবারের মধ্যেই কাপড় কাটার মতো ভঙ্গি করতে লাগল। তারপর কাটা শেষ হলে সুঁই বের করে সেলাই করার ভান করতে লাগল।

সভার পাত্রমিত্র, নায়েব-গোমস্তা কেউ-ই কাপড় দেখতে পায় না, অথচ সবাই বলে, চমৎকার! চমৎকার!

সেলাই শেষ করে দরজি বলল, মহারাজ, এইবার এই জামাটা পরুন। তবে তার আগে আপনার গায়ে যে জামাটা আছে সেটা খুলে ফেলতে হবে।

রাজা দেহ থেকে সব জামাকাপড় খুলে ফেললেন। দরজি শূন্য দুটা হাত তুলে রাজার শরীরে জামা পরিয়ে দেয়ার মতো অঙ্গভঙ্গি করলো। উজির-নাজির সবাই বলে উঠল, অপূর্ব! অপূর্ব! এমন চমৎকার জামা সত্যিই মহারাজকে সুন্দর মানিয়েছে। যেমন কাপড়, তেমন জামা হয়েছে।

রাজা খালি গায়ে কিছুক্ষণ সভার মধ্যে পায়চারি করলেন। আপন মনে ভাবতে লাগলেন, এই আজব নতুন জামা গায়ে দিয়ে তাকে অপরূপ লাগছে!

এরপর রাজা গোঁফে তা দিতে দিতে সিংহাসনে গিয়ে বসলেন।

‘বন্দে আলী মিয়ার রূপকথা সমগ্র’ থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো