বনফুল
বনফুলের পাঁচটি খুদে গল্প
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২০
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরন করেন। তিনি বনফুল ছদ্মনামেই অধিক পরিচিত। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত পাঁচটি খুদে গল্প পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
সমাধান
আকাশ নীল, বাতাস স্নিগ্ধ, ফুল সুন্দর এবং আমার নাম নীহাররঞ্জন হওয়া সত্ত্বেও আমার বিবাহ হইল পাকুড়াগ্রাম-বাসিনী ক্ষান্তমণি নাম্নী এক পল্লীবালার সহিত এবং বৎসরান্তে তিনি একটি কন্যারত্ন প্রসব করিয়া তাহার নাম রাখিয়া দিলেন—বুঁচি!
নামকরণটীতে একটু আপত্তি করিয়াছিলাম। তাহাতে বাড়ীর এবং পাড়ার সকলে সত্য কথাই বলিল—এই কালে কুচ্ছিৎ মেয়ে— তার নাম পুষ্পমঞ্জুরি দিবি নাকি? তোর যত সব অনাছিষ্টি —
মেয়েটা কুৎসিতই ছিল । রঙ ত কালোই—একটা চোখ ছোট আর একটা বড়তাছাড়া কি রকম যেন বোকাহাবা ধরনের—মুখে সর্বদাই লাল ঝরে । পুষ্পমঞ্জুরি নাম দেওয়া চলে না তা ঠিক।
বছর দুই পরে।
ক্ষান্তমণি বুঁচিকে লইয়া বাপের বাড়ী গিয়াছেন। সেদিন রবিবার কাহারো কাজকর্ম নাই—চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া নানা আলোচনা চলিতেছে । হঠাৎ আমার কথাই উঠিয়া পড়িল ।
নৃপেন বলিল—এই দেখ না নীহারের অদেষ্ট। হল বা যদি একটা মেয়ে-তাও আবার এমন কদাকার—
শ্যাম বোস বলিলেন—তা আবার বলতে । বিয়ে দেবার সময় নাকের জলে চোখের জলে হতে হবে আর কি! টাকা চাই প্রচুর।
হারু খুড়ো তামাকটাতে দুটান দিয়া কহিলেন—আরে ভাই, আজকাল আবার শুধু টাকা হলেই হয় না। লোকে টাকাও চায়-রূপও চায় যে। চোখ দুটাে ছোট বড় হয়েই আরও মুস্কিল কিনা— কি যে হবে—
সকলেরই ঘোরতর দুশ্চিন্তা।
এমন সময় পিওন আসিয়া আমাকে একখানা চিঠি দিয়া গেল।
নৃপেন বলিল—কার চিঠি হে ?
আমি চিঠিটা পড়া শেষ করিয়া বলিলাম—বউ লিখেছে। বুঁচি মারা গেছে কাল।
সার্থকতা
আমার অতীত জীবনের দিকে চাহিয়া দেখি—আর আমার দুঃখ হয়! সে যেন একটা সুখ-স্বপ্ন ছিল! সেই আমার অতীত জীবনের স্মৃতি... আজ সত্য সত্যই স্মৃতিমাত্ৰ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সে জীবন গেল কোথায়? সেই শোভন, সুন্দর, মোহন জীবন।
...একদিন আমার রূপ ছিল-সৌরভ ছিল-মধু ছিল। আমার সেই সুষমার দিনে কত মধুলুব্ধ ভ্ৰমরই না আমার কানে কানে বন্দনার স্তুতিগান তুলিয়াছে! —তাহারা আজ কোথায়?
...এই আকাশ বাতাস আলো একদিন কতই না ভালো লাগিয়াছে! একদিন ইহাদের লইয়া সত্যই আমি পাগল হইয়া থাকিতাম... আজ কোথায় গেল আমার সেই পাগলামি… সেই সহজ উন্মাদনা-ছন্দময়ী ভাললাগার নেশা! আজি কই তারা সব?
...আজ আমি পরিপক্ক-অভিজ্ঞ। আমার সেই অতীতের তরল অনুভূতি জমিয়া যেন কঠিন হইয়া গিয়াছে।
মার আজ কেবলই মনে হইতেছে… আমার অতীত আর ফিরিবে না জানি-কিন্তু ভবিষ্যৎ? সে কেমন-কি জানি! আমার আনন্দময় অতীতকে হারাইয়া আজ এই যে পরিপক্ক অভিজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছি—ইহার পরিণতি কি?—ইহার সার্থকতা কোথায়?
গাছের একটি পাকা ফল এই সব ভাবিতেছিল। হঠাৎ বাতাসের দোলায় মাটিতে পড়িয়া গেল। একটি পাখী আসিয়া ঠোঁটে করিয়া ফলটি লইয়া একটি ডালে বসিল এবং পরম আনন্দে ঠোকরাইয়া খাইতে লাগিল।
চোখ খোলা
সাধারণের চোখে হয়ত সে সুশ্ৰী ছিল না।
আমিও তাঁহাকে যে খুব সুন্দরী মনে করিতাম তাহা নহে-কিন্তু তাহাকে ভালবাসিতাম। তাহার চােখ দুটিতে যে কি ছিল তাহা জানি না। তেমন স্বপ্নময় সুন্দর চােখ জীবনে কখনও দেখি নাই। দুষ্টু বলিয়াও তাহার অখ্যাতি ছিল।
সেই কুরূপা এবং চঞ্চল মিনি আমার চিত্ত-হরণ করিয়াছিল! তাহার চােখ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম।
মনে আছে তাহাকে একদিন নিভৃতে আদর করিয়া বলিয়াছিলাম—ইচ্ছে করে তোমার চোখ দুটো কেড়ে রাখি।
কেন ?
এই দুটােই তা আমাকে পাগল করেছে । আমি সব চেয়ে ওষ্ট দুটােকেই ভালবাসি।
এত ভালবাসিতাম-কিন্তু তবু তাঁহাকে পাই নেই।
অজ্ঞাত অপরিচিত। আর একজন আসিয়া বাজনা বাজাইয়া সমারোহ করিয়া তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল ।
প্ৰাণে বড় বাজিল ।
কিন্তু সে বেদন। হয়ত মুছিয়া যাইত যদি সঙ্গে সঙ্গে আর একটা মর্মাস্তিক ঘটনা না ঘটিত।
মিনি যখন বাপের বাড়ী আসিল, দেখি, তাহার দুটি চক্ষুই অন্ধ। কারণ শোনা গেল যে চোখে গোলাপ জল দিতে গিয়া সে ভুলক্রমে আর একটা ঔষধ দিয়া ফেলিয়াছে।
আমার সঙ্গে আড়ালে একদিন দেখা হইয়াছিল।
বলিলাম—অসাবধানতার জন্যে অমন দুটি চোখ গেল !
সে উত্তর দিল—কেন যে গেল তা যদি না বুঝতে পেরে থাক তাহলে না জনাই ভাল !
অজান্তে
সেদিন আপিসে মাইনে পেয়েছি ।
বাড়ী ফেরবার পথে ভাবলাম ‘ওর’ জন্যে একটা ‘বডিস’ কিনে নিয়ে যাই । বেচারী অনেক দিন থেকেই বলছে।
এ-দোকান সে-দোকান খুঁজে জামা কিনতে প্ৰায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। জামাটি কিনে বেরিয়েছি— বৃষ্টিও আরম্ভ হল। কি করি— দাঁড়াতে হল। বৃষ্টিটাট একটু ধরতে— জামাটি বগলে ক`রে —ছাতাটি মাথায় দিয়ে যাচ্ছি। বড় রাস্তাটুকু বেশ এলাম—তার পরই গলি, তা-ও অন্থকার।
গলিতে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। —অনেকদিন পরে আজ নতুন জামা পেয়ে তার মনে কি আনন্দই না হবে । আজ আমি—
এমন সময় হঠাৎ একটা লোক ঘাড়ে এসে পড়ল। সেও পড়ে গেল, আমিও পড়ে গেলাম-জামাটা কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল ।
আমি উঠে দেখি—লোকটা তখনও ওঠেনি-ওঠবার উপক্রম করছে। রাগে আমার সর্বাঙ্গ জলে গেল-মারলাম এক লাথি !
রাস্তা দেখে চলতে পারো না শুয়ার!
মারের চোটে সে আবার পড়ে গেল—কিন্তু কোন জবাব করলে না! তাতে আমার আরও রাগ হল— আরও মারতে লাগলাম।
গোলমাল শুনে পাশের বাড়ীর এক দুয়ার খুলে গেল। লণ্ঠন হাতে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন—ব্যাপার কি মশাই ?
দেখুন দিকি মশাই-রাস্কেলটা আমার এত টাকার জামাটা মাটি করে দিলে। কাদায় মাপামাখি হয়ে গেছে একেবারে। পথ চলতে জানে না-ঘাড়ে এসে পড়ল—
কে-ও? ওঃ—থাক মশাই মাপ করুন, ওকে আর মারবেন না! ও বেচারা অন্ধ বোবা ভিখারী—এই গলিতেই থাকে—
তার দিকে চেয়ে দেখি-মারের চোটে সে বেচার কাঁপচে-গা’ময় কাদা। আর আমার দিকে কাতরমুখে অন্ধ দৃষ্টি তুলে হাত দুটি জোড় করে আছে।
বেচারাম বাবু
হরিশ মুদী সন্ধ্যাবেলা হিসাব বুঝাইয়া গেল যে গত মাসের পাওনা, ২৭’৭০ পাইয়াছে এবং তাহা অবিলম্বে মিটাইয়া দেওয়া দরকার। সদ্য-অফিস-প্রত্যাগত বেচারামবাবু বলিলেন—‘আচ্ছা মাইনেটা পেলেই—!’ অতঃপর কাপড়-চােপড় ছাড়িয়া বেচারাম বাহিরের রোয়াকটিতে বসিয়া হাঁক দিলেন—‘ওরে চা আন—।’ চা আসিল। চা আসিবার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার হরিবাবু, নবীন রায়, বিধু ক্লার্ক প্রভৃতি চার পাঁচজন ভদ্রলোকও সমাগত হইলেন এবং সমবেতভাবে গল্প-গুজব সহযোগে চা-পান চলিতে লাগিল।
গল্প চলিতেছে। এমন সময় বেচারামবাবুর ছোট মেয়ে পুঁটি আসিয়া উপস্থিত—বাবা, দুখানা চিঠি এসেছে আজি ডাকে । আনব?
পুঁটির ছোট বোন টুনিও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। সে কহিল—আমি আনব বাবা!
বেচারামবাবু মীমাংসা করিয়া দিলেন—আচ্ছ। দু`জনে দুটো আনো।
শ্ৰীযুক্ত বেচারাম বক্সির পাঁচ কন্যা এবং দুই পুত্র।
পুঁটি ও টুনি দুজনে দু’খানি পত্র বহন করিয়া আনিল। প্রথম পত্ৰখানি বেচারামবাবুর প্রবাসী পুত্র বহরমপুর হইতে লিখিতেছে—তাহার কলেজ ফি, হষ্টেল চার্জ প্রভৃতি লইয়া এ মাসে ৫৫ টাকা চাই। দ্বিতীয় পত্রটি তাহার কন্যা শ্বশুরবাড়ী হইতে লিখিয়াছে যে গত বৎসর ভাল করিয়া পূজার তত্ত্ব করা হয় নাই বলিয়া তাহাকে অনেক খোটা সহ্য করিতে হইয়াছিল। এবার যেন পূজার তত্ত্বে কার্পণ্য করা না হয়, তাহা হইলে তাহার পক্ষে শ্বশুরবাড়ীতে তিষ্ঠান দায় হইবে।
বেচারামবাবু চিন্তিত মুখে পত্র দুটি পকেটস্থ করিলেন।
...আবার গল্প চলিল। নবীন রায় একটা পান মুখে পুরিয়া কহিলেন—তোমার মেজ মেয়ের বিয়ের কচ্ছ কি ? বিয়ে না দিলে আর ভাল দেখাচ্ছে না !
বেচারাম কহিলেন—পাত্র একটা দেখ না ।
নবীন তদুত্তরে বলিলেন—পাত্র একটি আছে, খাইও খুব বেশী নয়। ৫০১ টাকা নগদ-তেত্রিশ ভরি সোনা আর বরাভরণ। এমন কিছু বেশী নয় আজকালকার দিনে।
থামিয়া বেচারাম উত্তর দিলেন—তা বটে।
ক্ৰমে সভা ভঙ্গ হইল। বেচারামবাবু অন্দরে গেলেন। ভিতরে গিয়া আহারে বসিতেই গৃহিণী হরিমতি কাছে আসিয়া বসিলেন এবং নানা কথার পর বলিলেন—
বিনোদের মুখে মাসীমা খবর পাঠিয়েছেন যে, কাল তিনি আসবেন। কিছু আলোচাল আর একসের দুধের কথা বলে দিও তাহলে কাল থেকে। তিনি আফিং খান জান তো ?
শুইতে গিয়া দেখিলেন ছেলেমেয়ের ঘুম ভাঙিয়া কাঁদিতেছে। বলিলেন—কি হল এদের ?
স্ত্রী বলিলেন—হবে না ? শীত পড়ে গেছে-কারো গায়ে একটা জামা নেই। লেপটিও ছিঁড়ে গেছে। সেই পাঁচ বছর আগে করান হয়েছিল ছিঁড়বে না আর। তোমাকে ত বলে বলে হার মেনেছি। কি আর করব বল ?
বেচারাম এবার আর কিছু বলিলেন না! শুধু টেবিলের উপর আলোটার দিকে চাহিয়া রহিলেন। মোমবাতিটা পুড়িয়া পুড়িয়া প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে।